#সন্ধ্যারাতে_শালুক_ফোঁটে ❤️
#আদনীন_নিশাত_তারান্নুম_চৌধুরী ❤️
#পর্বসংখ্যা-(০৭)
_______________________________
তারপর আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। সেটা সত্যি সারপ্রাইজড ছিলো। বিয়ের রাতেই আপনি আমাকে একগাদা শর্ত দিলেন। আপনাকে ভালোবাসি বলে সব শর্ত মুখ বুজে মেনে নিয়ে সাইন করে দিই। আপনি বার-বার জিজ্ঞেস করলেন,আমার কোন বয়ফ্রেন্ড কিংবা কোন সম্পর্ক আছে কি-না! অথবা কেউ আমাকে বিরক্ত করে কি-না! কিছু বলতে যেয়েও আমি বলতে পারছিলাম না কারণ আপনি “ডিভোর্স” শব্দটা বার-বার উচ্চারণ করেছিলেন। আমি প্রচুর ঘাবড়ে গিয়েছি। যাকে ভালোবাসি তাকে পাওয়ার পর কিভাবে হারাই বলুন? আপনারা বিদেশি মানুষ আপনাদের কাছে ডিভোর্স শব্দটি খুব সাধারণ হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমাদের বাঙালি মেয়েদের কাছে এই ডিভোর্স শব্দটি অন্তত্য ভারী! কষ্টের! দুঃখের! অপমানের এবং অসম্মানের! এরচেয়ে ছাঁদের উপর থেকে লাফ দিয়ে সু’ই’সা’ই’ড করা আরো সহজ। রাতে আপনি মন থেকে ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিলেন কি-না জানা নেই। তবে আমি আপনার জন্য সত্যি প্রস্তুত ছিলাম। নিজেকে সঁপে দিতে রাজি ছিলাম। তখন আরাদ খান হয়তো আমার বিয়ের খবর পেয়ে ফোন করে। আমি ঘাবড়ে যাই। আপনি আমাকে ভুল বুঝেন। এর সপ্তাহখানেক এইভাবেই যায়। আপনি দূরত্ব বজায় রেখেছেন। আমিও নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক ছিলাম। নিজের অদৃষ্ট এবং ভাগ্যে যা ছিলো তাই হচ্ছে,হবে। হুট করে আজ ফোন আসে। আমি ভাবলাম আপনি কল দিয়েছেন। কারণ নাম্বারটা আননোন। আমি কল পিক করতেই আরাদ খান বলে উঠে ও একটা এড্রেস দিচ্ছে ওখানে না গেলে আপনাকে মে’রে ফেলবে। সে নাকি আপনাকে বন্দী করে রেখেছে। আমি দিশেহারা হয়ে যাই। আপনাকে কল করলাম দেখলাম আপনার ফোন বাসায়। রিয়াদ ভাইকে কল দিতে চাইলাম কিন্তু তার ফোন নাম্বার আমার কাছে ছিলো না। আমি দিশেহারা হয়ে কাউকে কিছু না বলে একপর্যায়ে বেরিয়ে পড়ি। সেখানে যেতেই আরাদ খান আমার শরীরে হাত দিয়ে কথা বলতে নিলেই আমি থাপ্পড় মা’রি। এরপর সে জোরপূর্বক আমাকে রে’প করার চেষ্টা করে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি সেখানে স্বইচ্ছায় গিয়েছিলাম এটা ঠিক। কিন্তু আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে নেওয়া হয়েছে। আমি তার দ্বারা জোরপূর্বক সেক্সুয়াল হ্যারেজমেন্টের শিকার হয়েছি। আপনি যে আল্লাহর ইবাদাত করেন এবং আমি যেই আল্লাহর ইবাদাত করি সেই এক আল্লাহর কসম করে বলছি সত্যি আমার কোন অতীত নেই,হারাম রিলেশন নেই। আমি কারো সাথে পরকীয়া করিনি। আমার শরীর এবং সম্ভ্রম সবসময়ই হেফাজত রেখেছিলাম আমার স্বামীর জন্য। আমি সবসময়ই লয়্যাল এবং অনেস্ট ছিলাম। নিজেকে আমি কাউকে বিলিয়ে দিইনি। আমি আপনাকে ঠকিয়ে বিয়ে করিনি। আমি এই বিয়েটাও করতে চাইনি।”
একনাগাড়ে সবকথা বলে প্রভা ফ্লোরে লেপ্টে বসে হাঁফাতে হাঁফাতে কাঁদতে লাগলো। আরমান কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। যেখানে “আল্লাহর কসম” করলো সেখানে অবশ্যই মিথ্যে বলেনি। কিন্তু আরমান মানতে পারছে না সে ছোঁয়ার আগেই অন্যকেউ তার স্ত্রীকে ছুঁয়ে দিলো! আরমানের অসহ্য লাগছে সব। হুট করে প্রভার ঘাড় চেপে তুলে দাঁড় করিয়ে বলল,”আমি বলেছি না আমার পারমিশন ব্যতিত কোথাও যেতে পারবেন না?”
“বলেছিলেন।”
“তাহলে কেন গেলেন?”
“আমার মন-মস্তিষ্ক তখন ভালোমন্দ আপনার শর্ত,পারমিশন সত্যিই কিছুর কথা মনে ছিলো না।”
“আপনাকে আমি ঘৃণা করি। আপনি আমার শর্ত ভঙ্গ করেছেন। আপনি শর্তভঙ্গকারী! আপনার ক্ষমা নেই।”
প্রভার চোখ বেয়ে অবিরাম গতিতে জল গড়াতে লাগলো। আয়েশা মির্জা এতক্ষণ চুপ থেকে সব শুনলেন। এখানে কার দোষ দেবে? কারো দোষ নেই। বরং প্রভা ষড়যন্ত্রের শিকার।
“দাদুভাই যা হয়েছে এনাফ।”
“এই মেয়েটাকে আমি মানতে পারবো না। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমার শর্ত ভঙ্গ করে।”
“এতো কঠোর হওয়া ঠিক নয়। তোমরা স্বামী-স্ত্রী। ভুল হলে মাফ করে কাছে টেনে নাও। তোমরা তোমরাই তো!”
“সম্ভব না। ঘৃণা করি তাকে।”
“আরমান!”
“ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবে সময়মতো। আসছি।”
আরমান বেরিয়ে গেলো। মূর্তির মতো বসে রইলো প্রভা। এতোকিছুর পরেও মানুষটা তাকে ক্ষমা করতে পারলো না। সেও আর সস্তা হবে না। অনেক হয়েছে। পা পর্যন্ত ধরেছে সম্পর্কটা টিকানোর জন্য। তা বোধহয় আর সম্ভব হবে না। যাক চলে যাক! ভালো থাকুক মুক্তি দিয়ে। বিচ্ছেদ সাজিয়ে চলে গেলো মানুষটা! পেছনে ফেলে গেলো মূর্তির মতো নিশ্চল নিষ্প্রাণ হয়ে বসে থাকা প্রভাকে। একটাবারও পিছনে তাকানোর প্রয়োজন মনে করলো না। একবারও কি ইচ্ছে করলো না যে মানুষটা তাকে এতো ভালোবাসে,এতোগুলা দিন ধরে স্বপ্নের জ্বাল বুনেছে তাকে ছেড়ে যাওয়ার সময় তার কেমন লাগবে? আয়েশা মির্জা দিকদিশা খুঁজে পাচ্ছেন না। কি থেকে আচমকা কি হয়ে গেলো মাথায় ঢুকছে না কিছুই। তিনি আর দাঁড়ালেন না। ব্যালকনিতে আসতেই দেখলেন আরমান গাড়িতে উঠে গেছে। আয়েশা মির্জার প্রেসার হাই হয়ে গেলো। ঘন্টাখানেক পর প্রভা উঠে দাঁড়ালো। চোখের জল মুছলো। গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে গেলো মহল থেকে। গেটের বাইরে পা বাড়াতে নিলেই সিকিউরিটি গার্ড বাঁধা দিলো। বারণ শুনলো না প্রভা। লাঠি দিয়ে সিকিউরিটি গার্ডের মাথায় আঘাত করে বেরিয়ে গেলো মহল থেকে। এলোমেলো পায়ে দৌঁড়াতে শুরু করলো। ততক্ষণে আয়েশা মির্জার কানে খবর পৌঁছে গেলো। ওনার বুকে ব্যথা উঠলো। তিনি ফোন করলেন আজহার শেখ এবং ফায়াজকে। কয়েকজন গার্ড প্রভার পিছু নিলো। আয়েশা মির্জা গাড়ি নিয়ে প্রভাকে ফলো করতে লাগলেন। প্রভা গিয়ে হসপিটালে ঢুকলো। আত্নীয়ের বেশে একজন নার্স থেকে আরাদের কেবিন নাম্বার জেনে নিলো। আইসিসিইউর কেবিনের সামনে আসতেই ভেতরে ঢোকার পারমিশন চাইলো। কিন্তু কর্তব্যরত নার্স দিলো না। একপর্যায়ে প্রভা নার্সের চুল ধরে ওয়ালের সাথে মাথায় আঘাত করলো। র’ক্ত’পা’ত হয়ে নার্স সেখানেই সেন্সলেস হয়ে গেলো। কেবিনে ঢুকে প্রভা আরাদের মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে একটা বালিশ চাপা দিলো। আরাদ ধড়ফড়াতে লাগলো বাঁচার জন্য। ততক্ষণে আরাদের শরীরের সাথে এটাচ করা সবগুলো যন্ত্র শব্দ করতে শুরু করলো। ডক্টর নার্সরা সব জড়ো হয়ে গেলো। আয়েশা মির্জা,আজহার শেখ এবং ফায়াজও ততক্ষণে হসপিটালে পৌঁছালো। ডক্টররা কেবিনে ঢুকে প্রভাকে আঁটকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু প্রভার শক্তির সাথে ফেরে উঠছিলো না কেউ। বুঝাই যাচ্ছে কতোটা ক্ষোভ নিয়ে আরাদকে হ’ত্যা করার চেষ্টা করছে! কয়েকজন পুরুষ ডক্টর শেষমেশ প্রভাকে ছাড়াতে সক্ষম হলো। আজহার সাহেব মেয়ের গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মা’র’লে’ন। কিছু সময়ের জন্য প্রভা থমকে যায়। জীবনে ফাস্ট বাবার হাতে মা’র খেয়েছে আজ। আচমকা করিডোরের উপর দিয়ে ঝাঁপ দিলো নিচে। ততক্ষণে একটি এম্বুল্যান্স ইমার্জেন্সি পেশেন্ট নিয়ে হসপিটালে ঢুকছিলো। এম্বুল্যান্সের উপর পড়ে মাথায় আঘাত পেলো প্রভা। ঘটনাটি খুব দ্রুত ঘটে গেলো। যার জন্য প্রস্তুত ছিলো না কেউ। প্রভাকে ইমার্জেন্সি ট্রিটমেন্ট দেওয়া হলো দ্রুত। অন্যদিকে আয়েশা মির্জা প্রভার ব্যপারটা হ্যান্ডেল করলেন ডক্টরদের ভয় দেখিয়ে। যদি খবরটা গণমাধ্যমে লিক হয় তাহলে জেলে ঢুকাবেন এবং চাকরি খেয়ে ছাড়বেন বলে ব্ল্যাকমেইল করলেন। ডক্টররা সেখানেই চুপ হয়ে যায়। ক্ষমতা এবং টাকার কাছে চাপা পড়ে গেলো আরাদকে হ’ত্যা’র প্রচেষ্টার সত্য ঘটনাটি।
(২৫)
আমেরিকা পৌঁছালো আরমান। প্রিন্সেস মারইয়াম টাওয়ারে প্রবেশ করে নিজের কামরায় যেতেই দেখলো সবে ডিনার করতে বসেছেন তার আম্মিজান। পুত্রকে মহলে ফিরতে দেখে তিনি ভীষণ অবাক হলেন।
“ফিরে এলে যে?”
“প্রয়োজন ছিলো।”
“একা এলে?”
“কেউ আসার কথা ছিলো নাকি?”
“বিয়ে-শাদী করেছো,তা বউকে আনলে না যে? বিয়ের শখ মিটে গেলো নাকি?”
মায়ের মতলব বুঝতে পারলো আরমান।
“যখন আনার সময় হবে তখন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বউকে নিয়ে আসবো। প্রস্তুত থাকবেন।”
মুখ বাঁকা করলেন মারইয়াম ইউজিওয়েল।
“বাই দ্যা ওয়ে,তোমাকে কেমন যেন বিমর্ষ দেখাচ্ছে! এনি প্রবলেম?”
প্রতিত্তোর না করে কামরায় ফিরে গেলো আরমান। তার মা প্রভাকে মানতে পারেনি সেটা সে ভালো করেই জানে। ড্রেস চেঞ্জ করলো। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। বড্ড ক্লান্ত সে। দু-চোখ বুজতেই প্রভার মুখখানি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কেন মেয়েটা এমন করলো তার সাথে? আরমানের খুব কষ্ট হচ্ছে! প্রভাকে ডিভোর্স দিতে বলেছে ঠিক কিন্তু সত্যি বলতে সে এটা পারবে না। প্রভাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার ও করতে পারবে না সে। প্রভার জন্য মায়া লেগে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। প্রভাকে ডিভোর্স দিলে তার দাদীমা কষ্ট পাবে। এদিকে তার মা তাকে বাঁকা কথা ছুঁড়তে কার্পণ্য করবে না। আরমান সময় নিবে। রাগের বশে হুটহাট সিদ্ধান্ত নিবে না। ভাবনার মাঝেই চোখজোড়া মুদে এলো। ঠিক তাহাজ্জুদের সময় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। হাত-মুখ ধুয়ে অযু করে তাহাজ্জুদ আদায় করলো। দু-হাত তুলে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলো,”হে রব! প্রত্যাশা কমতে কমতে আমার এমন হয়েছে যে আজ-কাল আপনার কাছে কিছু চাইতে ইচ্ছে হয় না! মনে হয় লাগবে না,কিচ্ছু লাগবে না! সব যেমন আছে তেমনই ঠিক আছে! কারণ আমি আপনার কাছে যা চেয়েছি আপনি তার বিপরীত দিয়েছেন। তাই এখন আপনার কাছ থেকে কিছু চাইতে ভয় হয়! ইয়া রব! আপনি তো বললেন,“দুশ্চরিত্রা নারীরা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং দুশ্চরিত্র পুরুষরা দুশ্চরিত্রা নারীদের জন্য। আর সচ্চরিত্রা নারীরা সচ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষরা সচ্চরিত্রা নারীদের জন্য।”(সুরা আন-নূরঃ আয়াত ২৬) তাহলে আমার সাথে এমনটা কেন হলো রব? আমার স্ত্রীর দ্বারা কেনো কলুষিত করলেন আমার জীবন? আমি তো সদাসর্বদা সৎ এবং নিষ্ঠাবান ছিলাম। কখনো কোনো নারীর দিকে কুনজর কিংবা খারাপ দৃষ্টিতে তাকাইনি! তাহলে আমার স্ত্রীর সাথে এমনটা কেনো করলেন আপনি?হে খোদা! আমি মানতে পারছি না! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! ইয়া রব! আপনি আমায় অন্যভাবে শাস্তি দিতে পারতেন! সেটা আমি সহ্য করে নিতাম। কিন্তু আপনি আমার স্ত্রীকে দিয়ে কেনো এমনটা করলেন?এ কেমন পরীক্ষা নিচ্ছেন আপনি?এ কেমন পরিকল্পনা আপনার? ইয়া রব! আমি শান্তি চাই! আমি সব ভুলে যেতে চাই! আমি একটু ভালো থাকতে চাই।”
(২৬)
সকালে ব্রেকফাস্ট করতে বসলো সবাই। ফর্মাল ড্রেস-আপে আরমান একবারে রেডি হয়ে বেরিয়েছে। অনেকদিন পর অফিসে যাবে। কাজ কতটুকু জমে আছে তা আন্দাজ করতে পারছে না। খেতে খেতেই মারইয়াম ইউজিওয়েল জিজ্ঞেস করলেন,”তুমি কিছু নিয়ে চিন্তিত মেইবি?”
“নো। আ’ম ওকে।”
“তোমার বউকে নিয়ে এলে না যে?একা এলে কেনো?”
“রাতে বলেছিলাম।”
“তোমার কি মনে হয় এই মেয়েটা তোমার সাথে সংসার করবে? তুমি বিদেশি সে বাঙালি।”
“এইসব আপনার না ভাবলেও চলবে আম্মিজান। বউ আমার ভাবার দায়িত্বও আমার। আপনি সুস্থ থাকলেই হয়।”
“আমি তোমার মা। তোমার ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব-কর্তব্য এবং অধিকার সব আমার।”
“পালন করুন। নিষেধ করিনি। তবে আমার পারসোনাল ব্যপার নিয়ে ইন্টাফেরয়ার করবেন না। বিশেষ করে আমার স্ত্রীকে নিয়ে। আমি ডিস্টার্ব ফিল করছি।”
“বাই দ্যা ওয়ে,আর্সেল আসবে সপ্তাহ তিনেক পর।”
“হু ইজ শী?”
“তোমার ফিয়ন্সে।”
উঠে গেলো আরমান। কিছু খেলো না আর। তার মায়ের বাড়াবাড়িটা একটু বেশিই। কঠোর গলায় বলল,”একবার খ্রিস্টান এক মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছেন। আবার কি শুরু করলেন?”
“আর্সেল তো মুসলিম! আমার আপন মামাতো বোনের মেয়ে। ভীষণ সুন্দরী! কোন পরপুরুষ তাকে দেখেনি সেইম আমার মতো। তোমার সাথে আর্সেলকে বেশ মানাবে।”
“আমি ম্যারিড। আমার বৈধ স্ত্রী আছে।”
“আর্সেলের সমস্যা নেই তাতে। সব শুনেই রাজি হয়েছে।”
ফুলদানিতে একটা লা’থি মে’রে ভেঙে ফেললো। মুহূর্তেই চোখগুলো রক্তাভ হয়ে গেলো। একটা সমস্যা না যেতেই আরেকটা হাজির হচ্ছে! সে কি মুক্তি পাবে না?
“আর্সেলের সমস্যা না থাকতে পারে। কিন্তু আমার এবং আমার স্ত্রীর রয়েছে।”
“ফাজলামো করছো আমার সাথে?”
“আমার মাথা গরম করবেন না আম্মিজান। ভালো থাকতে দিন। ভালো থাকবেন নয়তো আমায় হারাবেন।”
বেরিয়ে গেলো আরমান। সেদিকে তাকিয়ে তপ্তশ্বাস ফেললেন মারইয়াম ইউজিওয়েল।
(২৭)
নাক ডুবিয়ে অফিসের কাজে ব্যস্ত আরমান। রিয়াদ দৌঁড়ে এলো প্রায়। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,”স্যার একটা দুঃসংবাদ!”
মাথা তুললো আরমান। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,”কিসের?”
“স্যার শশীপ্রভা ম্যাম..”
বলতে দিলো না আরমান।
“চুলোয় যাক! ওনার বিষয়ে কোনো সংবাদ চাই না। আসতে পারো।”
“স্যার শুনুন।”
“রিয়াদ,ইউ ক্যান গো নাও।”
“স্যার প্লিজ।”
“কথা কানে যায় না তোমার?”
অসহায় নেত্রে তাকালো রিয়াদ। এতো কঠিন হৃদয়ের কেন তার স্যার? রয়ে-সয়ে এবার সাহস করে বলেই ফেললো,”মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে স্যার।”
দপ করে জ্বলে উঠলো আরমান।
“মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে মানে? ওয়েট! ওয়েট! এটা কেমন কথা রিয়াদ?”
কাচুমাচু করলো রিয়াদ।
“মৃত্যুশয্যায় মুমূর্ষু ব্যক্তির ব্যপারে অনেকেই বলে থাকে অমুক মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এভাবে বলা ভুল। পাঞ্জা লড়ার বিষয়টি সাধারণত সমশক্তিসম্পন্নদের মাঝে হতে হয়,যেখানে হার-জিত উভয়ের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু মৃত্যুর ব্যপারটি এমন নয়। মৃত্যু হলো সরাসরি আল্লাহ্ তাআলার হুকুম। এর সাথে একজন দূর্বল মানুষের পাঞ্জা লড়ার প্রশ্নই আসে না। কোন মুসলমান এ বিশ্বাসও রাখে না। অসাবধানতার কারণে এ ধরনের কথা মুখে চলে আসে,যা পরিহার করা জরুরী। আর কখনো এইসব কথা বলবে না। শিরক হবে।”
মৌনতা অবলম্বন করে সব শুনলো রিয়াদ। এবার সাহস করে বলেই ফেললো,”স্যার শশীপ্রভা ম্যামের অবস্থা ভালো না। তিনি সু’ই’সা’ই’ড এটেম্প করেছেন?”
চমকে উঠলো আরমান।
“হোয়াট?”
“সত্যি স্যার।”
“কিভাবে কি হলো?”
সময় নিয়ে রিয়াদ এ-টু-জেড সব খুলে বললো। আরমান কেন যেন আর বসে থাকতে পারলো না। ননস্টপ প্লেনে চড়ে বাংলাদেশে ফিরে এলো। প্রভার অবস্থা ভালো নয়। মাথার পেছনে আঘাত পেয়েছে। ডক্টর আংশকা করেছেন স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে। আরমানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সব তার জন্যই হয়েছে। সেদিন নিজের রাগ সংবরণ করে প্রভাকে ক্ষমা করে কাছে টেনে নিলে এমনটা হতো না। তার অতিরিক্ত রাগের কারণে প্রভা আজ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। আরমান পাথর হয়ে গেলো। তার অতিরিক্ত রাগ তার জীবনটা নরক বানিয়ে দিলো। কথায় আছে না,“রাগ ধ্বংস করে জীবনকে।” আরমান হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এখন। ডক্টর আরো জানালেন প্রভার অবস্থা ভালো না। যেকোনো সময় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে পারে। আরমান সময় বিলম্ব না করে দ্রুত এয়ার এম্বুল্যান্সের মাধ্যমে প্রভাকে আমেরিকা নিয়ে আসলো এবং হসপিটালে প্রভার ট্রিটমেন্ট শুরু করলো।
(২৮)
হসপিটালে প্রভার কেবিনের সোফায় আয়েশা মির্জা এবং মারইয়াম ইউজিওয়েল বসে আছেন চিন্তিত হয়ে। প্রভার দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মারইয়াম ইউজিওয়েল। হঠাৎ শ্বাশুড়ি মাকে বলে উঠলেন,”আমার কপালটাই মন্দ আম্মা।”
“কী হয়েছে তোমার?”
“মনের মতো পুত্রবধূ পেলাম না।”
“পুত্রবধূ তোমাকে কি করলো আবার?”
“আমার ছেলে কি আর এই মেয়ে কি! কিসের সাথে আপনি কি মিলিয়েছেন?”
আয়েশা মির্জা বুঝতে পারলেন সব। খোঁচা মে’রে বললেন,”আসো মারইয়াম বুকে আসো। দু’জনে কোলাকুলি করে জড়িয়ে ধরে কাঁদি। তোমার আর আমার এক কপাল।”
বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন শ্বাশুড়ি মায়ের দিকে। আয়েশা মির্জা বাঁকা হাসলেন। মারইয়াম ইউজিওয়েল আর কিছু বলতে পারলেন না। উনার শ্বাশুড়ি মা যে উনাকে কোণঠাসা মে’রে কথা বললেন বুঝতে পারলেন তিনি।
(২৯)
জ্ঞান ফিরতেই আয়েশা মির্জা,মারইয়াম ইউজিওয়েল এবং একজন ডক্টর ও নার্সকে চোখের সামনে দেখতে পেলো প্রভা। সেন্স ফিরতে দেখে আয়েশা মির্জা খুশি হলেন। ডক্টর টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করলো ইংরেজিতে। ডক্টর এবং নার্সের পোশাক-আশাক দেখে প্রভার মনে হলো সে বাংলাদেশে নয়। কিন্তু কোথায় সেটাও বুঝতে পারলো না। কৌতুহল সৃষ্টি হলো। ঠিক তখুনি হাতের মধ্যে কিছু মেডিসিন নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করলো আরমান। প্রভার দিকে চোখ পড়তেই নামিয়ে ফেললো। জ্ঞান ফিরতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। প্রভার মন ভার হলো তবে খুশি হলো আরমানকে দেখে। মানুষটা তার পাশে আছে এটা ভেবেই শান্তি পেলো। মেডিসিনগুলো রেখে ডক্টরের সাথে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলো আরমান। এরপর সারাদিন গেলো কিন্তু মানুষটার দেখা আর পেলো না প্রভা। মানুষটাকে এক নজর দেখার জন্য প্রভা ছটফট করলো সারাদিন।
(৩০)
রাত সাড়ে এগারোটা। চোখ বুজে শুয়ে রইলো প্রভা। কেবিনে কারো উপস্থিতি টের পেতেই চোখ খুলতেই দেখলো আরমান এসেছে। পূর্বের ন্যায় প্রভার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। কিছু জিজ্ঞেস করলো না। লাইট অফ করে কেবিনের সোফায় বসলো। ল্যাপটপ অন করে কাজ করতে লাগলো। প্রভার অভিমান হলো খুব। মানুষটার রাগ এখনও কমেনি! না কমলে তাকে এখানে এনেছে কেন? ম’রে যেতো সেটাই ঢের ছিলো। এখন আবার ইগনোর করছে। বুক ফেটে কান্না এলো। প্যাঁচ প্যাঁচ করে কান্নার শব্দ আরমানের কানে পৌঁছালো। নির্বিকার রইলো আরমান। মানুষটার সাথে কথা বলতে না পেরে প্রভার কলিজাটা ফেটে বেরিয়ে যাচ্ছে যেন। ঘুমানোর চেষ্টা করলো প্রভা। তবে ঘুম এলো না। ঘন্টা তিনেক পর প্রভার ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলো। উশখুশ করলো প্রভা। মানুষটা তো তার সাথে কথা বলবে না। তাই সে নিজেই স্যালাইনের নল খোলার চেষ্টা করলো। হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠতেই আরমান চট করে তাকালো। ল্যাপটপ রেখে দ্রুত এগিয়ে এসে বলল,”কি করছেন?”
অভিমান তীব্র হলো প্রভার। সেও প্রতিত্তোর করবে না। আবারও নল খোলার চেষ্টা করলো। এবার ধমকে উঠলো আরমান।
“কি সমস্যা? নল খুলছেন কেন?”
“ওয়াশরুমে যাবো।”
স্যালাইনের সুইচ অফ করে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো প্রভাকে। বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো আরমান। কখন না জানি আবার মাথা ঘুরে পড়ে যায়। প্রায় মিনিট পনের হলেও প্রভা বের হলো না। হিঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো। আরমানের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গলো। ডোরে টোকা দিয়ে বলল,”এতক্ষণ কি করছেন?বের হোন তাড়াতাড়ি।”
কান্না গিলে একহাত দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বের হলো প্রভা। আরমান একপলক তাকাতেই দেখলো চোখ-মুখ ফোলা। চোখগুলো লাল। চোখ নামিয়ে ফেললো। বেডের উপর বসলো প্রভা। স্যালাইনের সুইচ অন করে করিডোরে গিয়ে বসলো। সারা রাত ছটফট করলো দু’জনে। এতো কাছে থেকেও যোজন যোজন দূরত্ব দু’জনের।
(৩১)
সপ্তাহ দুয়েক হসপিটালে থাকার পর আজ ডিসচার্জ দিয়েছে প্রভাকে। মারইয়াম ইউজিওয়েল চিন্তা-ভাবনা করে দেখলেন প্রভাকে মেনে নিতে না পারলেও পুত্রবধূ হিসেবে তাদের মহলে নিয়ে যেতে হবেই। তাছাড়া স্বামী,শ্বাশুড়ি এবং পুত্র রয়েছে। নিষেধ করলে হীতে-বিপরীত হবে। তাই প্রভাকে মহলে তোলা উপলক্ষে নিজ থেকেই আয়োজন করেছেন। করতেই হতো। আয়েশা মির্জা ভীষণ খুশি হলেন। ভাবলেন নিজের পুত্রবধূ হয়তো ছেলের পুত্রবধূকে মেনে নিতে শুরু করেছে। তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন মারইয়াম ইউজিওয়েলের চালাকি কেউই বুঝতে পারলো না। প্রভাকে মহলে আনা হলো। রাজপ্রসাদের মতো মহলের বাইরে-ভেতরে দেখে প্রভার চোখ কপালে। বিশ্বাসই হচ্ছে না মানুষটা এতো সুন্দর রাজপ্রাসাদে থাকে। এতো এতো কিছুর মালিক তারা। প্রভাকে আরমানের কামরায় নেওয়া হলো। আয়েশা মির্জা সব দেখিয়ে শুনিয়ে দিলেন। প্রভা ঘুরে ঘুরে সব দেখছে। একটাই ভাবনা প্রভার মস্তিষ্কে ঘুরছে,আরমান কেন তাকে বিয়ে করলো?
__________
চলবে।