#সৎ_মা
#মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৮
মা ইদানীং আমার সামনে তেমন একটা পরে না, কেমন যেন পালিয়ে বেড়ায়। আমার নাশতা, রাতের খাবার নাঈফা মানে সীমন্তর বৌ নিয়ে আসে। দাদীরও সিড়ি বেয়ে উঠা সম্ভব না।
নাঈফা মেয়েটা অসম্ভব স্মার্ট, বেশভূষায় না বুদ্ধিতে
আর লক্ষ্মী ও। এই কয়দিনে সবাইকে খুব আপন করে নিয়েছে। আমি সম্পর্কে ওর ভাসুর হই, তবুও আমার সাথে কুটকুট করে কথা বলে। শুনতে ভালোই লাগে।
প্রথম যেদিন খাবার নিয়ে আসলো ভিতরেই আসতে চায় না, ভয়ে হয়তো৷ আমি অভয় দিতে ভালোভাবে কথা বললাম। বাড়ির খোঁজখবর নিলাম। ব্যাস এখন সারা সময় কথা বলে। মনে হয় আমি যেন ওর বন্ধু কিংবা সহপাঠী ।
বাবার বৌ পছন্দ হয়েছে কিন্তু এত কম বয়সে আর আমার আগে বিয়ে করায় সীমান্তর উপর রাগ। কথাও নাকি বলে না এখনো। তিন তলার সব খবর আমি ছাদে বসেই পেয়ে যেতাম নাঈফার সুবাদে। পিচ্চি মেয়েটা মাঝে মাঝে স্বামীর জন্য সুপারিশ ও করতো। এসব ভেবে আমার হাসি পেতো।
আমাদের বাড়ির ছাদটা বিশাল বড়। দুইপাশে গাছ লাগানো আছে তাছাড় পুরো ছাদই খোলামেলা। আর আমার ঘরটা ছাঁদের এক কোণে। দড়জাটা এমন জায়গাতে দেওয়া যে ঘরে বসে থাকলে ছাদে কে এলো গেলো, তা বোঝা যায় না। যেন ছাদের মধ্যেই অন্য এক দুনিয়া। এতে করে আমার সুবিধাই হয়েছে। ছাদে উঠা কেও আসে না বিরক্ত করতে।
ছাঁদের গৃহবন্দী জীবণ আমার ভালোই কাটতে লাগলো
গোধূলীর সময়টাতে যে অপার্থিব একটা সৌন্দর্যের ব্যাপার তা আমি ঐ দিনগুলোতে জেনেছি, পরিচিত হয়েছি জোছনার অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের সাথে, টিনের চালে বৃষ্টি, ছাদের মেঝেতে শুয়ে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখা , ঢাকায় স্থায়ী হওয়ায় এসব এত সূক্ষ্মভাবে দেখা হয়নি ঐ দিনগুলোর আগে। সারাটাদিন অপেক্ষায় থাকতাম রাতের অদেখা এই রূপ দেখার জন্য।
এরমধ্যেই একদিন বিকেলে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। সন্ধ্যে হতে বেশ দেড়ি তবুও পুরো আকাশ কালো মেঘেদের দখলে। একটু আগেও রৌদ্রে ঝলমল করা আকাশটা কেমন যেন কালো মেঘের আগমনে স্তব্ধ হয়ে গেলো। ব্যাপার গুলো ঘটলো খুব দ্রুত। সেদিন আমি পেছনের দিকের বেদীতে, প্রকৃতির এমন আকষ্মিক রূপ বদল আমাকে বিমোহিত করলো, ধমকা বাতাসও শুরু হলো মুহূর্তেই।
অবশেষে বৃষ্টি এলো, মুষলধারে। আমি তখন বেদীতে বসে পা ভিজাচ্ছি । বৃষ্টি বিলাস না, তবে কেন যেন বৃষ্টি থেকে সেদিন বাঁচার চেষ্টা না করেই বসে ছিলাম ঐ বেদীতে। হাতে ব্যান্ডেজ ভিজবার ভয়, তাই বসেই ছিলাম ওখানটাতে, বৃষ্টি একটু কমলে ঘরে যাবো।
এমন সময় ছোট্ট একাট মেয়ে এলো, বয়স কত হবে চৌদ্দ কি পনের। শুকনো কাপড় গুলো তাড়াহুড়ো করে নিচ্ছে। আমি পেছন থেকেই দেখছিলাম। কাপড় টানাটানির এক পর্যায়ে দড়ি গেলো ছিঁড়ে। তাও কাপড় বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে তার প্রাণপণ চেষ্টা। দড়িটা ফেলে মেয়েটা কাপড়গুলো নিয়েই দৌড় দিলো। আমি মনে মনে ভাবলাম আহা, বেচারা…
এর প্রায় মিনিট পাঁচেক পর মেয়েটা আবার ছাঁদে আসলো, গায়ের জামাটা দেখে চিনেছিলাম। ততক্ষণে চারদিকে অন্ধকার ছেঁয়ে রাতের মতো হয়ে গেছে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করছি তাকে। এমন ঝড়বৃষ্টির ভিতরে আবার কেন এলো ছাঁদে…!
ভিজতে তো অবশ্যই না। কারন এই সময়ে সচরাচর কেও কারো ঘরের মেয়েকে বৃষ্টিতে ভিজতে পারমিশন দেয় না। তো ও কেন এলো….
ভাবনাগুলো খুব দ্রুত ঘটছে।
এরি মধ্যে মেয়েটা ছেঁড়া দড়িটা হাতে নিয়ে ছাঁদে রেলিংয়ের দেয়ালের বেরিয়ে থাকা ইটে পা দিয়ে জোড়াবার চেষ্টা করছে। আমি আর বসে থাকতে পারলাম না, দ্রুত উঠে ওকে একটা ধমক দিলাম, বললাম
: এই মেয়ে কি করছো তুমি, ছাঁদ থেকে পরে যাবে তো,
(ততোক্ষণ আমি, আমার ভাঙা হাতের ব্যান্ডজ ভিজে একাকার) বর্ষাকাল হওয়ায় দেওয়াল গুলো স্যাঁতস্যাঁতে, যে কোন সময় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। তোমার সাহস তো কম না মেয়ে….
আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম, একেবারে সাধারণ একটা বাচ্চা মেয়ে, তবুও চোখদুটো গভীর বিষাদে ডুবানো।
মেয়েটা ভয় পেয়েছিলো আমাকে দেখে, তবে খুব দ্রুতই সামলে নিলো নিজেকে, জবুথবু হয়ে বললো দড়িটা আমার টানে ছিড়ে গেছে তাই জোড়া লাগাতে….
আমি ওর কথা শেষ করতে না দিয়েই বললাম, দাও আমার হাতে, মেয়েটা দড়ির ছেড়া অংশ আমার হাতে দিলো। অনেক কষ্টে একহাতে দড়িটা জুড়ে দিলাম।
দড়ির জুড়ে যাওয়া দেখে মেয়েটা কিছু না বলেই চলে গেলো, এমনকি একটা ধন্যবাদ ও দিলো না, আবার মনে মনে ভাবলাম ছোট মানুষ, এতকিছু বুঝে না হয়তো।
উপকারীকে বাঘে খায় কথাটা আমার জন্যও সত্যি প্রমাণিত হলো। ব্যান্ডেজ ভিজবার কারনে আমার হাতে ইনফেকশন হয়ে গলো। ডাক্তার যেখানে বলেছিলো সপ্তাহ খানিক পর খুলে দিবে, সেখানে আমাকে পরদিন গিয়ে আবার ব্যান্ডেজ করতে হলো। ইনফেকশনের যন্ত্রণায় আমার বেহাল অবস্থা। জ্বর, হাত ব্যাথা, আর অসুস্থতায় আমি ঐ ছোট্ট মেয়েটার কথা ভুলেই গেলাম।
বাবা ইদানীং খুব ব্যাস্ত সময় পার করছে ব্যাবসা আর ফ্ল্যাট ঠিক করার কাজে৷ ভাড়াটিয়ারা সামনের মাসেই চলে যাবে। তাই। কিভাবে কি হবে, তা ভেবে রাতের ঘুম নষ্ট। এমনিই একটু বেশি হিসেবী তাই আর কি। আমি বাবাকে বললাম বাবা মাত্র তো মাস শুরু, এত পাগল কেন হলেন, আগে বের হোক ভাড়াটিয়ারা, বাবা ধমকের সুরে বললেন –
: আর কতদিন ছাঁদে পরে থাকবে, তাড়াহুড়া তো আর শখে করি না, আমি এমন উত্তর আশা করি নি তাই চুপ করে গেলাম। তাছাড় তিনি মাথা গরম মানুষ, হাই-প্রেশার রোগী। তাই কিছু মনেও করলাম না।
আস্তে আস্তে আমার হাত ঠিক হতে লাগলো। যেদিন হাতের ব্যান্ডেজ খুললো আমি নাঈফাকে বললাম বড় ভাইয়ের অনেক সেবা করলে, আজ থেকে তোমার ছুটি, আমি নিচে গিয়েই খেতে পারবো ৷
মেয়েটা মন খারাপ করে ফেললো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো এই বাড়ির কেও আমার সাথে কথা বলে না তেমন একটা। আপনার সাথেই কথা বলি আপনি কিছু মনে করেন না তো ভাইয়া….!
আমি বললাম আরে নাহ্, কি মনে করবো, তুমি আমার ছোট বোনের মতো।
ভাইয়া আপনিকি আমার একটা উপকার করবেন…!
বলেই মাথা নিচু করে ফেলেলো।
আমি বললাম কি উপকার বলো, সাধ্য মতো চেষ্টা করবো।
আপনি ভেবে বসেন না যে আপনার সেবা করেছি তাই প্রতিদান চাচ্ছি, সামনের মাসে আমার কলেজে প্রি-টেস্ট শুরু। আগামী এপ্রিলে পরীক্ষা৷ বাসার সবাইতো আমাকে মানেই নাই মন থেকে , পড়ালেখার কথা বলবো কোন মুখে…
একটু থেমে আবার বললো-
আপনার কথা সবাই শুনে, আপনি বললে হয়তো মা পড়তে দিতে রাজি হবে।
আমি হেসে বললাম এইটুকু মানুষ তুমি এত কথা শিখলে কোথায়…!
এই সমস্যাই তো, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমার কিডনিটা দিয়ে দিতে বলবে….
আমার কথা শুনে নাঈফা মৃদু হেসে দিলো,
আমি বললাম –
আচ্ছা আমি মাকে বলবো। মা অবশ্যই পারমিশন দিবেন।
নাঈফা সেদিন হেসে থ্যাংক-ইউ বলে চলে গিয়েছিল। আমি মাকে বুঝিয়ে বলাতে মা রাজি হয়েছিল।
ছাদে থাকার দিনগুলো বেশ ভালোই কেটেছে আমার, দিনের বেলায় গরম লাগতো অবশ্য তবে রাত হলেই হু হু বাতাস। প্রায়ই আমি ছাদের বেদীতে বসে চারপাশের মায়াময় পরিবেশ, আর চাঁদ দেখতাম। টিভি না থাকায় কিছু বই এনে দিয়ে গেছে নাঈফা। একসময় অনেক বই পড়তাম। এখন তো সেসব ভুলেই গিয়েছি।
কিছুদিন ধরে লক্ষ করতাম একজোড়া চোখ আমাকে ফলো করে৷ আমি যখনই তাকাতাম কাওকেই দেখতাম না।
চলবে….
previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/905025583291967/
Next: https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=907199603074565&id=659404701187391