সন্ধ্যারাতে_শালুক_ফোঁটে ❤️ #আদনীন_নিশাত_তারান্নুম_চৌধুরী #পর্বসংখ্যা-(০৯)

0
69

#সন্ধ্যারাতে_শালুক_ফোঁটে ❤️
#আদনীন_নিশাত_তারান্নুম_চৌধুরী
#পর্বসংখ্যা-(০৯)
_______________________________

টেবিলে বসার পর থেকে আর্সেলের দিকে একবারও তাকায়নি। প্রথম সাক্ষাতে হাই-হ্যালো করলেও ব্যস্ততা দেখিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে করেছে। আর্সেলের আত্মঅহমিকায় লাগলো। সে-কি এতোটাই অসুন্দর যে তাকে ইগনোর করছে এই মানুষটা! মনে মেঘ জমলো। তবুও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। মানুষটা তো তার হবেই! এইতো আর কিছুদিন। তাহলে অভিমান জমিয়ে লাভ কি? আর একবার তার রূপ দেখলেই হলো,তখন মানুষটার এই দেমাক,দাম্ভিকতা কোথায় চলে যাবে। এরপর ঠিকিই নিজের বউ রেখে তার পেছন পেছন মিউমিউ করে ঘুরঘুর করবে ছ্যাঁছড়ার মতো। এছাড়াও মানুষটার বউটাকে তো সে দেখেছে। কিসের সাথে কিসের বিয়ে হলো আর্সেল ভেবে পেলো না। দুনিয়াতে মেয়ের কি এতোই অভাব পড়লো যে এইরকম হ্যাংলা,পাতলা,রোগা,খাটো মেয়েকে বিয়ে করতে হবে? মানুষটার রুচির দুর্ভিক্ষ দেখে বিদ্রুপের হাসি পেলো আর্সেলের।

“মারইয়াম,এক গ্লাস গরম দুধ পাঠিয়ে দাও তো। মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”

শুনিয়েই বললেন হঠাৎ আয়েশা মির্জা। আরমান চমকালো। হাত থেমে গেলো। অসুস্থ মানে? কই সে-তো কিছু জানে না! আরমান খেতে পারলো না। কি হয়েছে মেয়েটার জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করতে পারছে না। খাবার অসমাপ্ত রেখে উঠে গেলো। হাত ধুয়ে দাদীমার কামরায় রওনা দিলো। নিশ্চয়ই ওখানেই আছে। আয়েশা মির্জা ডিনার সেরে দ্রুত উঠে গেলেন। আরমান কামরায় ঢুকতে নিতেই তিনি আগে ঢুকেই ঠাস করে ডোর লাগিয়ে দিলেন মুখের উপর। হতভম্ব হলো আরমান। এমন করলো কেন? দাদীমা কি রেগে আছে? কিন্তু কেন? বিব্রতবোধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর ডোরে নক করলো। দাদীমা ডোর খুলে বললেন,”কি চাই?”

দাদীমার এহেন রূপ চিনতে পারলো না। রয়ে-সয়ে জিজ্ঞেস করলো,”উনি কোথায়?”

“উনি কে?”

বিরক্ত হলো আরমান।

“উনি আর কি!”

“তোমার দাদুভাই তো বেশ কয়েক বছর পূর্বে ইন্তেকাল করেছেন।”

“দাদুভাইয়ের কথা না। উনার কথা বললাম।”

“সেই উনিটা কে?”

দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”আপনার নাতবউ।”

“আমার নাতবউ কে?”

তপ্তশ্বাস ফেলে বলল,”শশীপ্রভা।”

“শশীপ্রভা ঘুমাচ্ছে।”

“কিভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লো?”

“তার ব্যপারে তোমায় কিছু জানতে হবে না। থাকো না ঐ টার্সেল-পার্সেলকে নিয়ে?”

“টার্সেল-পার্সেল মানে?”

“তোমার মাথা।”

ডোর অফ করে দিলেন। বেডের উপর শুয়ে দাদীমার তামাশা দেখলো প্রভা। টার্সেল-পার্সেল কথাটা শুনতেই হাসি পেলো। আরমান আবারও ডোর নক করলো। রেগেমেগে ডোর খুলে বললেন,”বিরক্ত করছো কেন?”

“উনি মেডিসিন নিয়েছেন?”

“বলেছি না জানতে হবে না কাউকে।”

“বউ তো আমার।”

“হ্যাঁ,আর বিয়ে দিয়ে ঠেকে গেলাম আমি।”

সুচতুর,তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন আরমান বুঝতে পারলো প্রভা তাদের সব সিক্রেট বলে দিয়েছে দাদীমাকে। বিড়বিড় করে বলল,”মাথামোটা গাধী মেয়ে। পারসোনাল বলতে কিছুই নেই।”

তিনি আবারও ডোর অফ করে দিলেন। কিছুতেই আজ দেখা করতে দিবেন না। শুধু তাই নয় পুরো এক মাস দেখা করতে দিবেন না। থাকুক না ঐ টার্সেল না পার্সেলকে নিয়ে। এখানে কি? সবসময়ই মেয়েটা কেন সস্তা হবে?ছোট হবে? ক্ষমা চাইবে?মেয়েটার কি আত্মসম্মানবোধ বলতে কিছুই নেই?এতো দাম কিসের ওই বিলাতি ছাওয়ালের? তিনিও দেখে ছাড়বেন! আয়েশা মির্জার সাথে পাঞ্জা লড়া!

(৩৮)
ডিনার সেরে আর্সেল তার কামরায় গেলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নিজেকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। কি নেই তার? কতো সুন্দরী এক মেয়ে সে। রাজকুমারীর থেকেও কোন অংশে কম নয়! রূপে-গুণে-স্বাস্থ্যে,টাকা-পয়সা,ধনসম্পত্তি-ক্ষমতা,ঐশ্বর্য কি নেই তার? তবুও ওই নাকউঁচু মানুষটা তার দিকে একটিবারের জন্যও তাকালো না। তাকে না দেখেও প্রতিদিন কত-শত লাভ লেটার আসে তার বাড়িতে। আর এই মানুষটা তার দিকে তাকালো না অব্ধি! হাই-হ্যালোটুকুও করলো ব্যস্ততা দেখিয়ে তাও কি-না অন্যদিকে তাকিয়ে! আর্সেল গর্জে উঠে একটা ফুলদানিতে লা’থি মা’র’লো। সব ভেঙ্গেচুরে গুঁড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ভাঙচুরের শব্দ হতেই মারইয়াম ইউজিওয়েল আর্সেলের কামরায় প্রবেশ করলেন।

“এইসব কী হচ্ছে আর্সেল? আর ইউ ওকে?”

“ওকে থাকবো কিভাবে বলুন তো! আপনার ছেলের এতো অহংকার কিসের?”

“কি করেছে?”

“আমার দিকে একটাবারও তাকালো না। এতোই অসুন্দর আমি? কি নেই আমার মধ্যে? রূপ-গুণ,ধনসম্পদ,টাকাপয়সা?কোনটা নেই?”

“অহেতুক ভুল বুঝেছো আর্সেল। তোমাকে এর পূর্বেও বলেছি আমার ছেলে এমন। সে নারীদের সম্মান করে। কিন্তু বেগানা নারীকে যথেষ্ঠ এড়িয়ে চলে।”

“আমি বেগানা নারী?”

“অফকোর্স!”

আর্সেল ফুঁসলো।

(৩৯)
সারাটা রাত লিভিং স্পেসে বসে রইলো আরমান। বিন্দুমাত্র ঘুম এলো না তার। প্রভার সাথে বাড়াবাড়িটা মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ের ছিলো বলে মনে মনে স্বীকার করলো। আসলেই,সেও বা কি করতো! তার স্ত্রীকে অন্য একটা বাজে পুরুষ কামনার দৃষ্টিতে তাকালো,স্পর্শ করলো সে এইসব কেন যেন মেনে নিতে পারছিলো না। প্রভাকে দেখলেই চোখের সামনে ওই দৃশ্যগুলো ভেসে উঠে। তখন আরমান স্বাভাবিক থাকতে পারে না। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে বলে প্রভাকে ইগনোর করে। তপ্তশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর উঠে ছাঁদে চলে গেলো। কার্নিশের উপর পা ঝুলিয়ে বসলো। একরাশ হিমেল হাওয়া এসে মুহূর্তেই তার দীর্ঘকায় শরীরটা শীতল করে দিলো। হিড় হিড় করে সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। গোল থালার মতো আকাশে মস্ত বড়ো রূপালি একটা চাঁদ। পূর্ণিমা হবে বোধহয় কাল পরশু। প্রভাকে খুব মিস করছে আরমান। এই মুহূর্তে প্রভা যদি পাশে থাকতো,তাহলে তার কাঁধে প্রভার মাথা রেখে একটা গান শুনাতো।

“আমার ভিনদেশি তারা
একা রাতের আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে
ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্প বলো কাকে?
আমার রাত জাগা তারা
তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ি
আমার ভয় পাওয়া চেহারা
আমি আদতে আনাড়ি
আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি।”

(৪০)
গলা শুকিয়ে গেছে প্রভার। জগের মধ্যে এক ফোঁটা পানিও নেই। প্রভা পানির জন্য বের হতেই দেখলো সিঁড়ি বেয়ে ইয়া লম্বা সাদা কি একটা নেমে একটু একটু করে তার দিকে এগিয়ে আসছে। প্রভা “ভূত! ভূত!” বলে চিৎকার করে উঠতেই মানুষটা প্রভার মুখ চেপে ধরতে নিতেই প্রভা হাতের মধ্যে কামড় দিয়ে ঘটনাস্থলে সেন্সলেস হয়ে পড়লো। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো মানুষটা। এটা কি হলো? মারইয়াম ইউজিওয়েল তাহাজ্জুদের জন্যই উঠেছিলেন। প্রভার চিৎকার শুনে এগিয়ে এলেন। দেখলেন আরমান একহাতে প্রভাকে জড়িয়ে রেখেছে। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”কি হয়েছে শশীপ্রভার?এতোরাতে তোমরা এখানে কি করছো?”

“ভয় পেয়েছে।”

“জ্বীন-ভূতের মতো রাত-দুপুরে এইভাবে ঘুরঘুর করছো কেন? ভয় তো পাবেই।”

কিছু বলতে পারলো না আরমান। মারইয়াম ইউজিওয়েল প্রভার গালে হাত রাখলেন। চিন্তিত হয়ে বললেন,”ইশ! মেয়েটার গা পুড়ে যাচ্ছে! আমার কামরায় নিয়ে চলো।”

তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে আরমান।

“কি হলো যাও। জ্বর এসেছে। মাথায় জলপট্টি দিতে হবে। নয়তো জ্বর নামবে না,খারাপের দিকে চলে যাবে।”

আরমান আর কিছু বললো না। মায়ের বেডের উপর শুইয়ে দিলো। বড় মির্জা সাহেবকে তার আগে তুলে নিলেন মারইয়াম ইউজিওয়েল। স্বামীকে বললেন,”আপনি গেস্টরুমে গিয়ে ঘুমান। শশীপ্রভা এখানে থাকুক।”

বিনাবাক্য ব্যয়ে তিনি চলে গেলেন।

“তুমি দাঁড়িয়ে কেন? যাও নামাজ আদায় করে ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে অফিস আছে না তোমার!”

প্রতিত্তোর না করে মনভার করে চলে গেলো আরমান। একবার দাদীমা একবার তার মা। বউটাকে নিয়ে পেয়েছেটা কি এরা? মারইয়াম ইউজিওয়েল নামাজ আদায় করে প্রভার মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলেন। সাংঘাতিক জ্বর উঠেছে মেয়েটার। হাত-পা সারা শরীর মুছে দিয়ে মাথায় আবারও জলপট্টি দিয়ে এবার প্রভার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছু একটা টানছে ওনাকে। মায়া না-কি! চাঁদের মতো গোলগাল মুখ মেয়েটার। থুতনির নিচে কুচকুচে কালো ছোট্ট একটি আকর্ষণীয় তিল। মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরী না হলেও বার-বার নজর কাঁড়ছে তিলটি। ছেলে বোধহয় এটার মধ্যেই ডুবেছে! নয়তো বিদেশী হয়ে বাঙালি মেয়ে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না।

(৪১)
সাতদিন হয়ে গেলেও প্রভার দেখা মিললো না। আরমানও জিদ চেপে রেখেছে। কতদিন থাকতে পারে থাকুক! এদিকে আর্সেল খুব বেহায়াপনা করছে,যেটা আরমানের কাছে অসহ্য বলে ঠেকছে! এই যেমন হুটহাট তার কামরায় চলে আসা,কফি আনা,তার ব্যক্তিগত জিনিসগুলো ধরা-ছোঁয়া,তার গা ঘেষে বসা ইত্যাদি। মায়ের জন্য সব দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে। কখন না জানি আবার গালে থাপ্পড় লাগায়! সকালবেলা ব্রেকফাস্ট না করেই অফিসে চলে গেলো। আচমকা রিয়াদ এসে বলল,”স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে!”

গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে?”

“স্যার,ম্যাডামের এঙ্গেজমেন্ট হচ্ছে।”

“হোয়াট! কোন ম্যাডাম?”

“শশীপ্রভা ম্যাডামের।”

“মানে?”

রিয়াদ তার মোবাইল বের করে একটা ভিডিও দেখালো। আরমানের মাথা উত্তপ্ত হয়ে গেলো মুহূর্তেই। অফিসের কাজ ফেলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মহলে পৌঁছুতেই দেখলো লাল টুকটুকে শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে প্রভা সোফায় বসে আছে দাদীমা আর তার আম্মিজানের পাশে। আর অন্য সোফায় তার হারামি বন্ধুগুলো। আরমানকে দেখতেই অ্যারোন না দেখার ভান করে পকেট হাতড়ে একটি রিং বের করলো। দাদীমা প্রভার হাত এগিয়ে আনতেই অ্যারোন লাজুক হেঁসে রিংটি পড়িয়ে দিতে নিতেই আচমকা আরমান রিংটা কেঁড়ে নিয়ে পায়ের তলায় পিষে বজ্রকণ্ঠে বলল,”কি হচ্ছে এইসব?”

কেঁপে উঠলো প্রভা। আয়েশা মির্জা পাত্তা দিলেন না। অ্যারোন রেগেমেগে উঠলো।

“এই তুমি জানো এই রিংটার দাম কতো? কি করলে এটা? আর ইউ ম্যাড?”

“জানতে হবে না কিছু।”

“মানে কি?”

“তুমি আমার ওয়াইফকে কিসের রিং পড়াতে নিয়েছো?”

“তোমার ওয়াইফ মানে?”

আরমান দাঁতে দাঁত চাপলো। তার ওয়াইফ না হলে কার ওয়াইফ?এমিল বলল,”আশ্চর্য ব্যপার তো! এইসব কি হচ্ছে আরমান? তুমি আমাদের কাজে বাঁধা দিচ্ছো কেন?দেখছো না শুভকাজে এসেছি আমরা?”

“এই মুহূর্তে তোমরা আমার বাসায় কেন? তাও আবার আমার অনুপস্থিতিতে?”

“আমরা তো এঙ্গেজমেন্ট করতে এলাম।”

“কিসের এঙ্গেজমেন্ট?”

“অ্যারোনের সাথে শশীপ্রভার বিয়ে।”

“বিয়ে মানে?এইসবের মানে কি দিদিভাই?”

“তুমি না কোথাকার কোন টার্সেল-পার্সেলকে বিয়ে করবে শশীপ্রভাকে ডিভোর্স দিয়ে?”

“কে বলেছে আপনাকে এমন কথা?”

“যাকে বলেছো সেই।”

“সে-তো মাথামোটা গাধী মেয়ে একটা। ম্যানার্স নেই।”

ঘোমটা দিয়ে বসে থাকা প্রভার খুব রাগ হলো। মাথামোটা গাধী মেয়ে মানে কি! আর তার ম্যানার্স নেই মানে?

“এতোকিছু বুঝি না বাপু! তুমি তোমার টার্সেল-পার্সেলকে নিয়ে থাকো ; আর রাগ,জিদ,অহংকার সব দেখাও। আমাদের সামনে না। তোমার মতো বিলাতি ছাওয়ালের রাগ দেখার সময় নেই আয়েশা মির্জার।”

চোয়াল শক্ত করলো আরমান। দাদীমা বাড়াবাড়ি করছে বেশি। তার পারমিশন ব্যতীত পরপুরুষের সামনে তার ওয়াইফকে নিয়ে এসেছে।

“অ্যারোন বসে রইলে কেন রিং পড়াও।”

“আরে গ্র্যান্ড মা,রিংয়ের চৌদ্দটা বাজিয়ে দিয়েছে আপনার নাতী।”

“এই তোরা যাবি?”

আর মাথামোটা গাধী মেয়েটা বউ সেজে বসে রয়েছে কেন? আজ এর একটা ব্যবস্থা করে তবেই সে ছাড়বে! এখনো তার আসল রাগটাই দেখেনি মেয়েটা! আচমকা প্রভার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যেতেই আয়েশা মির্জা সামনে দাঁড়ালেন।

“কি হচ্ছে এইসব?”

“আপনি কি শুরু করেছেন? আমার বউকে পরপুরুষের সামনে কেন নিয়ে এলেন?”

“এই শোনো,পুরুষের জিদ আর নারীর অভিমান দুটোই যখন একই সময়ে হয়,তখন এই দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটে বুঝলে?”

“কি বলতে চান?”

“শশীপ্রভাকে যেহেতু আমি বিয়ে দিয়েছি সেহেতু আমিই ডিভোর্স নিয়ে অ্যারোনের সাথে বিয়ে দেবো। অ্যারোনের আপত্তি নেই। আর তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করলে নারীও শিশু নির্যাতনের মামলা দেবো। সেইসাথে যৌতুক,মদ-গাঁজা,ইয়াবা এবং নারী ও শিশু পাচারকারীর মামলাও।”

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো দাদীমার দিকে। কি বলছে এইসব?শেষমেশ সে কি-না সে নারী ও শিশু পাচারকারীর নামে মামলা খাবে? মাথা ঠিক আছে দাদীমার? নাকি সব গেলো? ওহ নো! ওরা ছয়জন দাঁত কেলিয়ে হাসছে আর মিষ্টি মুখে পুড়ছে। যেনো কিছুই হয়নি। এমনভাবে বসেছে যেন অ্যারোন সত্যি নতুন বর। আরমানের জিদ চাপলো মাথায়। বন্ধু নামের হারামি এগুলো।

“আমাদের এখনো ডিভোর্স হয়নি।”

“তুমি তো বললে দিয়ে দিবে। তো দাও।”

“দিদিভাই আপনি আমার মাথাটা গরম করছেন।”

“তোমার মাথা সারাজীবনই গরম থাকে। এক কাজ করো ড্রীপফ্রিজের মধ্যে ঢুকে বসে থাকো। তো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।”

বলেই প্রভাকে টেনে নিয়ে আবারও বললেন,”একদম ছোঁবে না ওকে। তোমার কোনো রাইট নেই ওর উপর।”

“আমি ওনার স্বামী। আমার রাইট সবার চেয়েও বেশি।”

“দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য নেই। এখন এসেছে স্বামী স্বামী করতে!”

আরমান প্রভার হাত ধরে টেনে আনলো। আয়েশা মির্জা আবারও টেনে নিয়ে বললেন,”মানুষ চাঁদ হাতে পাওয়ার পর চাঁদের গায়ে কলঙ্কের দাগ খোঁজে! সেইসব মানুষের চাঁদ ছোঁয়ার কোনো অধিকার নেই ; যোগ্যতা নেই।”

“দিদিভাই বেশি বাড়াবাড়ি করছেন আপনি। সামান্য একটা ব্যপারকে বিশাল বড় করে ফেললেন।”

“সেইম তোমার মতো। আর শুনো,একদম ছোঁবে না শশীপ্রভাকে। তুমি এখুনি ডিভোর্স দাও আমি শশীপ্রভাকে নিয়ে দেশে চলে যাবো। অ্যারোন গিয়ে বিয়ে করে আনবে। অ্যারোনের কাছেই ভালো থাকবে শশীপ্রভা। স্ত্রীর অধিকার,মর্যাদা এবং সম্মান সব পাবে।”

অ্যারোন লাজুক হাসলো। তা দেখে আরমানের ব্রম্মতালু উত্তপ্ত হয়ে গেলো।

“বার-বার ডিভোর্সের প্রসঙ্গ আসছে কেন?”

“তুমিই তো বিয়ের রাত থেকে ডিভোর্স ডিভোর্স করে ব্ল্যাকমেইল করছো। এখন সহ্য হচ্ছে না কেনো?”

দাদীমাকে বুঝাতে আরমান অক্ষম। তার হারামী বন্ধুগুলো তো দাদীমার পক্ষ নিয়েছে তাকে জব্দ করার জন্য। সেও সুযোগ আসলে দেখে নিবে।

“সবকিছুর জন্য স্যরি! দিদিভাই।”

“স্যরি-টরি আয়েশা মির্জা বুঝে না।”

আরমান হতাশ শ্বাস ফেললো।

“দিদিভাই রিল্যাক্স?”

“তুমি রিল্যাক্স।”

দিদিভাই যে নাছোড়বান্দা আরমান হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। প্রলম্বিত তপ্তশ্বাস ফেললো একটা। আয়েশা মির্জা বলতে লাগলেন,”মানুষ মাত্রই ভুল। তাই বলে কি ক্ষমা পায় না?যেখানে মহান আল্লাহ তায়ালা কোটি কোটি ভুল,গুণাহ,পাপ করলে ক্ষমা করে দেয় সেখানে তুমি তো অতি নগন্য এক ইনসান। তোমার এতো দাম্ভিকতা আসে কোথা থেকে? তুমি না রাসূল (সা.) এর অনুসারী? আমাদের রাসূল (সা.) কে কখনো দেখেছো উনার স্ত্রীদের সাথে এতো কঠোর হতে? উনি তো স্ত্রীদের সাথে এতো কঠোর ছিলেন না? শশীপ্রভা তোমার শর্ত ভঙ্গ করেছে তোমার জন্য। ও ভেবেছিলো তুমি বিপদে পড়েছো। তাই মেয়েটা দিকদশা ভুল বেরিয়ে গেছে। আজ তোমার জায়গায় যদি আমার স্বামীকেও কেউ বন্দী করে অথবা মিথ্যা করে বললেও আমি এমনটাই করতাম যেমনটা শশীপ্রভা করেছে। বাসা থেকে বের হয়েছে। মেয়েটা এতোকিছু তখন ভেবেছে নাকি! যার জন্য করলো চুরি সেই বলে চোর! হ্যাঁ এই শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছে তোমাকে মারইয়াম তাই না?”

আরমান কথা বলতে পারলো না।

“তুমি মেয়েটার মনের অবস্থাটা একটা বারও বুঝতে চেষ্টা করোনি। তার শারিরীক অবস্থার চেয়ে মানসিক অবস্থা কতোটা করুণ! জটিল! একটা কঠিন ফাঁড়া কাটিয়ে উঠলো সবে। যেখানে স্বয়ং ডক্টর বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন আর সেখানে তুমি তাকে পানিশমেন্ট দিচ্ছো?”

মাথা নুয়ে রাখলো আরমান।

“বাপু! তোমাদের রাজপ্রাসাদে থাকার চেয়ে কুঁড়ে থাকা আরো ভালো। তুমি একজন যোগ্য স্বামীর মতো আচরণ করতে পারোনি। ধরেই শুরু করে দিয়েছো একটা অসুস্থ মেয়ের সাথে। এই ভুল সেই ভুল হাজার ভুল। কথায় কথায় ডিভোর্সের প্রসঙ্গ টেনে আনা। অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে ব্ল্যাকমেইল করা। ইসলামে বলা হয়েছে স্ত্রী ভুল করলে তাকে বুঝাতে,সময় দিতে,ভালোবেসে কাছে টানতে। এভাবে মেন্টালিটিভাবে প্রেসার ক্রিয়েট করতে বলেনি। আল্লাহ ক্ষমাশীল। পরম দয়ালু। সেখানে তার অনুগত একজন বান্দা হয়ে তুমি যে তোমার স্ত্রীর সাথে এমন করছো এইসব কি ঠিক হচ্ছে?কোনো সুস্থ বিবেকবান মানুষ এমনটা করতে পারে না। তোমার মস্তিষ্কের চিকিৎসা করাও। আর শুনো,শশীপ্রভা তার ভুল বুঝতে পেরেছে,অপরাধ স্বীকার করেছে,তোমার পায়ে পরে ক্ষমা চেয়েছে। এরবেশি আর কি হতে পারে? তুমি যে কথায় কথায় বস্তাভরা রাগ দেখাও এটা কি ঠিক? রাগ মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে। তুমিও ধ্বংসের পথে হাঁটছো। তোমাকে আমি বিবেকবান ভাবতাম। কিন্তু তুমি সেটা কাজেকর্মে বুঝিয়ে দিলে। পৃথিবীর কোথায় দেখেছো,এতো এতো শর্ত সাপেক্ষে ভালোবাসা হয় সংসার হয় কিংবা টেকে?যেখানে হায়াত-মউতের গ্যারান্টি নেই সেখানে আবার কিসের শর্ত? তুমি সুন্দর! বিদেশী ছেলে এইজন্যই তোমার এতো এটিটিউড। ভুলে যেও না বাঙালি হিসেবে শশীপ্রভাও সুন্দরী! তোমার মতো বিদেশি ছাওয়ালকে দিয়ে আমাদের বাঙালি মেয়েরা জুতাও সাফ করায় না। তোমাদেরকে ঘৃণা করে।”

আর সহ্য করতে পারলো না আরমান।

“অনেক হয়েছে ব্যস! এনাফ।”

“না কিছুই হয়নি। সবে শুরু।”

“কি বলতে চান আপনি?”

“যারা ধার্মিক আল্লাহ ভীরু তাদের মন থাকে নরম কোমল অমায়িক। তোমার মনটা মাকাল ফলের মতো এতো জঘন্য কেন?”

“দিদিভাই!”

চেঁচিয়ে উঠলো আরমান।

“সাটআপ! মুখে মুখে কথা বলবে না। এতোদিন তোমার তামাশা দেখেছি।”

তপ্তশ্বাস ফেললো আরমান। মারইয়াম ইউজিওয়েল ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন কড়া চোখে। কই তার বাবা মানুষটা তো এমন না! তাদের বিয়ের ৩২/৩৩ বছর হবে বয়স। কখনো টু শব্দটিও হয়নি আজ পর্যন্ত। আর ছেলে বিয়ে না করতেই কিসের শর্ত দিয়ে বসে আছে।

“শোনো প্রভাকে দেখেশুনে আমিই তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছি। সে ছোট বংশের মেয়ে না। কতো ভালো ভালো সম্বন্ধ এসেছিলো আমি সব বাদ দিয়েছি তোমার সাথে বিয়ে দেবো বলে। আর সেই তুমি কি-না মেয়েটাকে অনাদর করছো?এটা কি সহ্য করা যায়?”

আরমান কিছু বলতে পারলো না।

“মেয়েটাকে দেখেশুনে আমিই এনেছি। তোমাদের ভালোর জন্য শশীপ্রভাকে আমি অনেক আজেবাজে কথাও বলেছি। সব তোমার জন্য। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তুমি মেয়েটাকে শর্ত দিয়েছো তবে শর্ত পালনের জন্য সময় কিংবা কোনপ্রকার হেল্প করেছো আদোও? কথায় কথায় ডিভোর্স! মানুষ মাত্রই ভুল। তোমার এইসব শর্তের কারণে মেয়েটা ঘাবড়ে গেছে। শশীপ্রভা যা করেছে তোমার জন্য করেছো। এতে তার কোনো দোষ দেখি না। বরং শশীপ্রভা ব্ল্যাকমেইলের স্বীকার। পুরুষের রাগ থাকে। থাকাটাও শোভনীয়। তবে অতিরিক্ত রাগ কিংবা অতিরিক্ত কোনকিছুই ভালো না। যেমন উদরপূর্তি করে খেলে মানুষ বমি করে তেমনি অতিরিক্ত রাগ জীবনকে ধ্বংস করে। মনে রেখো গরীব ঘরের মেয়েরাও উত্তম মানুষটার কাছে গেলে রাজরানী হয়। সবকিছু আস্তে আস্তে মেনে চলে। শশীপ্রভা তোমার ভাত-কাপড়ের জন্য পড়ে রয়নি। তার ব্যবস্থা আল্লাহই করবেন। বিয়ে হচ্ছে,মেয়ে মানুষের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। ভাগ্যের জোরে সে যদি ভালো জীবনসঙ্গী পায়,তাহলেই ভালো। না হলে একজন মেয়ে মানুষ কবরের দেয়াল পর্যন্ত আফসোস করেই থাকে। শোনো,স্ত্রীকে সম্মান করতে না পারলে বিয়ে করো না। শুধুমাত্র দুটো ভাতের জন্য সে তার বাবা-মাকে ছেড়ে আসে না।”

“যথেষ্ট হয়েছে।”

“না হয়নি! উত্তম জীবনসঙ্গী পেতে চাও! প্রথমে নিজে উত্তম হও! নতুবা উত্তমের আশা ছেড়ে দাও! কারণ একটা ভালো জিনিস একটা নষ্ট জিনিসের কাছে কখনো টেকে না!”

দাঁতে দাঁত চাপলো আরমান। নষ্ট জিনিস মানে!? তার দাদীমা যা ইচ্ছে তাই শুনিয়ে যাচ্ছে। টলারেট করা সম্ভব হচ্ছে না আর।

“এবার তো থামুন। যথেষ্ট হয়েছে!”
_______________

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here