‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১৩]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
তুয়া ওর ডায়েরিতে লিখল, “এক টুকরো আকাশ সেজে তোমাকে দেখতে বেশ ভালো লাগছে। একদম আমার সুদর্শন শঙ্খচিলের মতো।”
কথাটা লিখে তুয়া লজ্জা পেয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ডেকে নিল। তুরাগরা ফিরলে দুপুরে একসঙ্গে খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। তুয়ার আম্মু তুয়াকে একবার দেখে চলে গেলেন।
প্রত্যয়রা সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। প্রিয়ম চাঁদের সঙ্গে খেতে বসে না। তাই চাঁদ খাবার নিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে গেল। প্রিয়ম একটু পরে খেতে আসলো। সবাই খেতে খেতে কিছু নিয়ে আলোচনা করছিল, হঠাৎ চাঁদের অট্রহাসির হাসির শব্দে সবাই কথা থামিয়ে ওর দিকে তাকাল। চাঁদ মুভি দেখে হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
প্রিয়ম রাগী চোখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর একটা টু শব্দ আমার কানে আসলে খবর আছে।”
প্রিয়মের কথা শুনে চাঁদের হাসিটা মলিন হয়ে গেল। প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “চাঁদ, হাসি আটকাবে না। যারা বেশি হাসে তাদের মন ভাল থাকে।”
চাঁদ হেসে বলল, “সত্যি?”
প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “একদম সত্যি।”
চাঁদ প্রত্যয়ের সাপোর্ট পেয়ে আগের ন্যায় মুভি দেখে হাসতে লাগল। ওর হাসি দেখে প্রিয়ম বাদে বাকিরাও মিটিমিটি হাসতে লাগল।
প্রিয়ম কোনো রকমে খেয়ে উঠে চলে গেল। প্রত্যয়ের আব্বু বললেন, “প্রত্যয়, প্রিয়মের সঙ্গে সরাসরি কথা বলো, প্রিয়ম নিশ্চয় তোমার কথা শুনবে।”
প্রত্যয় পানি খেয়ে গ্লাস রেখে মুচকি হেসে বলল, “আব্বু, ভাই পড়াশোনা না করলে বুঝিয়ে বলা যায়। সিগারেট খেলে বা অন্যায় কাজে লিপ্ত হলে দু’টো মেরে শাসন করা যায়। কিন্তু ভাইয়ের জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের দায়িত্ব-সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। আর অধিকার আছে বলে তো অনধিকারচর্চা করতে পারি না।”
প্রত্যয়ের কথা শুনে কেউ আর কথা বাড়ালেন না। চাঁদও প্রত্যয়ের কথা গুলো শুনল। সবাই নিজের খাওয়া সমাপ্ত করে রুমে চলে গেল। প্রত্যয় রুমে গিয়ে শুয়ে একটা বই পড়তে লাগল। হঠাৎ দরজার কাছে ছোট ছোট দু’টো পা দেখে প্রত্যয় চোখ বন্ধ করে নিল। ইচ্ছে উঁকি মেরে দেখল প্রত্যয় ঘুমাচ্ছে। সে সর্তকতার সাথে রুমে প্রবেশ করে পরখ করল প্রত্যয় সত্যি ঘুমাচ্ছে।
ইচ্ছে দুষ্টু হেসে প্রত্যয়ের ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার আগেই, প্রত্যয় ওর হাত ধরে বলল, “এগুলো কি দিচ্ছ?”
ইচ্ছে ভয়ে ঢোক গিলে বলল, “তোমাকে বউ সাজাব, তাই নিমিষ্টিক দিচ্চি।”
প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “প্রিয়ম বউ সাজতে পছন্দ করে, ওকে গিয়ে সাজাও।”
ইচ্ছের চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে উঠে নিমিষেই মুখটা মলিন করে বলল, “যদি না দেয়?”
প্রত্যয় ইচ্ছের কানে কানে কিছু বলল। ইচ্ছে দাঁত বের করে হাসল। প্রত্যয় ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে প্রিয়মের রুমে নক করল। প্রিয়ম দরজা খুলে প্রত্যয়কে দেখে বলল, “ভাইয়া, ভেতরে এসো।”
প্রত্যয় রুমে প্রবেশ করে বলল, “প্রিয়ম, শুয়ে পড়ো। ইচ্ছে তোমার হার্ট চেক করবে।”
প্রিয়ম ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে হেসে শুয়ে পড়ল। ইচ্ছে প্রিয়মের বুকে হাত রেখে বলল, “রুগী মারা গেছে, রুগীকে সূচ দিতে হবে।”
প্রত্যয় হেসে বলল, “তাহলে পেশেন্টের হাত বাঁধতে হবে, যাতে নড়াচড়া করতে না পারে।”
প্রিয়ম শুয়ে শুয়ে দু’জনের কান্ড দেখছে। ইচ্ছে গিয়ে চাঁদের একটা ওড়না এনে বলল, “প্রত্তুয়, হাত বাঁদো।”
প্রত্যয় প্রিয়মের হাত বেঁধে ইচ্ছেকে প্রিয়মের বুকের উপর বসিয়ে দিল। প্রিয়ম ইচ্ছের হাতে লিপস্টিক দেখে বলল, “না! ভাইয়া এটা ঠিক না। আমার হাত খুলে দাও, ভাইয়া।”
প্রত্যয় হাসতে হাসতে বলল, “ট্রিটমেন্ট চলছে, কথা বলিও না।”
ইচ্ছে প্রিয়মের ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে গেলে, প্রিয়ম মাথা নড়াচ্ছে দেখে ইচ্ছে প্রিয়মের গালে থাপ্পড় বসিয়ে বলল, “চুপ, একদম চুপ।”
প্রিয়ম করুণ চোখে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, “আম্মু! আম্মু! আমাকে বাঁচাও।”
ইচ্ছে আরেকটা থাবড় দিয়ে বলল, “চুপ! চুপ বলছি!”
প্রত্যয় মিটিমিটি হেসে প্রিয়মকে ফাঁসিয়ে চলে গেল। প্রিয়মের ডাক শুনে ওর আম্মু এসে এসব দেখে হাসতে হাসতে বললেন, “ইচ্ছে, আর সাজগোজের জিনিস লাগবে?”
ইচ্ছে দাঁত বের করে হেসে বলল, “দাও।”
প্রিয়মের আম্মু ইচ্ছেকে উনার মেকাপ বক্স দিয়ে চলে গেলেন। ইচ্ছে ওর মনমতো প্রিয়মকে সাজাতে লাগল। প্রিয়ম করুণ চোখে ওর আম্মুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। সে কিছু বলতেও পারছে না, কিছু বললেই ইচ্ছে ওকে মারছে।
প্রত্যয় রুমে এসে দেড় ঘন্টার মতো ঘুমাল। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে কলিকে খেতে দিতে বেলকনিতে গেল। তুয়া তখন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল। হঠাৎ কলির চেচাঁমেচি শুনে তুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। কলি অনবরত বলে যাচ্ছে, “তুয়া! বউ! তুয়া! বউ!” তুয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তুয়ার মুখভঙ্গি দেখে প্রত্যয় মিটিমিটি হাসতে হাসতে চলে গেল।
সন্ধ্যার পর ইচ্ছে দৌড়ে এসে তুয়াকে বলল, “আপু, প্রত্তুয়ের বুকে দুঃখু! চল! চল।”
তুরাগ এসে বলল, “তুয়া দ্রুত প্রত্যয়দের বাসায় চল।”
তুয়া কিছু বলতে পারছে না, অজানা ভয়ে ওর বুক কাঁপছে। ওর মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরছে, প্রত্যয় ঠিক আছে তো?
ইচ্ছে তুয়ার হাত ধরে টানতে টানতে প্রত্যয়দের ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসলো। সবাই গোল হয়ে বসে আছে কিন্তু প্রত্যয় নেই। তুয়া ঢোক গিলে তুরাগকে বলল, “প্র প্রত্যয় কই, ভাইয়া?”
প্রত্যয়ের আম্মু তুয়াকে নিয়ে পাশের রুমে চলে গেলেন। বিকেলে প্রত্যয় হসপিটালে গিয়েছিল। টানা দুই ঘন্টা পেশেন্ট দেখে উঠতে যাবে, তখন তুরাগের কল পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ছুটে আসল। ওদের ড্রয়িংরুমের সোফাতে লাল টুকটুকে শাড়ি পরিহিত তুয়াকে দেখে প্রত্যয় দাঁড়িয়ে গেল।
প্রত্যয় জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। সে যেন নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছিল। তুরাগ ওকে বলেছে, তুয়া আবার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। কিছুতেই ওর সেন্স ফিরছে না। ওর হৃৎস্পন্দনের গতি কমে যাচ্ছে। এসব শুনে প্রত্যয় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। সাদা শার্টটা ঘামে ভিজে গেছে। পরিপাটি ছেলেটার এই অবস্থা দেখে সবাই হেসে উঠল।
প্রত্যয় নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, “হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে সম্পর্কিত ফান বুকে গিয়ে বিঁধে। দম আঁটকে আসে, মনে হয় এক্ষুণি মারা যাব।”
প্রত্যয়ের কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। তুয়া প্রত্যয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তুরাগ এসে প্রত্যয়কে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমাদের দু’জনের টান পরীক্ষা করছিলাম। এখন কেউ কারো থেকে অনুভূতি আড়াল করতে পারবে না।”
প্রত্যয়ের আব্বু এসে বলল, “যাও, রেডি হয়ে এসো।”
প্রিয়ম প্রত্যয়কে নিয়ে ওর রুমে গেল। প্রত্যয় সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পড়ে তুয়ার পাশে বসল। কাজী এসে বিয়ে পড়ানো শুরু করল।
তুয়া ভাবতেও পারেনি ওর জীবনে এমন সুখময় মূহুর্ত আসবে। তুয়ার চোখের পানি অঝরে ঝরে যাচ্ছে। প্রত্যয় সবার আড়ালে তুয়ার এক হাত শক্ত করে ধরল। তুয়াও প্রত্যয়ের হাতটা আঁকড়ে ধরল।
তুয়ার শাড়ির আঁচলে ওদের হাতের শক্ত বন্ধনটা ঢেকে আছে। যেটা গভীর ভাবে পরখ না করলে কেউ বুঝতেও পারবে না। তুয়া তিনবার কবুল বলে প্রত্যয়কে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করল।
“আল্লাহ, পরিপূর্ণ ভাবে ওকে ভাল রাখার তৌফিক দান করো।” প্রত্যয় মনে মনে কথাটা বলে কবুল বলল।
তুয়া এখনও শক্ত করে প্রত্যয়ের হাত ধরে আছে। মোনাজাতের সময় ওরা হাত ছাড়ল। দু’জনেই সাইন করে বিয়ের বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হল। বাসার সবাই যে ওদের এভাবে সারপ্রাইজ দিবে, ওরা ভাবতেও পারে নি। মোনাজাত শেষে কাজী খাওয়া-দাওয়া করে চলে গেলেন। দুই পরিবার মিলে খাওয়ার পর্ব শেষ করলেন।
তুয়া প্রত্যয়ের পাশে চুপটি করে সোফাতে বসে আছে। তুরাগ এসে বলল, “তুলা, এবার বাসায় চল।”
তুয়া প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “যাও।” তুয়া মাথা নিচু করে নিল। সবাই মিটিমিটি হাসছে। প্রত্যয়ের আম্মু বললেন, “এ তো বর পাগল মেয়ে।”
উনার কথা শুনে সবাই অট্রহাসিতে ফেটে পড়ল। ইচ্ছের আম্মু, চাঁদ আর প্রিয়ম প্রত্যয়ের রুম সাজিয়ে বের হলো। ইচ্ছের আম্মু বলল, “কি রে তুয়া, বাসায় যাবি না?”
তুয়া করুণ চোখে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয় স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে। কিন্তু পা দিয়ে তুয়াকে আঁটকে রেখেছে, এটা কেউ টেরও পাচ্ছে না। প্রত্যয়ের আব্বু হাসতে হাসতে বললেন, “আমার পুত্রবধূ যখন যাবে না, তখন কেউ জোর করবে না।”
-“তুলা, মান ইজ্জত শেষ করে দিলি।” (তুরাগ)
সবাই তুয়াকে নিয়ে অনেক মজা করলেন।
তুয়ার আব্বু এসে তুয়ার মাথায় হাত রেখে বললেন, “মন খারাপের কিছু নেই। পাশাপাশি আমাদের বাসা।”
তুয়ার ছলছল চোখে ওর আব্বু-আম্মুর দিকে তাকাল। প্রত্যয় তুয়ার পা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তুয়ার আম্মু বললেন, “এটাই তোমার আসল ঠিকানা। নিজে ভাল থেকো আর সবাইকে ভাল রেখো।”
তুয়ার আব্বু-আম্মু চলে গেলেন। তুরাগ ছলছল চোখে বলল, “ভাল থাক।” তুয়া তুরাগকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। তুরাগ তুয়ার চোখে পানি মুছে দিয়ে চলে গেল। ইচ্ছের আম্মু আর চাঁদ তুয়াকে প্রত্যয়ের রুমে রেখে স্থান ত্যাগ করল।
প্রত্যয় ড্রয়িংরুমে সোফাতে বসে ফোনে কথা বলছে। প্রিয়ম ওর রুমে চলে গেল। প্রিয়মের আম্মু প্রিয়মকে পানি দিতে গিয়ে বললেন, “প্রিয়ম, তোমার চোখ লাল হয়ে আছে কেন? কিছু হয়েছে, আব্বু?”
প্রিয়ম বুকের বা পাশে হাত বুলিয়ে বলল, “না আম্মু, বুকে জ্যাম বেঁধেছে তাই হয়তো চোখ লাল দেখাচ্ছে।”
To be continue….!!