অনুভূতিরা মৃত দশম পর্ব .

0
166

গল্প- অনুভূতিরা মৃত
দশম পর্ব
.
ডায়েরিটা হাতে নিতেই অপরাধবোধ হচ্ছে, অনুমতি ছাড়া কারো ডায়েরিতে হাত দেওয়া অন্যায়৷ জেনেশুনে সেই অন্যায়টি করতে যাচ্ছে রুয়েল। ধূসর রঙের ডায়েরিটা খুব যত্নে করে খুলতে লাগল। কালো কালিতে সযত্নে লেখাগুলো ফুটে উঠছে; প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা– প্রিয় রুয়েল, আমি সাধারণত ডায়েরি লিখি না! কখনোই লিখি না। কিন্তু তোমায় দেখার পর ডায়েরি লিখতে ইচ্ছে হলো, আরো ইচ্ছে হলো তোমার সাথে প্রতিটি মুহূর্ত স্মৃতি, ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা। প্রথম যেদিন তোমায় দেখছিলাম বুলবুল স্যারের ক্লাসে, সেদিনই তোমার প্রতি আমার অনুভূতি জেগে উঠে, বলতে পারো প্রথম দেখায় প্রেমে পড়া। প্রথম দর্শনে প্রেম নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী। তাদের দাবি, প্রথম দর্শনে প্রেম হওয়া সম্ভব নয়। মানুষ যেটাকে প্রথম দর্শনে প্রেম বলে ভাবে, সেটি আসলে কাম বা শারীরিক আকর্ষণ। জানি না বিজ্ঞানীদের এই গবেষণা কতটা সত্য? তবে বিশ্বাস করো, প্রথমবার তোমাকে দেখে মনের মধ্যে তৈরি হলো অজানা ভালোলাগা। ইচ্ছে হলো, চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। মাঝরাতে রিকশায় করে ঘুরি, তোমার জন্য সাজি, শাড়ি পরে ফেইসবুক স্টোরিতে দেওয়া ছবিটায় তোমার লাভ রিয়েক্ট জানান দিবে আমার ভালোবাসা।
.
দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখা– সেদিন হেঁটেছি তোমার পিছু। ভয়ভীতি কমাতে করেছি ফেইসবুকে ফলো। অসংখ্যবার তোমার পায়ের ধূলিতে স্পর্শ করেছি আমার আঙ্গুল। ক্যান্টিনে প্রথম যেদিন চা খেয়েছিলে, সেই চায়ের কাপটি সংগ্রহ করেছি, সযত্নে তুলে রেখেছি আমার টেবিলের উপরে। সেখানে জুড়ে আছে তোমার ঠোঁটের স্পর্শ।
.
ডায়রির তৃতীয় পৃষ্ঠায় এমন দুষ্টু মিষ্টি লেখা, রুয়েল খুঁজছে সদ্য লেখা পৃষ্ঠাটি, হসপিটাল থেকে এসে মিহি লিখেছিল অভিমান গড়া কিছু লেখা। কয়েকটি পৃষ্ঠা উল্টোতেই দেখা মিলল সদ্য লেখাটি, ভেজা পাতায় স্পষ্ট ভেসে আসছে অভিমানী মিহির চোখের জল। যেখানে লেখা– প্রিয় কঠিন হৃদয়ের মানুষ। হ্যাঁ, তোমায় কঠিন হৃদয়ের মানুষ বললেও ভু্ল হবে না। কেননা তোমার মনটা যে কঠিন পাথরে ঘেরা। আমার ভুল ছিল পাথরে ফুল ফোঁটাতে যেয়ে, ভুল ছিল আমার তোমার পথ আটকানো। তোমার কাছ থেকে অবহেলায় অপমানে নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। তখন পর্যন্ত আমার মনে কষ্ট ছিল না, অভিমান ছিল না। অভিমানের পাহাড় তৈরি হয়। আমার এমন পাগলামোর কথা শুনেও যখন তুমি আরামে রাত কাটিয়েছ, আমি হসপিটালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি, একবার আসতে পারলে না আমায় দেখতে? কেমন আছি আমি, জানতে পারতে, তুমি চাইলেই পারতে, একটিবার আসতে পারতে……. ভালোবাসা থেকেই ঘৃণার সৃষ্টি হয়। তোমার জন্য এখন যা আছে সবটা ঘৃণা। আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি তুমি। মাফ করো।
.
অশ্রু টলমল করছে, নিজের প্রতি ক্ষোভ হচ্ছে কিন্তু মিহির ভাবনাগুলো ভুল৷ কীভাবে ভুল প্রমাণ করবে? ডায়েরিতে লেখা মিহির প্রতিটি কথা রুয়েলকে যন্ত্রণা দিচ্ছে, যথাসম্ভব মিহিকে সবটা জানাতে হবে। সে জানে না তাকে দেখতে গিয়েছিল, এটাও জানে না তার শরীরে বয়ছে রুয়েলের রক্ত। জানাতে হবে, স্যরি বলতে হবে, নয়তো ক্ষমা পাবে না। এই মুহূর্তে তা সম্ভব নয়৷ অসুস্থ মিহি যথেষ্ট রেগে, তার সামনে এখন যাওয়া যাবে না। বেরিয়ে পড়ে রুয়েল। আনমনে হাঁটছে, কানে বাজছে মিহির ডায়েরির কথাগুলো। রোদ্দুর দুপুরে স্পষ্ট ছায়া ভাসছে, মিহি হয়তো এটাই চেয়েছিল ছায়া থাকবে। তা আর হয়নি, কখনো হবে না। ভালোবাসার মানুষ থেকে সে আজ ঘৃণার সৃষ্টি। মিহি কি তাকে ক্ষমা করবে? ডায়েরির লেখাগুলো বলছে সে ক্ষমা পাবে না।
.
দীর্ঘ পথ শহরের ফুটপাত দিয়ে উদ্দেশ্যহীন হাঁটছে, উদ্দেশ্যহীন হাঁটা এসে থামল রিভার ভিউ। ক্লান্ত পা দুটোকে শান্ত করে বসল সুরমার রিভার ভিউতে, মানুষজন সাতার কাটছে, কেউবা নদীর বুকে নৌকায় করে ভেসে উঠছে, বিকেল হলেই সুরমার পাড় রিভার ভিউতে মানুষের ভীড় জমে। অবকাশ যাপনের দারুণ একটি জায়গা। রুয়েল প্রায় এখানে আসতো, ইদানিং আসা হয় না। বসে আছে সে, আশেপাশে চোখ ঘুরাচ্ছে, একটা ছাউনির নিচে বসে আছে দু’জন ছেলে মেয়ে। ঠিক যেই ছাউনিতে বসে থাকতো তারা। দুজনের হাতে ফুচকা একটি প্লেটে দু’জনে আরাম করে খাচ্ছে, আহা কী প্রেম। এই ছাউনিতে বসে তারা কাটিয়েছে কত সময়। দুজন দু’জনার হাতে হাত রেখে স্বাদ নিয়েছে সুরমার। সেদিনগুলো আজ অতীত। সোনালী অতীত মনে পড়তেই যন্ত্রায় কাতর রুয়েল। সবকিছু ঠিকঠাক শুধু ঠিক নেই সে অনুভূতিরা তার মৃত।
.
প্রকৃতির নিয়মে সবকিছু চলছে, থেমে নেই পৃথিবী, চলছে তার নিজস্ব গতিতে কিন্তু মাঝে মাঝে থেমে যায় রুয়েল। কি এক অদ্ভুত ভাবনা থামিয়ে রাখে। উঠে পড়ে রুয়েল। সুরমার রিভার ভিউতে রিকশায় উঠে বসল। কানে হেডফোন গুঁজে গান প্লে করল– তুই একটু জেগে উঠ, রাখি তাের ঠোঁটে ঠোঁট, তাের মেঘের সাথে লুকোচুরি ভাল্লাগেনা, আমার ভাল্লাগেনা; আমার ভাল্লাগেনা। তুই একটু জেগে উঠ, রাখি তাের ঠোঁটে ঠোঁট, তাের জন্য অপেক্ষাটা আমার চিরকালের। তাের সঙ্গে হয় না দেখা দোষ কার কপালের?? তাের মেঘের সাথে লুকোচুরি ভাল্লাগেনা, আমার ভাল্লাগেনা। তাের জন্য এই বুকে বাজে গান কবিতার আদর আমি পাগল হলে কিন্তু কলঙ্ক যে তাের। তাের মেঘের সাথে লুকোচুরি ভাল্লাগেনা, আমার ভাল্লাগেনা।
.
কোন কাজে মন বসছে না তার। মনোযোগী হতে পারছে না কিছুতেই, বারবার শুধু কানে বাজে মিহির কথাগুলো। এই কী যন্ত্রণা। বিষাদ মাখা যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা আর নয়। মিহিকে সবটা জানাতে হবে। মুক্তি পেতে হবে এই যন্ত্রণার গ্রাস থেকে। ছুটছে সে। উদ্দেশ্য মিহির বাসা। উিতরে ঢুকতেই মিহির বাবার সাথে দেখা। ভদ্রলোকের মুখে সবসময় একটা হাসি লেগে থাকে, হাসিমুখে স্বাগত জানায় তাকে, রুয়েল সম্মান দেখায়। জানতে চাই, মিহির কথা। উত্তরে বলে, মিহি ছাদে। পাঁচতলা বাড়ির ছাদ। লিফটের ব্যবস্থা নেই, শুনেছে মিহির বাবা সরকারি চাকরি করতো। ভূমি অফিসার ছিলেন। তাদের এমন বাড়ির সংখ্যা সাতটি। সিলেট শহরেই পাঁচটি, এত বাড়ি গাড়ি দিয়ে ভদ্রলোক কী করবে? একটিমাত্র মেয়ে উনার। নিশ্চয় মেয়ের জামাইকে দিয়ে যাবেন। তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রুয়েল ভাবে, সরকারি চাকরি করলেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এত টাকা আসে কোথা থেকে? সবই কী, বেতনের টাকা। মাথা কাজ করে না তার। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে পৌঁছায়। ছাদে দাঁড়ানো মিহি। বিষন্ন মনে আকাশে তাকিয়ে আছে, মন খারাপ হলে আকাশকে বড় আপন মনে হয়। খোলা আকাশ কিংবা বিশাল মাঠে উপস্থিত হলে মন ভালো হয়ে যায়।
.
মিহির মন কিছুটা হলেও ভালো। আকাশে সাদা মেঘ, হেমন্তের বিকেল, সূর্যের মিষ্টি রোদ, উড়ন্ত বাতাস, ঝরঝরে খোলা চুল। মিহির পিছন সাইড অনেকটা পরীদের মতো৷ পরীদের চুল কখনো কেউ দেখেছে? কেমন দেখতে তাদের চুল। রূপকথার গল্পে পরীদের চুলের বর্ণনা দেওয়া হয়নি। তবে বাস্তবে এক পরীর চুল দেখেছে সে। উড়ন্ত বাতাসে চুলগুলো বারংবার উড়ছে, মিহি ঠিক করার চেষ্টা করছে, খোলা চুলে অপরুপ তার মুগ্ধতা। কবির কবিতার মত মুগ্ধকর।
.
কীভাবে শুরু করবে রুয়েল? তা আর ভাবেনি। স্বাভাবিক ভাবেই ডাক দিল– মিহি। অদ্ভুত একটা মায়া ছিল এই ডাকে, পরিচিত কণ্ঠস্বর। চমকে উঠে মিহি। পিছন ফিরে তাকাতেই মুখোমুখি রুয়েল ও মিহি।
— আমি জানতাম না তুমি এমন পাগলামি করবে। তবে সত্যি বলছি, তোমার বন্ধুত্ব আমি গ্রহণ করতাম। বিশ্বাস করো, তোমার কষ্টে আমি কষ্ট পেয়েছি, ঘুমাতে পারিনি একটি রাত। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে, ক্ষমা করো আমায়। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শেষ করে রুয়েল। মিহি নিশ্চুপ। চলে যাচ্ছে সে। পথ আটকে দাঁড়ায় রুয়েল। মিহির হাত ধরে অাটকানোর চেষ্টা করে, চোখ বন্ধ করে রাখে। তুমি যেতে পারবে না। বলো আমায় ক্ষমা করেছো? প্লিজ বলো। নয়তো আমি শান্তি পাবো না। আরাম পাবো না। প্লিজ! মূহুর্তে থমকে উঠে রুয়েল। মিহির হাতের স্পর্শে তার গাল নেড়ে উঠে, নাটক হচ্ছে এগুলো? কে বলেছে তোমায় এখানে আসতে? তখন কোথায় ছিলে যখন আমি মৃতপ্রায় ছিলাম। প্লিজ আমার সামনে থেকে যাও, নিতে পারছি না আমি।
.
মিহির হাতের থাপ্পড় তার অনেক দিন মনে থাকবে। চলে আসছে সে, কান্নায় ভেঙে পড়ে মিহি। কী এক মায়া। মিহি কেন কাঁদছে? সে তো ছেলেটাকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তাহলে কেন এই মিথ্যে কান্না? মিহির কাছে অপরাধী রুয়েল, ক্ষমার অযোগ্য রুয়েল, মানুষের আবেগ নিয়ে খেলা করা রুয়েল, পাথর মনের অধিকারী রুয়েল। আজকে থাকে অসংখ্য নামে অাখ্যায়িত করা যাবে৷ তাতে কোন আক্ষেপ নেই শুধু একটিবার মিহি যদি বলতো ইট’স ওকে, হেঁসে উঠতো তার মন। নেঁচে উঠতো হৃদয়। ভিতরে থাকা অপরাধবোধকে ছুঁয়ে দিতো শীতল বাতাস।
.
চলবে……………….
— সাকিব হাসান রুয়েল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here