#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৭.
তনয়ার ঘরের বিশাল বুকশেলফটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিল স্বরূপ৷ শেষে মন্তব্য না করে থাকতে পারল না সে, “তোমার বইয়ের কালেকশন তো দারুণ!”
তনয়া হাসল। “হ্যাঁ, ছোটোবেলা থেকে জমিয়েছি সব।”
“বই পড়তে ভালোবাসো বুঝি?”
“খুব!”
“আগে তো বলোনি।”
“সময়টা কোথায় পেলাম?”
স্বরূপ বই দেখতে লাগল। আহমদ ছফার বইগুলো দেখে বলল, “এগুলো সব পড়েছ?”
“হ্যাঁ!”
“কেমন লাগে?”
“দারুণ! আমার পছন্দের লেখক।”
স্বরূপ একটু অবাক হয়ে তাকায়৷ তারপর বলে, “আমার মনে হতো মেয়েরা আহমদ ছফা বোঝে না।”
তনয়া ভুরু কুঁচকে বলল, “এর মানে কী? বুঝবে না কেন? মেয়েদের মাথায় কি ঘিলু কম?”
“ঠিক সেটা না..” স্বরূপ কথা ঘোরাল, “আমার আসলে ধারণা ছিল মেয়েরা শুধু প্রেম ভালোবাসার গল্প পড়ে, যেমন শরৎচন্দ্র, কিংবা হুমায়ূন..”
“হুহ…” হাত উল্টে তনয়া বলল, “মেয়েরা সবই পড়ে। পাঠকদের মধ্যে মেয়ে পাঠকই বেশি বুঝলে? এত যে জ্ঞান দিচ্ছো, তোমার নিজের বাড়িতে তো বইয়ের চিহ্নও দেখলাম না।”
“বই পড়ি না অনেকদিন।”
“কেন?”
“ইচ্ছে করে না। ব্যস্ততায় বই পড়ার ইচ্ছে মরে গেছে।”
বলতে বলতে সে ড্যান ব্রাউনের ‘ইনফার্নো’ বইটা টেনে নিয়ে বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল।
“পড়বে এখন?”
“হুম। এটা অনেক আগের পড়া। খুব পছন্দের ছিল, কিন্তু ভুলে গেছি৷ আরেকবার পড়াই যায়।”
তনয়া খুশি হয়ে বলল, “আচ্ছা পড়ো।”
“তুমি খুশি হচ্ছো কেন?”
“আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমার বরও বই পড়বে। তারপর একসাথে বই কিনব, পড়ব, আলোচনা করব।”
স্বরূপ হেসে বলল, “বইপড়া ছেলের অভাব পড়ে গিয়েছিল বুঝি?”
“মানে?”
“এইযে আমাকে বিয়ে করে ফেললে?”
“তোমার সাথে কপালে লেখা ছিল।”
স্বরূপ বাঁকা হাসল। কিছু বলল না। তনয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি কি তোমাকে খুব বিরক্ত করছি?”
স্বরূপ বই থেকে চোখ না তুলে বলল, “গানের সুরে প্রশ্নটা করো, তাহলে উত্তর দেব।”
তনয়া একটা কুশন ছুঁড়ে মারল স্বরূপের মুখে। তারপর উঠে চলে গেল। স্বরূপ কুশনটা বুকে জড়িয়ে বই পড়ায় মনোযোগ দিল।
কিছুক্ষণ পর তনয়া দুই কাপ কফি নিয়ে ফিরল। একটু আগে সকালের নাস্তা সেরেছে তারা। আজ অনেক রান্নাবান্না হবে। মা আগে থেকেই পাশের বাড়ির ছুটা বুয়া বিনু খালাকে বলে রেখেছিল তাকে একবেলা কাজ করে দিয়ে যেতে হবে। আর ওদের গৃহপরিচারিকা তো আছেই। মা তনয়াকে বললেন তাকে কোনো সাহায্য করতে হবে না। সে স্বামীকে সঙ্গ দিতে পারে।
তনয়া একটু লজ্জা পেয়েই চলে এসেছে।
স্বরূপ কফির কাপ হাতে বলল, “তুমি বানিয়েছ?”
“না, মা বানিয়েছে।”
“তুমি কি রান্নাবান্না পারো না?”
তনয়া একটু অবাক হয়ে বলল, “পারব না কেন?”
“কখনো খাওয়ালে না তো।”
“আশ্চর্য তো! সুযোগ পেলাম কখন?”
“তাই তো! তাই তো!”
স্বরূপে আরও কিছু অসংলগ্ন কথা বলে গেল বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে। তার প্রধান মনোযোগ রইল বইতে। তনয়াও একটা বই নিয়ে বসেছে, পশ্চিমবঙ্গের লেখকের বই। খুব নামডাক হয়েছে বইটার। এটা নিয়ে সিরিজও তৈরি হয়েছে। ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। সেই কবে কিনে রেখেছিল তনয়া। আজও পড়া হয়নি।
পড়তে শুরু করে তনয়ার খুব মজা লাগতে শুরু করল। কত রকমের রান্নার বর্ণনা আর সাথে এগিয়ে যাওয়া ইন্দুবালার জীবনের গল্পটা! এক পর্যায়ে তনয়ার চোখে পানি চলে এলো। সে বই বন্ধ করে অন্যদিকে তাকাতেই দেখল স্বরূপ চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। ওর মুখে এত গভীর বিষাদের ছায়া সে আগে দেখেনি। কিসের এত বেদনা তার?
স্বরূপ অনেকক্ষণ পর চোখ খুলল। তার চোখ লাল। তনয়ার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল, “ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
তনয়া জানে, ও ঘুমায়নি। এইমাত্র একটা মিথ্যে বলল। সে কি এত কাছে থেকেও মানুষটাকে স্পর্শ করতে পারছে না?
বইটা শেলফে রেখে দিয়ে বারান্দায় চলে গেল স্বরূপ। তনয়াও আর কিছু পড়তে পারল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ঝুলে রইল ঘরে।
*
দুপুরের খাবারটা জমজমাট হলো। এত পদ দেখে স্বরূপের মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়! সে হেসে বলল, “আন্টি, এত পদ দিয়ে আমি জীবনেও খাইনি। এসব এক মাস ধরে খাওয়া যাবে।”
তনয়ার মা হাসিমুখে বললেন, “বিসমিল্লাহ বলে শুরু করো, আজকেই খেতে পারবে।”
স্বরূপ মনে মনে ইন্না-লিল্লাহ পড়ল।
খাবে না খাবে না করেও সে কম খেল না৷ তনয়া খেয়াল করল স্বরূপ বেশ আরাম করে খাচ্ছে। মা আর বাবার যত্নটা সে উপভোগ করছে। ওর চোখেমুখে সকালকার সেই বিষাদের ছিটেফোঁটাও নেই। কী প্রাণবন্ত হাসি! মানুষটা ভালোবাসা ভালোবাসে। তাহলে তাকে কেন নয়? সে কি ভালোবাসতে পারছে না? নাকি তার ভালোবাসা মানুষটাকে স্পর্শ করছে না?
*
সন্ধ্যার দিকে ওরা রওনা দিল নিজেদের বাসায়। মা সাথে খাবারদাবার দিয়ে দিয়েছেন। তনয়ার জিনিসপত্র তো আছেই। স্বরূপ সব জিনিস গাড়িতে তুলতে তুলতে বলল, “তোমাকে নিয়ে বাসা বদলাতে হলে আমার খবর হয়ে যেত। ভাগ্যিস নিজের ফ্ল্যাটে থাকি।”
তনয়া কিছু বলল না। দন্ত বিকশিত হাসি উপহার দিল।
বাড়িতে পৌঁছে তনয়া বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিল। যদিও বিয়ে করে এখানেই সে এসেছিল, তবুও এই প্রথম তার মনে হলো এই তো তার সংসার। তার বর্তমান ঘর। নিজের ঘরের মতো শান্তি লাগছে। এর আগে মা চাচীরা থাকায় ভালো করে দেখতে পারেনি তনয়া। আজ ঘুরে ঘুরে সব দেখল। চারটা বেডরুম, সবগুলোই সুন্দর করে সাজানো। রান্নাঘরটা দুর্দান্ত বলা যায়! পুরোটা ঝকঝক করছে। বসার ঘরটা বড়। একপাশে বিশাল জানালায় হালকা রঙের মসৃন কাপড়ের পর্দা টানা। পর্দা সরিয়ে দিতেই আলোজ্বলা শহরের বড় একটা অংশ যেন উন্মুক্ত হলো চোখের সামনে।
সে মনে মনে স্বরূপের রুচির প্রশংসা না করে পারল না। স্বরূপের কথা মনে হতেই নিজেদের বেডরুমে উঁকি দিল সে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে কার সাথে যেন। সে পেছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল স্বরূপকে। স্বরূপের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে ধীরেসুস্থে কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
“বাসাটা এত সুন্দর করে সাজিয়েছ তুমি! আমি ইম্প্রেসড!”
“তোমাকে ইম্প্রেস করতে তো সাজাইনি।”
তনয়া একটু অপমানবোধ করে বলল, “তা জানি। কিন্তু কাকে ইম্প্রেস করতে সাজিয়েছ শুনি?”
“নিজেকে।” ছোট্ট উত্তর দিল স্বরূপ।
তনয়া ওর কথা কানে নিল না। মাঝেমধ্যে লোকটাকে বিরক্তিকর লাগে। সে জিনিসপত্র একটু একটু করে গোছাতে শুরু করল। স্বরূপের ডাক শুনে একটু পরে উঠে পড়ল। বসার ঘরে গিয়ে দেখল সে দুই কাপ চা বানিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। তনয়া যেতেই বলল, “লাইট অফ করে দিয়ে এসে বসো।”
“অন্ধকারে চা খাবে?”
“অফ করো আগে তারপর দেখো কী হয়।”
তনয়া লাইট বন্ধ করে মুগ্ধ হয়ে গেল। বিশাল জানালা দিয়ে চাঁদের আলো গলগল করে ঢুকে যাচ্ছে। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। রূপার থালার মতো চাঁদটা আকাশে বসে বিলিয়ে দিচ্ছে সব রূপ।
স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “চা খেতে অসুবিধা হবে?”
“নাহ।” সে পাশে গিয়ে বসে চায়ের কাপ তুলে নিল।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর স্বরূপ বলল, “আজকে যে বইটা পড়তে নিলাম তার সাথে কিছু স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। সেজন্যই কিছুটা অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলাম সকালে।”
তনয়া মনে মনে বলল, “অন্যমনষ্ক না, কথাটা হবে আবেগী। কিন্তু আপনাকে তো তা বলা যাবে না। বললে বলবেন আপনার আবেগ টাবেগ কিছু নেই।”
স্বরূপ বলে গেল, “ওটা আমাকে একজন উপহার দিয়েছিল জন্মদিনে। পড়ার পর তার সাথে লম্বা আলোচনা হয়েছিল। তোমার বইটা অনুবাদ হলেও আমি পড়েছিলাম ইংরেজিতে। সে ইংরেজি সাহিত্য পছন্দ করত। ছাত্রীও ছিল ইংরেজি সাহিত্যের। ওর জন্যই অনেক বই পড়েছিলাম। চলে যাবার পর আর পড়িনি।”
তনয়া চুপ করে শুনল শুধু। আবার কিছুক্ষণ নিরবতা।
স্বরূপই ফের কথা শুরু করল, “ও সবসময় সেই টিচারের কথা বলত। তার গলায় পোয়েট্রি শুনলে নাকি পাগল পাগল লাগে। আমার রাগ হতো, অভিমান হতো। কিন্তু বুঝিনি মানুষটাই আমার নেই।”
তনয়া স্বরূপের একটা হাত ধরল। একসময় মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখনো ওকে ভালোবাসো?”
স্বরূপ তনয়ার হাতটা আঁকড়ে ধরল। হাত কাঁধে মাথা রেখে বলল, “না তনয়া, ভালোবাসি না। তবে সবটা ভালোবাসা আর বিশ্বাস তার জন্য একটা কাচের জারে জমিয়ে রেখেছিলাম। জারটা ভেঙে গেছে। আমার সব বিশ্বাস আর ভালোবাসা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার সেই ভালোবাসার টুকরোগুলোর জন্য কষ্ট হয়। কাউকে বিশ্বাস করতে না পারার জন্য কষ্ট হয়। তার দেয়া অপমানের জন্য কষ্ট হয়। আমি ভুলতে পারি না সেসব। তুমি বুঝবে না তনয়া। এতটা বিশ্বাসঘাতকতা চাইলেই ভোলা যায় না।”
তনয়া বুঝল, তার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। স্বরূপ কাঁদছে। ওর ভেতরটা কষ্টে মুচড়ে যাচ্ছে। তবুও তার মাঝে একটা স্বস্তি টের পাচ্ছে সে। ভালোবাসা না থাকুক, স্বরূপ তাকে ভরসা করতে শুরু করেছে। আপন ভাবতে শুরু করেছে। নয়তো এসব কথা তাকে বলত না। তার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতও না।
তনয়া চুপচাপ স্বরূপের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল যতক্ষণ না তার কান্না থেমে যায়। একসময় সে নিজেই সামলে নিয়ে উঠে বসল। ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তোমার খুব খারাপ লেগেছে এসব শুনতে তাই না?”
তনয়া সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “তুমি আমাকে সব বলতে পারো। যা মনে আসে সব বলে দিলে তুমি হালকা হবে। তোমার মনও। আমি তাতেই খুশি হব।”
স্বরূপ এবারও হাসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তার অপরাধবোধ হচ্ছে কিছুটা। তনয়ার জায়গায় অন্য কেউ হলে ঝগড়া করত প্রাক্তনের কাহিনী শুনে। আর এই মেয়ে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সে মনে মনে বলল, “তনয়া, তুমি এত আলাদা কেন? তুমি এত ভালো কেন?”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু