#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_31
দৃশ্য সন্ধ্যা থেকে বিছানায় মুখ গুজে কাদঁছে।কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।তার এই ছোট্ট জীবনে দেখা সবচাইতে অমায়িক আর ভালোমানুষ হলো আমজাদ রহমান।এই মানুষটিকে দেখলে মন থেকে শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। মানুষটা যখন তাকে ঘরের লক্ষী বলে ডাকে তখন দৃশ্যর বুকে এক শীতল প্রশান্তিতে ভরে যায়। তার বাবা নিজে কোনো দিন তাকে এতো আদুরে গলায় ডাকেনি।আর আজ এই মানুষটি কে তার বাড়িতে এসে অপমানিত হতে হলো। মাহাদ কি করে সহ্য করবে তার বাবার এই অপমান?
দৃশ্যদের বাসা থেকে বের হয়ে আমজাদ রহমান চুপচাপ গাড়িতে বসেন। অন্যদিকে মাহাদের বড় মামা রাগে ফুসফুস করছেন। আরিফ বেশ চিন্তিত হয়ে গাড়িতে বসে আছে। আমজাদ রহমান বুকে কিছুটা ব্যথা অনুভব করছেন।তার পুরো জীবনে দ্বিতীয়বার এতটা অপমানের সম্মুখীন হলেন। প্রথমবার নিজের ভাইয়ের জন্য আর দ্বিতীয়বার নিজের ছেলের জন্য একই মানুষের ধারা তিনি দুইবার অপমানিত হলেন। পুরো রাজশাহী শহরে তিনি বেশ সম্মানিত একজন মানুষ। ঢাকাতেও ব্যবসায়ীক কাজে তিনি সকলের কাছেই সম্মান পেয়েছেন।
মাহাদের মামা রেগে বললেন
-“রাগে আমার শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে। এই দুইদিনের মেয়রের সাহস কি করে হয় আমজাদ ভাইকে অপমান করার? সে কি জানে না আমজাদ ভাইয়ের ক্ষমতা কতটুকু?ভাইয়ের একটা কল এই বেয়াদবের পুরো রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে পারে। ভাই শুধু আপনি আজ আটকিয়েছেন বলে। না হলে এই বেয়াদবের রাজনীতি চিরতরে ঘুচিয়ে দিতাম।”
আমজাদ রহমান নরম কন্ঠে বললেন
-“আহা রফিক! এত উত্তেজিত হইয়না। ওর মতো ক্ষমতার বড়াই করলে আমার আর ওর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না। তাছাড়া ওর মেয়েটার মাঝেই আমার ছেলের সর্বসুখ নিহিত।”
-“এত ভালো মানুষই দেখিয়ে কোন লাভ নেই ভাই।ওদের পুরো জাতটাই ঘাওড়া। অহংকারে এদের পা মাটিতে পড়ে না। আরিফের সাথে যা করেছে এখন মাহাদের ঠিক তাই করতে চাচ্ছে। কোন দরকার নেই এই পরিবার থেকে মেয়ে নেওয়ার। মাহাদের জন্য আমরা অনেক ভালো মেয়ে দেখব।”
আমজাদ রহমান চোখ বুঝে রইলেন।কারণ তিনি জানেন তার ছেলেকে বিশ্ব সুন্দরী এনে দিলেও তার ছেলে সে দিকে ফিরেও তাকাবে না।ছেলেটা যে ওই বাচ্চা মেয়েটাতে আটকে গেছে।আমজাদ রহমান গম্ভীর স্বরে বললেন
-“আজকের এই ঘটনা যেন মাহাদ কিছুতেই জানতে না পারে। ওকে শুধু এতোটুকুই জানাবো যে তারা রাজি হয়নি। বাকি ডিটেলস কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই। কারণ মাহাদ জানলে সবকিছু উলটপালট করে ফেলবে। আর আমি চাই না আমার ছেলের ধারা কোন অন্যায় হোক।”
গাড়ি চলতে শুরু করলো। ছেলেকে নিয়ে ভীষণ ভয়ে আছে আমজাদ রহমান। সব কিছু কিভাবে সামাল দিবে সেটাই ভাবতে পারছেন না। অন্যদিকে আরিফ বাইরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার মাথায় চলছে হাজারো চিন্তা। আর যাই হোক মাহাদের জীবনটা সে কিছুতেই নষ্ট হতে দিতে পারেনা। পর মুহুর্তেই তার আবার মনে পড়লো দৃশ্য সেই কান্না মাখা মায়াবী মুখটা। ওই মায়াবী মুখে কান্না একদম মানায় না।মেয়েটার হাসি নিশ্চয়ই দিশার মতোই হবে।
বাসায় ফিরতেই শামসুন্নাহার বেগম তাদের জিজ্ঞাসা করলেন সেখানে কি হয়েছে? কারণ তিনি বিশ্বাস করেন আর যাই হোক ওই আশরাফ খুব বেশি ভালো ব্যবহার করেছেন বলে মনে হয় না। মাহাদ বাসায় ছিল না। তাই রফিক সবকিছু খুলে বললেন। আখি রহমানের চোখ ভিজে উঠেছে। তার স্বামীকে এতটা অপমানিত হতে হয়েছে সেখানে ভেবেই কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মনের অজান্তেই দৃশ্যের প্রতি চাপা ক্ষোভ তৈরি হলো তার।
অন্যদিকে শামসুন্নাহার বেগম বিলাপ শুরু করলেন।
-“ওই জানোয়ারের বাচ্চা যে এমন করবো সেটা তো আমি আগে থেকেই জানতাম। কত বড় সাহস আমার পোলারে অপমান করে। হেরে সামনে পাইলে জুতা পিডা করতাম। বাপ ছিলো খচ্চর পোলা দুইটাও হইছে খচ্চর।আমি আগে মানা করছিলাম হেনে যাইতে। কেউ তো আমার কথা শুনেনা। ওই জাতের কোন মাইয়াই আমি আমার বাসায় তুলমু না।”
আমজাদ রহমান নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে মায়ের পাশে বসে হাত ধরে বললেন
-“আম্মা মাথা ঠান্ডা করেন। এখানে যা কিছু হয়েছে তাতে তো মেয়েটার কোন দোষ নাই। আর আপনি এরকম করলে প্রেসার বেড়ে যাবে। যা হয়েছে সব ভুলে যান।”
-“কি কস তুই আমি ভুলমু এই কথা? এই জীবনে ও না। আমার পোলারে অপমান করছে এত বড় বুকের পাডা?”
-“আহা আম্মা! এই বিষয়ে আর একটা কথাও বলবেন না। মাহাদকে ভালো করেই চিনেন। আমি চাইনা মাহাদ এত সব কিছু জানুক। মাহাদ সব কিছু জানলে কি ঝড় তুলবে সেটা তো আন্দাজ করতে পারছেন?”
কথাটা বলে দরজার দিকে তাকাতেই তিনি থমকে গেলেন। মাহাদ দরজার সামনে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। মাহাদের চোখ দিয়ে যেন আগুনের শিখা বের হচ্ছে। দরজার পাশের বড় ফ্লাওয়ার ভাসটা এক লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেলল মাহাদ।আর রেগে বললো
-“ওই আশরাফ হোসেনকে তো আমি আজকে জিন্দা কবর দিব। তার সাহস কি করে হয় আমার বাবাকে অপমান করার?”
কথাটা বলেই মাহাদ বাইরে যেতে নিলে আমজাদ রহমান দ্রুত মাহাদকে আটকায়। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্ত স্বরে বলেন
-“বাবা আমার শান্ত হও। আমি চাইনা রাগের বসে তুমি কোন অন্যায় কর।কারণ তোমার প্রতিটা পদক্ষেপ সরাসরি দৃশ্যর উপর প্রভাব ফেলবে।কারণ তারা দৃশ্যর পরিবার।তাদের কষ্ট দেওয়া মানে দৃশ্যকে কষ্ট দেওয়া।তুমি নিশ্চই সেটা চাওনা?”
মাহাদ বাবাকে জড়িয়ে ধরে নিরবে চোখের পানি ফেলে চলছে।আজ তার জন্যে বাবাকে এতো অপমানিত হতে হলো।এতো কিছুর পরও দৃশ্যর কথা ভাবছে।কয়জন বাবা এমন করে?তার বাবা এতো ভালো মানুষ কেনো?নিজেকে স্বচ্ছ রাখতে রাজনীতির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসেছেন। রাজনীতি তাদের বংশে রক্তের সাথে মিশে থাকলেও সেটা হয়তো তার বাবাকে ছুঁতে পারেনি। তাইতো তিনি মেয়র পদ থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ব্যবসা মন দিয়েছেন।
আমজাদ রহমান তার বাবার ইচ্ছায় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতি তার কোনো কালেই খুব একটা পছন্দ ছিল না। তাই তিনি রাজনীতির পাশাপাশি এই ব্যাবসা গড়ে তুলেছেন।আশরাফ হোসেন পরপর দুই বার চেষ্টা করেও মেয়র পদে জিততে পারেননি। কিন্তু আমজাদ রহমান রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার পরই আশরাফ হোসেন মেয়র পদে জয়ী হতে পেয়েছেন। অথচ আমজাদ রহমান সরে না আসলে তা সম্ভব হতো না।
সারা বিকেল আর সন্ধ্যায় দৃশ্য মাহাদ কে কল দিতে পারেনি।আসলে তার মধ্যে জড়তা কাজ করছে। মাহাদকে ফেইস করতে ভয় পাচ্ছে।কি জবাব দিবে মাহাদকে?তাছাড়া তার বাসার পরিবেশও অনেক থমথমে।বাবা আর জেঠু অনেক্ষন বাবার রুমে বসে আলাপ আলোচনা করেছেন।আর ফাহিম বিকেলেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে।
রাত দশটার দিকে দৃশ্য ভয়ে ভয়ে মাহাদকে কল করলো।দুইবার বাজার পরও কল রিসিভ হলো না।দৃশ্য কিছুক্ষণ পর আবার কল করলো। এভাবে দৃশ্য অনেকবার কল করার পর ও মাহাদ কল ধরেনি। এবার দৃশ্যর কান্না পাচ্ছে।চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে।রাতে আর ডিনার করা হলোনা দৃশ্যর।মা ডেকেছিল।কিন্তু আজ আর খাবার দৃশ্যর গলা দিয়ে নামবেন।
রাত তখন বারোটা।দৃশ্য আবার কল করলো মাহাদের নম্বরে। এবার কল রিসিভ করলো মাহাদ। মাহাদ গম্ভীর স্বরে বললো
-“বলো?”
দৃশ্য যেনো মুহূর্তেই সব কথা হারিয়ে ফেললো।কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।সে আমতা আমতা করে বললো
-“আসল, মানে..”
মাহাদ কিছুটা রেগে বললো
-“কিছু বলবে নাকি কল রেখে দিবো?”
দৃশ্যর সব গুলিয়ে যাচ্ছে।তবে বুঝতে পারছে মাহাদ প্রচন্ড রেগে আছে।দৃশ্য ভাঙ্গা গলায় বললো
-“আংকেল ঠিক আছে?”
মাহাদ যেনো এবার রাগে ফেটে পরলো।সে চেঁচিয়ে বললো
-“বাবা ঠিক আছে কিনা জেনে কি করবি?আরো অপমান করা বাকি আছে?তোর বাপ ভাইকে আজ সামনে পেলে কুচি কুচি করে কাটতাম। এত কিসের অহংকার তাদের? আমি কি রাস্তা ঘাটের লোফার ছেলে? আমার বাবার যা সম্পত্তি আছে না তা দিয়ে তোর বাবাকে দশবার কিনে বেচেঁ ফেলতে পারবে। আমার চাচ্চু লাইফটা শেষ করে এখন আবার আমার সাথে একই নাটক শুরু করেছে।দেখবো তোর বাবা তোর জন্য কোন রাজপুত্র নিয়ে আসে। তোর ফুপুকে দিয়েছিলো না জানোয়ার, বাস্টার্ড সাথে বিয়ে। আমার চাচুর কাছে থাকলে তার সুখ হতো না তাই না? পরে দেখলি না অতি সুখে সে সুইসাইড করেছে?আমিও দেখবো তোর জন্য কোন লেভেলের বাস্টার্ড আসে? তোর গলায় দড়ি পড়লেও তোর বাপ ভাই জীবনে শোধরাবে না।আজ মনে হচ্ছে আমার জীবনের তুই না আসলেই ভালো হতো।আমাকে আর কখনো কল দিবি না।”
কথাটা বলেই মাহাদ কল কেটে দিল।দৃশ্য দুই চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো।ফোনটা এখনো তার কানে ধরে রাখা।সামনের সবকিছুই ঝাপসা লাগছে। মাথায় বার বার একটা কথায় ঘুরছে সে মাহাদের জীবনে না আসলেই ভালো হতো।সত্যিই তো বলেছে।আসলেই সে মাহাদের জীবনে একটা অভিশাপ।সারা রাত দৃশ্য আর চোখের পাতা এক করতে পারলো না।নিজেকে শেষ করে দিয়ে ইচ্ছে করছে।
দৃশ্যর সাথে কথা বলার সময় তানিম মাহাদের পাশেই ছিল।প্রচন্ড রেগে বাসা থেকে বের হয়ে তানিমের সাথে মাঠে বসে ছিল।বাবার অপমান সে কিছুতেই মানতে পারছে না।আবার বাবার জন্য দৃশ্যর পরিবারকেও কিছুই বলতে পারছেনা।দৃশ্যকে সে কল করেনি।কারণ রাগের মাথায় কি না কি বলে ফেলবে তার ঠিক নেই।পড়ে দৃশ্য কষ্ট পাবে।কিন্তু দৃশ্য বার বার কল করেই যাচ্ছে।শেষে যেই ভয় পেয়েছে তাই হলো।সব রাগ দৃশ্যর উপরেই ঝরলো।তানিম বললো
-“শুধু শুধু দৃশ্যকে ঝরছিস কেনো?এতে ওর কি দোষ?তুই ভালো করেই জানিস দৃশ্য কতটা ইমোশনাল মেয়ে।”
-“আমার কিছুই ভালো লাগছে নারে।কি করবো বুঝতে পারছিনা।আমার জন্য বাবাকে তাদের কাছে ছোট হতে হয়েছে এটা মানতে পারছিনা।”
-“এতো ঝামেলার কি দরকার?দৃশ্যকে নিয়ে সোজা কাজী অফিসে যেয়ে বিয়ে করে ফেল।পড়ে তোর শশুরকে যেয়ে মিষ্টি খাইয়ে আসিস।”
-“আমি সব সুস্থ ভাবে ফেমিলিগত ভাবে করতে চেয়েছি।নাহলে আমার এক কথায় দৃশ্য সোজা বিয়ে করতে রাজি হয়ে যেতো।কিন্তু আমি চাইনা এমন করে সব হোক।”
পরদিন দৃশ্য নাস্তা না করেই কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো।বাবা আর ভাইয়ার মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না তাই।নাবিলা দৃশ্যর অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।দৃশ্যর চোখ মুখ ফুলে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারা রাত না ঘুমিয়ে কান্না করেছে।আজ নাবিলার নিজের বাবা চাচাদের উপর অনেক রাগ হচ্ছে।এমন কেনো তারা? কাল দৃশ্য দের বাসা থেকে এসে তার বাবা তাকে অনেক শাসিয়ে গেছে।দৃশ্যর মতো তারও যদি এমন কারো সাথে সম্পর্ক থাকে তবে তার জন্য সেটা ভালো হবে না।
কলেজের কাছাকাছি আসতেই দৃশ্য দের সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো।নাবিলা আর দৃশ্য দুইজনই কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।পড়ে বুজলো এটা মাহাদদের গাড়ি।কারণ এর আগেও দৃশ্য এই গাড়িতে অনেকবার উঠেছে।এটা মূলত আমজাদ রহমান মাহাদের জন্য কিনেছে।গত বছর ছেলের জন্মদিনে গিফট করেছেন।
মাহাদ গাড়ির কাচ নামিয়ে গম্ভীর ভাবে বললো
-“গাড়িতে উঠে এসো।”
দৃশ্যকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নাবিলা দৃশ্যর কাধে হাত রেখে ফিসফিসিয়ে বললো
-“দৃশ্য ভাইয়া ডাকছে।যা দ্রুত।পড়ে রেগে গেলে ঝামেলা।”
দৃশ্য ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠে বসলো। মাহাদ দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিলো।দৃশ্য চুপচাপ বাহিরে তাকিয়ে আছে। গাড়িটা বেশ দূরে নিরিবিলি একটা জায়গাতে থামালো মাহাদ।দৃশ্য আড়চোখে মাহাদের দিকে তাকালো। মাহাদ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।দৃশ্য কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা।তাই চুপ করে রইলো।হটাৎ মাহাদ এক টানে দৃশ্যকে নিজের কাছে এনে চিবুকে হাত রেখে চোখে, গালে,কপালে চুমু একে দিতে লাগলো।আর বলতে লাগলো
-“সরি পিচ্ছি।কালকের জন্য এত্তোগুলো সরি।আসলে মাথা ঠিক ছিলো না।কি বলতে কি বলে ফেলেছি। এর জন্যই কল রিসিভ করছিলাম না।সব রাগ তোমার উপর ঝেরেছি।সরি জান।মাফ করে দাও।”
মাহাদের আদর পেয়ে দৃশ্য ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।মনের কষ্ট গুলো অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছে।এই মানুষটির সামান্য ধমকও দৃশ্য সহ্য করতে পারে না।তার কোমল হৃদয় ভেঙে যায় মাহাদের সামান্য উচ্চশব্দে।মেয়েটা মাহাদের কাছে আসলেই আরো বাচ্চা হয়ে উঠে। তাই তো মাহাদ সব সময় তার সাথে আদুরে স্বরে কথা বলে।
মাহাদ শক্ত করে দৃশ্যকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকে।আর বলে
-“কাদেনা পাখি।আমি সরি তো।আর বকা দিবো না।এইযে আদর করে দিচ্ছি। এখন থামো।”
দৃশ্য কাদতে কাদতে বললো
-“আমি তোমার লাইফ একটা অভিশাপ হয়ে এসেছি। আমার জন্য সব হচ্ছে।আঙ্কেলকে এতো কথা শুনতে হয়েছে।আমাকে ভুলে যাও।নাহলে দুই পরিবারে আরো ঝামেলা হবে।”
-“একদম ফালতু কথা বলবে না।তোমাকে ভুলে যাওয়ার জন্য ভালবেসেছি?এইসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।আমি নিজে তোমার বাবার সাথে কথা বলবো।দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।”
-“আমার অনেক ভয় করছে মাহাদ।বাবা মানবে না।তোমাকেও অপমান করবে।”
-“কিছুই হবে না।চিন্তা করোনা।আমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমাকে পাশে চাই জান। তাই এতো জলদি হেরে গেলে চলবে না।যদি এই রাজকুমারীকে জয় করতে আমার যুদ্ধ করতে হয় তবে তাই করবো। বুজলে পিচ্ছি?”
দৃশ্য মুচকি হেসে মাহাদের বুক থেকে মাথা তুলে তাকালো।দৃশ্যর চোখে নেশা লেগে আছে। ধূসর চোখের নেশা। যেখানে দৃশ্য বার বার হারিয়ে যায়।দৃশ্য হটাৎ মাহাদের ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠকে বিলীন করে দিলো। মাহাদ একটু চমকালো।এই পিচ্চিরটা আজ আবার নিজ থেকে তাকে চুমু খাচ্ছে।পিচ্চিটা কি বুঝেনা তার এই হটাৎ আক্রমনে মাহাদ বেসামাল হয়ে পড়ে?আর না ভেবে মাহাদ ও প্রিয়সীকে সায় দিয়ে তার কোলে বসিয়ে দিলো দৃশ্যকে।দৃশ্যর কোমরে হাত দিতে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। এ যেনো অদ্ভুত অনুভূতি।প্রীয়সীর ঠোঁটের ভাজেও এতো সুখকর অনুভূতি কেনো থাকে?প্রেমিক পুরুষটি নিজেকে এই সুখ থেকে কি করে দূরে রাখবে?
তার দুই দিন পর মাহাদ দৃশ্যদের বাসায় এসে হাজির হলো।সাথে আছে তানিম,রাফসান আর জয়।দৃশ্য ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে এক সাইডে দাড়িয়ে আছে। মাহাদ চোখের ইসারায় তাকে শান্ত হতে বললো।দৃশ্যর মাও পাশে দাড়িয়ে আছেন। মাহাদকে দেখে তার প্রাণ জুড়িয়ে গেলো।ধূসর চোখের মায়াবী সুদর্শন যুবক।আশরাফ হুসাইন প্রথমে চিনতে না পারলেও ফাহিমের রাগ দেখে বুঝেছে।ফাহিম রেগে বললো
-“তোর সাহস তো কম না আমার বাসায় চলে এসেছিস?”
মাহাদ নরম গলায় বললো
-“দেখ ফাহিম আগে যা হয়েছে সব ভুলে যা।”
-“কি ভুলে যাবো?আমাকে মেরে হসপিটালে পাঠিয়েছিস সেটা?নাকি তোর চাচুর জন্য আমার ফুপি সুইসাইড করেছে সেটা?”
রাফসান বললো
-“দেখ ফাহিম সেদিন যেটা হয়েছে সেটা একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং।আমার ছোট বোনকে তোদের ফ্রেন্ড গ্রুপের ছেলেরা ইফটিজিং করেছিলো।তাই এমনটা হয়েছে।”
মাহাদ বললো
-“তোর ফুপি আমার চাচুর জন্য না বরং তার মেরিড লাইফের অশান্তির জন্য সুইসাইড করেছে।আমার চাচু তাকে ভালোবাসতো। এখনো বাসে।”
-“একদম নাটক করবি না।এক্ষনি আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যা।নাহলে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে দিবো।”
মাহাদ এবার দৃশ্যর বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো
-“আংকেল আমাদের দুই পরিবারের অনেক ঝামেলা আছে আমি জানি।আপনি চাইলেই কিন্তু সব মিটে যেতে পারে।আমি কি এতটাই অযোগ্য আপনার মেয়ের জন্য?আমি মন থেকে দৃশ্যকে চাই।তাকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে সুখে রাখবো।”
ফাহিম রেগে বললো
-“এইগুলা সব তোর নাটক।আমার বোনকে ফাসিয়ে তোরা বাপ চাচারা বদলা নিতে চাইছিস?আমি সেটা কিছুতেই হতে দিবো না।আমার বোনের জীবন নিয়ে তোকে খেলতে দিবো না।দৃশ্য বোকা হতে পারে কিন্তু আমরা না।তোর মতো বেয়াদবের কাছে আমার বোন দিবো না।”
জয় বললো
-“দেখ ফাহিম, তোর বোনকে তোর সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা মাহাদের আছে।তাছাড়া তারা দুইজন দুইজনকে ভালোবাসে। মাহাদ বেয়াদব হলে তোর বোনকে পাওয়ার জন্য তোদের সামনে দাড়াতো না।এমনি নিয়ে যেতো।”
আশরাফ হুসাইন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন
-“তোমার বাবাকে মানা করে দেওয়ার পর আবার তোমাকে কোন আক্কেলে এখানে পাঠিয়েছে?”
মাহাদ আশরাফ হুসেনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে উনার হাত ধরে বললো
-“আংকেল আমি সত্যি দৃশ্যকে প্রচন্ড ভালোবাসি।দৃশ্যকে বিয়ে করতে চাই।আমি নিজের সকল ইগোকে ঝেড়ে ফেলে আপনার কাছে দৃশ্যকে ভিক্ষা চাইছি।আপনার মেয়ের কোনো অসম্মান হতে দিবো না।”
আশরাফ হুসেনের যেনো তাতেও মন গললো না।তিনি সরে বসলেন।ফাহিম রেগে মাহাদ কে টেনে উঠিয়ে বললো
-“নাটক শেষ হলে বের হো বাসা থেকে।তোর বাপকে সেদিন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করা উচিত ছিলো।আমার বংশের মেয়েদের পেছনে কুত্তার মত পড়ে আছিস তোরা।”
মাহাদ এতখন সব সহ্য করলেও এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।ফাহিমের কলার চেপে ধরে বললো
-“আমাকে যা খুশি বল।কিন্তু বাবা আর চাচু কে নিয়ে আর একটা শব্দও সহ্য করবো না।”
ফাহিম রেগে মাহাদের নাক বরাবর এক ঘুসি মেরে বসলো।জয় ফাহিমকে আটলো।দৃশ্য হুহু করে কেদে দিলো। দৌড়ে এসে মাহাদকে জড়িয়ে ধরলো।আর নিজের গায়ের উড়না দিয়ে নাকে লেগে থাকা রক্ত মুছে বললো
-“ভাইয়া প্লিজ ওকে মারিস না।ওর কিছু হলে আমি মরে যাবো।প্লিজ ভাইয়া।”
ফাহিমের রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।এই মাহাদ তার বোনটাকে পুরোপুরি হাত করে ফেলেছে।সে রেগে দৃশ্যকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে বললো
-“ছি! তুই বাবার সামনে এই বেয়াদবকে জড়িয়ে ধরিস?এতো অধপতন হয়েছে তোর?”
দৃশ্য একটু রেগে বললো
-“হে হয়েছে।তোমরা যদি অমানুষের মতো বিহেভ করো তবে আমার এমন করা লাগবে। ফুপি কে হারিয়ে ও তোমরা আবার এমন শুরু করেছো?”
আশরাফ হুসাইন রেগে বললেন
-“বেয়াদবের মতো ভাইয়ের সাথে তর্ক করছিস?আর তুই কি আমাদের দিশার মতো সুইসাইড করার হুমকি দিচ্ছি?”
কথাটা বলেই দৃশ্যর গালে চর মেরে দিলো। আনিকা কবির দ্রুত মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।তার দুচোখে জল।মাহাদ দাতে দাত চেপে রাগকে কন্ট্রোল করে বললো
-“আংকেল প্লিজ দৃশ্যর গায়ে হাত তুলবেন না।”
আশরাফ হুসাইন রেগে বললেন
-“আমার মেয়ে আমি বুজবো।তুমি বের হও বাসা থেকে।আমার বাসার ত্রিসীমানায় যেনো তোমাকে না দেখি।বাপকে বিদায় করেছি এখন ছেলেকে পাঠিয়েছে গুন্ডমি করতে।আমার মেয়েকে কেটে মাটিতে পুঁতে রাখবো।তবুও ওই বাড়িতে পাঠাবো না।”
জয় তানিম ওরা মাহাদকে জোর করে দৃশ্যর বাসা থেকে নিয়ে আসলো।নাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।যা দৃশ্য বা মাহাদ করো জন্য সুখকর হবে না।