#রঙিন_দূত – ৩৭
লাবিবা ওয়াহিদ
————————–
কলিংবেলের শব্দে হৃধির সম্বিৎ ফেরে। সাথে শ্রবণ হয় রাবেয়া খাতুনের তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর।
–“হৃধি, দরজাটা খুল তো! আমি কাজ করছি!”
হৃধি বিনা-বাক্যে বেলকনি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। চুল খোপা করতে করতে দরজার সামনে গিয়ে থামলো। অতঃপর মাথায় ওড়না টেনে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতে মাহিনের হাসি-মুখ দর্শনে এলো। হৃধি গোল গোল চোখে একপলক মাহিনকে দেখে মাহিনের হাতের দিকে লক্ষ্য করলো। একি, এত শপিং ব্যাগ? কার জন্য!? হৃধি প্রশ্ন করার জন্যে প্রস্তুতি নিতেই মাহিন বলে ওঠে,
–“ওহ হৃধি, দাঁড় করিয়ে রাখবেন নাকি?”
মাহিনের কন্ঠস্বর পেতেই রাবেয়া খাতুন কাজ ফেলে দ্রুত চলে আসে। মেয়েকে হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাবেয়া খাতুন হৃধিকে ধমকালেন।
–“এটা কেমন অভদ্রতা হৃধি? ছেলেটাকে ভেতরে আসতে বলবি তো। এভাবে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
হৃধিকে অপ্রস্তুত দেখালো। হৃধি নিজেকে তটস্থ করে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সরে দাঁড়ায় এবং মিনমিন স্বরে বলে,
–“আ..আসুন!”
মাহিন মুচকি হেসে ভেতরে প্রবেশ করে। মাহিনের হাত জোড়ায় এত শপিং ব্যাগ দেখে রাবেয়া খাতুনকেও হতবিহ্বল দেখালো।
–“আরে বাবা, এসবের কী প্রয়োজন?”
–“কী যে বলেন না মা। প্রথমবার এসেছি শ্বশুরবাড়িতে অথচ আপনাদের উপহার দিবো না? এটা কী করে হয়! শপিং ব্যাগ খুলে দেখুন, বাবার জন্যে আপনার জন্যে শাড়ি, পাঞ্জাবি আছে। পছন্দ হলে বলবেন আর না হলে আমি ফেরত দিয়ে নতুন করে আবার আনবো!”
রাবেয়া খাতুন অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ড্যাবড্যাব করে মেয়ের দিকে তাকালো। মেয়ে তার বরাবরের মতো শান্ত হলেও অধরে লেগে আছে এক চিলতে হাসি! রাবেয়া খাতুন নিজেকে তটস্থ করে হাসার চেষ্টা করে বলে,
–“ঠিক আছে। হৃধির বাবা আসুক, একসাথেই নাহয় দেখবো!”
–“বাবাকে অলরেডি কল করে দিয়েছি। গাড়িও পাঠিয়েছি, কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসবেন।”
বলেই মাহিন হৃধির দিকে তাকালো। অধরে হাসি ঝুলিয়ে হৃধির উদ্দেশ্যে বললো,
–“মাথাটা ধরেছে হৃধি। আপনি কফি বানিয়ে দিলে আমি কিছু মনে করবো না!”
————————–
–“কী রে হৃধি? জামাই তোকে “আপনি” সম্বোধন করে কেন?”
রাবেয়া খাতুনের বচনে হৃধি যেন পরলো চিপায়। চোখে-মুখে ভর করেছে একরাশ লাজ। লাজুক স্বরে আটকে গলায় বলে,
–“স্বভাব আম্মু। বলেছে বিয়ের পর তুমি করে বলবে, তার কোনো খবরই নেই। তুমি থেকে আবারও আপনিতে আসছে!”
–“এর মানে তোদের আগে থেকেই সম্পর্ক ছিলো?”
হৃধি অস্বস্তিতে অধর কামড়ে চুপসে গেলো। এই প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারবে না। হৃধিকে চুপ থাকতে দেখে রাবেয়া খাতুন মুচকি হাসে। মেয়ের গালে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে বলে,
–“আমার আগে থেকেই সন্দেহ ছিলো। নাহয় তোকে বিয়ে করার জন্যে এত পাগলামি করতো না। তবে আমি সত্যি-ই অনেক খুশি এবং নিশ্চিন্ত যে এরকম ছেলের হাতে তোকে তুলে দিতে পেরেছি। সত্যি বুক থেকে বড়ো পাথর নেমে গেলো রে হৃধি। এখন আমি শান্তিতে মরতে পারবো!”
–“এসব কী বলছো তুমি? এখনো তুমি জোয়ান আছো আম্মু, খবরদার এসব কথা মুখে আনবে না!”
রাবেয়া খাতুন স্মিত হাসলেন।
–“আচ্ছা, বলবো না। কফি বানানো তো শেষ। যা, জামাইকে কফি দিয়ে আয়!”
—
–“আপনি বানিয়েছেন তো কফি?”
–“বিশ্বাস নেই?”
মাহিন স্মিত হেসে কফিতে চুমুক দিলো।
–“না, আপনার মুখ থেকে “হ্যাঁ” শুনতে ইচ্ছে করছিলো। আমি কখন বললাম বিশ্বাস নেই?”
হৃধি দৃষ্টি নত করে আড়ালেই হাসলো।
–“বুঝেছি। কোথায় গিয়েছিলেন?”
–“শপিং করতে গেলাম। চুজ করতে পারছিলাম না কোনটা নিবো আর কোনটা নিবো না। ডিসাইড করতেই দেরী হয়ে গেলো!”
–“মাস্ক পরে ছিলেন?”
–“হু। এটাই আমার জীবন।”
হৃধি মাহিনের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়। নাক আর গালটা কেমন লাল হয়ে আছে মাহিনের। গরমে মাস্ক পরে চলাচল করেছে, লাল তো হবেই। তবে মাহিনকে দেখলে হৃধির কেন যেন তাঁরার কথা মনে পরছে। কোথাও একটা তার পুড়ছে, ভিষণ পুড়ছে। কিন্তু কেন? হৃধির জানা নেই। মাহিন কফিতে চুমুক দিতে দিতে লক্ষ্য করলো হৃধির অন্যমনস্ক চেহারা! কফি শেষ করে পাশের সেন্টার টেবিলে মগটা রাখলো মাহিন।
–“কী হলো হৃধি? আপনি কী কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
হৃধি চমকে মাহিনের দিকে তাকায়। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে আওড়ায়,
–“ক..কিছু না!!”
–“কিছু তো অবশ্যই আছে। কী লুকাচ্ছেন হৃধি?”
হৃধি চুপসে রইলো। সে তাঁরার বিষয়ে কথা বলতে একদমই নারাজ। হৃধির চুপ থাকা মাহিনও মেনে নেয়ার পাত্র নয়। একপ্রকার বাধ্য করলো হৃধিকে মুখ খুলতে। হৃধি বেশ সময় নিয়ে বললো,
–“তাঁরা আপুর কথা ভাবছিলাম!”
–“কোন তাঁরা?”
হৃধি তার ভ্রু-যুগল কুচকে মাহিনের পানে তাকালো। মাহিনের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ। হৃধি কাঠকাঠ গলায় বলে,
–“শাফীনের ম্যাম, আমাদের উপর তলার ভাড়াটিয়া।”
–“ওহ, আচ্ছা!”
–“শুধু এইটুকুই? আপনার কী মনে হচ্ছে মাহিন, আপনি দিনদিন সব ভুলে যাচ্ছেন?”
–“দুনিয়া ভুললে ভুললাম, আপনাকে মনে থাকলেই চলবে!”
হৃধি মুখ বাঁকালো।
–“বললে না ওই মেয়েকে নিয়ে কী সমস্যা?”
হৃধি এবার শান্ত হলো। বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। অদ্ভুত জড়তা তাকে ঘিরে ধরেছে, গলায় যেন কথাদের ধামাচাপা দিয়ে ঢালাই করা হয়েছে। সামান্য কথা বলতে এত সমস্যা কী? নিজের স্বামীকে অন্য মেয়ের ভালোবাসার কথা বলাটা বুঝি এতই কঠিন? হৃধিকে মাহিন সময় দিলো। মাহিন নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করছে হৃধির বিব্রতবোধ।
–“তাঁরা আপু আপনাকে ভালোবাসে!”
বলেই বিনা-বাক্যে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বুকটা ভিষণরকম কাঁপছে। অদ্ভুত, অজানা আশঙ্কায় মন তার ব্যাকুল। দহনে পুড়ছে যেন সে। মুহূর্তে-ই রুমটা প্রগাঢ় নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায়। সিলিং ফ্যানের শোঁ শোঁ ব্যতীত কোনো শব্দ-ই যেন কানে আসছে না। বাহির থেকে ভেসে আসছে রিকশার ক্রিং ক্রিং শব্দ।
মিনিটখানেকের মাঝে শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো হৃধি। আবেশে তার চোখ বুজে এলো। চোখ বুজতেই চোখের কোণা বেয়ে দু’ফোটা জল টুপ করে পরলো। হৃধি শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মাহিনের বলিষ্ঠ হাত।
–“আপনি ভিষণ বোকা হৃধি। ভালো তো আমায় কতজন-ই বাসে। কিন্তু মাহিনেতে যে আপনার বসবাস। এই ছোট বিষয়টি এখনো বুঝেন না আপনি? সবাই তো রূপের পূজারী, কতজন আছে স্নিগ্ধ হৃদয়ের পূজারী? আমার জীবনে তাঁরা বা অন্য নারীর প্রবেশ কখনো হয়নি আর না হয়েছে। এই বোকারাণী, থম মেরে আছেন কেন? কিছু বলুন!”
হৃধি নিশ্চুপ রইলো। ঘুরে মাহিনকে জড়িয়ে ধরলো, নিবিড়ভাবে। মাহিন স্মিত হেসে হৃধির মাথায় ওষ্ঠ্যদ্বয় ছুঁলো। ওড়না তো কখনোই বেসামালে মাথা থেকে পরে কাঁধে ঠেকেছে।
–“জানেন হৃধি, আপনি যখন আমার বক্ষে অবস্থা করেন তখন মনে হয় এই বুঝি আমার শূণ্য বক্ষ পূর্ণতা পেলো। আপনাকে এ জীবনে পেয়ে আমি সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ হৃধি!”
–“আপনিও আমার জন্যে নিয়ামত মাহিন।”
কথাটি নিরবে হৃধি আপনমনে আওড়ালো। ছোট্ট বাক্যটি মাহিনের কান অবধি গেলো না। হৃধি ওভাবেই লেপ্টে রইলো বেশ কিছু সময়।
—
আধঘন্টার মাঝে করিম উল্লাহ এলেন। এত শপিং দেখে তিনি নিজেও থমকালেন।
–“এতসব?”
–“জ্বী বাবা। কোনো হেয়ালি করবেন না। আমি নাহয় আপনাদের ছেলে হতে পারলাম না তবে ছেলে ভাবতে তো পারেন তাই না? তাই প্লিজ এই ভাবা ছেলের উপহার গ্রহণ করুন। উপহার ফিরিয়ে দিতে নেই, জানেন তো?”
করিম উল্লাহ পলকহীন তাকিয়ে রইলেন মেয়ে জামাইয়ের দিকে। মাহিন মুচকি হেসে করিম উল্লাহ’র হাতে একটি প্যাকেট ধরিয়ে দিলো এবং হেসেই বললো,
–“মা বললো আপনি ব্যতীত প্যাকেট খুলবেন না। তাই ভাবলাম আপনার প্যাকেট-ই প্রথমে খোলা হোক! চটপট খুলে দেখুন তো, পছন্দ হয়েছে কি না?”
করিম উল্লাহ তার পিছে অবস্থান করা সোফায় বসলো। খুবই শান্ত হয়ে প্যাকেট খুললেন। প্যাকেট খুলতেই একটি এশ কালারের খুব সুন্দর পাঞ্জাবি পেলেন। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয় পাঞ্জাবির দিকে। মাহিন এবার রাবেয়া খাতুনকে বসিয়ে তার প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলে,
–“বাবা প্যাকেট খুলেছে। আপনি এবার নিশ্চিন্তে খুলতে পারেন!”
রাবেয়া খাতুন একবার স্বামীর দিকে চোখ বুলিয়ে নিজের প্যাকেট খুলে নিলো। একটি জামদানি শাড়ি। রাবেয়া খাতুন অবাক চাহনিতে শাড়িটির দিকে তাকিয়ে রয়। আপনমনেই ধীরে শাড়িটাতে হাত বুলায় সে। শাড়ির রঙ হালকা জাম।
হৃধি দূর হতে নিজ বাবা-মায়ের সাথে মাহিনের গভীর সখ্যতা দেখছে। মাহিনের আচরণে মনেই হয় না সে এ বাড়ির নতুন জামাই। কত সহজে মিশে যায় ছেলেটা। হৃধি আপনমনেই আওড়ায়,
–“এত ভালো কেন আপনি মাহিন?”
ডিনারে রাবেয়া খাতুন তিস্তা এবং তার হাসবেন্ডকে নিমন্ত্রণ করেন। তারাও সৌজন্যের সাথে চলে আসে। সকলে একসাথেই ডিনার করলো। খাবার সার্ভ করলো রাবেয়া খাতুন এবং হৃধি। সকলের পাতে খাবার দিতেই তারা দু’জনও বসে পরে। খাওয়া-দাওয়া শেষে মাহিন, তিস্তার বর এবং করিম উল্লাহ বৈঠকঘরে বসলেন। হৃধি তিস্তাকে নিয়ে নিজ রুমে চলে আসে। তিস্তা আসার পর থেকেই হৃধি লক্ষ্য করছে তিস্তা তাকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। হৃধি হাসির কারণ বুঝতে না পেরে তিস্তাকে প্রশ্ন করলো,
–“কী হলো, এভাবে হাসছো কেন?”
–“মন চাইলো গো নতুন বউ। তা কী করলে বাসর রাতে? হানিমুন কবে যাচ্ছো?”
তিস্তার লাগাম ছাড়া কথাবার্তায় হৃধির ভেতরটা ধ্ক করে উঠলো। অজানা অনুভূতিতে মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি হলো। যার ফলে মাথাটা হুট করে চক্কর দিয়ে উঠলো। মুহূর্তে অনুভব করলো তার গালজোড়া গরম হয়ে আছে। হৃধি লাজুক স্বরে আওড়ায়,
–“কিসব বলো না তুমি তিস্তা আপু!”
–“বাহ। লজ্জা পাচ্ছো বুঝি? এই লজ্জাবতীকে মাহিন কীভাবে সামলায় শুনি?”
হৃধি লজ্জায় লাল, নীল হয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গ বদলাতে চাইলে হৃধিকে নানান ভাবে লজ্জায় ফেললো তিস্তা। আজ যেন হৃধিকে লজ্জায় ফেলাই তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
~চলবে, ইনশাল্লাহ।