সন্ধ্যারাতে_শালুক_ফোঁটে ❤️ #আদনীন_নিশাত_তারান্নুম_চৌধুরী ❤️ #পর্বসংখ্যা-(০৬)

0
78

#সন্ধ্যারাতে_শালুক_ফোঁটে ❤️
#আদনীন_নিশাত_তারান্নুম_চৌধুরী ❤️
#পর্বসংখ্যা-(০৬)
_______________________________

১৬.
ছেলের বিয়ের খবর শোনামাত্রই সূদুর আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে ছুঁটে এলেন মারইয়াম ইউজিওয়েল। আরমান ফজর আদায় করে ভোরের হাওয়া অনুভব করছিলো। প্রভা ঘুমাচ্ছে। তখনই গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকলো। গাড়ি থেকে মারইয়াম ইউজিওয়েল বের হলেন। আয়েশা মির্জা এবং বড় মির্জা সাহেবকে দেখা গেলো। ওনারা বোধহয় জানতেন। আরমান তড়িৎ নিচে নেমে মায়ের কাছে গেলো। ছেলেকে দেখতেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন বুকে। হঠাৎ বুক থেকে সরে বললেন,”তোমাকে বার-বার নিষেধ করার পরেও তুমি বিয়ে করে নিলে?”

মৌন রইলো আরমান।

“শুনো,এই বিয়ে আমি কিছুতেই মানবো না।”

আয়েশা মির্জা বিরক্ত হলেন।

“মারইয়াম সবে এসেছো। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও। পরেরটা পরে দেখা যাবে।”

“আপনারা কিভাবে পারলেন এমনটা করতে? কিসের সাথে কি বিয়ে দিলেন?এরা একজন আরেকজনের সাথে এডজাস্ট করতে পারবে কি-না! আন্ডারস্ট্যান্ডিং কেমন হবে?মেন্টালিটি ম্যাচ করবে কি-না! ফিউচারে কি হবে না হবে একটাবার ভেবে দেখেছেন?”

“ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে দিয়েছি। তোমাকেও জানিয়েছি। আসোনি। এখন এতো কথা বলছো কেন?”

“পুত্রবধূ হিসেবে ওই মেয়েকে আমি জীবনেও মানবো না।”

মুখ খুললো আরমান।

“বিয়েটা আমি করেছি আপনি নয়। আর আমি এডাল্ট। আমার বউকে আমি মানলেই যথেষ্ট! এখন বাড়াবাড়ি না করে রেস্ট করুন।”

রুমে ফিরে গেলো আরমান। সারা রাত না ঘুমানোর ফলে তার মাথা ব্যথা করছে। আয়েশা মির্জা মারইয়াম ইউজিওয়েলকে উনার কামরায় নিয়ে গেলেন। যেতে যেতে কিছু একটা বলতে লাগলেন।

১৭.
সকালবেলা সবকিছু স্বাভাবিক। নানান রকমের আত্নীয়স্বজন বাসায় ভরপুর! আরমানের বিয়েতে বাবা থাকলেও মা থাকতে পারেনি। তবে তিনিও এসে পড়েছেন। সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলে প্রভার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিলো উনার। বাঙালি মেয়ের সাথে একমাত্র পুত্রের বিয়ে হয়েছে এটা তিনি মানতে পারেননি। তবে মুখে হাসি রেখেছিলেন সবটাসময়। বুঝতে দেননি কিছুই। সবটাসময় খুব স্বাভাবিক ছিলেন। ছেলের বউকে উপহারস্বরূপ অনেক কিছুই দিয়েছেন। বিকেলে শশীপ্রভার বাসা থেকে মেহমান এসেছে মির্জামহলে। শশীপ্রভাকে নিয়ে গিয়ে দুইদিন রেখেছিলো। তবে আরমান যায়নি। পরেরদিন সৌজন্যতামূলক টুকটাক কথা বলে শশীপ্রভাকে নিয়ে এসেছে মহলে।

১৮.
একসপ্তাহ পরের কথা। আরমান-শশীপ্রভার সম্পর্কের উন্নতি না হলেও সবকিছু ঠিকঠাক রয়েছে। দু’জনে স্বাভাবিক থাকলেও শশীপ্রভার জড়তা কাটেনি। সকালবেলা রিয়াদকে নিয়ে জরুরী এক জায়গায় গেলো আরমান। এর ঘন্টা দুয়েক পর হঠাৎ শশীপ্রভার ফোনে কল এলো। মোবাইলটা আরমান দিয়েছে। তবে শশীপ্রভা পুরাতন সিমটা এই ফোনে সেটিং করে নিয়েছে। যদিও আরমান সিমও দিয়েছিলো। ভাবলো আরমান কল দিয়েছে। নাম না দেখেই কল পিক-আপ করলো।

“হ্যালো।”

“কি করছো বেইবি?”

ধড়ফড় করে উঠলো শশীপ্রভার বুকটা।

“আপনি আবারও ফোন দিয়েছেন? সমস্যা কি আপনার?”

“একটা এড্রেস দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি চলে আসো বেইবি। নয়তো তোমার স্বামীকে জানে মে’রে ফেলবো।”

“মানে? কী বলছেন এইসব?”

“একদম ঠিক বলেছি বেইবি। তোমার স্বামী এখন আমার কাছে বন্দী। ওই যে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখেছি। বেচারা বোধহয় কিছুক্ষণ পর মারা যাবে। ডাঙায় তোলা মাছের মতো তড়পাচ্ছে!”

কল কেটে দিলো আরাদ। দিশেহারা হয়ে গেলো শশীপ্রভা। আরমান বন্দী মানে? শয়তানটা আবার কিছু করেনি তো? বার-বার কল করলেও লাভ হয়নি। আরাদ পিক-আপ করলো না। দিকবিদিকশুন্য হয়ে কাউকে কিছু না বলে শশীপ্রভা মহল থেকে বেরিয়ে গেলো। সাথে সাথেই আরমানের কাছে শশীপ্রভার সংবাদ পৌঁছে গেলো। শশীপ্রভার দুঃসাহসিকায় এবং শর্ত ভঙ্গ করায় আরমান হতভম্ব! লোকেশন ট্র্যাক করলো শশীপ্রভার।

১৯.
আরাদের দেওয়া ঠিকানায় এলো শশীপ্রভা। কি রকম একটা ভূতুড়ে পরিবেশ গুদামঘরের ভেতর। শশীপ্রভার ভয় ভয় লাগছে। নিশ্চয়ই এখানে আরমানকে বন্দী করে রেখেছে। ভয়ে ভয়ে শশীপ্রভা কয়েক কদম এগুতেই হঠাৎ আরাদ বেরিয়ে এলো। আরাদকে দেখতেই ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো। শশীপ্রভার মুখোমুখি দাঁড়ালো আরাদ।

“বেইবি তুমি এসেছো? জানতাম আসবে। তবে আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না।”

শক্ত গলায় বলল,”আমার স্বামীকে কোথায় রেখেছেন?”

“এতো অস্থির হচ্ছো কেন বেইবি?”

“আপনি আমার পিছু ছাড়বেন কবে?এতো ছ্যাঁছড়া কেন আপনি? লজ্জা করে না আপনার?”

শশীপ্রভার চিবুক তুলে বলল,”ছাড়ার কথা কখনো ছিলো নাকি বেইবি? আর শুধু তোমার জন্যই ছ্যাঁছড়ামি করছি। কারো জন্য না।”

শশীপ্রভা রেগে উঠে বলল,”গায়ে হাত দিয়ে কথা বলছেন কেন? মাস্তান কোথাকার! দেশের সেবা না করে মানুষকে অপহরণ করে মাস্তানী করা হচ্ছে! আপনাকে জু’তা’পি’টা করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দেওয়া উচিত। ভণ্ড মন্ত্রী।”

বলেই আরাদকে ধাক্কা মে’রে নিচে ফেলে দিলো। আরাদের মেজাজ উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। কত বড় সাহস তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়! আবার জু’তা’পি’টা’র কথা বলে! জ্বীভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে মেয়েটার! নেহাৎই ভালোবাসে বলে পারছে না। দয়া করছে!

“সবে তো গায়ে হাত দিলাম। এবার দেখো বেইবি তোমায় কি করি! বিয়ে করবো বলে এতোদিন তোমায় স্বাধীনতা দিয়েছি। আজ থেকে আর নয়।”

বলেই আরাদ শশীপ্রভাকে জড়িয়ে ধরতেই আচমকা কষিয়ে একটা থাপ্পড় মা’র’লো। আরাদের ব্রহ্মতালু উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। কার গালে হাত তুললো মেয়েটা ধারণা আছে?এবার শশীপ্রভাকে টেনেহিঁচড়ে একটি রুমে নিয়ে বেডের উপর ছুঁড়ে মা’র’লো। জোরপূর্বক রে’প করার চেষ্টা করতেই আকস্মিক আরাদের মেরু বরাবর একটা লা’থি পড়লো। পড়ে গিয়ে পেছনে ফিরতেই আরাদ সহ শশীপ্রভা চমকে উঠলো। ঘাবড়ে গিয়ে পরিহিত শাড়ি ঠিক করতে লাগলো। আরাদের গলা চেপে ধরে টেনে উঠিয়ে একের পর এক লা’থি,ঘুষি মা’র’তে লাগলো আরমান। এমন মা’র মে’রে’ছে যে ঘটনাস্থলে আরাদ রক্তাক্ত হয়ে ঘটনাস্থলে সেন্সলেস হয়ে পড়লো। আরমান পিছনে তাকালো না। চলে গেলো। পেছনে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শশীপ্রভা। ঠিক কি হলো সব তার মাথার উপর দিয়ে গেলো।

২০.
দেশের বিভিন্ন টিভি নিউজ চ্যানেলে আরাদকে দেখাচ্ছে। দেশের স্বনামধন্য একজন মন্ত্রীর উপর এমন নিষ্ঠুর বর্বরতা কে বা কারা করতে পারে সবার মধ্যে কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে। তবে সাংবাদিকরা প্রকাশ করছে না কিছুই। মিডিয়া পাড়া অত্যন্ত সরগরম! কেউই সঠিক উত্তর দিতে পারছে না। আবার দিতে গেলেও চুপ করে যাচ্ছে। আরাদ খানের অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল। বাঁচবে কি-না সেই আশাটাও ডক্টররা ছেড়ে দিয়েছেন। আরাদ খানকে কেউ আক্রোশ থেকে হ’ত্যা করার চেষ্টা করেছে সেটা শরীরের ক্ষতগুলোর দিকে তাকালেই বুঝা যায়। আরাদের পরিবার ভেঙ্গে পড়েছে। ডাক্তাররা এখানে রাখতে চাইছে না। আশা করা যাচ্ছে রাতের মধ্যেই তাকে দেশের বাইরে উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর করা হবে। আপাতত ইমার্জেন্সি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাখা হয়েছে।

২১.
রাত বাজে দশটা। আরমান এখনও বাসায় ফিরেনি। টেনশনে প্রভা অস্থির হয়ে উঠলো। আজ কি হবে তার সাথে অপেক্ষা করছে তার জন্য। প্রভা দিকদিশা কিছুই পাচ্ছে না। হঠাৎ কামরায় প্রবেশ করলো আরমান। কোনদিকে না তাকিয়ে লাগেজ বের করে গুছাতে লাগলো। প্রভার কলিজা কেঁপে উঠলো।

“লাগেজ গোছাচ্ছেন কেন? সারাদিন কই ছিলেন?”

প্রতিত্তোর করলো না আরমান। প্রভা হাত ধরতেই ঝাড়ি মে’রে ফেলে দিলো। প্রভার চোখে জল এলো।

“আমার ভুলের জন্য আমি অনুতপ্ত! আমাকে ক্ষমা করুন প্লিজ। তবুও আমাকে ছেড়ে যাবেন না।”

আরমান সরিয়ে দিলো। প্রভা আবারও বলল,”আমি জানি আমার ভুলের ক্ষমা নেই। তবুও ক্ষমা করুন।”

“সামনে থেকে সরুন। ছোঁবেন না আমাকে। আপনি একটা লায়ার।”

চিৎকার করে উঠলো আরমান।

“একটু আমার কথা শুনুন প্লিজ। আমি ইচ্ছে করে যাইনি। আমাকে..”

“আপনার কোন কথাই শুনতে চাই না। যথাসময়ে ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবেন।”

রিয়াদকে ডাকতেই লাগেজ নিয়ে গাড়িতে তুললো। আরমান কামরা থেকে বেরিয়ে যেতেই আচমকা প্রভা দৌঁড়ে এসে হাত টেনে ধরলো। আকুতি ভরা কণ্ঠে অনুনয়-বিনয় করে বলল,”আমাকে ছেড়ে যাবেন না।”

“হাত ছাড়ুন।”

“আমাকে ছেড়ে যাবেন না বলুন?”

তরতর করে মেজাজের পারদ বাড়লো আরমানের। শক্ত করে হাত ধরে ছাড়িয়ে নিলো।

“আমার মাথা গরম করবেন না। আজ কিন্তু খুব খারাপ কিছু ঘটে যাবে। যেটা আপনার কল্পনার বাইরে। মৌখিক ডিভোর্স দিতে বাধ্য হবো।”

মাথায় বাজ পড়লো প্রভার। আরমানের চোখ-মুখ দিয়ে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। দিকবিদিকশুন্য হয়ে প্রভা বলল,”একটাবার আমার কথা শুনুন প্লিজ।”

“প্রয়োজন নেই।”

“এই রাগী সাহেব,আপনার এতো রাগ কেন? আপনার রাগটা একটু কমান। আমার কথা শুনুন।”

আরমান ফের বেরিয়ে যেতেই প্রভা ডুকরে উঠে হাত চেপে ধরলো। এই মুহূর্তে প্রভাকে অসহ্য লাগছে আরমানের।

“বড্ড বাড়াবাড়ি করছেন আপনি?”

চিৎকার করে উঠলো।

“আপনি আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছেন না কেন?”

“আপনাকে আমি ঘৃণা করি। আই হেট ইউ।”

প্রভার হৃদয়টা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো।

“মানুষ মাত্রই ভুল। আপনি তো ধার্মিক মানুষ। নিশ্চয়ই অবিবেচক নয়। আপনি তো জানেন ক্ষমা করা মহৎ গুণ।”

আচমকা শক্ত করে প্রভার চোয়াল চেপে ধরলো।

“ক্ষমা! কিসের ক্ষমা! সেদিন রাতে এলার্ট করিনি আমার শর্ত ভঙ্গ করলে কঠিন থেকে কঠিনতর পানিশমেন্ট পাবেন? তাহলে কেন লুকিয়েছেন আপনার অতীত,হারাম সম্পর্ক? আর আজ! ছিঃ! ছিঃ! এ আমি কি দেখলাম! আমার স্ত্রী কি-না আরেকজনের বিছানার সঙ্গী হলো! কিসের কমতি ছিলো আমার মধ্যে? গাছেরও খাবে তলারও কুড়াবে! খুব বুদ্ধিমতী ভাবেন নিজেকে?”

প্রভার মাথায় বাজ পড়লো। আরমান তাকে কঠিন ভুল বুঝেছে। প্রভা শ্বাস নিতে ভুলে গেলো। কিভাবে এই ভুল ভাঙ্গাবে?

“আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন। আপনি যা দেখেছেন তা সত্য নয়। অনেক সময় দেখা এবং শোনার মাঝেও ভুল থাকে। এর আড়ালে আসল সত্য লুকিয়ে থাকে।”

“স্টপ ইডিয়েট লেডি। নিজের চোখে আজ যেটা দেখলাম সেটা ভুল?”

“আপনার দেখা ভুল নয়। তবে বোঝার ভুল রয়েছে। বিশ্বাস করুন আমি সেক্সুয়াল হ্যারেজমেন্টের শিকার হয়েছি।”

প্রভার গলা চেপে ধরে বলল,”মিথ্যা কথা! আপনি একটা লায়ার।”

কি করলে মানুষটা তাকে বিশ্বাস করবে প্রভা দিকদিশা খুঁজে পাচ্ছে না। এ কোন আযাবের মধ্যে পড়লো?

“আমাকে একবার বিশ্বাস করে আমার কথাটুকু শুনুন প্লিজ।”

“আপনার কথা শুনতেও আমার রুচিতে বাঁধছে! বলুন এই পর্যন্ত কয়জনকে আপনার এই নোংরা দেহটা বিলিয়ে আমাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছেন?”

জলপ্রপাতের ন্যায় অঝোরে জল গড়াতে লাগলো প্রভার চোখ বেয়ে। কিভাবে পারলো মানুষটা এমন নোংরা কথা বলতে?সে কি সত্যিই এমন?

“এই নোংরা দেহ নিয়ে আমার সাথে সংসার করতে এসেছেন? আপনার কি ভয় নেই? বিবেকবোধ নেই? অনুশোচনা নেই? আপনি আমাকে কঠিনভাবে ঠকিয়েছেন। আই হেট ইউ।”

“আমি কাউকে ঠকাইনি। আমি পিওর ছিলাম,পিওর আছি।”

“ঠকবাজ! প্রতারক! লায়ার! বিশ্বাসঘাতক! বেইমান! অসৎচরিত্রা নারী।”

বলেই আবারও আক্রোশ নিয়ে শক্ত করে প্রভার গলা চেপে ধরলো। প্রভার শ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো। ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলো। রিয়াদ সবে এদিকেই আসছিল আরেকটা লাগেজ নিতে। দু’জনকে এমতাবস্থায় দেখতেই রিয়াদের মাথায় বাজ পড়লো। তার স্যারকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। সে খুব ভালো করে চিনে মানুষটাকে। কোন বাজে নেশা নেই। কোন নারীর সাথে হারাম সম্পর্কে জড়িত নেই। জীবনে প্রভার দিকেই মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো। আর বিয়েও করেছিলো। রিয়াদ যতোটা বুঝতে পারলো তার স্যার প্রভাকে ভালোবাসে। তা না হলে রাত-বিরেতে প্রভাকে দেখতে তাদের পাড়ায় যেতো না। আর আজ খুব আঘাত দিয়েছে তার স্যারকে। এমনটা কাম্য ছিলো না। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে রিয়াদ আয়েশা মির্জাকে ডেকে আনলো। দু’জনকে এমতাবস্থায় দেখতেই আয়েশা মির্জা চেঁচিয়ে উঠে বললেন,”এইসব কি হচ্ছে? পা’গ’ল হয়েছো তোমরা?”

প্রভাকে ছাড়িয়ে নিলেন তিনি। গলার ধরে কাশতে লাগলো প্রভা। সব ক্ষোভ নিংড়ে দিয়েছে মানুষটা।

“মে’রে’ই ফেলবো আজ প্রতারক ঠকবাজ মেয়েটাকে! আমার সাথে বেইমানীর ফল হাতে-নাতে বুঝাবো।”

“কি করেছে? যার জন্য তুমি মে’রে ফেলতে চাইছো?”

“নিজের স্ত্রীকে নিজের আগে অন্য পুরুষ বাজেভাবে স্পর্শ করেছে,এমন দিন দেখার আগে আমার কেন মৃ’ত্যু হলো না? কি পাপ করলাম আমি?”

আয়েশা মির্জা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কি বলছে এইসব?

“আরমান তুমি ঠিক আছো? কি বলছো মাথা ঠিক আছে?”

“আজ মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।”

“ভালোই তো ছিলে সারাদিন। এখন পা’গ’লা’মি করছো কেন?”

“তো কি করবো?”

“যথেষ্ট হয়েছে। থামো এবার।”

আরমান দাদীমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,”আমি আপনাকে বার-বার বলেছি,অশ্লীল মেয়েটা যতোই সুন্দরী হোক না কেন তাকে আমি বিয়ে করবো না। আর একজন মুত্তাকী মেয়ে যতোই অসুন্দর হোক তাকে আমি বিয়ে করবো। এবার সে বাঙালি হোক কিংবা যাই হোক! আপনাকে আরো বলেছিলাম,আমার জীবনসঙ্গী কালো,ফর্সা যেমনি হোক না কেনো,শুধু প্রতারক আর চরিত্রহীন না হোক! শুধু তাই নয়,ব্যক্তিগতভাবে আমি সবসময়ই একটা হালাল সম্পর্ক চেয়েছি। বিপরীতে এমন সম্পর্ক পাবো আশা করিনি। জীবনসঙ্গী নিয়ে কতশত স্বপ্ন ছিলো আমার। সব টুকরো টুকরো হয়ে গেছে একমাত্র এই প্রতারক ঠকবাজ মেয়েটার জন্য। এই মেয়েটাকে আমি কখনোই ক্ষমা করবো না। পরপুরুষকে শরীর বিলিয়ে মেয়েটা আমাকে ঠকিয়েছ! যেই আমি কি-না কোনোদিন ভুলেও কোনো নারীকে স্পর্শ করিনি। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাইনি সেই আমাকে!”

“মানে কি বলছো এইসব? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কিসের ঠকবাজ! কিসের প্রতারক! কিসের কি?”

“এই বিশ্বাসঘাতক মেয়েটাকে আজ আমি হাতে-নাতে একটা ছেলের সাথে খুব বাজে অবস্থায় ধরেছি।”

আয়েশা মির্জার মাথায় বাজ পড়লো।

“এইসব কি শুনছি শশীপ্রভা? তুমি আমার মানসম্মান সব এইভাবে জলাঞ্জলি দিলে? তোমার ভালো চাইতে গিয়ে তবেই কি আমি আমার নাতীর খারাপ করে ফেললাম?”

প্রভা প্রতিত্তোর করতে পারলো না। সব দোষ তো একান্তই তার। সে কেনো সবকিছু খুলে বললো না?সে কোনো ওই জা’নো’য়া’র’টার কথা শোনামাত্রই চলে গেলো?কেন সে এতো বোকা?কেন?কেন? আরমান তাচ্ছিল্য হাসলো।

“বলার মতো কিছু থাকলে তো বলবে।”

“আমার মানসম্মান সব শেষ করে দিলো মেয়েটা! কিভাবে পারলো এমনটা করতে! কিসের কমতি ছিলো আমার নাতীর মধ্যে! ছিঃ! ছিঃ!”

আয়েশা মির্জা অনুশোচনায় দগ্ধ হলেন।

“দিদিভাই,আমি ফিরে যাচ্ছি। শীঘ্রই ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবে। এই সম্পর্ক থেকে আমি মুক্তি চাই! যেই মেয়ের অতীত আছে,হারাম সম্পর্ক আছে,যেই মেয়ে বিয়ের রাত থেকেই মিথ্যা দিয়েই সম্পর্ক শুরু করেছে ; স্বামী থাকা সত্ত্বেও পরকীয়া করে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না। আমার মতো একজন সৎ,নিষ্ঠাবান পুরুষ সে ডিজার্ভ করে না।”

আরমান বেরিয়ে যেতে নিলে এবার প্রভা আরমানের পায়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,”আল্লাহর দোহাই যাওয়ার আগে আমার কথাটুকু শুনে যান। তারপর যা করার করবেন। সম্পর্ক থাকলে থাকবে না থাকলে কিছু করার নেই। তবুও আমাকে ভুল বুঝে যাবেন না প্লিজ। অপরাধবোধে আমি সু’ই’সা’ই’ড করবো।”

“পা ছাড়ুন।”

প্রভা বলতে শুরু করলো,”সেদিন বিয়ের রাতে আপনি আমাকে বার-বার জিজ্ঞেস করেছিলেন,আমার কারো সাথে সম্পর্ক আছে কি-না? কিংবা আমার বয়ফ্রেন্ড আছে কি-না! তখন আমি একটা কথাই বলেছি আমার কেউ নেই। আমি সেটা সত্য বলেছি। সত্যিই আমার কোন বয়ফ্রেন্ড কিংবা বিয়ের পূর্বে কারো সাথে কোনো হারাম রিলেশন ছিলো না।”

“না থাকলে সেদিন রাতে কল দেওয়া ছেলেটা কে? আপনার ফোন নাম্বার তার কাছে কেন? আপনাকে রেস্তোরাঁয় কেন আরেকটা ছেলে বউ বলে সম্বোধন করলো?”

“সে এক বিরাট হিস্টোরি। বছর দুয়েক পূর্বে আমাদের ভার্সিটিতে ফ্রেশার্স পার্টি হয়। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে শেহজাদ আনবীর আরাদ খান আসেন। আজ যাকে আপনি মে’রে’ছে’ন সে। আমরা নয় বান্ধবী খুব ভালো নাচ করতে পারি। তাই যৌথভাবে আমাদের ওপরও নাচ পরিচালনা করার দায়িত্ব পড়ে। আরাদ খান স্টেজে তার বক্তৃতা দেওয়ার পর গান হয় তারপর নাচ। তখন আমরা নয় বান্ধবী মিলে যৌথদলে নাচ করি। ওখান থেকেই আরাদ খান আমাকে দেখতে পায়। এরপর তিনি আমাকে ফলো করতে শুরু করেন। জানতে পারলেন ওনাদের তিন পাড়া পরেই আমাদের বাসা। অথচ উনি আমাকে এবং আমি উনাকে চিনতাম না কিংবা কেউ কাউকে কখনো দেখিনি। এরপর হুট করে উনার চ্যালাপ্যালা নিয়ে আমাকে বিরক্ত করতে শুরু করেন। কোন এক মাধ্যমে আমি জানতে পারি তিনি একজন মন্ত্রী। তখন সদ্য মন্ত্রী হয়েছিলেন। তাই উনার অবাধ চলাফেরা ও শুরু হয়েছিলো। মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করতো না। যখন যা ইচ্ছে হতো সেটাই করতো ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে। উনার ভয়ে পাড়ার লোকেরা তটস্থ থাকতো। এরপর প্রতিদিন আমাকে বিরক্ত করতে শুরু করলো। শুধু তাই নয় যখন-তখন আমাদের বাসায় আমার বেডরুমেও ঢুকে যেতো। আমাকে নানানভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করতো। আমার ভাইয়ের গায়ে হাতও তুলেছে। উনার বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষমতা আমাদের কারোরই ছিলো না। উল্টো আমার পরিবারকে জেলে ঢুকানোর ব্ল্যা’ক’মে’ই’ল করতো। আমার আব্বু এবং ভাইয়াকে বারকয়েক থ্রেট দিয়েছিল আমাকে তুলে নিয়ে যাবে এবং ওনাদের চাকরি শেষ করে ফেলবে। আব্বু এবং ভাইয়া সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাই চাকরি হারানো এবং মামলার ভয়ে চুপ করে থাকতো। উনার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস কারোরই নেই। খুব দাপট নিয়ে চলাফেরা করে। বান্ধবীদের সাথে একদিন ভার্সিটির পার্কে যাই। ওখানের ঝোপঝাড়ের আড়ালে একটা মেয়ের সাথে খুব বাজেভাবে আরাদ খানকে দেখতে পাই। সেখান থেকেই উনার প্রতি আমার ঘৃণা চলে আসে। আরো শুনতে পেলাম কোন মেয়েকে পছন্দ হলেই নাকি তুলে নিয়ে রে’প করে। আমাকে এতোদিন সুযোগ দিয়েছিলো আমাকে নাকি তিনি বিয়ে করবেন তাই। এজন্যই স্বাধীনতা দিয়েছেন। আমার বিয়ের জন্য কোন পাত্র আসলেই তাদের হাড়-গোড় ভেঙ্গে হসপিটালে ভর্তি করে দিতো। এরপর আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। এই নিয়ে অনেকগুলো ছেলেকে এইরকম করেছে। শেষবার যখন আপনার দাদীমা আপনার কথা আমার দাদীমাকে জানায়,তখন আমি খুব ঘাবড়ে যাই। তার কারণ আমার দাদীমার সাথে আপনার দাদীমার খুব ভালো একটা সম্পর্ক রয়েছে। আরাদ খান যদি কোনমতে আপনার খোঁজ পায় তাহলে আপনাকেও ওইরকম করবে এবং আমার দাদীমার সাথে আপনার দাদীমার সম্পর্কে ফাটল ধরবে। তা ভেবে আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। আমি চাইছিলাম না এই বিয়েটা হোক। হলেই বিপদ অনিবার্য। আরাদ খান এতো সহজে আমার পিছু ছাড়বে না তা আমি জানি। এরপর আমি শুনলাম আপনি খুব ধার্মিক সহজ-সরল। কোনো একটা কোম্পানিতে আপনি খুব অল্প স্যালারির জব করেন। তাই খুব মায়া হলো। ফের বিয়ের কথা উঠতেই আমি আবারও নিষেধ করি। পরিবার আমার কথা না শোনায় একপর্যায়ে আমি আপনার ফোন নাম্বার সংগ্রহ করি। এরপর আপনাকে ফোন করে কড়া গলায় নিষেধ করি যাতে আমাকে বিয়ে না করেন। এরপর আপনার সাথে ম্যাসেজ করাকালীন আমি বুঝতে পারি আপনি সত্যি খুব মার্জিত,ভদ্র। আবার এটাও ভাবতাম আপনি কোন হ্যাবলা টাইপের ছেলে। সেটা আপনার আধভাঙ্গা কথা শুনে ভাবলাম। তবে কিভাবে যেন আপনাকে না দেখে সত্যিই আমি আপনার প্রেমে পড়ে যাই। মনে মনে আপনাকে ভালোবাসতে শুরু করি। তবে মনের মধ্যে একটা চাপা রাগ ছিলো আপনি আমাকে ইগনোর করতেন। আপনার সাথে মিট করার খুব ইচ্ছে হলো। আবারও ফের বিয়ের কথায় উঠায় আমি ঘাবড়ে যাই। তখন আট বান্ধবীকে নিয়ে একটা প্ল্যান করলাম বিয়েটা ভাঙ্গার। আপনি না-কি সাজগোজ এবং বেপর্দা হয়ে চলাফেরা পছন্দ করেন না। তবুও সেদিন আমি আমার সবটুকু দিয়ে সাজগোজ করলাম যাতে আমাকে আপনি সত্যিই রিজেক্ট করেন। সত্যিই তাই করলেন। কিন্তু আমি কেন যেন মানতে পারলাম না। খুব কেঁদেছিলাম আপনার জন্য। আপনার বিয়ের কথা শুনতেই একেবারে ভেঙ্গে পড়লাম। একদিন রাতে আপনি আমায় দেখতে এলেন আমার দৃষ্টি তা এড়ায়নি। গভীরভাবে আমি ফিল করতে পারলাম আমার মতো আপনিও আমাকে ভালোবাসেন। নয়তো রাতের আঁধারে আমাকে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতেন না।
______________

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here