#ধারাবাহিকগল্প
#কলঙ্কের বোঝা
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী
অথচ শায়লার বান্ধবী শিলাকে দেখে শায়লার খুব মায়া হতো। শিলা প্রায় কলেজে এসে শায়লার কাছে কান্নাকাটি করতো। শিলার পরীক্ষার রেজাল্টও খুব খারাপ হতো। ও খুব ডিপ্রেশনে থাকতো। একদিন শায়লা শিলাকে বলে,
—–কিরে শিলা তুই বাসায় ঠিকমতো পড়াশোনা করছিস না? এভাবে পরীক্ষায় ফেল করলে তোকে তো ফাইনাল পরীক্ষা দিতে কলেজ অনুমতি দিবে না।
—–শায়লা আমার তো বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমি তো অপয়া অলক্ষী।
—-শিলা এসব কথা কেন বলছিস? মানুষ কেন অপয়া অলক্ষী হবে?
—তুই যাই বলিস না কেন আমি সত্যি অপয়া অলক্ষী।
—- শিলা তোর নিজেকে অপয়া বলার কারণটা কি?
আমাকে বলা যাবে?
—–শায়লা আমি আর পারছি না। এতটুকু বয়সে জীবনের এতো ভার বইতে পারছি না। নিজের রক্তের সম্পর্কের কাছে আমার কষ্টের কথাগুলো বলতে পারছি না। তারাতো ধরেই নিয়েছে আমি যেহেতু অপয়া অলক্ষী আমার কোন কষ্ট থাকতে নেই। শায়লা আমি আমার বন্ধ মনের জানালা খুলে তোর কাছে সব বলতে চাই। তবে এটা আমার পরিবারের কথা। তুই আমাকে কথা দে, কাউকে বলবি না।
—-ঠিক আছে শিলা আমি তোকে কথা দিলাম। তবে তুই ও আমার কাছে শেয়ার করে মনটা হালকা করবি আর পড়াশোনায় মনোযোগ দিবি।
—শায়লা আমরা চার ভাই বোন। দুই বোন দুই ভাই। আমার উপরে এক বোন এক ভাই। আমি আর সজল জমজ ভাই বোন। আমাদের জন্মের সময় মার শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়। সে সময় গ্রাম থেকে একটা ষোল বা সতেরো বছরের এতিম মেয়ে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওর নাম সখিনা। আমার ভাইটা মার কাছে থাকতো আর সখিনা আমার দেখাশোনা করতো। একদিন রাত্রে আম্মু ঘুম থেকে উঠে দেখে পাশের খাটে আব্বু নেই। তারপর আব্বুকে খুঁজতে গিয়ে দেখে আব্বু সখিনার ঘরে শুয়ে আছে। আম্মু শরীর খুব খারাপ থাকার কারনে আব্বুকে কিছু বলতে পারেনি। কিছুদিন পর সখিনা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আসলে ও তখন কনসিভ করে ফেলে। আম্মু ওকে দেশে পাঠিয়ে দিতে পারেনি কারণ লোকের কানে গেলে আম্মুদের পরিবারের বদনাম হবে। আমার নানার বংশ নাকি জমিদারের বংশ। আম্মু আব্বুর সাথে সখিনার বিয়ে দিয়ে দেয় এবং আব্বুকে কিছু শর্ত দেয়। আব্বু সখিনাকে সামাজিক ভাবে স্বীকৃতি দিতে পারবে না। তবে সখিনা আর মেয়ের খরচ বহন করবে এবং স্ত্রী আর সন্তানের হক পালনও করতে পারবে।
—-শিলা, আন্টি তো অনেক বড় মনের পরিচয় দিয়েছে।
—- তা হয়ত আমার মা দিয়েছে কিন্তু আমার জীবনটাকেও বলি দিয়েছে। সব রাগ আমার মা আর ভাইবোন আমার উপর ঢালতো। সব সময় বলতো আমার কারনে আমার মার কপালে সতীন জুটেছে। অথচ সজলের জন্মও আমার সাথে হয়েছে। সজলকে কেউ কিছু বলতো না। কারন ওতো ছেলে সন্তান। আমি মেয়ে আবার কালো হয়েছি। আমার ভাই বোনেরা সব ফর্সা হওয়ার কারনে আমাকে ওদের থেকে আলাদা লাগতো। সবাই যে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতো আমি দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতাম কারো মাথা ব্যথা ছিলো না। আমি বাঁচি কি মরি তাতেও ওদের কোন চিন্তা নেই। অথচ এই ব্যাপারে আমার কোন হাত ছিলো না। আর সবচেয়ে দোষী ছিলো আমার বাবা উনি কিন্তু বহাল তবিয়তে ছিলেন। উনাকে কেউ কিছু বলতো না। ওই মহিলার কাছে যায় সময় কাটায় তা নিয়ে বাসায় কোন অশান্তি হয় না। সব রাগ ঝাল ওদের আমার উপর। আমাকে সারাদিন সংসারের কাজ করে যেতে হয়। পান থেকে চুন খসলেই খোঁটা শুনতে হয়। এখন বল আমি কিভাবে পড়াশোনা করবো?
শায়লার সখিনার জন্য খুব মায়া হয়। আর নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে হয়। কিন্তু শায়লার কপালে সুখ বেশীদিন সইলো না। ওর মার ক্যান্সার ধরা পড়লো। ঘরের কাজকর্ম অচল হয়ে পড়লো। গত ছয়মাস শায়লাদের পরিবারের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলো। অপারেশন করে শায়লার মার ইউটেরাস ফেলে দেওয়া হলো। এরপর কেমো চলতে লাগলো। ঘরের কাজকর্ম, রোগীর সেবা, শায়লার কলেজ, ওর বাবার অফিস, সবকিছু মিলে ওদের বাসায় তখন বেসামাল অবস্থা। এমন সময় ওর বাবার অফিসের পিয়ন পঁয়ত্রিশ বছরের এক বিধবা মহিলাকে বাসায় কাজের জন্য ঠিক করে দেয়। যার ফলে ওদের সংসার আবার স্বাভাবিক গতি ফিরে পায়। কিন্তু ভালবাসার ভিত নড়ে যায়।
দু,দিন আগের কথা।
এর মধ্যে শায়লার কলেজে প্রি টেস্ট শুরু হয়। ওর মার শরীরটাও সামলে উঠে। রাত জেগে শায়লা রুমের দরজা বন্ধ করে পড়াশোনা করছিলো। ওর খাবার পানি বোতলে ছিলো না। রাত দুটোর দিকে ও রুম থেকে বের হয়। এমন সময় শায়লা দেখে ওই মহিলার ঘর থেকে ওর বাবা বের হচ্ছে। আর বাবার পিছনে আলুথালু বেশে ওই মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। শায়লা ভুত দেখার মতো চমকে উঠে। শায়লার বাবাও শায়লার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে। শায়লা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। শায়লার বাবা মাথা নিচু করে ওর সামনে থেকে চলে যায়। সেদিন সকালে শায়লা ওর বাবার মুখোমুখি হতে পারেনি। শায়লা ভাবছিলো বাবা এই কাজটা কিভাবে করলো। ওর বাবাও হয়ত বিবেকের সাথে লড়াই করে পেরে উঠেনি। তাই অফিসে স্ট্রোক করে বাথরুমে পড়ে গেলো। তারপর ওর বাবা দুনিয়া থেকে চলে গেলো। ওই মুখটা শায়লাকে আর দেখতে হলো না। মানুষের জীবনের কি নির্মম পরিহাস!
শায়লা ছোটো মামা লোকমানের ডাকে সম্বিত ফিরে পায়।
—-শায়লা তোর বাবাকে মসজিদে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শেষ বারের মতো নিচে গিয়ে দেখে আয়।
—-শায়লার বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠে। ও ভাবে সেদিন আব্বার মুখোমুখি না হলে তো উনি স্ট্রোক করতেন না। আবার নিজেকে সান্তনা দেয় আব্বুর হায়াত এই টুকুই ছিলো। আর ওর বাবার কলঙ্কের দাগটা ওর হৃদয়ের গভীরে রয়ে গেলো।
শায়লা বাবাকে শেষ বিদায় দিয়ে ঘরে চলে আসলো। আত্মীয় সবাই যার যার বাড়িতে চলে গেলো। ঐ ঘটনার পরদিন ওই মহিলাও চলে গিয়েছিলো। শায়লার মা শায়লার রুমে এসে বললো,
—-গোসল করে ওজু করে এসে নামাজ পড়ে বাবার জন্য দোয়া করো। আর তোমার বাবার উপরে কোন অভিযোগ রেখো না।
—-মা আমার বাবা, বাবা হিসেবে ভাল হলেও স্বামী হিসেবে তোমার কাছে পরিপূর্ণভাবে কৃতকার্য হতে পারেনি। তবে তুমি কেন তাকে পাশ মার্ক দিয়ে তার সাথে সংসার করে গেলে।
—-আমার বাবা মা বেঁচে নেই। আমি এসএসসি পাশ করেছি। কোথাও চাকরিও পাবো না। ভাইদের সংসারে গিয়ে দাসীবৃত্তি করার থেকে নিজের সংসারে মানিয়ে নিয়ে খাওয়াটাকে আমার শ্রেয় মনে হয়েছে। আর লড়াই করতে গেলে পায়ের তলার মাটিটা শক্ত হতে হয়। এইজন্য তোকে ছোটোবেলা থেকে একটা কথা বলতাম, পায়ের তলার মাটি শক্ত করো।
—-আচ্ছা মা, পায়ের তলার মাটি শক্ত হলে কি এইসব পরিস্থতির মুখোমুখি হতে হয় না?
—-হয়ত হয় তবে চাইলে লড়াই করা যায়। আমার মতো মুখ বুঁজে মেনে নিতে হয় না। জীবনকে নিয়ে তখন অন্যভাবেও চিন্তা করা যায়।
পরবর্তীতে শায়লার জীবনে ওর বাবার এই ঘটনাটা অনেক প্রভাব ফেলেছিলো।
__________
এইভাবে মায়ের রোগে শোকে শায়লাদের দিন পার হতে লাগলো। ওর বাবা মারা যাওয়াতে ওরা আজিমপুরের বাসা ছেড়ে দিয়ে কল্যাণপুরে চলে আসলো। তবে ওর চাচা খুব একটা খুশী হলেন না। নিজের বিধবা ভাবি আর এতিম ভাস্তির কোন খোঁজখবর রাখতেন না। মা মেয়ে অনেক লড়াই করে ওর বাবার কলিগদের সহায়তায় পেনশনের টাকাটা উঠাতে পেরেছিলো। শায়লা জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও খুব ভালভাবেই এইচএসসি পাশ করলো। তখন ওর মেজ মামা এসে এমন প্রস্তাব দিলো শায়লা ভাবলো মানুষ এতোটা হিংসুটে কিভাবে হয়।
চলবে