#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৩
পৃথিবীর বুকে ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যের আঁধার। সূর্যাস্ত গেছে খানিক আগেই। তবে আকাশের লাল আলোকছটা এখনো মেলায়নি। সন্ধ্যের আকাশে অস্তিত্ব মেলে সন্ধ্যা তারার, সেইসাথে বিরাজ করছে অর্ধচন্দ্র। আকাশে হালকা হালকা মেঘ ভেসে বেড়ায় ভেলার মতো! মাঝে মধ্যে মেঘের আড়ালে গিয়ে চাঁদ মামা লুকোচুরি খেলছে। ছাঁদের রেলিং এ হাত রেখে এক মনে আকাশের পানে চেয়ে এমন স্নিগ্ধ প্রকৃতির রূপ রহস্য উন্মোচন করার বৃথা চেষ্টা করছি আমি। বিকেলের ভ্যাপসা গরম ভাবটা এখন মিলিয়েছে কিছুটা। চারপাশে বইছে মৃদু মন্দ হাওয়া। আমি চোখ বুঁজে বুক ভরে শ্বাস টেনে নিলাম। শীতল হাওয়ায় আমার শরীর মন উভয়েই সতেজতা ফিরে পেলো যেন।চোখ মেলে নিচে তাকিয়ে একবার দেখে নিলাম এই ব্যস্ত নগরীকে। অবসর পেলেই আমি এমন নিস্তব্ধ প্রকৃতির ব্যাকুল রূপ দেখবার জন্য ছুটে চলে আসি আমাদের বাসার ছাঁদে।
আমি এক ধ্যানে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে ব্যাস্ত এমন সময় হুট করে পেছন থেকে এসে কেউ আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ এমন হওয়ায় কিছুটা চমকালাম। আমার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে রিশতা দুষ্ট হেসে বলল
-‘ কিরে চমকে গেলি বুঝি?
আমি তা বুঝতে না দিয়ে কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললাম
-‘ এখানে আবার চমকানোর কি আছে?
রিশতা এবার আমার পেছন থেকে সরে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। আমার দিকে তাকিয়ে গালে এক হাত রেখে বলল
-‘ ইশ আমায় দেখে যে তুই আশাহত হয়েছিস তা আমি জানি। তবে আমার জায়গায় আদ্রিশ ভাইয়া থাকলে কিন্তু ঠিকই চমকের সাথে সাথে শিহরিতও হয়ে যেতিস। কি ঠিক বললাম না, মেহুসোনা?
আমি এবার রিশতার দিকে ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে কিছুটা রাগ নিয়ে বললাম
-‘ মেয়ে হয়েও আরেকটা মেয়েকে এভাবে টিজ করে কথা বলছিস তুই? এমনিতেই দুপুরের ঐ ঘটনাটা নিয়ে আমার মেজাজ এখনো সপ্ত আসমানে চড়ে আছে, তার উপর আবার এসব বকবক, আমি জাস্ট টলারেট করতে পারছিনা।
রিশতার এবার হাসিহাসি মুখখানা মলিন হয়ে যায়। থমথমে গলায় বলল
-‘ এমন করছিস কেন মেহু? আমরা তো জাস্ট মজা করেছিলাম। কাজিনদের মধ্যে তো এসব হাসি তামাশা আরও কতো কি হয়। আর আমরা তো সেই ছোটবেলা থেকেই এমন, আজ তো আর নতুন না। তাহলে এতো সিরিয়াসলি কেন নিচ্ছিস ব্যাপারটাকে? ইভেন তুই এই কারণে আমার সাথে কথাও বলতে চাইছিস না। আমাদেরকে তুই এতোটাই পর ভাবিস যে সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এমন করছিস?
-‘ রিশতা তো ঠিকই বলেছে মেহরুন। সামান্য একটা বিষয় নিয়ে কেন এতো রিয়াক্ট করছিস? রং নাম্বারে ফোন দিয়ে ওলোট পালোট বকবক করা এসব তো তোরই বুদ্ধি। তুই যখন আমাদের এসব ডেয়ার দিতিস, কই তখন তো আমরা এমনভাবে রিয়াক্ট করতাম না। তাহলে তোর কেন এমন আচরণ?
আড়ালে দাঁড়িয়ে অরনী আমাদের কথা শুনছিল। আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে উক্ত কথাগুলো বলল অরনী। আমার দুই বাহু ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে অরনী বলল
-‘ মুখটাকে এমন বেজার করে কেন রেখেছিস, বল তো? আচ্ছা, আদ্রিশ ভাই কি কিছু বলেছে তোকে?
আমি না সূচক মাথা নাড়ালাম। অরনী এবার আমার থুতনিতে হাত রেখে ভ্রু কুটি করে বলল
-‘ তাহলে মুখভঙ্গি এমন কেন? ভাবখানা এমন যে আদ্রিশ ভাই তোকে ঠাস ঠাস কারে থাপ্পড় মেরে দিয়েছে, এইজন্য পেঁচার মতো মুখ করে আছিস।
আমি এবার কিছুটা থমথমে গলায় বললাম
-‘ আমিও বিষয়টাকে মজা হিসেবেই নিতাম কিন্তু রিশতারও তো ওভাবে আদ্রিশ ভাইয়া আর আমাকে নিয়ে সবার সামনে বিরূপ মন্তব্য করা উচিত হয়নি।
-‘ হুম, রিশতারও উচিত হয়নি এমন করা। তবে ও তো আর ইচ্ছে করে কিছু বলেনি। আর তাছাড়া আমরা তো মামিকে প্র্যাঙ্ক কল দিয়েছিলাম। কিন্তু আদ্রিশ ভাই যদি ফোন রিসিভ করে তাহলে আমরা কি করতে পারি, বল? আমরা তো আর ইচ্ছে করে এমন করিনি। আর রাগ করে থাকিস না বনু। আলাবুউউ।
রিশতাও এবার অরনীর সাথে সুর মিলিয়ে বেশ অনুনয়ের সুরে বলল
-‘ আমি ইচ্ছে করে ওমন করিনি রে। আমার মুখ ফুসকে কথাটা বেড়িয়ে গিয়েছিল। সরি বনু। এমন আর কখনো হবেনা, প্রমিস।
আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম
-‘ ঠিকাছে, হয়েছে। এতো করে যখন বলছিস তখন মাফ করে দিলাম। তবে নেক্সট টাইম যেন এমন না হয়।
দুজনেই মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে জড়িয়ে ধরে আমাকে। ফিক করে হেসে দিয়ে আমিও আলতো হাতে জড়িয়ে নিই ওদের।
অরনী আমায় ছেড়ে এবার শান্ত কন্ঠে বলল
-‘ আমরা তোকে এমন হাসিখুশি ভাবে দেখতেই অভ্যস্থ মেহরুন। রাগ, অ্যাটিটিউড এসব আদ্রিশ ভাইয়ের সাথেই যায়। তবে তোর সাথে এসব ঠিক যায়না। আমরা তো এই হাসিখুশি দূরন্ত মেহরুনকেই চাই। তোর এই দূরন্তপনাই জানান দেয় তোর অস্তিত্ব। সবসময় এমনই থাকবি কেমন? কখনো বদলে যাসনা, আমরা তাহলে খুব কষ্ট পাবো।
অরনী এসব শান্ত কণ্ঠে বললেও তার কথাগুলোর মাঝে করুণ সুর লুকিয়ে আছে।
আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি এমনিও রাগ করিনি ওদের উপর। শুধু একটু ভাব নিচ্ছিলাম। আসলে দেখতে চাচ্ছিলাম আমি রাগ করলে ওদের রিয়াকশনটা কেমন হয়? তবে ওরা ধরতেই পারেনি কিছু। এখন আমার মাথায় শুধু দুষ্ট বুদ্ধিরা এসে হানা দিচ্ছে।
অরনী আমার কাঁধে হাত রেখে শীতল কন্ঠে বলল
-‘ আচ্ছা মেহরুন, তুই ভালোবাসিস আদ্রিশ ভাইকে?
আমি চকিত তাকালাম অরনীর দিকে। এর কোনো উত্তর আমার জানা নেই। আদৌও আদ্রিশ ভাইয়ার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি আছে কিনা তা-ও আমার জানা নেই। আমায় চুপ থাকতে দেখে অরনী আবারও জিজ্ঞেস করল। আমিও শান্ত কন্ঠে বললাম
-‘ তোরা আমায় আর আদ্রিশ ভাইয়াকে নিয়ে ভুল ভাবছিস অরু। আদৌও আমাদের মাঝে এমন সম্পর্কের কোনো অস্তিত্বই নেই।
-‘ তুই না বাসলেও আদ্রিশ ভাই হয়তো ঠিকই তোকে ভালোবাসে।
অরনীর দিকে ফিরে মলিন হাসলাম আমি। বুকে চিড়ে বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘশ্বাস। তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম
-‘ আমার প্রতি কোনো বিন্দুমাত্র অনুভুতির ছিটেফোঁটাও দেখিনি তার চোখেমুখে। আর তুই বলছিস সে আমায় ভালোবাসে? হাসালি আমায়।
অরনী চুপ করে রইল। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। ও হয়তো এমন উত্তর আশা করেনি আমার কাছ থেকে।
-‘ মেহু…
পিনপতন নীরবতার মাঝে হঠাৎ গমগমে পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে এলল আমার কর্ণকুহরের মাঝে। আমি তাই কিছুটা চমকে পেছন ফিরে তাকালাম।
বুকের মাঝে দুহাত গুঁজে ছাঁদের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিশ ভাইয়া। ধূসর রঙের টিশার্টা আদ্রিশ ভাইয়ার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ে বেশ মানিয়েছে। অবহেলায় অনাদরে তার কপালের অংশটাতে কিছু চুল লেপ্টে রয়েছে। হালকা বাতাসে সেই চুলগুলো নড়ছে। আজকে তাকে কেন জানিনা অন্যরকম লাগছে দেখতে। তার শীতল চাহনি আমার হৃদ মাঝারে তোলপাড় করে তোলে প্রতিনিয়ত। আমি হয়তো পলক ফেলতেই ভুলে গিয়েছিলাম। এক ধ্যানে কতক্ষন তাকিয়ে ছিলাম জানা নেই, তবে আমরা ভাবনায় টান পড়ে আদ্রিশ ভাইয়ার ডাকে।
আদ্রিশ ভাইয়া এগিয়ে আসতে আসতে কিছুটা ধমকের সুরে বলল
-‘ এই ভর সন্ধ্যে বেলা পেত্নির মতো চুল খোলা রেখে ছাঁদে কি করছিস? নিচে চল বলছি। নেক্সট টাইম যেন এই অসময়ে এভাবে আর ছাঁদে না দেখি তোকে।
আমি কিছুটা দায়সারা ভাব নিয়ে বললাম
-‘ খোলা চুলে ছাঁদে এলে কি হবে ভাইয়া?
আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া শান্ত কণ্ঠে বলল
-‘ ভুত প্রেত এসে তোমায় তুলে নিয়ে গেলে তখন বুঝবে কি হয়।
এই রে আমার তো খেয়ালই ছিলনা। সন্ধ্যার সময় ছাঁদে এলে মা-ও ভীষণ রাগ করে। তবুও আমি তো এতো সহজে দমে যাওয়ার পাত্রী নই। তাই এবার অবাক হয়ে বললাম
-‘ তুমি না একজন ডাক্তার। তাহলে ডাক্তার হয়েও কিভাবে এসব ভুত প্রেত বিশ্বাস করো ভাইয়া?
আদ্রিশ ভাইয়া সুক্ষ্মভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আমার দিকে। হঠাৎ হেসে উঠে বলল
-‘ ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, পেত্নীদের দেখলে তো ভুতেরা পালায়। তোর মতো পেত্নীকে দেখে আসল পেত্নীরা হিংসায় ঝলসে যাবে। আর তোর এই পেত্নী মার্কা চেহারা দেখলে তো ভুতেরাও নির্ঘাত মরে পড়ে থাকবে।
আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমি বেশ অপমান বোধ করেছি। আমিও তো কিছু কম যাইনা। উনিও যে বংশের ছেলে আমিও ঠিক সেই বংশেরই মেয়ে। তাই আমি চোখ ছোট ছোট করে কিছুটা জোড় গলায় বললাম
-‘ আমি পেত্নী হলে তুমি তাহলে একটা আস্ত মামদোভুত।
আমার এহেন কথায় রেগে যায় আদ্রিশ ভাইয়া। তার ধমকে আমার হাড় পর্যন্ত শিরশির করে কেঁপে ওঠে। এবার আমি একেবারে চুপসে গেলাম। অগত্যা আদ্রিশ ভাইয়ার ধমক খেয়ে আমরা তিনজনই সুরসুর করে ভেজা বিড়ালের মতো ছাঁদ থেকে নেমে এলাম। যাওয়ার পথে ঘাড় ঘুড়িয়ে এক পলক তাকালাম আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে। মনে মনে আওড়ালাম
-‘ আচ্ছা পেত্নীরা যে চুল খোলা রাখে, এটা জানলো কিভাবে আদ্রিশ ভাইয়া? উনি কি ডাক্তারি ছেড়ে শেষমেশ পেত্নীদের নিয়ে গবেষণা করা শুরু করে দিয়েছেন আজকাল? বিষয়টা তো আমার কাছে ঠিক সুবিধার ঠেকছেনা।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই নিচে চলে এলাম।
আদ্রিশ বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। মেহরুনকে কোথাও না পেয়ে ছাঁদে এসেছিল। ছাঁদে এসে এই ভর সন্ধ্যেবেলায় এমন সেঁওরা গাছের পেত্নীর মতো খোলা চুলে মেহরুনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটুর জন্যে ভবলীলাসাঙ্গ হয়ে যায়নি আদ্রিশের। নিজেকে ধাতস্থ করতেও কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল তার। মেহরুনকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হয় আদ্রিশের। ‘এই মেয়ে যার কপালে জুটবে তার জীবনটা একেবারে ত্যানাত্যানা হয়ে যাবে।’ মেহরুন নয়, মেহরুনের ভবিষ্যত হাসবেন্ডের কথা ভেবেই ভীষণ দুঃখ দুঃখ ফিল হয় আদ্রিশের। ‘আহারে! ইস বেচারা জামাইবাবুটা।’ কথাটা ভেবেই ঠোঁট চেপে হেসে ফেলে আদ্রিশ।
#চলবে ~
[কষ্ট করে লিখেছে তাই সবার গঠনমূলক মন্তব্য চাই। আমার পেজটাকে ফলো করে দিবেন।]
পেইজঃ Bindas Life ✅ ফলো করুন ❤️ ।।