#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_41
ঘন কালো মেঘ ভেদ করে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই।আকাশে মেঘ বার বার গর্জে উঠছে।তবে মেঘের গর্জনের চাইতে আশরাফ হুসেনের গর্জনের শব্দ বেশি হচ্ছে।দরজার পাশে গুটিসুটি মেরে দাড়িয়ে আছে আনিকা কবির।কিছুক্ষণ আগেই আশরাফ হুসাইন হন্ত দন্ত হয়ে বাসায় ফিরেছেন।তবুও বৃষ্টির ছিটেফোঁটায় কিছুটা ভিজে গেছে।বাসায় এসেই তার চোখ পরে দৃশ্যর রুমের দিকে।আজকাল তার তীক্ষ্ণ নজর দৃশ্যর উপর সারাক্ষণ থাকে।রুমের দরজা খোলা দেখে তিনি সেই রুমে যেয়ে বুঝতে পারেন দৃশ্য বাসায় নেই। এর পরই তিনি আনিকা কবিরের সাথে রাগারাগি শুরু করেন।মেয়েকে নাকি আনিকা কবির উস্কে দিচ্ছেন।আরো নানান ভাবে গালিগালাজ করতে লাগলেন।
ফাহিম বাসার দরজায় আসতেই বাবার চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেলো।বাবার মুখের ভাষা শুনে তার মনটা তিক্ততায় ভরে উঠলো।এতো বছর অন্ধকারে থাকলেও আজ কাল বাবার এই রূপটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে।বাবা যার তার সাথে যেমন ব্যবহারই করুক।কিন্তু তার মায়ের সাথে এমন ব্যাবহার সে কিছুতেই সহ্য করবে না।সে এসে আশরাফ হুসাইনকে থামিয়ে বললেন
-“বাবা কি শুরু করেছ এসব মায়ের সাথে এ ধরনের ব্যবহার কেন করছো?”
-“তোর মা যে ভালো কাজ করেছে তাই?সারাদিন বাসায় বসে করেটা কি?বাসায় বসে বসে তো শুধু গিলছেই।মেয়ের দিকে একটু নজর রাখতে পারে না?মেয়ে তলে তলে আকাম করে বেরাইছে আর তোর মা কিছুই জানে না। নির্বোধ মহিলা একটা।”
-“বাবা মুখ সামলে কথা বলো।দৃশ্য যেটাই করুক।তাতে মায়ের কোনো দোষ নেই।তুমি অকারণে মায়ের উপর জেদ ঝরবে না।”
আশরাফ হুসাইন রেগে বললেন
-“তাহলে তোর মাকে জিজ্ঞেস কর দৃশ্য কই।ওকে আমি লক করে গেছি।আর এখন দরজার লক বাইরে থেকে ভাঙ্গা।নিশ্চয়ই বাইরের কেউ এসে ভেঙে নিয়ে যায় নাই।”
আনিকা কবির ফুপাতে ফুপাতে বললো
-“আপনারা সবাই মিলে মেয়েটাকে কষ্ট দিতেছেন।আপনারা ওই বিয়ে না মানলেও আমি মানি।বিয়ের পর স্বামী হয় সবচাইতে আপনজন।ছেলেটার এই দুঃসময়ে মেয়েটার পাশে থাকা উচিৎ।ওই মানুষটার মৃত্যুর কারণটাও আপনি।ওরা যে আপনাকে এখনো জেলে পুরেনি এটাই আপনার ভাগ্য।”
আশরাফ হুসাইন প্রচন্ড রেগে আনিকা কবিরকে একটা থাপ্পর মারতে নিলে ফাহিম আটকায়।নিজের বাবার প্রতি তার ঘেন্না ধরে গেছে। কতো সহজেই মায়ের গায়ে হাত তুলে ফেলে।সেও প্রচন্ড রাগী।তাই বলে নিজে বউয়ের গায়ে কোনোদিন হাত তুলবে না।নারীদের সম্মান দিতে জানে সে।তবে তমার বিষয় আসলে সব গুলিয়ে যায়।এই মেয়েটা তাকে প্রচন্ড বিরক্ত করে। সরি করতো।আজ কাজ মেয়েটা তার চোখের আড়ালে আড়ালে চলে।সে কি তমাকে নিয়ে বেশি ভাবছে?
আজ তার উপস্থিতিতে যদি মায়ের গায়ে হাত উঠে তবে নিজেকে কাপুরুষ মনে হবে। ভাবনা থেকে ফিরে রেগে বললো
-“নেক্সট টাইম যেনো তোমাকে মায়ের গায়ে হাত তুলতে না দেখি।তাহলে আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবে না।”
শুরু হয়ে গেলো বাবা ছেলের মধ্যে দ্বন্দ্ব।ফাহিম ও আজ বাবাকে ছেড়ে কথা বলবে না।কারণ মা তার কাছে জান্নাত।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোটা গাড়ির কাচের জানালা গুলোকে আবছা করে রেখেছে।মনোরম পরিবেশ।তবে দৃশ্যর সে দিকে কোনো খেয়াল নেই।সে এক দৃষ্টিতে মাহাদকে দেখে যাচ্ছে।তার তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি মাহাদকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।সিল্কি চুল গুলি আজ কেমন উস্কো খুস্কো।মুখের দাড়ি গুলো অযত্নে বড়ো হয়ে উঠেছে।আর চোখের নিচে কালি জমেছে।এতো কিছুর মাঝেও মানুষটি কে দেখতে ভালো লাগছে।এই মানুষটির এলোমেলো রূপ ও দৃশ্যকে ঘায়েল করে।
মাহাদ চুপ চাপ গাড়ি ড্রাইভ করছে।একটা কথাও বলেনি সে।আর না দৃশ্যর দিকে তাকিয়েছে।তার চোখ জোড়া কেমন লাল হয়ে আছে।সে কি অনেক বেশি রেগে আছে?এই মুহূর্তে মাহাদের মুখ দেখে কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা।
মাহাদ হঠাৎ গাড়িতে ব্রেক কসলো।এতে দৃশ্য ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলো।সামনে তাকাতেই দৃশ্যর ব্রু জোড়া কুচকে গেলো।সে অবাক চোখে মাহাদের দিকে তাকিয়ে বললো
-“মামাহাদ এখানে কেনো নিয়ে আসলে?এক্ষনি চলো এখান থেকে।”
মাহাদ সোজা সামনের দিকে তাকিয়েই গম্ভীর স্বরে বললো
-“নামো।”
দৃশ্য চমকে গেলো।কি রুক্ষ কন্ঠে কথা বলছে মানুষটা।সে অবাক হয়ে বললো
-“পাগল হয়ে গেছো?আমি কিছুতেই বাসায় যাবো না।তোমার সাথে থাকবো।তুমি যেখানে যে ভাবেই রাখবে সেভাবেই থাকবো।তবুও এই খানে না।আমার দম বন্ধ হয়ে আসে এই বাড়িতে।”
মাহাদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।সে দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে দৃশ্যর পাশের দরজা খুলে দিলো।দৃশ্য তখনও গাড়ীর সাথে মিশে বসে আছে।আর মাথা নেড়ে না জানাচ্ছে। মাহাদ এক টানে দৃশ্যকে গাড়ি থেকে বের করে আনলো।দৃশ্য পেটে হালকা বেথা অনুভব করছে।তবুও মাহাদের হাত থেকে হাত ছাড়তে চেষ্টা করতে করতে কান্না করে বললো
-“আমি বাসায় যাবো না।এইবার গেলে আর সেখান থেকে বেরুতে পারবো না।প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো।আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না।আমি আমার স্বামীর সাথে থাকবো।”
মাহাদ আরো শক্ত করে দৃশ্যের হাত ধরে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো।দৃশ্য বার বার তাকে আকুতি মিনতি করতে লাগলো।সিড়ির কাছে শব্দ পেয়ে নাবিলা আর তার মা দরজা খুলে তাকালো।দেখলো মাহাদ এক প্রকার টেনে হিছরে দৃশ্যকে উপরে তুলছে।আর দৃশ্য বার বার হাত ছাড়াতে চেষ্টা করছে আর কেদে কেঁদে কি সব বলছে।নাবিলা অবাক হয়ে গেলো।বিকেলেই সে দৃশ্যকে রিকশা ঠিক করে দিলো মাহাদের বাসায় যাওয়ার জন্য।নিজের জমানো টাকাও দিয়েছিলো।আর এখন এরা এখানে কি করে?মাথার তার ছিড়ে গেলো নাকি?আবার কি তাকে মার খাওয়াতে চায় নাকি?
সেদিন দৃশ্যকে সেই বাড়ি থেকে নিয়ে এসে নাবিলার বাবা নাবিলাকে অনেক বকা ঝকা করে।কারণ দৃশ্যর বিয়ে তার সামনেই হয়েছে সেটা সবাই জেনে গেছে।আর দৃশ্যর বিষয়ে সব জেনেও কেনো কাউকে কিছু জানালো না তাই অনেক কথা শুনতে হয়েছে।নাবিলাকে তো বেশ কয়েকটা থাপ্পর ও খেতে হয়েছে বাবার হাতে।আর আজ বিকেলে সেই দৃশ্যকে বাসার বাহিরে যেতে হেলপ করেছে জানলে বাবা আর চাচা মিলে তাকে জেন্ত কবর দিবে।আর দৃশ্যর কি হবে আল্লাহ মালুম।
নাবিলা আর তার মা দৌড়ে তাদের পিছু পিছু ছুটলো। মাহাদকে দেখে তার ভয় করছে।এই মানুষটি কে সে বরাবর ভয় পায়।তবে আজ মাহাদের রক্তিম চোখ জোড়া দেখে আরো ভয় বেড়ে গেলো।নাবিলা ভিত হয়ে বললো
-“মাহাদ ভাইয়া কি করছেন এসব।দৃশ্যকে কেনো এখানে নিয়ে এসেছেন?চাচু দেখার আগে দৃশ্যকে নিয়ে চলে যান।”
নাবিলার মা ভীষণ অবাক হলো।তার মেয়ে যে দৃশ্য সব কিছুতেই গভীর ভাবে জড়িত সেটা বুঝে গেলেন।এমন কি আজ দৃশ্যর পালানোর ব্যাপারেও তার মেয়ে সব জানে।
মাহাদ কোনো রিয়্যাক্ট করলো না।যেনো একটা পাথর।সে সোজা দৃশ্য দের বাসার দরজার সামনে আসলো।ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ আসছে।দৃশ্য বুজলো বাবা তাকে না পেয়ে ঝামেলা শুরু করেছে।দৃশ্য মাহাদের হাত শক্ত করে ধরে কেদে বললো
-“মাহাদ এমন কেনো করছো।রাগ করে আছো তাই না?সব কিছুর জন্য আমি মাফ চাইছি।আমার বাবার ভুলের জন্য সারা জীবন আমি দাদীর আর আন্টির বকা খেতে রাজি আছি।তবুও আমায় এই জায়গায় রেখে যেওনা।”
মাহাদ কোনো জবাব দিলো না।সে সোজা দৃশ্য দের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো।শব্দ পেয়ে ফাহিম আর আশরাফ থেমে গেলেন। মাহাদ আর দৃশ্যকে দেখে অবাক হলেন।আনিকা কবির ভীষণ ভয় পেলেন।দৃশ্য ফিরে কেনো আসলো?এই নরকে কেনো আসলো মেয়েটা?
ফাহিম দুইজনকে এক সাথে দেখে কিছুটা চমকে গেলো।পরক্ষনেই ভাবলো তার ধারণা ঠিক।দৃশ্য মাহাদের কাছে গেছে।ফাহিম আচমকা একটা জিনিষ আবিষ্কার করলো যে তার বোনটার পাশে মাহাদকে ভীষণ মানিয়েছে।যেনো মেড ফর ইচ আদারস।
তমার কথা মনে পড়লো।আসলেই লন্ঠন নিয়ে খুঁজলেও তার বোনের জন্য মাহাদের চাইতে সুদর্শন আর ভালো ছেলে খুজে পেতো না।পূর্বের রেষারেষির জন্য কোনোদিন মাহাদের ভালো দিক চোখে পড়েনি।তবে এখন মনে হচ্ছে মাহাদই একমাত্র যোগ্য ছেলে।
মাহাদের হাতে দৃশ্যর আবদ্ধ হাত দেখে আশরাফ হুসাইন রেগে গেলেন।বললেন
-“এই বেয়াদব ছেলে তোর সাহস তো কম না।আমার মেয়েকে আবার নিয়ে ভেগেছিস?বাপ হারিয়েও তোদের শিক্ষা হয়নি? এখনো আমার মেয়ের পেছনে পরে আছিস?বাপ চাচা যেমন ছিলো ছেলেও তেমন।সব বেহায়ার দল।”
মাহাদের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।রাগে দাত কটমট করতে লাগলো।সামনের এই মানুষটিকে তার পৃথিবীর নিকৃষ্ট তম প্রাণী মনে হয়।তার বাবাকে দেওয়া আঘাতের দৃশ্যপট তার সামনে ভেসে উঠলো।বাবার কপালের আর হাতের রক্ত চোখে ভেসে উঠছে।মায়ের আর ভাইয়ের আর্তনাদ কানে বেজে উঠছে।সে প্রচন্ড রেগে দৃশ্যকে তাদের দিকে ছুঁড়ে মারলো।আর দৃশ্য সোজা যেয়ে পড়লো বাবার পায়ের কাছে।হাতের কনুইতে ভীষণ বেথা পেলো সে।
ফাহিম দৃশ্য বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে দৃশ্যকে ধরলো।নাবিলা ও আসলো।দৃশ্য তখন অবাক চোখে মাহাদ কে দেখছে।দু চোখ বেয়ে তার অশ্রু ঝরছে।
মাহাদ প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে আশরাফ হুসাইনকে উদ্দেশ্য করে বললো
-“আমার বাবা আর চাচু কে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে আপনার জিব আমি টেনে ছিড়ে ফেলবো।অনেক সহ্য করেছি আপনাকে।আপনার জায়গাতে অন্য কেউ থাকলে এতক্ষণে পিটিয়ে শুইয়ে দিতাম।শুধু মাত্র বয়সের জন্য বেচেঁ গেছেন।নাহলে যেই হতে আমার বাবাকে আঘাত করার সাহস দেখিয়েছেন,সেই হাত ভেঙে ঘুরিয়ে দিতাম।কিন্তু বেচেঁ গেছেন।কারণ আমার বাবা মানুষকে সম্মান করতে শিখিয়েছে।কিন্তু আপনারা সম্মানের যোগ্য না।
আপনার ওই দুই টাকার অহংকারকে আমার ভেঙে গুড়িয়ে দিতে দুই মিনিটও লাগতো না।কারণ যে অপরাধ আপনি করেছেন তাতে এতক্ষণে আপনার জেলের ঘানি টানা লাগতো।যাকে এতো অপমান করেছেন,আঘাত করেছেন সেই মানুষটাই মৃত্যুশয্যায় থেকেও আপনাদের কথা ভেবেছেন।তিনি বলে গেছেন আপনাদের যাতে কোনো ক্ষতি না করি।কোনো মামলা না করি।নাহলে এতক্ষণে জেলের হাওয়া আপনার মুখস্ত হয়ে যেতো।
আপনার মতো নিকৃষ্ট মানুষ আমি আর একটাও দেখিনি।আপনার মেয়েকে ভালোবেসেছি বলে আমার বাবাকে অপমান করার সুযোগ পেয়েছেন তাইনা?আপনার মেয়েকে বিয়ে করেছি বলে আমার বাবাকে আঘাত করেছে তাইতো?
দিয়ে গেলাম আপনার মেয়েকে। এবার মেয়েকে শোকেসে ভরে সাজিয়ে রাখুন।যার জন্য আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি তাকে আমার জীবনে কোনো দরকার নেই।আপনার মতো নিকৃষ্ট মানুষের রক্ত আমার ঘরে রাখবো না।”
ফাহিম বুঝতে পারছে মাহাদ ভীষণ রেগে আছে।বাবাকে হারিয়ে তার মাথা ঠিক নেই।হঠাৎ দৃশ্য দৌড়ে সবার সামনেই মাহাদকে ঝাপটে ধরলো।আর চিৎকার করে কাদতে কাদতে বললো
-“মামাহাদ এমন করো না।আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।আমি সারা জীবন তোমার দাসী হয়ে থাকবো তবুও আমাকে ছেড়ে যেও না।তুমি না বলেছিলে তোমাকে ছুয়ে কথা দিতে যে তোমার হাত কোনো দিন ছাড়বো না।এই দেখো আমি তোমার হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছি।আমিতো তোমাকে ছাড়ছি না।তাহলে তুমি কেনো মাঝ পথে এসে আমার হাত ছেড়ে দিচ্ছ।সারা জীবন পাশে থাকবে বলেছিলে।প্লিজ আমাকে তোমার বুকে শক্ত করে ধরে রাখো।নাহলে আমি মরে যাবো।আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।প্লিজ মাহাদ তোমার বুকে একটু জায়গা দাও।আর কিছু চাইবো না।ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে।”
দৃশ্য যেনো তার হিতাহিত জ্ঞান হারালো।সে সকলের সামনেই মাহাদ কে ঝাপটে ধরে রইলো।সে যেনো আর নিজের মধ্যে নেই।প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাকে জ্ঞানশূন্য করে দিয়েছে। সে আশেপাশের সব ভুলে গেছে।
মাহাদ চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো।বুকের ভেতরটা তার দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।এতটা বেথা সে জীবনে কোনদিন অনুভব করেনি।তার ইচ্ছে করছে দৃশ্যকে বুকের মাঝে পিসে ফেলতে।নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলতে।এই মেয়েটার চোখের জল শুষে নিতে।দৃশ্যর আর্তনাদ তার বুকে সুচের মতো বিদছে।কিন্তু যখনই বাবার লাশটা চোখে ভেসে উঠে তখন পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করে।মায়ের মলিন মুখটা তার হৃদয়কে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এসবের মাঝে নিজের ভালোবাসাটাকে ও তুচ্ছ মনে হচ্ছে।সে দৃশ্যকে নিজের কাছথেকে ছাড়িয়ে ফাহিমের কাছে দিয়ে বললো
-“তোর বোনকে ভালোবেসেছি এটাই আমার অপরাধ তাইতো? আমারও আজ মনে হচ্ছে,সত্যি যদি তোর বোন আমার জীবনে না আসতো তাহলে ভালো হতো।সে না আসলে বাবা আজ আমার সাথে থাকতো।তোর বোন আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো অভিশাপ।তাই তোর বোনকে দিয়ে গেলাম।আমার জীবনে তার কোনো জায়গা নেই।”
ফাহিমের আজ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।এতটা কঠোর কেনো হয়েছিলো সে?একটাবার কেনো বোনের সুখের কথা ভাবলো না?নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।সব কিছুতে বাবা যতটা দোষী,সেও ঠিক ততটা দোষী।
ফাহিম বলতে লাগলো
-“মাহাদ সব কিছুর জন্যে আমি তোর কাছে মাফ চাইছি।এই সব মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর..
ফাহিম কে এখনেই থামিয়ে মাহাদ রাগ দেখিয়ে চিৎকার করে বললো
-“মাফ কিসে মাফ?তোদের মাফ করলে কি আমি বাবাকে ফিরে পাবো?তোদের করা অপমান আর আঘাত বাবাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে গেছে।আল্লাহ জানে আমি কেনো তোর বোনকে ভালোবাসতে গেছিলাম।ভুলতো আমার।তোর বোন আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো ভুল।তাই সেই ভুল সুদ্রে নিচ্ছি।তোর বোনকে দিয়ে গেলাম।এই মাহাদ আর তোর বোনের পেছনে ছুটবে না।তাকে দেখলে আমার বাবাকে মনে পরে।তোদের এতো অপরাধের পরও আমার বাবা তোর বোনকে মাথায় তুলে নিয়েছিলো।ঘরের লক্ষীর মর্যাদা দিয়েছিলো।কিন্তু তোরা সেই সম্মান পাবার যোগ্য না।এই মেয়েটা কেনো তোদের রক্তের হতে গেলো?দূষিত রক্ত তার শরীরে।খবরদার সে যেনো আমার সাথে কোনো যোগাযোগ না করে।আর আমার বাড়ির আশেপাশেও যেনো তোর বোনকে না দেখি।তাহলে সেদিনই হবে তার শেষ দিন।নিজ হাতে শেষ করবো তাকে।তখন বুজবি আপনজন হারানোর যন্ত্রণা।কথাটা মাথায় রাখিস।”
কথাগুলি বলে মাহাদ এক পলক দৃশ্যর দিকে তাকালো।দৃশ্য তখনও অবাক চোখে মাহাদকে দেখে যাচ্ছে।চোখের জলে গাল ভিজে আছে।সে তাকানোর সাথে সাথে টুপ করে আরো দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মাহাদ চোখ ফিরিয়ে নিলো।ওই চোখে তাকালে সে দূর্ব হয়ে পড়বে।কিন্তু সে দুর্বল হতে চায়না।সে দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে আসলো।বাবা মানা না করে গেলে হয়তো ওই আশরাফ আর ফাহিমকে মেরে পগারপার পাঠিয়ে দিতো।
মাহাদ বেরুতেই দৃশ্য ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো।এই শরীরের ভর সে কিছুতেই বইতে পারছেনা।হাত পা প্রচন্ড কাপছে।তার মনে হচ্চে পৃথিবী বোধয় থমকে গেছে।তাই অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেছে।নাহলে সে নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা কেনো?দৃশ্য বার বার জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলো।কিন্তু অক্সিজেন পাচ্ছেনা।সৃষ্টিকর্তা কি তার জন্য বরাদ্দকৃত অক্সিজেন টুকু বন্ধ করে দিল?মুহূর্তেই সামনের সব কিছু ঝাপসা দেখতে লাগলো।
মাহাদ দৃশ্য দের এলাকা থেকে বেরিয়েই জয়কে কল করলো।সে কিছুতেই ড্রাইভ করতে পারছে না।হাত প্রচন্ড কাপছে।নির্ঘাত অ্যাকসিডেন্ট করবে।কয়েক মিনিটের মধ্যেই জয় চলে আসলো। মাহাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা মুচর দিয়ে উঠলো।ছোট বেলা থেকে বন্ধু তারা।হাসি খুশি ছেলেটা কে এই রূপে দেখে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।আসে পাশে তাকিয়ে বললো
-“দৃশ্য কই?মাহিম বললো তুই ওকে নিয়ে বেড়িয়েছি?”
মাহাদ স্থির কন্ঠে বললো
-“যেখানে থাকার কথা সেখানে দিয়ে এসেছি।”
জয় কপাল কুচকে বললো
-“মানে কি?”
-“ওর বাসায় দিয়ে এসেছি।”
-“কেনো?সেতো তোর কাছে চলে এসেছিল।তাহলে ওকে বাসায় দিয়ে আসার মানে কি?আমি জানি দাদী আর আন্টি অনেক কথা শুনাবে।তাই বলে তুই দিয়ে আসবি?এক্ষনি চল ওকে নিয়ে আসি?”
-“না।আমার জীবনে আর ওকে আনতে চাই না।”
-“পাগল হয়ে গেছিস?দেখ!আংকেল কে হারিয়ে তোর মাথা ঠিক নাই।তাই বলে রেগে সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলবি?সে তোর বউ।তাছাড়া এসবে দৃশ্যর কোনো দোষ নেই।”
মাহাদ গম্ভীর হয়ে বললো
-“গাড়ি চালা।আর কিছু শুনতে চাইনা।”
জয় আর কিছুই বললোনা।সে জানে মাহাদ একরোখা।যা একবার বলে তাই করে ছারে।আর এখন তার মাথা এমনি ঠিক নেই।সে গাড়ি চালাতে শুরু করলো।
মাহাদ সে দিন বাসায় ফিরলো গভীর রাতে।রুমে ঢুকে দরজা আটকে ফ্লোরে বসে পড়লো।তার হাতটা আপনা আপনি বুকের বা পাশে চলে গেলো।সে হাতটা বার বার বুকে ঘষছে।বুকটা তার ভীষণ জ্বলছে।কোন মলম লাগলে যে এই জ্বালা কমবে সে বুঝে পাচ্ছে না।এতো সবের পর সে কি পেলো? কিছুই না।দিন শেষে তার প্রাপ্তির খাতা শূন্য।তার পাশে না আছে বাবা আর না আছে ভালোবাসার মানুষ।ভালোবাসার মানুষ থাকবে কি করে?সেতো নিজ হাতেই নিজের ভালোবাসাকে কবর দিয়ে এসেছে।কি করতো সে, মায়ের ঘৃণা নিয়ে সে কি করে দৃশ্যর সাথে থাকতো?কি করে সংসার সাজাতো?দৃশ্যকে দেখে যে মায়ের ক্ষতটা আরো বেড়ে যাবে।মায়ের চোখে সে দৃশ্যর জন্য যে ক্রোধ আর ঘৃণা দেখেছে।তাতে করে দৃশ্যকে তার জীবনে রাখলে মা ভীষণ কষ্ট পেতো।হয়তো বাবার মত সেও তাকে একা ফেলে চলে যেতো।আর সন্তান হয়ে মায়ের চোখের অশ্রু কি করে ঝরতে দিত?মাকে কি করে হারিয়ে যেতে দিতো?
মাহাদ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে।সে চিৎকার করে কাদতে লাগলো।আর রাতের আধারে সেই কান্নার শব্দ বাড়ির প্রতিটি সদস্যের কান অব্দি পৌঁছালো।আখি রহমান চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো।এই শব্দ তিনি সহ্য করতে পারছেননা।কিন্তু তিনি যাবেনা ছেলের কাছে।কারণ তার চোখে মাহাদ ও অপরাধী।যাকে তিনি মাফ করবেননা।