#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৯.
তনয়া ভেবেছিল স্বরূপ সন্ধ্যায় ফিরে তাকে না পেয়ে অবশ্যই ফোন করবে। কিংবা তাকে নিতে চলে আসবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। সে মোবাইল হাতে জানালার পাশে বসে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত কাটিয়ে দিল।
তনয়াকে হঠাৎ চলে আসতে দেখে আর ওর কান্না দেখে মা বেশ ভয় পেয়ে গেছেন৷ তনয়া কিছু বলছে না দেখে তার আশঙ্কা আরও বাড়ছে। স্বরূপকে ফোন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তনয়া শক্তভাবে নিষেধ করেছে স্বরূপের সাথে যোগাযোগের কোনো চেষ্টা না করতে৷ তিনি একটু পরপর এসে মেয়েকে দেখে যাচ্ছেন। রাত দশটায় যখন খেতে ডাকতে গেলেন তখন দেখলেন তনয়া বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছে। তার গায়ে ভীষণ জ্বর।
*
স্বরূপ অনেকবার কলিংবেল চাপল। দরজা খুলল না। আবারও কেঁদেকেটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে কি না এই আশঙ্কায় সে চাবি দিয়ে দরজা বাইরে থেকে খুলে ভেতরে ঢুকল। তবে ভেতরে পা দিয়েই তার মনে হলো তনয়া নেই। শোবার ঘরে গিয়ে ভালো করে দেখে বুঝল তনয়া ইচ্ছে করেই চলে গেছে। ঘরে তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর জায়গা ফাঁকা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্বরূপ। এজন্যই বিয়ে করতে চায়নি সে৷ নিজের তিতকুটে জীবনে অন্য কাউকে জড়ানোর কোনো ইচ্ছেই তার ছিল না। সে তো ইচ্ছে করে বিয়ে করেওনি, অন্যরা জোর করেছে, আর যাকে করেছে তারও ইচ্ছে ছিল। এখন তাকে দোষ দিয়ে তো লাভ নেই।
স্বরূপের গতকালের মেজাজ এখন অনেকটা ঠান্ডা। ভেবেছিল আজ ফিরে তনয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু ভালোই হলো। কয়েকদিন আলাদা থাকা উচিত। অন্তত তার মেজাজের উন্নতি হওয়া পর্যন্ত। এখানে থাকলে বরং আরও ঝগড়াঝাটি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সে ফোন করবে ভেবেও করল না। চলে যাওয়ার সময় তো তাকে বলার প্রয়োজন মনে করেনি। এখন সেই বা কেন যেচে পড়ে খোঁজ নিতে যাবে!
স্বরূপের ক্ষুধা লেগেছিল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল কিছুই রান্না হয়নি। সে ক্লান্ত শরীর নিয়েই রান্না বসিয়ে দিল। অল্প কিছু হলেও করতে হবে। মিলিও তো খাবে।
মিলি ফিরল একটু রাত করে। এসে যখন জানতে পারল তনয়া নেই, তখন সে একটু গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “আমি থাকায় তোদের কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“তোকে নিয়ে কিছু না। অন্য বিষয়ে ঝগড়া হয়েছে।”
“তাই বলে চলে গেল?”
স্বরূপ বলল, “এটা কোনো ব্যাপার না। একসাথে থাকলে ঝগড়া হয়ই। তুই হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়।”
খেতে বসে মিলি অনেকদিন পর স্বাভাবিক সুরে কথা বলল। তাকে বেশ সতেজ লাগছে আজ। স্বরূপের রান্নার বেশ প্রশংসা করল সে। দুজন একসাথে টেবিলটাও গুছিয়ে ফেলল।
স্বরূপ খাওয়ার পর নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েছিল, তখন মিলি দরজায় টোকা দিল, “আসতে পারি?”
স্বরূপ উঠে বসে বলল, “হ্যাঁ আয়।”
মিলি ঢুকল। তাকে দেখে স্বরূপের মনে হলো সে সাজগোজও করেছে। কারন কী?
মিলি বিছানায় বসে খুব সহজ গলায় বলল, “বাবা মাকে কী বলব ঠিক করে ফেলেছি।”
“কী বলবি?”
“আগে আমার দিকে তাকা। কী মনে হয়?”
“কী মনে হবে?”
“আরে আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে, আমি কোনো শোকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি?”
স্বরূপ একটু ভেবে বলল, “তোর চেহারা আগের থেকে খারাপ হয়ে গেছে।”
“আর কথা শুনে কী মনে হয়?”
“স্বাভাবিক।”
“হ্যাঁ, এভাবেই বাসায় যাব। ভাব দেখাব সব ঠিকঠাক আছে। কয়েকদিন এমনিতেই থাকব৷ হাসিখুশিভাবে দিন কাটাব। তারপর একসময় দুজনকে বুঝিয়ে বলব যে সাফাতের সাথে কোনোভাবেই বনিবনা হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও আমরা ব্যর্থ। সবাই তো সবকিছু পারে না। এত স্লোলি বিষয়টা বোঝাব যে তাদের একেবারে পুরো ধাক্কাটা লাগবে না। আর সত্যি কথা বলার তো প্রশ্নই আসে না।”
“কিন্তু আঙ্কেল আন্টি যদি কথা বলতে চায় সাফাত বা তার পরিবারের সাথে?”
“সাফাত তো আর নিজের দোষ স্বীকার করবে না৷ আর ওর পরিবারের লোক মা বাবার কথা জানে। তাদের আমি বলে দিয়েছি তাদের কিছু না বলতে। তারা কিছুই জানবেন না।”
“যাক, ভালো।”
“তোকে আর তনয়াকে কী বলে ধন্যবাদ দেব জানি না। সেদিন বাড়িতে গেলে আমি এভাবে যেতে পারতাম না৷ তোদের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম৷ এখন তুই ওঠ। আমাকে পৌঁছে দিয়ে আয়।”
স্বরূপ অবাক হয়ে বলল, “এখন যাবি?”
“হ্যাঁ।”
“আগে তো বলিসনি।”
“প্ল্যান অন্যরকম ছিল। ভেবেছিলাম পরশু যাব। আরেকটু সময় নেব। কিন্তু আজই যেতে হবে। তনয়া যেহেতু নেই, আমাদের এক ফ্ল্যাটে থাকাটা উচিত হবে না।”
স্বরূপ রেগে গিয়ে বলল, “তুই এত বেশি বুঝিস কেন? আমি মেয়ে হলে কি তুই থাকতিস না? বন্ধুত্বের মধ্যে ছেলে মেয়ের পার্থক্য হবে কেন?”
মিলি একটু হেসে শান্ত স্বরে বলল, “তোর সাথে যে তনয়া কিভাবে থাকে! এত শর্ট টেম্পার কেন তুই? শোন, আমার বাসায় যদি সাফাতের কোনো বান্ধবী এসে থাকত, আমি কখনোই মেনে নিতাম না। তনয়া তো অনেক বড় মনের। সে কতদিন আমাকে থাকতে দিল। আমাদের মনে কোনো সমস্যা নাই থাকতে পারে, কিন্তু বায়োলজিকালি আমরা অপজিট জেন্ডার এবং আমাদের কোনো রক্তের সম্পর্কও নেই। তাই এভাবে থাকাটা অনুচিত। তাছাড়া সমাজ বলেও একটা বিষয় আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, তনয়ার প্রতি আমার অনেকটা কৃতজ্ঞতাবোধ আছে। সেকথা ভাবলে আমি থাকতে পারি না।”
“তোকে দেখতে আধুনিক মনে হলেও ভেতরে ভেতরে তুই অনেক কনজার্ভেটিভ রয়ে গেছিস।”
“হ্যাঁ রে, ঠিক ধরেছিস। নইলে এই দশা দেখতে হতো না। সাফাত যা করছে, আমিও তাই করতাম। ওপেন রিলেশনশিপে থাকতাম৷ আর বাইরে বাইরে ম্যারেটাল স্ট্যাটাসও বজায় থাকত। কিন্তু সবাই তো সবকিছু পারে না। আমি ভেতরে ভেতরে পাক্কা ঘরোয়া বাঙালি নারী। যে যাকগে, এখন উঠতে হবে।”
“তার মানে তুই সত্যিই চলে যাবি?”
“হ্যাঁ। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। খাওয়ার জন্য আরও দেরি হলো। কিন্তু তুই নিজের হাতে রান্না করেছিস দেখে না খেতে যেতে পারলাম না৷ তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে যা, আমি ড্রইংরুমে বসছি।”
স্বরূপ কাঁধ ঝাঁকাল, “ওকে!”
স্বরূপ তৈরি হতে হতে মিলি তনয়ার মোবাইলে একটা মেসেজ পাঠাল,
“তনয়া, আমাকে নিয়েই হয়তো তোমাদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। আমি আসলে বুঝতে পারিনি এমন কিছু হতে পারে। আগেই বোঝা উচিত ছিল। আমার নিজের সংসার ভাঙার পর আমি চাই না আমার শত্রুর সাথেও এমনটা হোক। আর তুমি তো আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। আমি চলে যাচ্ছি নিজের ঠিকানায়। তুমিও নিজের ঠিকানায় ফিরে এসো। আর আমার কারনে কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিও।”
*
গাড়িটা মিলিদের বাড়ির সামনে আসতেই মিলি বলল, “ভেতরে যেতে হবে না, এখানেই রাখ। তোকে ভেতরে যেতে বলছি না সেজন্য স্যরি। মা বাবাকে জানতে দিতে চাই না যে তোর সাথে এসেছি।”
“ইটস ওকে! অন্য সময় আসব।”
মিলি গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার বসে পড়ে বলল, “স্বরূপ একটা অ্যাডভাইজ দেই। আজকের দিনে লয়্যাল জীবনসঙ্গী পাওয়া কত বড় ভাগ্যের বিষয় তুই জানিস না। যারা পায় না তারা জানে। তাই নিজের সম্পর্ককে হেলাফেলা করিস না৷ তোর মধ্যে কোনো আর্জ দেখলাম না বউকে ফিরিয়ে আনতে। এসব বিষয়ে যত সময় নষ্ট করবি, সম্পর্ক তত ফিকে হতে থাকবে। তনয়া ভালো মেয়ে। তুই ওকে ভালো রাখলে নিজে তারচেয়েও ভালো থাকবি।”
স্বরূপ শুনল। কিছু বলল না৷ মিলি বেরিয়ে চলে গেল গেটের ভেতর।
স্বরূপ ফোন ফেলে এসেছে ভুলে। রাত বাজে এগারোটা৷ বাড়ি ফিরতে ফিরতে স্লো একটা মিউজিক চালিয়ে দিল সে৷ তনয়ার কথা সত্যিই মনে পড়ছে। ও পাশে থাকলে হাবিজাবি কথা বলত, হাসত, দুষ্টুমি করত। এমনিতে বাসায় ফিরে তাকে পাওয়া যায়। আজ তাও যাবে না। স্বরূপের একবার মনে হলো শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়৷ তারপর আবার কী মনে করে গাড়িটা নিজের বাসার দিকেই নিয়ে চলল। তনয়ারও বোঝা উচিত সব পরিস্থিতিতে একরকম রোমান্টিকতা চলে না৷ সবারই একটা পার্সোনাল স্পেস থাকা উচিত।
*
তনয়ার জ্বর কমছে না দেখে ভয় পেয়ে তার মা স্বরূপকে বার কয়েক ফোন করলেন৷ ভাবলেন সে এলে হয়তো মেয়েটা একটু সুস্থ হবে। না জানি কত ঝগড়া করে এসেছে! কিন্তু স্বরূপ ফোন তুলল না৷
তনয়া সারাদিন কিছু খায়নি। মা ওর শিয়রে বসে মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে বারবার ডাকতে লাগলেন, “মা, ও মা, একটু তাকাও৷ কিছু খেতে ইচ্ছে করে? একটা কিছু মুখে দিলে তো ঔষধটা খাওয়াতে পারি।”
তনয়া অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে চাইল। বলল, “খাব।”
“কী খাবে মা?”
“ভাত খাব।”
মা তাড়াতাড়ি ভাত নিয়ে এলেন। কয়েক লোকমা ভাত মুখে তুলে দিলেন। কিন্তু তনয়া খেতে পারল না৷ বমি করে ফেলল। তার আরও দুর্বল লাগছে এখন।
*
বাসায় ফিরে স্বরূপ দেখল তনয়ার মায়ের মোবাইল থেকে বেশ কয়েকটা মিসড কল। তাও অনেকক্ষণ আগের। হয়তো মিটমাট করাতে ফোন করেছিলেন। ঘড়ি দেখল সে। বারোটা বাজে৷ এখন আন্টিকে ফোন করাটা উচিত হবে না। হয়তো শুয়ে পড়েছেন। তারচেয়ে কাল করা যাবে।
সে বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুতেই ঘুম এলো না। ইনসমনিয়া কি ফিরে এলো? সে গতরাতে ঘুমায়নি, আজ সারাদিন কাজ করেছে, তবুও চোখে ঘুম নেই। তনয়া কি সাথে করে তার ঘুমও নিয়ে গেছে?
বিয়ের পর থেকে স্বরূপের ঘুম ভালো হতো। বিছানায় শুয়ে তনয়ার গায়ের ঘ্রাণে ঘুম চলে আসত। স্বরূপ একসময় বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে বারান্দায় চলে গেল।
তনয়ার লাগানো গাছে হাস্নাহেনা ফুল মাতাল করা ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। যেদিন প্রথম এই গাছটাতে ফুল ফুটেছিল, তনয়া বাচ্চাদের মতো খুশি হয়েছিল। ওর মোবাইলের গ্যালারি ভর্তি এসব ফুলের ছবি।
আশ্চর্য তো! গতকালও এই বারান্দায় পুরো রাত কাটিয়েছে স্বরূপ। কাল তো এসব দেখে তনয়ার ছোটো ছোটো ব্যাপারগুলি মনে পড়েনি৷ সে ঘরেই ছিল সেজন্য? কে জানে!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু