হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶 #নুসাইবা_জান্নাত_আরহা #পর্ব২

0
141

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২

দুপুরের সেই বিব্রতকর ব্যাপারটা এখনো মস্তিষ্কের নিউরন সেলের মাঝে বিচরণ করছে প্রতিনিয়ত। আমি লজ্জায় নিজের ঘর থেকে আর বের হইনি। অরনী আর রিশতা এসে ডেকে গেছে বেশ কয়েকবার কিন্তু আমি কোনো সাড়া দেইনি। চুপচাপ হাটুতে মাথা ঠেকিয়ে বিছানায় বসে রইলাম।

এমন সময় দরজায় কেউ কড়া নারে। আমি এবার বিরক্ত হয়ে কিছুটা চেচিয়ে বললাম

-‘ আমাকে এ মুহুর্তে কেউ ডিস্টার্ব করবে না তো।

দরজার অপর প্রান্ত হতে ভেসে এলো এক গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠস্বর। তীক্ষ্ণ কন্ঠে মানুষটা বলল

-‘ ভালো ভাবেই বলছি, তুই কি আসবি মেহরুন নাকি যে অবস্থায় আছিস সেভাবেই ধরে বেঁধে নিয়ে যেতে হবে আমার?

আমার আর বুঝতে বাকি রইল না, এই তীক্ষ্ণ কন্ঠের মালিক কে? ইনিই হলেন আমার শাশুড়ি ইয়ে মানে আমার মামনির ছেলে মিস্টার আদ্রিশ খান। যিনি সম্পর্কে আমার চাচাতো ভাই হন। সদ্য পাশ করা একজন ডাক্তার বলে যার ভাবের কোনো অন্ত নেই। আমাদের মুলত জয়েন ফ্যামিলি। আমার বাবা এবং চাচ্চু একসাথেই এক বাড়িতে থাকেন। আমি আর আলভি ভাইয়া পিঠাপিঠি দুই ভাই-বোন। আদ্রিশ ভাইয়া আমার বড় চাচ্চুর একমাত্র ছেলে। আর রিশতা এবং অরনী আমার ফুফাতো বোন। খুব ছোটবেলায় যখন ফুপা মারা যান তখন থেকেই ফুপ্পি তার দুই মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাড়িতেই থাকতেন কিন্তু কয়েক বছর আগে ফুপ্পিও মারা যান। আর তারপর থেকে রিশতা আর অরনী আমাদের সাথেই থাকে। আমি আর রিশতা সমবয়সী হলেও অরনী আমাদের চাইতে প্রায় দশ মাসের বড় কিন্তু আমরা ছোট থেকে একই ক্লাসে পড়ার সুবাদে সময়বয়সীর মতোই মিশি। আমরা কাজিন হলেও আমাদের মাঝে সম্পর্কটা অনেকটা বেস্টফ্রেন্ডের মতোই। সবাই বলে ওদের মধ্যে আমি-ই নাকি খুব বেশি দূরন্ত কিন্তু আমি মোটেও দূরন্ত নই। আমার মতো এতো শান্তশিষ্ট আর ভদ্র মেয়ে এই পুরো দুনিয়া খুঁজলেও, একটাও মিলবে না!

আমাকে চুপ থাকতে দেখে তিনি আবারও হাক ছাড়লেন। অগত্যা আমি আর বসে না থেকে তড়িঘড়ি করে চলে এলাম তার কাছে। আদ্রিশ ভাইয়াকে দেখতেই একরাশ লজ্জারা এসে ঘিরে ধরল আমায়। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা আবারও মনে পড়ে গেল আমার। তবুও বুঝতে না দিয়ে মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে কিছু বলার জন্যে উদ্যত হতেই আমায় থামিয়ে দিয়ে তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন

-‘ রিশতা আর অরনী এসে খাওয়ার জন্য তোকে ডেকে গেছে কতবার, খেয়াল আছে কোনো? নাকি কানে তুলো গুঁজে বসেছিলি এতোক্ষণ?

-‘ সরি ভাইয়া। আসলে আমার না একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না।

আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে চিন্তিত সুরে বলল

-‘ তোর কি শরীর খারাপ লাগছে মেহু?

মাথা নাড়িয়ে বললাম

-‘ না ঠিক আছি আমি। এমনিই ভালো লাগছে না আরকি।

আমার হেয়ালীমার্কা কথা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া এবার কিছুটা শাসনের সুরে বলল

-‘ কানের নিচে মারব এক চটকনা। এতটুকু মেয়ে আবার বলে কিনা আমার খেতে ভালো লাগছে না! বলি, খাওয়া দাওয়া না করলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বি, তখন তো আবার মহারানীকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়বে। ডাক্তার হয়েই বিপদে পড়েছি আমি।

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে আমি ভ্রু কুটি করে বললাম

-‘ আমি অসুস্থ হলে তোমার কি তাতে?

-‘ আমার কি মানে, তুই অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার কি হবে বুঝতে পারছিস না তুই?

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে আমার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। মানুষটা আবার আমায় ভালো টালো বাসে নাকি। লোকটাকে বাজিয়ে দেখতে হবে তো একটু। আমি এবার মাথা নাড়িয়ে না বোঝার ভান করে বললাম

-‘ না তো আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা ভাইয়া।আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো তো ভাইয়া।

আদ্রিশ ভাইয়া এবার কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে শান্ত কন্ঠে বলল

-‘ এই যে মহারানী আপনার কিছু হলে তো ছোটমা এসে আমায় ধরে বলবেন তার গুণধর মেয়ের কি চিকিৎসা করেছি আমি, যে তার এই দশা। তখন তো আমার ডাক্তারি সার্টিফিকেট নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আর সেই সাথে উদুম কেলানিও ফ্রি। ভাবা যায় এগ্লা?

এতোটুকু বলে সুক্ষ্ম হাসল আদ্রিশ ভাইয়া। আমি তার হাসির পানে তাকিয়ে রইলাম খানিক্ষন। এই হাসিতেই তো আমি…।

আদ্রিশ ভাইয়ার কাছ থেকে এমন উত্তর এক্সপেক্ট করিনি আমি। তাই তার উত্তর শুনে আমি আশাহত হলাম কিছুটা। উনি আছেন ওনার সার্টিফিকেটের চিন্তায়। ধুর তোর নিকুচি করেছে সার্টিফিকেট। এমন নিরামিষ মার্কা কাজিন আমার চাই না! আমায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি এবার আবারও কিছুটা শাসনের সুরে বলল

-‘ মাথায় তো আছে শুধু দুষ্ট বুদ্ধি। ভালো বুদ্ধি থাকলে জীবনে শাইন করতে পারতিস। দিনদিন তো বেয়ারা হয়ে যাচ্ছো, মেয়ে। ভর দুপুরে মানুষকে ফোন দিয়ে ওলোট পালোট কথা বলা আমি বার করছি। আজ থেকে তোর ফোন জমা দিবি আমার কাছে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে এইসব ফাইজলামি করা, তাইনা? দাঁড়াও চাঁদ তোমায় দেখাচ্ছি মজা!

কথাটা বলেই বাঁকা হাসল আদ্রিশ ভাইয়া। ওনার কথা শুনে আমি একেবারে চুপসে গেলাম। এই লোক এখন আবার কি ফন্দি আঁটছে কে জানে? দুপুর বেলায় আমার ওমন বেহায়া মার্কা কর্মকান্ডে আমি নিজেই লজ্জা পেয়েছি ভীষণ। শেষমেশ ‘শাশুড়ি আম্মু’ বলে সম্মোধন করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম আদ্রিশ ভাইয়ার কাছে। ইশ কি লজ্জা কি লজ্জা! মনের ভুলেও রিশতা আর অরনীর সাথে আমি আমার জীবদ্দশাতেও আর ট্রুথ ডেয়ার খেলব না বলে মনে মনে পণ করলাম। ঘরে ঢুকে তখন থম মেরে বসেছিলাম এই মানুষটার সামনে পড়বো না তাই। কিন্তু ঠিক এসে হাজির হলো আমার সামনে। আর কয়েক দফা কথা শুনিয়ে দিলো আমার মতো নিষ্পাপ মাসুম বাচ্চাটিকে।

আদ্রিশ ভাইয়া পুনরায় বলে উঠল

-‘ তুই কি যাবি নাকি এখানে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকবি মেহু?

অগত্যা আমি আর কথা না বাড়িয়ে তাই আদ্রিশ ভাইয়ার পেছন পেছন চলে এলাম ডাইনিং রুমে।

ডাইনিং টেবিলে মা এবং মামনি খাবার পরিবেশন করছেন। রিশতা আর অরনী বসে বসে কিসব জানি ফিসফিস করছিল এমন সময় আমায় দেখতেই ফিচালো হেসে অরনী বলে উঠল

-‘ কি রে আমরা ডাকলাম তখন তো এলি না। যেই আদ্রিশ ভাইয়া ডাকতে গেলো ওমনি সুরসুর করে নেমে এলি?

রিশতা পাশে থেকে হেসে ঠাট্টা করে বলে উঠল

-‘ শাশুড়ির ছেলে বলে কথা তার ডাকে সাড়া না দিলে কি হয়…

এতোটুকু বলে রিশতা নিজেই নিজের মুখ চেপে ধরল। ইশ কি বলতে কি বলে ফেলেছে সে! দাঁত দিয়ে জ্বিভ কেটে মেহরুনের দিকে তাকায় রিশতা।

রিশতার পাশে বসে আলভি ভাইয়া ফোন চালাচ্ছিল। পুরো কথা না শুনে ওর বলার শেষোক্ত কথাটা শুনে আলভি ভাইয়া ফোন থেকে চোখ সরিয়ে ভ্রু কুচকে বলল

-‘ এই শাশুড়ির ছেলেটা আবার কে? কার কথা বলছিস রে রিশু?

রিশতা হতে আর কোনো জবাব মেলেনা। মুখ ফসকে কথা বেরিয়ে যাওয়া, এটা তা জন্মগত অভ্যাস! এদিকে আলভি ভাইয়ার এহেন কথায় আমি বিষম খেয়ে গেলাম। কাশতে কাশতে আমার প্রায় বেহাল দশা। আদ্রিশ ভাইয়া ডাইনিং টেবিল হতে পানির গ্লাসটা নিয়ে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি ছো মেরে আদ্রিশ ভাইয়ার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে গলায় পানি ঢাললাম। পানিটা খেয়ে এবার যেন কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম।

সবার দিকে তাকাতেই দেখলাম, উপস্থিত সবাই আমার আর আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে কি অদ্ভুত চাহনিতে চেয়ে আছে! লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ডাইনিং টেবিলটার নিচে ভেজা বিড়ালের মতো লুকিয়ে যেতে! কিন্তু আফসোস আমি তো আর বিড়াল নই। এই অরনী আর রিশতা আমায় ইচ্ছে করে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছে করছে দুটোকে গিয়ে দু ঘা বসিয়ে দেই। কিন্তু এখন ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। এমন কাজিন কপালে জুটলে তার কপালে দুঃখসহ শনি ঘুরতে থাকে চিরকাল! তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

আদ্রিশ ভাইয়া আর কোনো কথা না বলে থমথমে মুখে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ারটাতে বসে পড়লো। আমিও চেয়ার টেনে অরনীর পাশে বসে পড়লাম। কি আশ্চর্য আদ্রিশ ভাইয়া যেন কেমন অদ্ভুতভাবে আমায় দেখছেন! তার চশমা আঁটি চক্ষুদ্বয়ের মাঝে কি যেন এক অদ্ভুত সংমিশ্রণের খেলা চলছে এ মুহুর্তে! এ লোক কি আমায় ভালো টালো বাসে নাকি সবই নাটক? আমি আরও কয়েকবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম তার দিকে কিন্তু তিনি আর একবারও আমার দিকে ফিরে তাকাননি।

আজকে দুপুরে বাবা আর চাচ্চু বাসায় আসেননি। ফিরতে ফিরতে রাত হবে হয়তো তাদের। ভাগ্য ভালো যে, ওনারা কেউ নেই বাসাতে, নইলে কি বলতো তা কে জানে?

কেউ আর এ বিষয়ে কোনো কথা না বাড়িয়ে যে যার মতো খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। যেন কিছুই হয়নি। আমি কিছুটা অবাক হলাম আমার মায়ের মৌনতা দেখে। তবে খেয়াল করলাম মামনি কেমন যেন মুচকি মুচকি হাসছেন আমায় দেখে। তা দেখে আমি আর লজ্জায় খেতে পারলাম না। কোনো রকমে দুটো ভাত চিবিয়ে উঠে পড়লাম। আমায় চলে যেতে দেখে মা পেছন থেকে ডেকে বললেন

-‘ কি রে আর খেলি না?

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম

-‘ না মা, আমার আর খিদে নেই।

বলেই আর এক মুহূর্ত দেরি না করে নিজের কক্ষের পথে পা বাড়ালাম। অন্যদিন হলে মা জোড় করে বসিয়ে পুরো প্লেটের ভাত খাইয়ে দিতেন কিন্তু আজ আর কিছু বললেন না তিনি। আমার কেমন যেন লাগছে। ঘরে এসেই বালিশে মুখ গুঁজে বসে রইলাম আমি। ইশ আজ কি লজ্জাটাই না পেলাম! সুধে উষুলে সব পুষিয়ে নিবো আমি। হুহ! আমার নামও মেহরুন ইবনাত খান। আমি দেখিয়ে দিবো আমি কে? কথাটা মনে মনে ভেবেই নিজের চুল উড়িয়ে ভাব নিলাম😎

এদিকে মেহরুনের যাওয়ার পানে এক পলক তাকিয়ে আবারও খাওয়ায় মনোনিবেশ করল আদ্রিশ। মেহরুনকে নিয়ে আপাতত কিছু ভাবতে চায়না সে। আদ্রিশের ধারণা, “দূরন্ত কিশোরীর এখন উড়ন্ত মন। এই বয়সটাতে সবারই মন উড়ুউড়ু করে, তখন যাকে দেখে তাকেই তার ভালো লেগে যায়। এই বয়সটা তো এমনই। মেহরুনেরও ঠিক এক দশা। মেহরুন যেটা চায় বা করতে চায়, সেটা নিছকই আবেগ মাত্র! তাই এই বয়সে ছোটদের ভুল থেকে শোধরানোর জন্য যারা বড় তাদের শাসনের প্রয়োজন হয়। একটা পারফেক্ট গাইডলাইনই পারে একটা মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে। আর আদ্রিশ সেই দায়িত্বই পালন করতে চায়। আদ্রিশ চায় মেহরুন জীবনে অনেক বড় হোক। দরকার পড়লে ওর পাশে সবসময় ছায়ার মতো থাকবে। হোক সেটা বড় ভাই কিংবা বন্ধু বেশে।”

#চলবে ~

নোট: [প্রথম পর্বে আপনাদের এতোটা সাড়া পাবো আমি কখনোই ভাবেনি। এজন্য আপনাদের অনেকগুলো ভালোবাসা। আমি প্রায় সবার কমেন্ট পড়েছি, সবার কমেন্টের রিপ্লাই দেওয়ারও চেষ্টা করেছি। গল্পটা মুলত কাজিন রিলেটেড হবে। এটা মুলত আমারই কাহিনী। একবার কাজিনদের সাথে ট্রুথ ডেয়ার খেলার সময় এই কাহিনী হয়েছিল। যদিও এর পরের অংশটা আমি আমার মতো করে সাজিয়ে লিখবো। পরিশেষে ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর আপনাদের মুল্যবান মতামতের অপেক্ষায় রইলাম। সবাই গতপর্বের মতো এই পর্বেও বেশি বেশি রেসপন্স করবেন আর পেজটাকে ফলো করে দিবেন। হ্যাপি রিডিং]

[ পেইজঃ Bindas Life ✅ ফলো করুন ❤️ ।। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here