গল্প- অনুভূতিরা মৃত
এগারো পর্ব
.
পাথর মনের অধিকারী রুয়েল। আজকে থাকে অসংখ্য নামে অাখ্যায়িত করা যাবে৷ তাতে কোন আক্ষেপ নেই শুধু একটিবার মিহি যদি বলতো ইট’স ওকে, হেঁসে উঠতো তার মন। নেঁচে উঠতো হৃদয়। ভিতরে থাকা অপরাধবোধকে ছুঁয়ে দিতো শীতল বাতাস। চোখের নিচে পানি নিয়ে মিহির বাসা থেকে প্রস্তান করল। কষ্টে বুক ফেটে কান্না আসছে, নিজের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে, আমি কি সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য? মেঘলা আকাশ বৃষ্টি হতে পারে, মূহুর্তেই আকাশের কান্না বৃষ্টি হয়ে নামল। রুয়েল ভাবে, মিহি বুঝেনি বরং আঘাত করেছে, সেই আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হৃদয়। তাইতো তার কষ্টে কান্না হয়ে আকাশ থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পরছে…..
.
মধ্য দুপুর। শহরের রাজপথে বৃষ্টিতে নিজেকে ভেজাচ্ছে, যেখানে আছে এক রাশ দুঃখ কষ্টের যন্ত্রণা। বৃষ্টির পানির সাথে ধুয়ে মুছে যাক গ্লানি। কিছুদূর যেতেই সেভেন আপের একটা খালি বোতল রাস্তায় দেখতে পেলো। রুয়েল সেটাকে ফুটবল বানিয়ে কিক শুরু করল। এই দেশের ছেলেরা ফুটবল পাগল। কালের পরিক্রমায় ক্রিকেট জনপ্রিয়তা পেলেও ফুটবল তাদের হৃদয় জুড়ে আছে। কখনো পলিথিনের ভিতর কাগজ কিংবা খর ঢুকিয়ে, রাস্তায় পরে থাকা খালি বোতলটিকে কিক করতে করতে প্রমাণ রাখে তাদের ফুটবল অভিজ্ঞতা। একেকটা খালি বোতল হাতে পেলে আবিষ্কার করা যায় একেকজন তারকা মহাতারকা মেসি কিংবা রোনালদো। এই মূহুর্তে রুয়েল তাদেরই দলে। কেমন হতো বাংলাদেশ যদি ফুটবল ওয়াল্ড কাপে খেলতে পারতো? আর রুয়েল হতো সেই দলের বড় তারকা। বাংলাদেশের খেলা হলেই সকলের চোখ থাকতো তার দিকে, তাকে নিয়ে প্রতিপক্ষ আলাদা গেইমিং প্ল্যান করতো। খবরের পাতায় ছাপা হতো বাংলাদেশের বড় তারকা সাকিব হাসান রুয়েল এর ছবি। শিরোনামের হেডলাইন হতো ছোট দলেে বড় তারকা।
.
মুহূর্তে হেসে উঠে রুয়েল। মিহিকে একটু আঘাত করায় সে ভুল বুঝেছে, আঘাতের বিনিময়ে আঘাত ফিরিয়ে দিয়েছে। মানুষগুলো এমন কেন? অল্পতে রেগে যায়। অল্পতে ভুল বুঝে অথচ জানার চেষ্টা করে না ভিতরকার ঘটনা। অথচ সেভেন আপের এই বোতলটি কিছু বলতে পারছে না। বারবার আঘাত করার পরেও সে নিশ্চুপ। কোন আক্ষেপ নেই তার। এখানেই প্রাণহীন বস্তুর পার্থক্য। কিক মারতে মারতে সেভেন আপের বোতলটিকে ডাস্টবিন রেখে বাসায় ফিরে রুয়েল। দিন দিন শিক্ষার হার বাড়ছে অথচ কী লাভ এতে? শিক্ষিত মানুষ হয়েও যখন মূর্খ্যের মতো আচরণ করে। সেভেন আপের এই বোতলটি রাজপথে কোন পথশিশু ফেলেনি কিংবা কোন অবুঝ শিশুও ফেলেনি। লক্ষ টাকার গাড়িতে চড়তে চড়তে এই বোতলটির স্থান হয় পরিষ্কার ঝকঝকে এই পথে। আর কবে হুঁশ হবে? এভাবেই একদিন সৃষ্টি হবে জলাবদ্ধতা, আটকে যাবে ড্রেন। রাস্তায় তৈরি হবে সমুদ্র সৈকত তখন আর সমুদ্রের স্বাদ নিতে কক্মবাজার কিংবা সেন্টমার্টিন নয়। ঘরে বসেই জানালা দিয়ে উপভোগ করবে মানুষের সৃষ্টি সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য। প্লাস্টিক পচনশীল নয়, ব্যবহারের পর যেসব প্লাস্টিক পণ্য ফেলে দেয়া হয়, তার অধিকাংশই যুগের পর যুগ একই ভাবে পরিবেশে টিকে থাকে। আঘাত হানে পরিবেশের ভারসাম্যে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এক গবেষণায় বলেছে, একটি প্লাস্টিক ব্যাগ প্রকৃতিতে মিশে যেতে ২০ বছর সময় লাগে। চা, কফি, জুস কিংবা কোমল পানীয়ের জন্য যেসব প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর ডায়াপার এবং প্লাস্টিক বোতল ৪৫০ বছর পর্যন্ত পচে না।
.
বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরতে ফিরতে হতাশায় নিমজ্জিত রুয়েল। হতাশায় গ্লানিময় চেহারা মায়ের চোখকে ফাকি দিতে পারেনি। অবাক হয় মা। কতদিন পর সন্তানের এমন চেহারা। কী হয়েছে বাবা? রুয়েল ছোট করে উত্তর দেয়, কিছুনা! সান্ত্বনা পায় না মা। চিন্তার সাগরে ডুবে যান তিনি৷ নতুন কোন সমস্যা নয়তো? রুয়েল কিছু লুকাবে না ঠিক সময়ে জানাবে সবটা, অপেক্ষায় থাকে মা। হতাশায় নিমজ্জিত রুয়েল বিছানায় শরীর এলিয়ে দেই, মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠে। মনের ভিতরে জমে থাকা ঢেউ কিছুটা শীতল হয়। মিহি ক্ষমা করুক আর নাইবা করুক, তার কাছে ক্ষমা চাইতে পেরেছে, এতেই আনন্দে নেচে উঠে মন। অশান্ত ফুরফুরে মনকে রাঙ্গাতে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পরে রুয়েল। বৃষ্টি ভেজা পিচঢালা পথে সাইক্লিং করতে বেশ উপভোগ্য হবে। পুরো পৃথিবীর কাছে সাইকেল একটা বিস্ময়। বলা যায়, পৃথিবী ঋণী এই যানটির কাছে। নিজের চালক নিজেই। অন্যের ওপর জুলুম নেই। দাম মারাত্মক কিছু নয়। ধনী-গরিবের ভেদাভেদ মুছে দিতে সক্ষম। আবার দূষণ ঘটায় না। তেল বা গ্যাস, এর ধারে না। চলার জন্য শান বাঁধানো রাস্তাও লাগে না। এমন মানুষ পাওয়া কঠিন, যে সাইকেলের প্রেমে পড়েনি।
.
সাইকেল নিয়ে তার অনেক স্মৃতি আছে, সাইকেল নিয়ে বের হলেই স্মৃতি রোমন্থন হয়। ফিরে যায় অতীতে; আজও তার ব্যতিক্রম নয়। সাইকেলে প্যাডেল ঘুরিয়ে চলে এলো দশ কিলোর অধিক পথ৷ পাক্কা সাইকেল চালক রুয়েল। দুই চাকার এই বাহনটিকে পা এবং হাতের জাদুতে কারুকার্য করতে বেশ পারদর্শী সে। সাইকেল নিয়ে তাদের একটা গ্রুপ ছিল যার নেতৃত্বে ছিল রুয়েল। আজ সব অতীত। অতীতের তলহীন দৃশ্যকাব্যের কাহিনী যাইহোক বারবার হৃদয় নাড়া দিয়ে উঠে তার। সাইকেল থেকে নেমে পড়ল সে। খুব পরিচিত একটা জায়গা। এখানেই সময় কেটেছে বহুদিন। সবুজ অরন্য সবুজ পাতায় ছেয়ে যাওয়া বটবৃক্ষটি সেদিনও ছিল আজও আছে। অনেক গল্পের সাক্ষী হয়ে। বটবৃক্ষের কাছে প্রশ্ন করে। অনেক অজানা প্রশ্ন। যা তা অগোচরে থেকে যাবে বহু বছর। মূহুর্তে চমকে উঠে রুয়েল। এলোমেলো চুল, সাদা শাড়ি পরিহিত এক অষ্টাদশ তরুণী, হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। মুহূর্তে সাইকেলে চরে বসে সে। পিছন থেকে চিৎকার করে ডাকছে তরুণী। তরুণীর ডাক তার কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না। আর এক মূহুর্তও না। যত জলদি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে। সে যতো জোরে প্যাডেল ঘুরাচ্ছে, সাইকেল আরো ধীরগতি হচ্ছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে যাচ্ছে, এখান থেকে পালাতে হবে।
.
চলবে…………….
— সাকিব হাসান রুয়েল