#সন্ধ্যারাতে_শালুক_ফোঁটে ❤️
#আদনীন_নিশাত_তারান্নুম_চৌধুরী ❤️
#পর্বসংখ্যা-(২০)
_________________________________
এক রাতে নবীজি (সা.) তাঁর সাহাবিদের নিয়ে সফর করছিলেন। শেষ রাতে বিশ্রামের উদ্দেশ্যে সফর বিরতি দিলেন। হযরত বিলাল (রা.)-কে ফজরের নামাজের জন্য জাগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিলেন। এর পর সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে হজরত বিলাল (রা.) ও তন্দ্রাবিভূত হয়ে গেলেন। ফলে সবার ফজরের নামাজ কাজা হয়ে গেল। নবীজি (সা.) ঘুম থেকে জেগে সূর্য ওঠার কিছুক্ষণ পর সবাইকে নিয়ে ফজরের নামাজ কাজা করলেন। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,ঘুম বা বিস্মৃতির কারণে যার নামাজ ছুটে গেল,যখন সে জাগ্রত হবে,তখন সে যেন তা আদায় করে নেয়।”(বুখারি : হা/৫৯৭, মুসলিম : হা/৬৮১)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন,“সেই দুই রাকাআত যা নবীজি (সা.) কাজা হিসেবে আদায় করেছেন,আমার কাছে তা গোটা দুনিয়ার মালিকানা লাভ করার চেয়েও অধিক পছন্দনীয়।”(মুসনাদে আহমাদ : হা/৪/১৮১,মুসনাদে আবী ইয়ালা : হা/৩/২২-২৩,২৩৭১)
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন,“যে ব্যক্তি কোনো নামায আদায়ের কথা ভুলে যায়,তাহলে স্মরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঐ নামায আদায় করে নেয়া তার জন্য জরুরী। এছাড়া এই নামাযের আর দ্বিতীয় কোনো কাফফারা নেই।”(সহীহ বুখারী,কিতাবুল মাওয়াকিত : অধ্যায় ৩৭ হা/৫৯৭)
যদি কোনো ব্যক্তি নামায আদায় না করে নিদ্রায় চলে যায় কিংবা অলসতা করে নামায ছেড়ে দেয়,তাহলে স্মরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আদায় করে নেবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন,“আক্বিমিস সালাতা লি যিকরী” আমার স্মরণ আসার সঙ্গে সঙ্গে নামায কায়েম করো। (সহীহ মুসলিম,কিতাবুল মাসাজিদ : হা/১৫৬৯)
ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো,যে নামায আদায় না করে নিদ্রায় চলে গেলো কিংবা অলসতা করে নামায ছেড়ে দিলো। জবাবে রাসূল (সা.) বললেন,“এর কাফফারা হলো,নামাযের স্মরণ হওয়া-মাত্রই তা আদায় করে নেবে।”(সুনানে নাসায়ী,কিতাবুল মাওয়াকীতঃ খন্ড ১-পৃষ্ঠা-৭১)
উল্লিখিত হাদীসগুলোতে রাসূল (সা.) স্পষ্ট ভাষায় এই মূলনীতি জানান দিয়ে গেছেন যে,“যখন কোনো মানুষ সময়মত কোনো নামায আদায়ে ব্যর্থ হবে,তখন তার জন্য অপরিহার্য হবে,স্মরণ হওয়া মাত্রই সে তার কাযা আদায় করে নেবে। ভুলে নামায ছুটে থাকুক,নিদ্রায় চলে যাওয়ার কারণে কিংবা অলসতার কারণে ছুটে থাকুক।”
সহীহ মুসলিম ও সুনানে নাসায়ীর বর্ণনায় রাসূল (সা.) কোরআনের আয়াতে,“আমার কথা স্মরণ আসার সঙ্গে সঙ্গে নামায কায়েম করো”এর উদ্ধৃতি দিয়ে এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে,কোরআনের এই আয়াতটিতে কাজা নামায আদায়ের নির্দেশও অন্তর্ভুক্ত আছে। এই নীতিমালা বর্ণনা করার সময় রাসূল (সা.) নামাযের এমন কোনো পরিসংখ্যান উল্লেখ করে দেন নাই যে,এতো সংখ্যার মধ্যে কাজা নামায আদায় সীমাবদ্ধ থাকবে। এর চেয়ে বেশি হলে কাজা নামায আদায় করার প্রয়োজন হবে না। তাওবাই যথেষ্ট হবে।
খন্দকের যুদ্ধ চলাকালে রাসূল (সা.) এর বেশ কয়েক ওয়াক্ত নামায ছুটে গিয়েছিলো। তিনি সব নামাযেরই কাজা আদায় করে নিলেন। হাদীসের সব কিতাবেই এই বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। অথচ এই সময়েও রাসূল (সা.) এমন কোনো কথা বলেননি যে,যদি এর চেয়ে অধিক নামায ছুটে যায় তাহলে তার কাজা আদায় করতে হবে না।
সুতরাং কাজা নামায আদায়ের যে নির্দেশটি উল্লিখিত হাদীসসমূহে বর্ণিত হয়েছে,তারই উপর ভিত্তি করে ফুকাহায়ে কেরাম একথা পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ করেছেন যে,কাজা নামায যতো বেশিই হোক না কেনো তার কাজা করা অপরিহার্য।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর ফাতওয়াও তাই,
المسارعة الى قضاء الفوائت الحثيرة اولى من الأشتغال بالنوافل، واما مع قلة الفوائت فقضاء السنن معها احسن،.
অনুবাদঃ “যদি কাজা নামাযের পরিমাণ অনেক বেশি হয় তবে সুন্নাত নামাযে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে ফরয নামাযসমূহ আদায় করাই উত্তম। আর যদি কাজা নামাযের পরিমাণ কম হয়,তবে ফরযের সাথে সুন্নাত নামায আদায় করলে তা একটি উত্তম কাজ হবে।”(ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়া-২২/১০৪)
📌প্রসিদ্ধ ফিকহী মাযহাবসমূহের কয়েকটি কিতাবের উদ্ধৃতিগুলো উল্লেখ করছি।
🔸হানাফী মাযহাব।
🔹প্রসিদ্ধ হানাফী ফিকহ আল্লামা ইবনে নুজাইম রহ. বলেন,
فَالْأَصْلُ فِيهِ أَنَّ كُلَّ صَلَاةٍ فَاتَتْ عَنْ الْوَقْتِ بَعْدَ ثُبُوتِ وُجُوبِهَا فِيهِ فَإِنَّهُ يَلْزَمُ قَضَاؤُهَا سَوَاءٌ تَرَكَهَا عَمْدًا أَوْ سَهْوًا أَوْ بِسَبَبِ نَوْمٍ وَسَوَاءٌ كَانَتْ الْفَوَائِتُ كَثِيرَةً أَوْ قَلِيلَةً.
অর্থঃ “যে নামায নির্ধারিত সময়ে আদায় হয়নি তার কাজা আদায় করা অপরিহার্য,তা ইচ্ছাকৃতভাবে ত্যাগ করা হোক অথবা ভুলে যাওয়ার কারণে বা ঘুমন্ত অবস্থায় কাজা হোক,কাজা নামাযের সংখ্যা বেশি হোক বা কম হোক।”(আলবাহরুর রায়েক-২/৭৯)
🔸মালেকী মাযহাব।
🔹ইমাম মালেক রহ. বলেন,
من نسي صلوات كثيرة أو ترك صلوات كثيرة فليصل على قدر طاقته. وليذهب إلى حوائجه، فإذا فرغ من حوائجه صلى أيضا ما بقي عليه حتى يأتي على جميع ما نسي أو ترك.
অর্থঃ “ভুলে যাওয়ার কারণে যার অনেক নামায কাজা হলো বা ইচ্ছাকৃত কাজা করল,সে প্রয়োজনাদি সম্পন্ন করার মাঝে মাঝে সামর্থ্য অনুযায়ী তা আদায় করতে থাকবে এবং প্রয়োজনীয় কাজ সমাধা হওয়ার পর কাজা হওয়া সকল নামায আদায় করবে।”(আলমুদাওয়ানাতুল কুবরা-১/১২৩)
ইমাম ইবনে আব্দুল বার মালেকী (রহ.) বলেন,
وإذا كان النائم والناسي للصلاة – وهما معذوران – يقضيانها بعد خروج وقتها كان المتعمد لتركها المأثوم في فعله ذلك أولى بالا يسقط عنه فرض الصلاة وأن يحكم عليه بالإتيان بها لأن التوبة من عصيانه في تعمد تركها هي أداؤها وإقامة تركها مع الندم على ما سلف من تركه لها في وقتها وقد شذ بعض أهل الظاهر وأقدم على خلاف جمهور علماء المسلمين وسبيل المؤمنين فقال ليس على المتعمد لترك الصلاة في وقتها أن يأتي بها في غير وقتها… وشذ عن جماعة علماء الأمصار ولم يأت فيما ذهب إليه من ذلك بدليل يصح في العقول.
অর্থঃ ঘুম বা বিস্মৃতির কারণে যার নামায কাজা হয়েছে,ওযর থাকা সত্ত্বেও যখন তাকে ঐ নামায আদায় করতে হয়,তখন ইচ্ছাকৃতভাবে নামায ত্যাগ করে যে মহা অপরাধ করেছে তার নামায মাফ হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তার এই অপরাধের তওবা হলো নামাযটি আদায় করে অপরাধের ভার লাঘব করা এবং নির্ধারিত সময়ে আদায় না করার জন্য অনুতপ্ত হওয়া। এ বিষয়ে জনৈক ‘জাহেরী’ মুসলিম উম্মাহর অসংখ্য আলিমের বিরোধিতা করে ‘সাবীলুল মুমিনীন’ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন।
তার বক্তব্য,ইচ্ছাকৃতভাবে নির্ধারিত সময়ে নামায না পড়লে ঐ নামায আর আদায় করতে হবে না। এই মত অবলম্বন করে তিনি সকল মুসলিম জনপদের আলেমগণের জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন এবং তার দাবির সপক্ষে যুক্তিসংগত কোন প্রমাণ পেশ করতে সক্ষম হোননি। (আলইসতিযকার-১/৩০১)
🔸ফিকহে শাফেয়ী ও হাম্বলী।
🔹ফিকহে শাফেয়ীর অন্যতম কিতাব ‘ফাতহুল জাওয়াদ’-এ বলা হয়েছে,
من فاتته)… (مكتوبة) فأكثر (قضى) ما فاتته بعذر أو غيره نعم غير المعذور يلزمه القضاء فورا. ويظهر أنه يلزمه صرف جميع زمنه للقضاء ما عدا ما يحتاج لصرفه فيما لا بد منه.
অর্থঃ “যে ব্যক্তির এক বা একাধিক ওয়াক্তের নামায কাজা হয়েছে,ওযরবশত হোক বা বিনা ওযরে,তাকে সকল নামায আদায় করতে হবে। তবে বিনা ওযরে ত্যাগকারী অনতিবিলম্বে কাজাকৃত সকল নামায আদায় করবে এবং অতি প্রয়োজনীয় কাজকর্ম ছাড়া পূর্ণ সময় এই কাজে ব্যয় করবে।”(ফাতহুল জাওয়াদ-১/২২৩)
সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাকার সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম নববী (রহ.)
من نسي صلاة فليصها إذا ذكرها.
হাদীসটির উপর আলোচনা করতে গিয়ে শরহে মুসলিমে (৫/১৮৩) বলেন,
فِيهِ : وُجُوب قَضَاء الْفَرِيضَة الْفَائِتَة سَوَاء تَرَكَهَا بِعُذْرٍ كَنَوْمٍ وَنِسْيَان أَوْ بِغَيْرِ عُذْر ، وَإِنَّمَا قَيَّدَ فِي الْحَدِيث بِالنِّسْيَانِ لِخُرُوجِهِ عَلَى سَبَب ، لِأَنَّهُ إِذَا وَجَبَ الْقَضَاء عَلَى الْمَعْذُور فَغَيْره أَوْلَى بِالْوُجُوبِ ، وَهُوَ مِنْ بَاب التَّنْبِيه بِالْأَدْنَى عَلَى الْأَعْلَى.
অর্থাৎ এ হাদীসে ছুটে যাওয়া ফরয নামায আদায়ের অপরিহার্যতাও প্রমাণিত হয়। নামাযটি কোন ওযরবশত যথা,ঘুম বিস্মৃতি ইত্যাদির কারণে কাজা হোক বা বিনা ওযরে। হাদীস শরীফে শুধু বিস্মৃতির উল্লেখ এজন্য হয়েছে যে,তা একটি ওযর। আর ওযরের কারণে কাজা হওয়া নামায যদি আদায় করা অপরিহার্য হয় তবে বিনা ওযরে কাজা হওয়া নামায যে আদায় করা অপরিহার্য তা তো বলাই বাহুল্য। (শরহে মুসলিম-৫/১৮৩)
🔸হাম্বলী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য ইমাম আল্লামা মারদাভী (রহ.) বলেন,
قوله: “ومن فاتته صلوات لزمه قضاؤها على الفور”. هذا المذهب نص عليه وعليه جماهير الأصحاب وقطع به كثير منهم… قوله: “لزمه قضاؤها على الفور” مقيد بما إذا لم يتضرر في بدنه أو في معيشة يحتاجها فإن تضرر بسبب ذلك سقطت الفورية.
“যার অনেক নামায কাজা হয়েছে তার অনতিবিলম্বে আদায় করা অপরিহার্য। এটাই মাযহাব,ইমাম আহমদ (রহ.) একথা স্পষ্ট বলেছেন। আমাদের হাম্বলী মাযহাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম এমতের উপরেই আছেন এবং তাদের অনেকেই এটা নিশ্চিত করেছেন। তবে অনতিবিলম্বে যে কাজা করার কথা বলা হয়েছে,তা কেবল তখনকার জন্য যখন সে শারীরিকভাবে বা প্রয়োজনীয় জীবিকা উপার্জনে ক্ষতির সম্মুখীন হবে না। যদি হয় তাহলে অনতিবিলম্বে আাদায় করা অপরিহার্য থাকবে না। (আল ইনসাফ-১/৪৪২-৪৪৩)
উল্লেখিত বর্ণনা প্রমাণ করে নামায মূলত জিম্মা থেকে মাফ হয় না। তাই সময় সুযোগ পেলেই পূর্বের কাজা নামায আদাই করাই বাঞ্ছনীয়। নামাযের মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত কাজা হবার পর তাকে গাফলতীর সাথে অনাদায় রাখাটা চরম উদাসীনতা। আর নিজে সে ইবাদত কাজা না করাটা এক ধরণের গাফলতী,সেই সাথে অন্যকে ফাতওয়া দিয়ে কাজা আদায় করতে বিরত রাখাটা চরম পর্যায়ের ইবাদত বিদ্বেষী মনোভাবের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নয়। তাই এসব বাতিলপন্থী চিন্তার ধারকদের থেকে দূরে থাকা জরুরী।
🔹ফরজ বা ওয়াজিব নামাজ সময় মতো পড়তে না পারলে,সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পড়া হলে তাকে কাজা নামাজ বলে। কাজা নামায দুই প্রকার। যথাঃ
১) ‘ফাওয়ায়েতে কালীল’ অর্থাৎ অল্প কাজা পাঁচ ওয়াক্ত পরিমাণ নামায কাজা হলে উহাকেই ‘ফাওয়ায়েতে কালীল’ বা অল্প কাজা বলে।
২) ‘ফাওয়ায়েতে কাছির’ অর্থাৎ বেশি কাজা। পাঁচ ওয়াক্তের অধিক যত দিনের নামাযই কাজা হউক না কেন উহাকে ‘ফাওয়ায়েতে কাছির’ বা অধিক-কাজা বলা হয়। একে উমরী কাজা ও বলা হয়। এ ধরনের কাজা নামায সকল ওয়াক্তিয়া নামাযের পূর্বে পড়তে হবে। কোন ব্যক্তির যিম্মায় যদি ৬ ওয়াক্ত নামাযের কম কাজা হয়,তাহলে উক্ত ব্যক্তিকে ফিক্বহী পরিভাষায় “সাহেবে তারতীব” তথা এরকম ব্যক্তি বলা হয়,যার উপর সিরিয়াল ঠিক রাখা আবশ্যক হয়। অর্থাৎ যে নামায আগে কাজা হয়েছে,তা আগে আদায় করা আবশ্যক,পরেরটা পরে। সেই হিসেবে কাজা নামায আদায় করার আগেই যদি অন্য নামাযের সময় হয়ে যায় তাহলে প্রথমে কাজা আদায় করা আবশ্যক। তারপর বর্তমান আসা নামায আদায় করবে। আর যদি ৬ ওয়াক্ত থেকে বেশি নামায কাজা হয়ে থাকে। তাহলে তারতীব বা সিরিয়াল রক্ষা করা জরুরী নয়। সুতরাং সে কাজা আদায় না করেই নতুন আসা ওয়াক্তি নামায পড়তে পারবে।
সুতরাং আপনার যিম্মায় যদি ৬ ওয়াক্তের কম নামায কাজা হয়ে থাকে,তাহলে আপনার কাজা আদায় করা ছাড়া সুন্নত পড়া ঠিক হবে না। বরং আগে কাজা আদায় করতে হবে। আর যদি ৬ ওয়াক্তের বেশি কাজা হয়ে থাকে,তাহলে কাজা আদায় না করেই পরবর্তী নামায আদায় করা জায়েজ হবে।
প্রামান্য গ্রন্থাবলী
১) ফাতওয়ায়ে-২/৫২৩-৫২৭
২) ফাতওয়ায়ে আলমগীরী-১/১২১
৩) বাদায়েউস সানায়ে’-১/৫৬০-৫৬৩
এবার আসি উমরী কাযা সম্পর্কে। উমরী কাযা নামাজ হলো আপনি বালেগ বা বালিগা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত যত নামাজ কারণবশত পড়তে পারেন নাই। সেগুলো হিসাব করে আদায় করাকে উমরী কাযা বলে। দীর্ঘ দিনের বা সারা জীবনের কাযা নামাজকে ‘উমরী কাযা’ বলা হয়। উমরী কাযা আদায়ের বিশেষ কোনো পদ্ধতি নেই। সাধারণ নামাজের মতোই তা পড়া যায়। অতীত বিশ বছরের নামাজ এখন আদায় করলে প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ ও বিতরসহ মোট ছয়টি নামাজ আদায় করতে হবে। সুন্নত ও নফল নামাজের কাযা করতে হয় না। প্রতিদিনের নির্দিষ্ট নামাজের সঙ্গে পূর্ববর্তী দু’টি নামাজ নিয়মিত আদায় করলে দশ বছরে উমরী কাযা শেষ হবে। আরও বেশি করে পড়লে আরও দ্রুত শেষ হবে। কাযা নামাজ অনেক বেশি থাকলে উপস্থিত সুন্নতের স্থলে কাযা আদায় করা যেতে পারে। তবে সুন্নতে মোয়াক্কাদা ছেড়ে দেয়া কিছুতেই উচিত হবে না।
কাজা নামাজ আদায় করার সময় সূরা কেরাত পাঠ করার ক্ষেত্রে মূল নামাজের অনুকরণ করতে হবে। যদি সফরের সময় কারো কসর নামাজ কাজা হয়ে থাকে,তবে বাড়িতে ফেরার পরে তার কাজা কসরই আদায় করতে হবে অর্থাৎ চার রাকাতের জায়গায় দুই রাকাত আদায় করতে হবে। তেমনি ঘরে কাজা হওয়া নামাজ যদি কেউ সফরে গিয়ে আদায় করে তবে পূর্ণ নামাজ পড়তে হবে।
🔸উমরী কাযা নামায আদায় করতে হলে প্রথমে কোন ওয়াক্ত নামায কত রাকাত কাযা হয়েছে তা নির্ণিত করে নিতে হবে। যদি তা জানা সম্ভব না হয় তাহলে অনুমান করে নিতে হবে। অনুমান করে কোন নামায কত ওয়াক্ত কাযা করেছে তা নির্ধারণ করে নিতে হবে। তারপর একে একে তা আদায় করতে হবে। যেমন ফজরের নামায ৭০ ওয়াক্তের কাযা হয়েছে। তখন কাযা নামায আদায় করার সময় এভাবে নিয়ত করতে হবে,“আমার জিম্মায় যত ফজরের নামায কাযা আছে,তার অনাদায়কৃত প্রথম ফজরের কাযা আদায় করছি।”এমন নিয়তে নামায আদায় করতে হবে। তারপর জিম্মায় ৬৯ ওয়াক্তের ফজরের নামায বাকি থাকে। তবু এভাবেই নিয়ত করতে হবে,“আমার জিম্মায় যত ফজরের নামায কাযা আছে,তার প্রথম অনাদায়কৃত ফজরের নামাযের নিয়ত করছি।”এভাবে হিসেবে করে পড়তে হবে।
প্রতিবার অনাদায়কৃত প্রথম ফজর নামায বলার দ্বারা যে নামায বাকি আছে,তার প্রথম নামাযের নিয়ত হচ্ছে,তাই নিয়তটি নির্দিষ্ট নামাযের হয়ে যায়। ঠিক উল্টোভাবেও করা যায়। অর্থাৎ যত নামায কাযা আছে তার সর্বশেষ অনাদায়কৃত কাযার নিয়ত করছি। এভাবেও পূর্বোক্ত পদ্ধতিতে বাকি নামাযের কাযা আদায় করা যাবে। এভাবে বাকি নামায আদায় করতে হবে। যোহর,আসর,মাগরিব,ইশাও এভাবে আদায় করতে হবে। একদিনে একাধিক চারদিন পাঁচদিনের,যত দিনের ইচ্ছে কাযা আদায় করা যাবে। কোন সমস্যা নেই।
কাযা নামায অস্বীকারকারী ভাইদেরও মান্যবর আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহঃ) এর মতামত উল্লেখ করছি। আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহঃ) ফুকাহায়ে কিরামের অভিমত নকল করে তার সঙ্গে ঐক্যমত পোষন করে বলেন,“যে ব্যক্তির দায়িত্বে কোনো কাযা নামায রয়েছে,তার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ঐ নামায আদায় করে নেয়া ওয়াজিব। সে ঐ নামায ইচ্ছাকৃতভাবে কাযা করে থাকুক কিংবা ভুলক্রমে। এটিই জমহুর ফুকাহা,ইমাম মালিক (রাহঃ) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহঃ) এবং ইমাম আবু হানিফা (রাহঃ) এর অভিমত। ইমাম শাফঈ (রাহঃ) এর মাযহাবেও প্রাণিধান্য এটিই যে,যদি জেনে-বুঝে নামায কাযা করে থাকে,তবে তাৎক্ষণিক আদায় করে নেয়া ওয়াজিব (ফতওয়া শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ-খন্ড:২৩,পৃষ্ঠা:২৫৯)
আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হলো,“যে ব্যক্তির দায়িত্বে বেশকিছু কাযা নামায রয়েছে,সে কি তা আদায় করার সময় সুন্নাতও আদায় করে নেবে,না শুধুমাত্র ফরয আদায় করবে?” জবাবে ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহঃ) বলেন,“কাযা নামায বেশি হলে ওইসবের কাযা আদায় করা নফল নামাযে লিপ্ত হওয়া থেকে উত্তম। তবে কাযা নামায সংখ্যায় কম হলে তা সুন্নাতসহ আদায় করা উত্তম।”(ফতওয়া শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ : খন্ড-২২,পৃষ্ঠা:৪)
উপর্যুক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলো যে,মানুষের দ্বারা যেসব নামায কাযা হয়েছে,তার কাযা আদায় করা তার জন্য ওয়াজিব। কেবলমাত্র তওবা করার দ্বারা তা মাফ হবে না। পরিমাণে তা যত বেশিই হোক না কেনো। এই কথা বলে বেড়ানো যে,কাযা নামাযের প্রয়োজন নেই,কেবলমাত্র তওবা করে নেয়াই যথেষ্ট,এটি চরম দৃষ্টতা ও ভ্রষ্টতার শামিল। এর চেয়ে আগ বাড়িয়ে যদি কেউ বলে যে কাযা (উমরী কাযা বেশি কাযাকৃত নামায আদায় করা) বিদআত! তাহলে বলতে হবে যে,তার ঈমানের খতরা রয়েছে। আর যে ব্যক্তি নামাযের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও বুনিয়াদি ফরয ইবাদতকে কেবলমাত্র নিজের খেয়ালের বশীভূত হয়ে,কোনো দলীল-প্রমাণ ছাড়াই তওবা করে নিলেই যথেষ্ট হবে বলে ভ্রষ্ট ঘোষণা দেয় এবং নিজের ঐ অযৌক্তিক অবস্থানে অটল অবিচল থাকে সে নিশ্চিত ভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়াত দান করুন।
🔸বিতর নামায আদায় করা ওয়াজিব। তাই এটি কাযা হয়ে গেলে পড়ে কাযা আদায় করতে হবে।
فى تنوير الأبصار- وكذا حكم الوتر
وقال ابن عابدين، لأنه فرض عملى عنده (رد المحتار، كتاب الصلاة، باب قضاء الفوائت-2/73، سعيد)
বিতির নামাযের কাযা পড়তে হবে। তবে সুন্নাতে মুআক্কাদা নামাযের কোন কাযা নেই। তবে ফজরের নামায যদি সুন্নাতসহ কাযা হয়,আর তা সেই দিনই জোহরের নামাযের আগে আদায় করা হয়,তাহলে কাযা পড়া মুস্তাহাব। যদি সেদিনের যোহরের নামাযের পর আদায় করে তাহলে ফজরের সুন্নাতের কাযা পড়তে হবে না। আর জোহরের ফরজের পূর্বের চার রাকাত সুন্নাতে মুআক্কাদা ফরজের আগে পড়তে না পারলে,ফরজের পরে সেদিনের আসরের আগে পড়া উত্তম। জরুরী নয়।
فى رد المحتار- ( قوله وكذا حكم الوتر ) لأنه فرض عملي عنده (رد المحتار- كتاب الصلاة، باب قضاء الفوائت، مطلب فى اسقاط الصلاة عن الميت-2/، 440،533)
وفيه ايضا- لكن لما كان القضاء خاصا بما كان مضمونا والنفل لا يضمن بالترك اختص القضاء بالواجب ، ومنه ما شرع فيه من النفل فأفسده فإنه صار بالشروع واجبا فيقضى ، وبهذا ظهر أن الأداء يشمل الواجب والمندوب ، والقضاء يختص بالواجب (رد المحتار- كتاب الصلاة، باب قضاء الفوائت، مطلب فى ان الأمر يكون بمعنى اللفظ ، وبمعنى الصفة-2/519)
وفيه ايضا- ( بخلاف سنة الظهر ) وكذا الجمعة ( فإنه ) إن خاف فوت ركعة ( يتركها ) ويقتدي ( ثم يأتي بها ) على أنها سنة ( في وقته ) أي الظهر ( قبل شفعه ) عند محمد ، وبه يفتى جوهرة (رد المحتار- كتاب الصلاة، باب ادراك الفريضة- 2/512-513)
فى موطا مالك- و حدثني عن مالك أنه بلغه أن عبد الله بن عمرفاتته ركعتا الفجر فقضاهما بعد أن طلعت الشمس( موطا مالك-النداء للصلاة، باب ما جاء في ركعتي الفجر،رقم-422
অনুবাদঃ হযরত ইমাম মালেক (রহ:) বলেন,আমি জেনেছি যে,আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) এর ফজরের দুই রাকাআত ছুটে গিয়েছিল। তিনি তা সূর্যোদয়ের পর আদায় করেন। (মুয়াত্তা মালিক-৪৫)
وفى جامع الترمذى- عن أبي هريرة قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من لم يصل ركعتي الفجر فليصلهما بعد ما تطلع الشمس (جامع الترمذى- أبواب الصلاة عن رسول الله صلى الله عليه و سلم، باب ماجاء في إعادتهما بعد طلوع الشمس،رقم-423)
অনুবাদঃ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত যে,নবীজি (সা.) বলেন,“যে ফজরের দুই রাকাআত সুন্নত (সময়মতো) পড়লো না সে যেন সূর্যোদয়ের পর তা আদায় করে।”(জামে তিরমিজী-১/৯৬)
📌কয়েকটি জরুরী মাসয়ালা।
যেভাবে কাযা নামাজ আদায় করবেন।
১) পাঁচ ওয়াক্তের ফরজ নামাজ এবং বিতর নামাজ ছুটে গেলে কাযা করা।
২) নফল নামাজ শুরু করার পর ওয়াজিব হয়ে যায়। কোন কারণে নফল নামাজ নষ্ট হলে অথবা শুরু করার পর কোন কারণে যদি ছেড়ে দিতে হয়,তাহলে তার কাযা করাও ওয়াজিব।
৩) সুন্নতে মুয়াক্কাদা এবং নফলের কাযা নেই। তবে ফজরের নামাজ সুন্নত-ফরজ উভয়টা পড়তে না পারলে সুন্নত-ফরজ এক সঙ্গে কাযা করা উত্তম। দুপুরের চার রাকাত সুন্নত পড়তে না পারলে ফরজের পরও পড়ে নেওয়া যায়। ফরজের পর যে দুই রাকাত সুন্নাত আছে তার আগেও পড়া যায় এবং পরেও পড়া যায়। তবে দুপুরের ওয়াক্ত চলে গেলে কাযা ওয়াজিব হবে না।
৪) জুমার নামাজের কাযা নেই। জুমা পড়তে না পারলে চার রাকাআত যোহর কাযা পড়তে হবে।
৫) কাযা নামাজ পড়ার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। যখনই স্মরণ হবে এবং সুযোগ হবে পড়ে নিতে হবে। তবে নিষিদ্ধ সময়গুলোতে বিরত থাকতে হবে।
৬) বেশি কাযা হলে করনীয়ঃ কারো যদি কয়েক মাস এবং বছর নামাজ কাযা হয়ে যায়,তাহলে তার উচিত কাযা নামাজ একটা অনুমান করে নিয়ে কাজা পড়া শুরু করা। এ অবস্থায় কাযা নামাজ পড়ার নিয়ম এই যে,সে যে ওয়াক্তের কাযা পড়তে চাইবে সে ওয়াক্তের নাম নিয়ে বলবে যে,অমুক ওয়াক্তের সবচেয়ে প্রথম বা শেষ নামাজ পড়ছি। যেমন কাজা হওয়া নামাজের মধ্যে ফজরের নামাজের কাজা পড়তে চায়। তাহলে বলবে,ফজরের সবচেয়ে প্রথম অথবা শেষ নামাজ পড়ছি। এভাবে পড়তে থাকবে যাতে সকল কাজা নামাজ পুরা হয়ে যায়।
৭) ভ্রমণের সময়ের কাযাঃ সফরে যে নামাজ কাযা হবে তা মুকিম হয়ে পড়তে গেলে কসর পড়বে। কসর মানে চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজ দুই রাকাত পড়বে। তেমনি মুকিম অবস্থায় কাযা হলে সফরে তা পুরা পড়তে হবে। একদিনে একাধিক চারদিন পাঁচদিনের,যত দিনের ইচ্ছে কাযা আদায় করা যাবে। কোন সমস্যা নেই।
_________
চলবে।