#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৪|
দীর্ঘ সময় ধরে বাসে বসে আছি। ব্যস্ত শহরটা আজ বোধহয় একটু বেশিই ব্যস্ত। তাই তো বাস পিপীলিকার চেয়েও স্বল্পগতিতে চলছে। মাঝামাঝির দিকের একটা সিটে বসে আছি। মাথাটা জানালায় ঠেকিয়ে দিতেই মস্তিষ্কে পুরোনো কাহিনির বিচরণ শুরু হলো।
ঘটনা খুব আগের না। এই তো! আমি সে বছরের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আর কুঞ্জ ভাই দ্বাদশের ছাত্র। বয়সের দিক থেকে দু’জনেই তখন ইমম্যাচিউরিটিতে পিএইচডি করে ফেলেছিলাম। কথায় কথায় মণির কাছে ওঁর নামে অভিযোগের ঝুলি খোলা ছিল নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। ওদিকে কুঞ্জ ভাইয়েরও যেন এতে কিছুই হতো না। আমি মণির কাছে নালিশের ফাঁকফোকর দিয়ে যখন কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকাতাম, তখন তাঁর স্থির-নির্বিকার সেই দৃষ্টি আমার বুকের ঠিক এই বাঁ পাশটায় আঘাত হানত। বোঝাতে পারব না সেই অনুভূতির প্রখরতা।
রাহীর সাথেও তখন আমার তেমন একটা কথা হতো না। একই স্কুল, একই কোচিং, তার উপর মামাতো বোন! তবুও কোনো সখ্য ছিল না। রাহী বরাবরই একটু চুপচাপ প্রকৃতির মেয়ে ছিল, এখনও আছে। তবে আমি আগে অন্যরকম ছিলাম। একটু বেশিই একগুঁয়ে। কেউ নিজ থেকে এগিয়ে আমার সাথে কথা বলতে আসার আগ অবধি আমার মুখ থেকে টু শব্দটি বের করতে পারত না।
কুঞ্জ ভাই ছোটো থেকেই আমাকে পড়াতেন, এদিকে মণি আর মামাও আমাকে ঠিক নিজেদের সন্তানদের মতোই আদর করতেন। তাই তাদের সাথে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে লাগল নিবিড় সম্পর্ক।
আমার মতো কুঞ্জ ভাইও তখন অন্যরকম ছিলেন। একদম অ-ন্য-র-ক-ম। কখনও আমাকে বকতেন না, কখনই ধমক দিতেন না। একটু রাগী ছিলেন, তবে তা প্রকাশ করতেন না। সবসময় শান্ত থাকতেন। কখনও বিচলিত হতেন না। তাঁর নির্বিকার চাহনি ছিল খুব তীক্ষ্ণ, অসম্ভব রকমের ধারালো। কথা কম বলতেন। খু-ব মেপে মেপে। তবে তা ছিল বেশ গোছানো, পরিপাটি। তাঁর ব্যাক্তিত্ব আমাকে কেমন করে যেন টানত! বলাবাহুল্য, তাঁর অনমনীয় পৌরুষের কাঠিন্যতায়-ই হয়তো আমার মরণ ঘনিয়েছিল!
এমনও হয়েছে, উনি আমাকে লিখতে দিয়ে বসে থাকতেন। লিখতে গিয়ে আমার হাত খুব কাঁপত। কেননা আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তখন অনুভব করত, ওঁর তীর্যক দৃষ্টি যে আমাতেই সীমাবদ্ধ।
বুঝতে পারতাম— আমাকে পড়া-লেখায় ব্যস্ত রাখাটা নিছক এক বাহানা, উনি ভীষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন আমায়; যেন আমি ওঁর এইচএসসি সিলেবাস আর উনি সেই বোর্ড র্যাঙ্ক করা স্টুডেন্ট!
আমি তখন মোটেও তাড়াহুড়ো করতাম না। এক ঘণ্টার জায়গায় দু’ঘণ্টা ধরে লিখতাম। আনমনেই আমাকে তৃপ্তি নিয়ে দেখার সময়সীমা ওঁর জন্য আরও বাড়িয়ে দিতাম।
উনি শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে পড়াতে আসতে মিস দিতেন না। রোজ ৩ টায় কলেজ শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমাকে পড়াতে আসতেন। আম্মু অবশ্য বলত, এত কষ্টের প্রয়োজন নেই; অন্য টিচার খুঁজে নেবে।
উনি তখন শক্ত কণ্ঠে বলতেন, “আমি আছি। সমস্যা হচ্ছে না আমার।”
ব্যাস! আম্মু এর বিপরীতে কোনো কথা বলার আর সুযোগ পেত না। যখন কলেজের কোনো কাজে আটকে পড়েন, কিংবা খুব বেশিই ব্যস্ততায় জেঁকে বসেন; তখন আম্মুর ফোনে কল দিয়ে আমাকে শুধাতেন, “নবু, শুনছিস?”
বরাবরই বিছানায় কিংবা চেয়ারে পা দুলাতে দুলাতে ছোট্ট করে জবাব নিতাম, “হুঁ?”
তখন রোজকার মতোই ওঁর মুখস্ত প্রত্যুত্তর ছিল, “তোর কুঞ্জ ভাই আজ খুব খু-ব বেশিই বিজি। কাল এক্সট্রা সময় নিয়ে আসব। এখন আলমারিতে দ্যাখ, নতুন শাড়ি রেখেছি। তুই কি একটু সাজবি? এরপর না-হয় পিকগুলো হোয়াটসঅ্যাপ করে দিস। ঠিক আছে?”
কথাটি বলায় আমি অবাক হতাম না। মাঝে মাঝেই আলমারির সাইডের ড্রয়ারটিতে শাড়ি পেতাম। আমি জানতাম, এগুলো কার কীর্তি। দেখে সামান্য হেসে জায়গা মতোই থাকতে দিতাম। এরপর কুঞ্জ ভাই যখন এভাবে, এতটা আবদারের সুরে সেগুলো পরতে বলতেন, আমি তখন খুব যত্ন করে সাজতাম। আমি সেজে অনেকগুলো ছবি তুলতাম। ভালো-খারাপ সবটাই ওঁকে দিতাম।
উনি অনলাইন হয়েই আমার ইনবক্সে আসতেন। এরপর সেগুলোর সাথে কী করতেন, আমি জানতাম। কীভাবে জানতাম— এটা জানা নেই। শুধু জানতাম —উনি ছবিগুলো সেইভ করবেন এবং বাকিটা বিনিদ্র রাত মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে যাবেন।
আমি এসবের চাক্ষুস সাক্ষী নই, তবুও অকপটে বলতে পারি— উনি তাই করতেন। তবে, তবে, তবে! কখনও প্রকাশ করেননি উনি। অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলো চমৎকার হয়, তাই-না?
কিন্তু! সেদিন উনি আসেননি। একা বাসায় অপেক্ষা করেছি সন্ধ্যে অবধি। অথচ, অপেক্ষাকৃত সুখ আমার এলেনই না! সেদিন উনি কল দিয়ে বলেননি, “নবু, তোর কুঞ্জ ভাই আজ খুব বিজি। তুই কি একটু সাজবি?”
কিচ্ছু বলেননি। সেদিন প্রথমবারের মতো নিজে থেকে শাড়ি পরেছি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, চোখের কাজল চিন্তায়-ঘামে লেপ্টে গেছে। বিনুনি গাঁথা চুলগুচ্ছ সামনে থেকে দু’গাছি বেড়িয়ে গেছে। এভাবে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। প্রথমবার কিশোরী নবনীতাকে এই রূপে আবিষ্কার করেছি আমি। খারাপ নয়, কেমন যেন বড়ো বড়ো লাগছে।
আপিকে না বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছি। আম্মু বাসায় নেই, জানি না— কোথায়। ডানে-বামে না তাকিয়ে সোজা মামার বাসায় চলে এসেছি। বেশ কয়েকবার থেমে থেমে কলিং বেল বাজানোর পর রাহী দরজা খুলে দিয়েছিল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাহীর ফরসা লালচে মুখখানা দেখতে পেলাম। থেকে থেকে ফোঁপাচ্ছিল ও। ওর এই অবস্থা দেখে অজানা এক ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল। আমি দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করে ওকে শুধালাম, “কী হয়েছে, রাহী? কাঁদছ কেন?”
রাহীর ফোঁপানো এবার সত্যি সত্যিই কান্নায় পরিণত হলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, “জানো? ভাইয়া খুব সিক। আমি ওকে কখনও এভাবে দেখিনি। কেমন করে মাকে জড়িয়ে ধরে ছিল ও! আমার.. আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ওর জন্য।”
আমি কী বলব— বুঝতে পারছিলাম না। রাহীর সাথে আমার আবেগ বিনিময়ের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু মানবতার খাতিরে হলেও তখন আমার কিছু একটা বলা খুব প্রয়োজন ছিল। হয়তো অসুস্থতার খবর অন্য কারো হলে আমি ওর কাঁধে হাত রেখে কিংবা দু’হাতের বেষ্টনীতে ওর মুখটি তুলে ধরে বলতাম, “ইশশ্, পাগলী মেয়ে! কেঁদে কেঁদে এত সুন্দর মুখখানির কী হাল করেছ! চিন্তা কীসের, হুঁ? আমরা দু’জন আছি না? জাদু করে তোমার ভাইটার সব অসুখ দূ-র করে দেব। তুমি একদম কাঁদবে না। কাঁদলে তোমায় কষ্টের দেবী লাগে। তুমি হাসবে। খুব হাসবে। চলো, অসুস্থতাকে বিদায় জানাব, এক্ষুনি। আমার রাহী হাসবে কি এবার?”
কিন্তু এসব কথা বলা হলো না। আমার মন তখন বিষাদে ডুবে গেছে। রাহীর কথাগুলোকে একপ্রকার উপেক্ষাই করলাম, তবে এই মেয়েটিকে করতে পারলাম না। ভরসার হাতটি দিয়ে শক্ত করে ওর হাতটি চেপে ধরে সামনে এগোলাম। সেই হাত কি মেয়েটি ছাড়তে পেরেছিল?
কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের সামনে এসে দেখি, মণি ওঁর হাত ধরে মাথা নিচু করে কাঁদছে। আম্মু স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে আর উনি বিছানায় হেলান দিয়ে খেয়ে যাচ্ছেন। রক্তিম চোখ দুটো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, জ্বর ১০২° এর উপরেই হবে। মুখটি কেমন শুকনো দেখাচ্ছে! এক দিনের জ্বরেই কী অবস্থা!
কুঞ্জ ভাই হয়তো কিছুক্ষণ আগের বলা কোনো কথার পরিপ্রেক্ষিতেই বলে উঠলেন, “এখন ঠিক আছি আমি। তোমরা শুধু শুধু চিন্তা করছ! মা, কান্না থামাও না রে! ভালো লাগে না তোমার কান্না।”
মণি কান্না থামানোর অযথা চেষ্টা করছে। আম্মু রাগী স্বরে বলল, “এভাবে জ্বর বাঁধিয়ে বলছ, চিন্তা না করতে? সুস্থ হয়ে নাও, আমাদের হাতে মার পাওনা রইলে।”
এরই মাঝে মণি আমাকে দেখে ফেলল। ততক্ষণে মণির ফোঁপানোও প্রায় বন্ধ হয়েছে। আমাকে দেখে মলিন হেসে বলল, “কী রে! নবু, এসেছিস?”
আমি কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, “হুঁ।”
সেদিকে তাকিয়েই রাহীর হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করলাম। কুঞ্জ ভাই তাঁর আধখোলা গাঢ় বাদামি চোখের ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। অসুস্থ কুঞ্জ ভাইটা যেন আফিমের চেয়েও নেশালো এক নেশাদ্রব্য। আমি দৃষ্টি মেলাতে পারলাম না। লোকটার এই অবস্থা! অথচ কেউ আমাকে জানায়নি! জানাবেই বা কেন? কে আমি? কারোও কেউ না।
তীব্র অভিমানি দৃষ্টি মণির দিকে নিবদ্ধ করে শুধালাম, “তা তোমার গুণধর ছেলের এ-দশা হলো কী করে?”
আম্মু সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে উঠলেন, “আহ, নবনী! হচ্ছেটা কী? বড়োদের সাথে এভাবে কথা বলতে হয়? আর এই সন্ধ্যায় এখানে একা এলে কেন? বারণ করেছি না, সন্ধ্যার পর রাস্তায় একাকী চলতে?”
আমি গাল ফোলালাম। মণি আমাকে এভাবে দেখে হেসে ফেলল। এতক্ষণে নালিশ করার উপযুক্ত কাউকে পেয়ে গেল। অভিযোগের সুরে বলে উঠল, “আর বলিস না! রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছিল। এর আবার বৃষ্টি সয় না। কয় ঘণ্টা ভিজে এরকম জ্বর বাঁধিয়েছে, এই গাঁধাটা বলছেই না। কখন ভিজল… জ্বর বাঁধাল— কিচ্ছুটি জানি না। সকালে কলেজের জন্য না উঠায়, এসে দেখি বিছানা নিয়েছে এটা। তারপর গা কাঁপিয়ে জ্বর বাড়ল। সন্ধ্যার পরপর নেমেছে।”
প্রথমবারের মতো আমি অগ্নি ঝরানো চোখে কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। গতরাতে বৃষ্টি হয়েছিল। ১১টা থেকে ভোর ৬টা অবধি। আমি শুরুর দিকে ছাদে ভিজেছিলাম। এরপর ধোঁয়া ওঠানো কফি নিয়ে ভোর অবধি বৃষ্টি বিলাসে মত্ত ছিলাম। নিকষ কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে হঠাৎ বজ্রপাত হওয়ায় আলোর একছটা গিয়ে পড়ে পাশের রাস্তাটিতে। সেই আলোতে ভিজে জুবুথুবু হয়ে একদৃষ্টিতে আমার ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে থাকা ব্যক্তিকে এক ঝলক দেখে কুঞ্জ ভাই ভেবে বসাটা তবে নিছকই আমার মনের ভুল ছিল না!
চলবে…