‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[২২]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
প্রত্যয় মিটিমিটি হেসে তুয়াকে ওর বুকে আবদ্ধ করে নিল। আর তুয়া কাঁদতে কাঁদতে প্রত্যয়ের বুকে মাথা রেখে আবারও ঘুমিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর প্রত্যয় তুয়াকে ভাল ভাবে শুইয়ে রুমের বাইরে গেল। বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করা দরকার। দেশে ফিরেই বউয়ের সঙ্গে ঘরবন্ধী থাকাটা বড্ড বেমানান। আর এতক্ষণে ওর আসার খবরটা চাঁদ সবাইকে জানিয়েও দিয়েছে। প্রত্যয় ড্রয়িংরুমে গিয়ে ওর আব্বু-আম্মুর সঙ্গে কুশল বিনিময় করল। প্রিয়ম প্রত্যয়ের কথা শুনে সেও এসে প্রত্যয়ের পাশে বসল। টুকটাক কথার মাঝে প্রত্যয়ের আম্মু সবাইকে হালকা নাস্তা দিয়ে বললেন, “পাখি আর আকাশের থেকে খবর পেয়ে তুই ফিরলি নাকি, আব্বু?”
প্রত্যয় উনার কথার মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। প্রত্যয়ের আম্মু হেসে সকালের ঘটনাটা প্রত্যয়কে জানিয়ে হাসলেন। তুয়ার এমন পাগলামির কথা শুনে প্রত্যয় মৃদু হাসল। ছেলের মুখে হাসি দেখে প্রত্যয়ের আম্মু বললেন, “তুয়া কি এখনও ঘুমাচ্ছে?” প্রত্যয় বলল, “হুম।”
সন্ধ্যায় আজানের সময় তুয়া ঘুম থেকে উঠে মন ভার করে বসে রইল। সে সামনে প্রত্যয়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে প্রত্যয়কে না পেয়ে স্বপ্ন ভেবে সে কেঁদেই দিল।
হঠাৎ মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখ তুলে তাকাল। ছলছল চোখে তাকিয়ে দেখল, প্রত্যয় ওর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এটা তাহলে স্বপ্ন নয় বরং সত্যি! তুয়া মনে মনে খুশি হলেও প্রকাশ না করে অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিল। প্রত্যয় আলতো করে তুয়ার চোখ মুছে দিয়ে বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলল, “যা শাস্তি দিবে বিনাবাক্যে গ্রহন করব, বল কি শাস্তি দিবে?”
তুয়া প্রত্যয়ের বাহুডোর থেকে ছোটার চেষ্টা করলে প্রত্যয় ওকে শক্ত করে ধরে রাখল। তুয়া অভিমানী কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ, আমি তো কারো কেউ না। এখন ঢং করতে হবে না।” প্রত্যয় মুচকি হেসে তুয়ার দুই গালে হাত রেখে বলল, “তোমাকে কারো কেউ হতেও হবে না। তুমি আমার এবং আমার তারপরেও আমার হলেই চলবে।”
কথাটা শুনে তুয়া চুপ হয়ে গেল। প্রত্যয়ের ফোনে কল এসেছে, সে কথা বলতে লাগল। আর তুয়া ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে গেল। তবে তুয়ার মুখের দুষ্টু হাসি প্রত্যয়ের নজর এড়ালো না। তুয়া প্রত্যয়ের আম্মুর কাছে যেতেই উনি বললেন, “এতক্ষণ ঘুমালি, রাতে কি আর ঘুম আসবে?”
চাঁদ হেসে তুয়াকে খোঁচা মেরে আস্তে করে বলল, “রাতে পেনডিং কাজ গুলো সম্পূর্ন করতে হবে, তাই না আপু?”
তুয়া মাথা নিচু করে চাঁদকে একটা চিমটি কাটল। প্রত্যয়ের আম্মু কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে চুপ করে রইলেন। প্রত্যয় মাগরিবের নামাজ পড়ে ড্রয়িংরুমে ওর চাচা-চাচীদের দেখে উনাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করল।
সন্ধ্যার পরে প্রিয়ম প্রত্যয়কে বাইরে হাঁটতে যাওয়ার জন্য বলল। দুই ভাই একসঙ্গে বের হবে, তখন চাঁদ দাঁত বের করে হেসে প্রত্যয়কে বলল, “ভাইয়া, আমার বাদাম খেতে মন চাচ্ছে। এখন না খেলে হার্ট এ্যার্টাক করে মারা যেতেও পারি।”
প্রিয়ম বিরক্ত হয়ে চাঁদকে বলল, “সারাদিন খাওয়া ছাড়া মাথায় আর কিছু আসে না?” প্রত্যয় প্রিয়মকে থামিয়ে চাঁদকে বলল,”আচ্ছা, তোমরা আমাদের সঙ্গে চল।”
চাঁদ বাইরে যাওয়ার জন্য দৌড়ে তুয়াকে ডেকে আনল। প্রত্যয় ওর আম্মুকেও ডাকল, কিন্তু উনি যাবেন না বললেন। ওরা চারজনে বেরিয়ে একটা নিরিবিলি রাস্তায় হাঁটছে। চাঁদ আর তুয়া গল্প করতে করতে প্রত্যয়দের একটু সামনে হাঁটছে। রাতের ল্যাম্প পোষ্টের হলুদ আলোতে সবাইকে দেখতে অন্যরকম লাগছে। তুয়া হাসতে হাসতে পেছনে ফিরে প্রিয়মকে বলল, “ভাইয়া, ল্যাম্প পোষ্টের হলুদ আলোতে আপনাদেরকে দেখতে জন্ডিসের পেশেন্টর মতো লাগছে।”
কথাটা বলে চাঁদ তুয়া আবারও একসঙ্গে হেসে উঠল। তুয়ার কথাটা শুনে দুই ভাই মৃদু হাসল। এত জার্নি করে এসে, প্রিয় মানুষ গুলোর হাসি দেখে প্রত্যয়ের সব কষ্ট যেন ফিকে হয়ে গেছে।
প্রিয়ম প্রত্যয়কে কিছু বলার জন্য উশখুশ করছে, কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। প্রত্যয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, “মেয়ে মানে একটু আহ্লাদি, অভিমানিনী, মায়াবী, চঞ্চলাময়ী, তাদের একটু ভালবাসা পেলে তারাও ভালবাসা দিতে কার্পণ্যতা করে না। জীবনের কিছু কিছু ত্যাগ ভাল কিছু বয়ে নিয়ে আসে। প্রিয়ম, জীবনকে আরেকটাবার সুযোগ দাও। একটা মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছ, তাকে ভাল রাখার দায়িত্ব পালনে কোনো কমতি রেখো না।”
প্রিয়ম মুচকি হেসে প্রত্যয়কে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভাইয়া, তুমি শুধু আমাকে দূরে সরিও না।”
প্রত্যয় প্রিয়মের পিঠে ভরসার হাত রাখল। প্রিয়ম প্রত্যয়কে ছেড়ে চোখ মুছে মুচকি হাসল। তারপর ওরা চাঁদ আর তুয়ার দিকে এগিয়ে গেল।
পলক সেদিন বিকেলেই বাবার বাড়ি থেকে চলে এসেছে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি, বাবার বাড়ি কোনোটাই পলকের আপন রইল না। তবে সে স্বামী নামক মানুষটাকে ভরসা করে বাঁচবে। আজ সকালে পলক ইচ্ছের আম্মুর সঙ্গে হসপিটালে গিয়েছিল। আর কাঙ্খিত রিপোর্ট থেকে জেনেছে, সে মা হতে যাচ্ছে। এ কথা পলক রনিতকে ভয়ে বলতে পারছে না। রনিত অফিস থেকে ফিরে পলকের শুকনো মুখ দেখে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?”
পলক জোরপূর্বক হেসে রনিতকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। রনিত ওর হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে সুন্দর ভাবে আবার জিজ্ঞাসা করল, “বলো?”
পলক ভয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। রনিত পলককে এভাবে কাঁদতে দেখে অবাক বলল, “না বললে বুঝব কিভাবে? আচ্ছা! যাই হোক, কথা দিচ্ছি বকা দিব না।” পলককে হেঁচকি তুলে কেঁদে বলল, “আ আম আমি প্রেগন্যান্ট।”
রনিত ভ্রু কুঁচকে পলকের দিকে তাকাল। কিছুদিন আগেও তো পলক বলল ওর পিরিয়ড হয়েছে। তাহলে ও প্রেগন্যান্ট কিভাবে হয়? রনিত নিজেকে শান্ত করে হেসে বলল, ”সব ব্যাপারে মজা করতে নেই। কিছুদিন আগে না আমাকে বললে তোমার পিরিয়ড হয়েছে?”
পলক রনিতকে রিপোর্ট দেখিয়ে মাথা নিচু করে রইল। রনিত ওকে বার বার বলেছে এখন বাচ্চা নেওয়া যাবে না, এটা ওর জন্য রিস্কি হয়ে যাবে। কিন্তু সেই অঘটনটাই পলক ঘটাল।
পলক মুখ কাচুমাচু করে বলল, “আমিও ডাক্তারকে বললাম কিছুদিন আগে আমার পিরিয়ড হয়েছে। তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব? উনি আমাকে বললেন ট্রাইমেস্টারের শুরুর দিকে হালকা রক্তক্ষরণ নাকি গর্ভধারণের আগাম সংকেত। আর আমি ইমপ্ল্যান্টেশন ব্লিডিংকে পিরিয়ড ভেবেছিলাম।”
রনিত মাথা নিচু করে চুল মুঠো করে ধরে বসে রইল। অপরিপক্ক বয়সের মেয়েকে বিয়ের ফল সে হারে হারে টের পাচ্ছে। বাচ্চা আসার খবরটা সুসংবাদ হলেও পলকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর এজন্যই রনিতের মুখের হাসিটা মলিন হয়ে গেল। পলক ছলছল চোখে রনিতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু রনিত কিছু বলল না, উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। পলক চোখের পানি মুছে জানালার পাশে গিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকাল। বিয়ের পর জীবনটা ওর কাছে খুব কঠিন মনে হয়। সবকিছুই ‘না’ শব্দটায় সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে পলক মনে মনে খুশি। সে চায় ইচ্ছের মতো একটা তোতাপাখি ওর কোল জুড়ে আসুক। সারাদিন পুরো রুম জুড়ে ছোটাছুটি করে আদুরে আবদারের ঝুলি নিয়ে বসুক। পলক ওর পেটে হাত রেখে বলল, “ছোট্ট রনিত নাকি ছোট্ট পলক কে তুই? যেই হোস, বাবার মতো খাটাশ হবি না।”
রনিত হাতে টাওয়াল নিয়ে পলকের কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল। এতটুকু একটা মেয়ে সে আবার তার বাচ্চা নিয়ে কল্পনা-জল্পনা করা শুরু করেছে। রনিতের আর কিছু বলার নেই। সব আল্লাহর হাতে। উনার হুকুমেই বাচ্চাটা তার আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। রনিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ, বাবা খাটাশ আর মা অনেক ভাল। এজন্য খালি পেটে থেকে বাবুকে এখনও ক্ষুধার্ত রেখেছে।”
রনিতের কথা শুনে পলকের মুখে হাসি ফুটল। সে উঠে রনিতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
**!!
প্রত্যয়রা অনেক রাত অবধি ঘুরে তারপর বাসায় ফিরল। রাতে খাবার সময় প্রত্যয় চাঁদ আর প্রিয়মের পুনরায় বিয়ে দেওয়ার কথাটা জানাল। প্রত্যয়ের কথাতে কেউ অমত করেনি। বরং খুশি হয়ে প্রত্যয়ের আব্বু বললেন, “তাহলে আত্মীয়দের ডেকে কালকেই কাজটা সেরে ফেলি।” প্রত্যয় উনার কথায় সম্মতি দিয়ে বলল, “এটাই ভাল হবে, আব্বু।”
এসব বিষয়ে বড়রা আলোচনা করলেন। চাঁদ প্রিয়মের দিকে তাকাল, সে নিজের খাওয়াতে ব্যস্ত। প্রিয়ম ওকে মেনে নিয়েছে ভেবে চাঁদের মুখে হাসি ফুটল। তারপর খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল। প্রত্যয় বেডে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছিল। একটু পরে তুয়া রুমে এসে একটা বালিশ নিয়ে পা বাড়াতে যাবে, তখন প্রত্যয় ওর হাত আঁটকে বলল, “কোথায় যাচ্ছ?” তুয়া মুখ গোমড়া করে বলল, “চাঁদের রুমে ঘুমাব।”
কথা শুনে প্রত্যয় উঠে তুয়ার হাতের বালিশটা রেখে আদুরে সুরে গেয়ে উঠল,
“লক্ষী সোনা রাগ করেনা
একটু হাসো প্লিজ।
ভাল্লাগেনা আর আর হবে না
করছি যে প্রমিস।”
To be continue…..!!
(গল্প নিয়ে আলোচনা করতে জয়েন করুন)
📚 Nurzahan’s Family 📚 (আড্ডাঘর)