সুখ নীড় পর্ব-৩২

0
305

#সুখ_নীড়
#পর্ব_৩২

সকালবেলা জয়ীতা আযানকে নেবার জন্য চৈতীর রুমে গেল। সারারাত ঘুম আসেনি তার। গতকাল আযানের টীকা কার্ডটা হাতে পেয়ে তার মাথা বনবন করে ঘুরছে। আযানের মা বাবার নামের জায়গায় তার আর পল্লবের নামের পরিবর্তে চৈতী আর কল্লোলের নাম লেখা। এজন্যই তাকে টীকা দিতে যাবার সময়ও তাকে নেয়া হয় না। কোনোকিছু নিয়েই সে জোরাজুরিতে যেতে পারে না। এরা এতটা কৌশলে তাকে দূরে সরিয়ে রাখে সবকিছুতে!
আজকাল আযানকে তার কাছে দেয়া হয় খুব কালেভদ্রে। জয়ীতা সাহস করে কিছু বলতেও পারছে না। কিন্তু কাল সারারাত ধরে সে চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখনি সবার সাথে কথা না বললে তার জন্য একটা কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। সে যেটাকে তাদের ভালোবাসা মনে করছে সেটা কোনোভানেই ভালোবাসা হতে পারে না। আসলে তার কাছ থেকে তার ছেলেকে দূরে সরানোর জন্য এসব নাটক চলছে। তাছাড়া টীকা কার্ডে আযানের পরিচয় মিথ্যা দেওয়া হয়েছে। এদের উদ্দেশ্য যে ভীষণ নোংরা এটা মোটামুটি সে আন্দাজ করে ফেলেছে। এভাবে চলতে থাকলে তার ছেলে আযান তাকে মা না ভেবে বরং চাচী ভাববে আর চৈতীকে মা। ইতিমধ্যেই কাগজে কলমে মা বাবার জায়গাটা দখল করার পায়তারা শুরু করে দিয়েছে।

এদের মনে কী চলছে এটা তো সে জানে না। তবে এটা বুঝতে পারছে আযানকে তার থেকে এই দূরে রাখা তার নিজের জন্য ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে না৷ আযান পল্লবের রেখে যাওয়া একমাত্র স্মৃতি। অথচ সে চাইলেও আযানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারে না। তাকে এটা সেটা বলে নানান কাজে ব্যস্ত রাখা হয় আর আযানের থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়।

চৈতীর রুম ভেতর থেকে লক করা। কয়েকবার নক করেও কোন সাড়া শব্দ না পাওয়ায় জয়ীতা খুব জোরেসোরে দরজা ধাক্কাধাক্কি শুরু করল। আসলে চৈতী জেগেই আছে। ইচ্ছে করেই জয়ীতার শব্দ শুনে দরজা খুলছে না।
কারণ সে জানে জয়ীতা তার ছেলে আযানকে নিতেই এখানে এসেছে। গতরাতে কয়েকবার এসে জয়ীতা আযান-কে তার কাছে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও দিচ্ছে দিচ্ছে বলেও আযান-কে তার রুমে পাঠায়নি।

দরজার খটখট শব্দে এত জোরে হচ্ছিল যে জয়ীতার শাশুড়ির ঘুম ভেঙ্গে গেল।

সাজেদা চৌধুরীর কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় জয়ীতার উপর চরম ক্ষেপে গেলেন।

– কী হচ্ছে এসব? সকাল-সকাল অসভ্যের মতো এরকম চিৎকার চেঁচামেচি করছ কেন?

– আমি…. আমি দুঃখিত! আমি আসলে আযানকে নিতে এসেছি। অনেকক্ষণ ধরেই আস্তে আস্তে নক করছিলাম। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ না আসায় আমি জোরে জোরে নক করেছি। কালকে বাবুকে টীকা দেওয়া হয়েছে। ওর হালকা জ্বরও এসেছে। তাই!

– এত সকাল-সকাল আযানকে নিতে আসার কী আছে? সে কি পর মানুষের কাছে আছে? তোমার এত চিন্তা কিসের? তাছাড়া এমন তো না যে ছেলেটাকে এক ফোঁটা বুকের দুধ খাওয়ানোর মুরোদ আছে তোমার!

– আম্মি, এটা কেমন কথা বলছেন? আল্লাহ না চাইলে আমি কীভাবে!

জয়ীতার কষ্টে বুকের মাঝে তোলপাড় শুরু হলো। তার বাচ্চার প্রিম্যাচ্যুরিটির কারণে বুকে দুধ আসতে দেরী হয়েছে। তার উপর সে নিজেও পল্লবের শোকে এতটা বেখেয়ালি হয়ে পড়েছিল যে নিজের খাবার দাবারের দিকে কোনো খেয়াল ছিল না। পাগলের মতো এর দ্বারে ওর দ্বারে দৌড়েই সময় গিয়েছে। তাই ধীরে ধীরে তার বুকের দুধ শুকিয়ে গেছে। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছে সাজেদা চৌধুরী আর চৈতী। যাও একটু আশা ছিল তাও আযানকে কাছে না দিতে দিতে জয়ীতার পুরো সর্বনাশ করে ছেড়েছে। আযানকে গুড়ো দুধের ওপরে ভরসা করেই বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে এখন।

– কাল রাত থেকে আযানকে আমার কাছে নিতে পারিনি। একটা দুধের বাচ্চা সারারাত ধরে তার মায়ের কাছ থেকে দূরে। আমি চিন্তা করব না তাহলে ওর জন্য কে চিন্তা করবে?
কথাটা কিছুটা প্রশ্নের মতো করেই সে তার শাশুড়িকে বলল।

– তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি! তুমি আমাকে প্রশ্ন করছ! যে বাচ্চা মায়ের বুকের দুধই পায় না সে আবার মায়ের কাছে গিয়ে কী করবে! মায়ের সাথে একটা বাচ্চার আসল সম্পর্ক থাকে যে কারণে তুমি সেখানেই ব্যর্থ! আযানের জন্য তোমার ভাবনা না করলেই হবে। আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ কাউকে ভাববার প্রয়োজন নাই।

শ্বাশুড়ীর কথায় সেই পুরানো সুর টের পেয়ে জয়ীতার রক্ত টগবগ করে উঠল।

– আমি আপনার এ কথার পিঠে অনেক কিছুই বলতে পারতাম। কিন্তু ইচ্ছে হচ্ছে না। শুধু এটুকু বলব মায়ের থেকে বেশি দরদ দেখানোটা মেকি হয়ে গেল না?

– হোয়াট? কী বলতে চাচ্ছ তুমি!

– আপনি যেটা বুঝতে পারছেন আমি সেটাই বলেছি। আযান আমার সন্তান। আর আপনি ওর দাদী। দাদীকে দাদীর স্থানে থাকাই ভালো। আযানের জন্য আপনার খুব চিন্তা হচ্ছে, আযানকে নিয়ে আপনি খুবই ভাবেন, ওকে আদর করেন এটা দেখে আমার খুব ভালো লাগে। ওর নসিবে বাবার আদর ভালোবাসা কোনোটাই জোটেনি। হয়ত আপনাদের এই ভালোবাসা ওর সেই অভাবটা কোনোদিন পূরণ করতে পারবে না তারপরও কিছুটা হলেও ওকে স্বস্তি দিবে।

– এটা যদি বুঝোই তাহলে তুমি ওকে নেওয়ার জন্যে এত উতলা হয়েছ কেন?

জয়ীতা উনাদের খারাপ উদ্দ্যেশ্য সম্পর্কে এবার পুরোপুরি নিশ্চিত। মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল।

– একজন মা তার সন্তানকে কাছে নিতে চেয়েছে এখানে উতলা হওয়ার কী দেখলেন! দিনের পর দিন আপনারা সবাই মিলে আযানকে আমার থেকে দূরে রাখছেন! আমি কি কিছু বুঝতে পারছি না ভেবেছেন?

– কী বুঝতে পারছ তুমি? কিছুই বোঝোনি! আযান এই বংশের ছেলে। তাকে কীভাবে টেইক কেয়ার করতে হবে সেটা তোমার জানার কথা নয়। চৈতী সবকিছু ভালো করে বুঝে। এজন্য আযানের দায়িত্ব আমি চৈতীর উপরে দিয়েছি। এছাড়া আর কিছু বোঝাবুঝি নেই এখানে। যাও, রুমে যাও। আযানকে নিয়ে এত টেনশান করতে হবে না।

রাগে থরথর করে কাঁপছে জয়ীতা।

– মানে? আমার ছেলের দায়িত্ব আপনি তাহলে চৈতী ভাবিকে দিয়েছেন? আযানের বাবা নেই তাই বলে ওর মা তো এখনো মরে যায়নি। আমি মরে গেলে তখন না হয় দায়িত্বটা ভাগ বাটোয়ারা করে নিতেন।

– দেখো মেয়ে! এত বেশি বুঝো না! তুমি একটা লো ক্লাস ফ্যামিলি থেকে উঠে এসেছ। তোমরা যেভাবে একটা বাচ্চাকে টেইক কেয়ার করো আমরা সেভাবে করি না। আমি চাই না আযানের বেড়ে ওঠায় একফোঁটা কোনো ত্রুটি হোক। চৈতী তোমার মতো ফ্যামিলি থেকে আসেনি। বড়ো ঘরের মেয়ে সে। তাছাড়া চৈতী অলরেডি একটা বাচ্চাকে বড়ো করেছে, ও সবকিছু জানে বোঝে। তাই আযান-কে ওর হাতে দিয়েছি আমি।

– আপনি আমাকে হাসালেন, আম্মি। পৃথিবীতে এমন কোন মা আছে যে তার সন্তানের খারাপ চায়। আমি লো ক্লাস হই নাকি হাই ক্লাস আমার সন্তানের বেড়ে ওঠায় আমি নিশ্চয়ই কোনো অভাব রাখব না। আপনি কার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার সন্তানের দায়িত্ব চৈতী ভাবিকে দিয়েছেন?

– কার কাছে জিজ্ঞেস করে মানে? আমার কি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে নাকি? এই ফ্যামিলিতে যে আমি কাউকে জিজ্ঞেস করে কোনো কাজ করি না এটা ভুলে গেছ মনে হচ্ছে?

– না, সেটা ভুলব কেন? সেটা ভোলার কথাও না। আপনার ফ্যামিলির নানান ব্যাপারের সাথে আমার সন্তানকে গুলিয়ে ফেলছেন মনে হচ্ছে। আযান আমার নাড়ীছেঁড়া ধন। আপনার সম্পদ বা আপনার সন্তান সবার উপরে আপনার শতভাগ অধিকার থাকতে পারে কিন্তু আমার ছেলের উপরে আমার থেকে নিশ্চয়ই আপনার অধিকার বেশি না। তাই আমার ছেলেকে নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সেকেন্ড টাইম একবার চিন্তা করবেন। হ্যাঁ, আপনি আযানের দাদী। তাই ওর লাইফের অনেক ডিসিশন নেয়ার অধিকার আপনার আছে, তাই বলে আমার থেকে নিশ্চয়ই বেশি নয়।

– আজ থেকে একটা কথা স্পষ্ট জেনে রাখো। আযান তোমার ছেলে হতে পারে তাই বলে আযানের লাইফে কোন ইন্টারফেয়ার করতে আসার সাহসও দেখাবে না। আযান পৃথিবীতে কোনো কিছুর অভাব নিয়ে বেড়ে উঠবে না। তার মনে বিন্দু মাত্র কষ্ট থাকুক এটা আমি চাই না।

– বাহ! ওর জীবন থেকে ওর বাবাকে তো অলরেডি সরিয়েছেনই এবার ওর মাকেও সরিয়ে দিতে চাচ্ছেন?

– মুখ সামলে কথা বলো। ওর বাবাকে সরিয়ে দিয়েছি মানে?

– সেসব পুরনো ইতিহাস ঘাটতে চাই না। প্লিজ,ভাবিকে দরজা খুলতে বলুন। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে চাই।

– আজকে যেসব কথা বলার স্পর্ধা তুমি করেছ এরপর ভুলেও ভেবো না আযানকে যতটুকু সময় তুমি কাছে পেতে ততটুকুও পাবে! আজ থেকে সে চৈতীর কাছেই থাকবে। রুমে যাও। আর যদি আমার কথা ভালো না লাগে বাড়ির মেইন দরজা খোলা আছে বেরিয়ে যেতে পারো।

-মানে কি? আমি আপনার বাড়িতে থাকার জন্য আসতে চাইনি আর থাকতে চাইও না। আমি এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাব আপনি শুধু আমার ছেলেকে দিন।

চৈতী দরজার ওপাশে বসে সবকিছু শুনছিল। সে ইচ্ছে করেই দরজা খোলেনি! কারণ জয়ীতাকে সে চেনে। জয়ী সহজে দমে যাবার পাত্রী না। আযানকে নিয়ে যদি কোনো হাঙ্গামা তৈরি করে ওর সাথে সে পারবে না। তাই ইচ্ছে করেই দরজা বন্ধ করে বসে আছে।

জয়ীতা নিজেকে কোনোমতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। সে চৈতীর রুমের দরজার উপর ধুমধাম লাথি মারতে শুরু করল। শব্দের চোটে ভেতর বসে চৈতী কেঁপে উঠছে। ভাগ্যিস কল্লোল বাসাতে নেই। না হলে জয়ীতার সাথে এতক্ষণে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত।

কোন মায়ের পক্ষে এসব কথা শোনার পর শান্ত থাকা সম্ভব! জয়ীতা রাগে গরগর করছে আর একাধারে দরজার উপরে লাথি ঘুষি মেরে যাচ্ছে। আর সাথে চিৎকার-চেঁচামেচিতো আছেই ।

” আমি আমার ছেলেকে চাই। আমি আমার আযানকে চাই।”

কিন্তু কে শোনে কার কথা! জয়ীতার চোখের পানি আর চিৎকার কোনোটাই ছুঁয়ে যেতে পারছে না পাষণ্ড সাজেদা চৌধুরীর মনকে। উল্টা দূরে দাঁড়িয়ে জয়ীতাকে থামানোর বদলে তার এমন দুর্বিষহ অবস্থা খুব এনজয় করছে।

জয়ীতা নিরুপায় হয়ে রুমে ফিরে গেল। কী করবে মাথায় আসছে না তার। কোন কুক্ষণে যে এ বাড়িতে এসেছিল!
বনে থেকে কি সিংহের সাথে লড়াই করা যায়! এটা সে মোটামুটি নিশ্চিত যে আযানকে তার থেকে কেড়ে নেবার জন্যই তাকে এত আদর আপ্যায়ন করে এ বাড়িতে আনা হয়েছে। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে সে ৯৯৯ এ কল দিলো।

অল্প সময়ের মধ্যেই বাড়িতে পুলিশ এলো। পুলিশের কথা শুনে সবাই ড্রইং রুমে আসলো।
পুলিশ দেখে বাড়ির সবার চোখ ছানাবড়া। এত বড় সাহস এই মেয়ের যে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডেকেছে।

– আপনারা এনার থেকে তার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছেন? এটা কি সত্যি?

– কথাটাকে আমি মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেব না। হ্যা, এটা সত্যি। ওর বাচ্চাকে ওর থেকে কেড়ে নিয়েছি।

এত সহজে উনি সত্যিটা স্বীকার করবে এটা জয়ীতা ভাবেনি। সে তো রীতিমতো অবাক। তবে পরের কথাটুকু শুনে সে অবাক না, হতবাক।

– আযান এই বংশের ছেলে। সে আমার একমাত্র বংশধর। আমার পল্লবের শেষ স্মৃতি। আমাদের কাছে কতটা আদরের সেটা নিশ্চয়ই আপনাদের বলে বোঝাতে হবে না। আপনারা জানেন যে কিছুদিন আগে একটা দুর্ঘটনায় আমার ছেলেকে হারিয়েছি।
আমার ছেলের বউ মানে যে আপনাদের কাছে অভিযোগ করেছে সে মাত্র তার হাজবেন্ডকে হারিয়েছে। ওর মানসিক অবস্থা মোটেই স্বাভাবিক নয়। আমাদের বিরুদ্ধে আপনাদের কাছে অভিযোগ করেছে এতে আমি মোটেই বিচলিত হয়নি বা কোন ধরনের কষ্টও পাইনি। ওর জায়গায় আমি হলেও হয়তো এটাই করতাম। মাত্র স্বামীকে হারিয়েছে তাই এমনটা করা অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া ওরা একজন আরেকজনকে পাগলের মত ভালোবাসত। এতটাই ভালোবাসতো যে ওর জন্য আমার ছেলে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। সেই মানুষটাই ওর জীবন থেকে হারিয়ে গেল। কতটা কষ্ট হচ্ছে ওর, সেটা হয়ত আমি আপনি অনুভব করতে পারব না।

আজান প্রিম্যাচিউর বেবি। এক হিসেবে বলা যায় মৃত্যুর সাথে লড়াই করে সে বেঁচে ফিরেছে।এখন প্রয়োজন এক্সট্রা কেয়ার। অথচ জয়ীতা কিছুই করতে পারছে না। পল্লবের চিন্তায় মগ্ন থাকতে থাকতে নিজেকে অসুস্থ তো করেছেই, আমার নাতীটাকেও অসুস্থ করে ফেলেছে। ওর খাওয়া-দাওয়া, ঘুম সবকিছু নিয়ে এত খেয়াল করি তারপরেও মেয়েটা সবদিকে বেখেয়াল। ক’দিন ধরে তার নিজেরই খাওয়া-দাওয়া পুরোপুরি বন্ধ। ওর খাওয়া-দাওয়া বন্ধ থাকলে এতোটুকু বাচ্চার খাওয়া আসবে কোথা থেকে আপনারা বলুন। তারপরেও যদি বাচ্চাটার দিকে একটু নজর দিতো। এসব দেখে শুনে ডাক্তার সাজেস্ট করেছেন বাইরের খাবার দিতে। সেটাও সময়মতো দেওয়ার কথা তো দূরে থাক, নিজের যত্নের কথাটাও ভুলে যায় মেয়েটা।সাইকাট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাব সেই উপায়ও নেই। ছোটো বাচ্চা তো সে না যে জোরাজুরি করব। তাই বাচ্চাটাকে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে আমি আমার বড় বৌমার হাতে তুলে দিয়েছি।
জয়ীতাকে দেখে আপনারা হয়ত ভাবছেন সে পুরো সুস্থ একজন মানুষ। কিন্তু মাঝে মাঝে সে কী করে আর কী না করে নিজেও হয়তো ভুলে যায়। বাচ্চাটার খাবার-দাবার, গোসল করানো, ন্যাপি ক্লিন করা কোনো কিছুর দিকে ওর হুঁশ নেই। এসব করে যদি আযানের বড়ো কোন সমস্যা বাঁধিয়ে ফেলে তার জবাবদিহিতা কে করবে বলুন। এই পৃথিবীতে এখন এই মুহূর্তে সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমার কাছে আযান। ওর জন্য একচুল ছাড় দিতেও আমি রাজি না। তার জন্য আমাকে যদি কেউ স্বার্থপর মনে করেন তবে হ্যাঁ, আমি স্বার্থপর। আমাকে যদি নিষ্ঠুর মনে করেন, আমি নিষ্ঠুর। আর এ কথার সত্যতা যদি যাচাই করতে চান তাহলে বাড়ী ভর্তি মানুষ আছে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে নিবেন।

মুহূর্তেই এতো চমৎকার করে গল্পের প্লট সাজিয়ে সবার সামনে উপস্থাপন করল। জয়ীতা তো নিজেই অবাক।

– হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে। হঠাৎ মনে পড়লো টীকাকার্ডের কথা। দ্রুত যেয়ে টিকা কার্ডটা নিয়ে আসলো।

টিকা দিয়ে এসে চৈতী তড়িঘড়ি করে কার্ডটা ড্রইংরুমে ভুলে রেখে গিয়েছিল। সেখান থেকেই পেয়েছে জয়ীতা। ইচ্ছে করে সে শ্বাশুড়ির কাছে আগে কিছু বলেনি। প্রমাণ হিসেবে রাখার জন্য কার্ডাটাকে লুকিয়ে রেখেছিল নিজের কাছে।

– জয়ীতা টীকা কার্ডটা দেখিয়ে বলল, এগুলো কি তাহলে মিথ্যে? যে সন্তানকে আমি নয় মাস গর্ভে ধরে জন্ম দিলাম তার মা-বাবার নামের স্থানে আমার নামটা কোথায়? ওকে যে জন্ম দিয়েছে আপনার আদরের ছেলে পল্লব তার নামটাই বা কোথায়? নাকি বলবেন এগুলো আমার বানানো?

টীকা কার্ডটা দেখার পরে সাজেদা চৌধুরীর মেজাজ গরম হয়ে গেল। কটমট করে চৈতীর দিকে একবার তাকাল ।

অফিসার মতিন সাহেব টিকা কার্ডটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন!দেখে বললেন, এই অভিযোগের ব্যাপারে আপনার কিছু বলার আছে?

– অবশ্যই বলার আছে। বলার থাকবে না কেন?স্মার্টলি জবাব দিলেন, সাজেদা চৌধুরী।
কিছুক্ষণ থেমে পরে বললেন,

দেখুন, আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি কোনোমতেই আযান-কে কোনো ধরণের কষ্ট নিয়ে বড়ো হতে দেব না। আযানের বাবা নেই এই কষ্ট যেন কিছুতেই সে অনুভব করতে না পারে এজন্য এই মুহূর্তে এটাই আমার কাছে বেস্ট সলিউশন মনে হয়েছে। ও যখন বড়ো হবে, স্কুলে যাবে দেখবে সবার বাবা আছে , ওর নেই। সেই কষ্ট ওর জন্য কতটা ভয়ানক হবে একবার ভেবে দেখেছেন?

তাছাড়া জয়ীতার মানসিক অবস্থা যেভাবে দিনদিন খারাপ হচ্ছে তাতে ওর উপরে আমার একদম ভরসা নেই। দিনের মধ্যে দশবার আমাকে হুমকি দেয় আযানকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার।

তাহলে বলুন, আমি কোন ভরসায় এতকিছুর পরেও ওর হাতে আমার বংশের প্রদীপকে তুলে দিব?
জয়ীতার অতীত ইতিহাস একটু ঘেঁটে থাকবেন,
ও কীভাবে এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল, কীভাবে আমার ছেলেটাকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে আলাদা করে রেখেছিল, একথা এ বাড়ির সবাই জানে। ওর মত মেয়ে দ্বারা সবই সম্ভব। এজন্য ওকে আমি কোনো ভরসা পাচ্ছি না। ওর এতো অন্যায়ের পরেও সব ভুলে আমি আমার নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে এবাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। আমি চাইলে তখন ওকে রেখেই শুধুমাত্র আমার নাতিকে নিয়ে আসতে পারতাম কিন্তু আমি এতটা পাষণ্ড না। আমি সেটা করিনি কারন একজন মায়ের থেকে তার সন্তানকে আলাদা করতে আমি কোনোমতেই পারব না। আমি নিজেও একজন মা। সন্তান হারানোর কষ্ট কতটা ভয়ঙ্কর সেটা আমি প্রতিটা মুহুর্তে টের পাচ্ছি। কথাগুলো বলতে বলতে টিস্যু বক্স থেকে একটা টিস্যু বের করে নিজের চোখ মুছলেন সাজেদা চৌধুরী।

এতটা নিষ্ঠুর মানুষ কী করে হতে পারে ? এই মানুষটার কি একটু মরার ভয়ও নেই? জয়ীতার মুখে একটা কথাও নেই। দাঁড়িয়ে এসব ভাবম্নায় মগ্ন সে।

কী বলে সে সাজেদা চৌধুরীর কথার উপর কোনো কথা বলবে বা প্রতিবাদ করবে। তাদের থেকে এতটা অমানবিকতা সে আশা করেনি। পুরাই থ হয়ে গেছে জয়ীতা।

– দেখুন, এটা আমাদের পারিবারিক ঝামেলা। সব সংসারেই একটু টুকিটাকি ঝগড়া বিবাদ হয়। তারপরেও আপনাকে ডাকা হয়েছে। যদি মনে হয় এখানে আমার কোনো অন্যায় আছে আপনি আপনার ব্যবস্থা নিতে পারেন।

মতিন সাহেব জয়ীতার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখুন! সবই তো শুনলাম, আপনার কি কিছু বলার আছে?

জয়ীতা নির্বাক। চোখ দিয়ে শুধু দরদর করে পানি পড়ছে।

চলবে…….

পর্ব- ৩১

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/532282651887742/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here