#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১০
-‘ আদ্রিশ ভাইয়া, তুমি না আমায় বোনের নজরে দেখো তাহলে এসব কি করছো?
চোখ বুঁজে কাঁপা কন্ঠে এতোটুকু বলে থামলাম। আদ্রিশ ভাইয়া হতে কোনো জবাব না পেয়ে এবার পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম। সে তার পূর্বের অবস্থানেই রয়েছে এখনো। কিন্তু অধরের কোণে ঝুলে আছে তার বাঁকা হাসির রেখা। এই প্রথম আদ্রিশ ভাইয়াকে আমার এতোটা কাছাকাছি দেখে, ভড়কে গেলেও বুঝতে দিলাম না বিষয়টা।
সে আমার মুখের কাছে মুখ এনে হাসির রেখা প্রশস্ত করে শীতল কন্ঠে বলল
-‘ কি ভড়কে গেলি মেহু?
আমি নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে, শক্ত কন্ঠে বললাম
-‘ ভড়কে আমি যাইনি, তবে তোমার অসভ্যতামি দেখছি। ভদ্র মানুষের আড়ালে একটা মানুষ কতোটা চরম লেভেলের অসভ্য হতে পারে, সেটাই আমাকে ভীষণভাবে ভাবাচ্ছে।
আমার এমন কথায় আদ্রিশ ভাইয়া অবাক হওয়ার ভান ধরল তবে নিজের অবস্থান থেকে এক ছটাকও সরলো না। হাসির রেখা আরও খানিকটা প্রশস্ত করে সে বলল
-‘ বাহ্ এক ধমকানিতেই আমাদের মেহুপাখি বড় হয়ে গিয়েছে দেখছি? বাচ্চামো স্বভাব ছেড়ে সে এখন বড় বড় কথাও বলে! বাহ্, চমৎকার, নাইস, গ্রেট, ওয়ান্ডারফুল!
আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমার রাগ হলো ভীষণ। কন্ঠে তাই কিছুটা কাঠিন্য ভাব বজায় রেখে আমি বললাম
-‘ আদ্রিশ ভাইয়া এবার একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না? তুমি তো এমন ছিলেনা, আমায় নাকি তুমি বোনের নজরে দেখো তাহলে এখন এসব কেন? আবার নাকি তুমি আমায় অনেক বেশি সম্মান করো, আমার সম্মানে আঘাত লাগুক তা তুমি চাও না, তাহলে এসব কি? আমার পথ ছাড়ো নয়তো আমি মামনিকে ডাকতে বাধ্য হবো।
আদ্রিশ ভাইয়া আমার কথা শুনে আচমকা হো হো করে হেসে ফেলল। আদ্রিশ ভাইয়া এবার বিদ্রুপের স্বরে বলে উঠল
-‘ ওয়েট অসভ্যতামির কিন্তু এখনো কিছুই করিনি আমি। শুধু শুধু আমার মতো একটা ইনোসেন্ট চাইল্ডকে এসব অপবাদ দিচ্ছিস তুই। তবে যাই বলিস না কেন তুই কিন্তু বড্ড বেশি পাকনা হয়ে যাচ্ছিস মেহু।
এই ব্যাটা বলে কি? ডাক্তারি পাশ করা আধবুড়ো ছেলেটা নাকি ইনোসেন্ট চাইল্ড তাহলে আমি কি সদ্য জন্মানো নবজাতক! আমি এবার মৃদু চিৎকার করে বললাম
-‘ অসভ্যতামি করোনি মানে? এটা কি খুব সভ্য মানুষের কাজ? তুমি আমার এতো কাছাকাছি কেন, দূরে সরো বলছি।
আদ্রিশ ভাইয়া ভ্রু নাচিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল
-‘ কেন ভয় পাচ্ছিস আমায়?
-‘ তোমার মতো ধলা বিলাইকে কেন ভয় পেতে যাব আমি? আমি শুধু সরতে বলেছি তোমায়। আমায় নাকি বোনের নজরে দেখো তাহলে বোনের সাথে এসব ফাজলামি কেমন বেমানান না?
আদ্রিশ ভাইয়া এবার বেশ সিরিয়াসভাবে বলল
-‘ মানে সিরিয়াসলি মেহু, তুই নিজেকে কি ভাবিস বল তো? মানে তোর সাথে আমি… কিভাবে সম্ভব? হাসালি আমায়। ওয়াট অ্যা গ্রেট ফুলিশ পারসন ইউ আর!
আমার কপালে যৎ কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ল। এ ব্যাটা বলে কি? সকাল সকাল কি মাথায় ব্যামো বাঁধিয়ে বসল লোকটা? নিজে নিজেই তো সব বলে। একেক সময় একেক কথা। এমন চলতে থাকলে তো রোগীরা এমনিতেও হার্ট অ্যাটাক করবে!
আদ্রিশ ভাইয়া এবার রসিকতা ছেড়ে চোখমুখ শক্ত করে বলল
-‘ একেই তো বিনা অনুমতিতে আমার ঘরে এসেছিস? তার উপর আবার আমার মুখে মুখে তর্ক করছিস। তুই যতোই নিজেকে চেঞ্জ করিসনা কেন, তোর এই কৌতুহলপ্রবণ মনোভাবটা আর বোধ হয় যাবেনা। মানে মানুষ কতোটা বোকা হলে, সামান্য একটা ডায়েরিও লুকাতে পারেনা!
আদ্রিশ ভাইয়ার মুখে ডায়েরির কথাটা শুনতেই চমকে উঠলাম। আদ্রিশ ভাইয়া টের পেয়ে গেল কিভাবে? হাত দুটো পেছনে রেখে লুকিয়ে রেখেছিলাম ডায়েরিটা, যাতে আদ্রিশ ভাইয়ার নজরে না পড়ে। আমায় এবার আরও অবাক করে দিয়ে আদ্রিশ ভাইয়া একদম কাছাকাছি চলে আসে আমার। আমি চোখমুখ কুচকে ফেললাম। শাস্তিস্বরূপ না জানি আবার কি করতে কি করে বসে লোকটা। বিশ্বাস নেই এই পল্টিবাজটাকে। পল্টি খাওয়া যার নিত্য স্বভাব সে যা তা করেও ফেলতে পারে! ফট করে আমার হাত থেকে ডায়রিটা কেড়ে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায় সে। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, এতোক্ষণ যেন আমার দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল। সে এখন আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আমি এবার পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললাম। এই রে এভাবে যে ধরা পড়ে যাবো তা কখনো ভাবিনি আমি। ব্যাটায় বুঝল কেমন করে? চোখ তো না যেন বাজপাখির ধারালো দৃষ্টি!
ডায়রিটা হাতে নিয়ে সে এপিট ওপিট ওল্টায়। আমার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠল
-‘ তোর সাহস হলো কিভাবে আমার অনুমতি ব্যতিত আমারই পার্সোনাল ডায়রিতে হাত দেওয়ার? নেক্সট টাইম তোকে যেন ভুল ক্রমেও আমার ডায়রির আশেপাশেও না দেখি। তাহলে কিন্তু আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবে না। আজ তো এক ঝলক দেখেছিস, এরপর কিন্তু শাস্তিস্বরূপ কপালে শনি আছে তোর!
বুঝলাম না সামান্য একটা ডায়রি ধরায় তার আচমকা এমন রেগে যাওয়ার কি কারণ? আদ্রিশ ভাইয়া গম্ভীর কণ্ঠে কথা বললেও আমার সাথে কখনোই উচ্চ স্বরে কথা বলেনি সে। তাহলে আজ হঠাৎ এমন কেন করল? সামান্য একটা ডায়রির জন্যে তার এমন নিখুঁত অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়! তবে আমি তো সত্যিই ভড়কে গিয়েছিলাম তার এহেন কর্মকান্ডে! পরে বুঝলাম তিনি আমায় কথার জালে পেঁচিয়ে ডায়রির অবস্থানটা দেখে নিয়েছিলেন। আর আমার চাইতে লম্বা হওয়ার সুবাদে এটা তার কাছে কোনো ব্যাপারই ছিলনা। তবে ডাক্তার না হয়ে অভিনেতা হলে তার বেশ নামডাক হতো বটে। কিন্তু মাথামোটাটার মাথায় হয়তো এ বুদ্ধি খেলেনি! আমি ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস ফেললাম, কিন্তু কোনো জবাব দিলাম না। আপাতত এই ঢেড়ষের সাথে কোনো কথায় জড়ানোর মুড নেই আমার।
আদ্রিশ ভাইয়া ডায়রিটা বুক সেলফে রেখে দিলো, আমার অনুসন্ধানী দৃষ্টি এড়ায়না তা। কাবার্ড থেকে ট্রাউজারটা বের করে নেয় সে। কোমড়ে জড়ানো টাওয়াল খুলতে গিয়ে থমকে যায় সে। আমার দিক ফিরে ভ্রু কুটি করে থমথমে গলায় বলল
-‘ তুই এখনো আমার রুম থেকে গেলি না? আমার চেঞ্জ করা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে আছিস বুঝি?
আমি ছিলাম আমার ভাবনার জগতে আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমার ভাবনার সুঁতোয় টান পড়ে। আমি তার দিকে ফিরতেই সে এবার ভ্রু নাচিয়ে দুষ্ট হেসে বলল
-‘ আমার এমন রূপ দেখে তোর হয়তো যেতেই মন চাইছে না। তুই চাইলে এখানেই থাকতে পারিস। তোর সামনে চেঞ্জ করতে কিন্তু আমার কোনো প্রবলেম নেই। তুই চাইলে দেখেও নিতে পারিস কেমন করে আসলে চেঞ্জ করতে হয়।
আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম তার পানে। একটু আগে ঝাড়ি দিয়ে এখন আবার এসব ছি মার্কা কথাবার্তা বলতেও দ্বিধা বোধ করছে না এই অসভ্য মানুষটা! একই অঙ্গে আর কতখানি রূপ দেখিতে হইবে তাহার? আমি প্রথমে হতভম্ব বনে গেলেও পরে বোধগম্য হতেই একরাশ লজ্জায় নুইয়ে পড়লাম আমি। দরজা খোলাই ছিল তাই দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। ইশ লোকটা এমন নির্লজ্জ ঠোঁটকাটা স্বভাবের কেন! মুখে কি একটুও কিছু আটকায় না তার! আজ সকাল থেকেই সে যে ইচ্ছে করে আমার সাথে এমন করছে তা বুঝতে একটুও বেগ পেতে হয়না আমার।
আমার ঘরে এসে পাইচারি করছি আর ভাবছি কিভাবে আদ্রিশ ভাইয়ার ডায়রিটা বাগে আনা যায়। আমার মনে হচ্ছে ওটা পড়লেই আমি আমার সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব কারণ আমি দেখেছি ওখানে মনের মাধুরী মিশিয়ে ভালোভাবেই তার মনের কোণে জমে থাকা সুপ্ত কথাগুলি সাজিয়ে গুছিয়ে ব্যক্ত করে রেখেছে মহাশয়! আমার পড়ার ইচ্ছে না থাকলেও আদ্রিশ ভাইয়ার ওমন ডায়রিটাকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা দেখে আমার পড়ার আগ্রহ আরও শতগুণে যেন বেড়ে গেল। আমার কৌতুহলপ্রবণ মনটা বারবার চাইছে ডায়রিটা এক্ষুনি পড়ার জন্য। তবে তা আর হলো কই? কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়া থাকতে পড়া হবেনা আর। ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম বিকেলের দিকে আদ্রিশ ভাইয়া আর আলভি ভাইয়া বাইরে বের হবে। এটাই মক্ষোম সুযোগ! তখন ঘর ফাঁকা পড়ে থাকবে আর আমি টুপ ঢুকে টুকুশ করে পড়ে বেরিয়ে আসবো। ব্যাস্ কেল্লা ফতে! এইতো এই না হলে আমার বুদ্ধি! সত্যিই আমার বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়!
শিস বাজাতে বাজাতে ডাইনিং রুমে চলে এলাম আমি। নাস্তা পানি সেরে যোগ দিলাম অরনী আর রিশতার সাথে গল্পের আসরে। বিকেলের দিকে ওরা ওদের দাদু বাড়ি বেড়াতে চলে যায়। বাড়িতে শুধু মা, মামনি আর আমি রয়েছে। আমি আর কাল বিলম্ব না করে সোজা আদ্রিশ ভাইয়ার রুমে চলে এলাম। এদিক ওদিক দেখে বুক সেলফটার দিকে এগিয়ে গেলাম ডায়রি নিতে। যাক পেয়েও গেলাম। ইশ আদ্রিশ ভাইয়া এতোটা বোকা তা তো জানতাম না, ডায়রিটা না লুকিয়ে এখানেই রেখে চলে গেছে। আসলে আমার বুদ্ধির সাথে কি পারা যায়! সেও যেমন ‘খান’ বংশের ছেলে আর আমিও তেমনি ‘খান’ বংশের মেয়ে! সবসময় শেয়ানে শেয়ানে টক্কর হয়। আমি আর একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে ডায়রিটা নিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে এলাম।
বিছানায় ডায়রিটা ফেলে উবু হয়ে শুয়ে পড়লাম ডায়রি পড়ার জন্যে। ও মা এ কি ডায়রির পাতা সাদা পড়ে আছে কেন!
পেছন থেকে হঠাৎ ভেসে এলো কোনো এক পুরুষের ঘর কাঁপানো হাসির ঝংকার! আমি ঘাড়বে গেলাম। এই রে বেশি চালাকি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম যে। ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’ এটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি এখন। কেন মরতে বাঘের লেজে পারা দিতে গেলাম! এখন তবে কি হবে আমার? আমায় তো আস্তো রাখবে বলে মনে হয়না।
#চলবে ~
সবাই রেসপন্স করবেন আর কমেন্ট করে জানাবেন অবশ্যই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন ❤️
পেইজঃ Bindas Life ✅ ফলো করে রাখুন ।