#ধারাবাহিকগল্প
#কলঙ্কের বোঝা
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী
নাকের ফুলটা খুঁজে পাওয়া গেলেও শায়লা নাকফুলটা রেখে দিয়েছে। ওটা আর ইহজনমে ও পড়বে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অতঃপর সেজানের মাও আর এটা নিয়ে বেশী বাড়াবাড়ি করেনি। উনি ওনার বয়সের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছেন এই মেয়ে খুব শক্ত ধাতু দিয়ে গড়া।
এদিকে সেজান শায়লার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। শায়লার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। কিন্তু চেহারাটা ভারী মিষ্টি। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা। সহজেই সবার নজর কেড়ে নেয়। সেই ভার্সিটিতে প্রথম যেদিন ক্লাস করেছিলো সেজান সেদিন থেকেই শায়লার প্রেমে পড়েছে। অবশেষে শায়লাকে বউ হিসাবে পেলো। আনন্দে আহ্লাদে আটখানা হয়ে শায়লার কানে কানে বলতে ইচ্ছে করছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা ওর বউ হয়েছে। কিন্তু মায়ের হিন্দি সিরিয়ালের কাহিনীতে আর শায়লার রেগে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে সেজান মিইয়ে গেলো। কথাটা বলা হলো না। বাসর রাতের জন্য জমা রেখে দিলো।
যাইহোক আকদ হয়ে যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর রিসিপশনের ডেট ঠিক হলো। এর মাঝে সেজানের মা শায়লার মাকে ফোন দিয়ে বললো
—–বেয়াইন, ডালার মধ্যে বিশটা শাড়ি দিয়ে দিবেন। আমার আত্মীয়স্বজন সবাইকে দিতে হবে। বোঝেন তো এটা একটা সম্মানের বিষয়। তবে শাড়িগুলো একটু দামী দেখে পাঠাবেন। আমরাও আপনাদের ডালায় আপনাদের আত্মীয়স্বজনের জন্য শাড়ি কিনে পাঠাবো। আর একটা কথা বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার মেয়ে জামাইয়ের জন্য স্যুটপিস দিয়েন। আর সেজানের বাবার জন্য ভাল দেখে পাঞ্জাবী দিয়েন। হাজার হোক ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া উপহার। আত্মীয়স্বজন সবাই দেখবে তা একটু দামী না হলে কি চলে?
—-ঠিক আছে বেয়াইন। আপনার কথামত সব পাঠানো হবে।
ফোন রাখার পর শায়লা ওর মাকে বললো,
—-কি এতো কথা বললে আমার শাশুড়ীর সাথে?
—না, তেমন কিছু না। ডালায় কি কি যাবে ওনারা কি পাঠাবে এসব নিয়ে কথা হচ্ছিলো।
শায়লার মা মিনারা বেগম সেজানের মায়ের কথাগুলো শায়লার কাছ থেকে চেপে গেলেন। কারণ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এই মেয়ে তো বিয়েতে রাজি ছিলো না। আল্লাহপাকের রহমতে মেয়েটার বিয়ে দিতে পেরেছেন এতেই উনি খুশী। এমনিতেই মানুষের নিঃশ্বাসের কোন বিশ্বাস নেই। তার উপর শরীরে যে রোগ বাসা বেঁধেছে কটা দিনেই বা বাঁচবেন। মেয়েটার বিয়ে হওয়াতে শরীরটা হালকা লাগছে। এবার নিশ্চিন্তে দুনিয়া থেকে চলে যেতে পারবেন।
শায়লা ওর মায়ের অসুস্থতা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় শিলার খোঁজখবর রাখতে পারেনি। এর মধ্যে শিলার বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়েতে শায়লাকে দাওয়াত দিয়েছিলো। মায়ের অসুস্থতা থাকায় বিয়েতে যেতে পারেনি। শিলা একটু অভিমান করেছিলো। শায়লা ওর নিজের বিয়ের দাওয়াত দিতে শিলাকে ফোন দিলো।
—-হ্যালো, শিলা কেমন আছিস?
—-এতোদিন পর আমার কথা তোর মনে পড়লো।
—-তুই তো জানিস, মা প্রায় অসুস্থ থাকে।
—আমারও শরীর ভাল না শায়লা। আমার হার্টের বাল্বের সমস্যা ধরা পড়েছে। এর মাঝে আবার কনসিভ করেছি। ডাক্তার আমাকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছে। আমার জন্য দোয়া করিস।
শিলার সাথে কথা বলার পর শায়লার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মেয়েটা সারাজীবনে সুখ পেলো না।
যাইহোক আজ শায়লা আর সেজানের রিসিপশন। ডালায় করে দুই পরিবার উপহার পাঠিয়েছে। শায়লার মা সেজানের মায়ের কথা অনুসারে দামী শাড়ি পাঞ্জাবী পাঠিয়েছে। কিন্তু সেজানের মা খুব সাধারণ জিনিস পাঠিয়েছে। শায়লার মায়ের জন্য শাড়ি ওর চাচী আর ফুফুদের জন্য শাড়ি আর চাচা ফুফা এদের জন্য পাঞ্জাবী পাঠিয়েছে। সেজানের মা ছোটো মনের পরিচয় দিয়েছে।শায়লার মায়ের মন খারাপ হলেও মেয়ের সামনে প্রকাশ করলেন না। তবে শায়লা পুরোটাই বুঝে ফেলেছে। ওর শাশুড়ীকে ওর অনেকটাই চেনা হলো। এতো মন কষাকষির পরও বেশ সুন্দর ভাবেই ওদের রিসিপশনটা হয়ে গেলো। কারণ শায়লার মা কোন উচ্চবাচ্চ্যই করেননি। উনি চেয়েছেন উনার মেয়েটা সুখী হোক। আজ শায়লা আর সেজানের বাসর ঘর। শায়লা বাসর ঘরে বসে আছে।
সেজান ঘরে এসে শায়লাকে বললো,
—-শায়লা ওজু করে আসো। আমরা একসাথে নামাজ পড়ে নিজেদের সুখের জন্য আল্লাহ পাকের কাছে প্রার্থনা করি।
শায়লা ওয়াশরুমে গিয়ে পোশাক চেঞ্জ করে ওজু করে আসলো। তারপর দুজনে মিলে নামাজ পড়ে নিলো। নামাজ শেষ করে সেজান শায়লার কাছে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। শায়লা একটু দূরে সরে গিয়ে সেজানকে বললো,
—–সেজান আমার জীবনটা আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক ভাবে পার হয়নি। এইটুকুন বয়সে আমি অনেক চড়াই উৎড়াই পার হয়েছি। দেখ তোমাকে আমি কিছু শর্ত দিয়েছিলাম। তোমার নিশ্চয় মনে আছে।
—–শায়লা আমার সবই মনে আছে। আজকের রাতটা আমরা কঠিন কথা না বলে একটু রোমান্টিকতায় হারিয়ে যেতে পারি না?
—-সেজান ওই যে তোমাকে একটু আগেই তো বললাম আমার জীবনটা সবার মতো স্বাভাবিক নিয়মে চলে না। হয়ত আজ রাত আমি স্বামী সোহাগে সোহাগিনী হয়ে বাসর সজ্জা করবো। আল্লাহ না করুন সকালে না জানি মায়ের মৃত্যুর সংবাদে ঘুম ভেঙ্গে যায়। এটাই আমার জীবন। সেজান তোমাকেতো আগেই বলেছি সপ্তাহের চারদিন আমরা বাড্ডায় থাকবো আর তিনদিন আমরা কল্যানপুরে থাকবো। এটা নিয়ে আবার তোমাদের বাসায় ঝামেলা হবে নাতো?
—–আমি তো বলেছি শায়লা এগুলো ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার। জীবনে সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মে চলবে এই রাত কিন্তু বারবার আসবে না। আমাদের এমন করা উচিত না যাতে সারাজীবন এই রাত নিয়ে আফসোস করতে না হয়।
পরদিন খুব সকালে শায়লার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ফ্রেস হয়ে এসে ফজরের নামাজটা পড়ে নিয়ে বারান্দায় বসে থাকলো। সেজান তখনও ঘুমুচ্ছে। শায়লা ভাবছে বেলাটা একটু বাড়লে মাকে ফোন দিয়ে খোঁজ নিবে। একটু পর সেজানেরও ঘুম ভেঙ্গে গেলো। শায়লা পাশে নেই দেখে বারান্দায় এসে শায়লাকে বললো,
—-কখন উঠেছো?আমাকে ডাকোনি কেন?
—-কালকে তোমার উপর অনেক চাপ গিয়েছে। ভাবলাম আর একটু বেলা হলে তোমাকে ডেকে দিবো।
—-শায়লা তুমিও তো ক্লান্ত ছিলে।
—-তা ছিলাম। আম্মুর জন্য টেনশন হচ্ছে। ফোন দিয়ে আগে খোঁজটা নেই।
সেজান ওয়াশরুমে চলে গেলো। শায়লা ওর মাকে ফোন দিলো,
—–হ্যালো আম্মু কেমন আছো?
—-আমি ভাল আছি। তুই এতো সকালে ফোন দিয়েছিস কেন?
—-আম্মু তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছে।
—-এতো চিন্তা করিস না। শ্বশুর বাড়িতে সবার সাথে সুন্দরভাবে সময়টা পার কর। দু,দিন পর তোর অফিস খুলে যাবে।
সেজান বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে শায়লাকে বললো,
—–আজ রাতেই আমরা ঢাকার বাইরে যাচ্ছি।
—আমাকে তুমি কিছুই জানাওনি সেজান?
—-তোমাকে সারপ্রাইজ দিব বলে জানাইনি শায়লা। আমরা এর পর অফিস থেকে লম্বা ছুটি পাবো না। তাই ভাবছিলাম দেশের ভিতরে হানিমুন ট্রিপে যাবো। এই উদ্দেশ্য সাইরুতে বুকিং দিয়েছি।
শায়লা মনে মনে খুশী হলো। তারপর সেজানকে বললো,
—-সাইরুর ঘটনা তুমি জান?
—-না,জানিনা।
—–সাইরু হচ্ছে এক অভিমানী প্রেমিকার নাম। সে তার প্রেমিক না পেয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলো।
—শায়লা, তুমি কোন পজেটিভ কথা বলতে পারো না?
—-রাগ করছো কেন?এমনিতেই বললাম।
দরজায় কে যেন নক করছে। সেজান দরজাটা খুলে দিয়ে দেখে রিমি দাঁড়িয়ে আছে।
—-কি ব্যাপার তোমরা নাস্তা খাবে না?বাবা মা টেবিলে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
—-ঠিক আছে তুই যা আমরা এখুনি আসছি।
শায়লা আর সেজান পরিবারের সবার সাথে নাস্তার টেবিলে বসে সেজান ওর মাকে বললো,
—-মা আজ রাতে আমরা ঢাকার বাইরে যাবো।
—–কখন ঠিক করলি? আমাকে তো কিছুই জানাসনি।
—-এই যে মা আমি এখন তোমাকে জানালাম।
—-নিজেরা আগে সব ঠিক করে এখন বলছিস তোমাদের জানালাম।
—-ভাইয়া কাজটা ঠিক হলো না। তোমরা দু,দিন পরেও যেতে পারতা। আমরা তো সবাই জব করি। কেউ কাউকে সময় দিতে পারি না। তোমার বিয়ে উপলক্ষে আমিও দুদিন ছুটি নিয়েছি। ভাবির সাথে সময় কাটাবো। আর তুমি এখন ভাবিকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছ।
মিজান সাহেব বললেন,
—-তোরা সবাই তোদের দিকটা দেখছিস। ওদের কথাটাও তো তোদের ভাবা উচিত। ওরাও হরহামেশা ছুটি পাবে না। সেজান তুই ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। বৌমাকে নিয়ে ঘুরে আয়।
সেজানের মা মনে মনে ওর বাবার উপর খুব ক্ষেপে গেলো। এই মানুষটার কাজ হচ্ছে সবসময় উনার মতের বাইরে চলা। মুখে সেজানের মা কিছুই বললেন না। তবে শায়লার উপর খুব মনক্ষুন্ন হলেন। সব এই মেয়ের বুদ্ধি। আমার ছেলেটাকে এখন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে। কি দেখেযে আমার ছেলেটা মজেছে কে জানে। ধিঙ্গি মারা গঠন। আর গায়ের রংয়ের ঐ তো ছিরি। সেজান ওর মায়ের মুখ দেখে বুঝেছে মা এই বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি।
অতঃপর শায়লা আর সেজান রাত এগারোটার বাসে বান্দরবনের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো। খুব ভোরে ওরা বান্দরবনে পৌছে গেলো। তারপর চান্দের গাড়িতে করে সাইরুতে পৌছে গেলো। রুমে পৌছে শায়লার মনটা ভরে গেলো। হাত দিয়ে মেঘকে ছুঁয়ে দেওয়া যায়। চারিদিকে এতো সবুজ। পাহাড়ের কোল ঘেঁসে একেঁবেঁকে ঝিরিগুলো বয়ে চলেছে। শীতল বাতাস শরীরটাকে ঠান্ডা করে দেয়।
আসলেই প্রতিটি মানুষের শহরের যান্ত্রিক জীবন থেকে বের হয়ে পাহাড়, সমুদ্র কিংবা প্রকৃতির মাঝে নিজেকে মেলে ধরা উচিত। তাহলে দুঃখ কষ্টগুলো অনেক হালকা হয়ে যায়। জীবনটা বয়ে নেওয়া সহজ হয়। শায়লা খুশীতে সেজানকে জড়িয়ে ধরলো সেজানও শায়লাকে আদরে ভরিয়ে দিলো। পরদিন খুব ভোরে ফোনের শব্দে শায়লা আর সেজানের ঘুম ভেঙ্গে গেলো।
চলবে