#হলিডে
#পর্ব_১৫_ও_১৬
#পর্ব_১৫
নীরা তিনতলায় উঠে পুরো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। যেখানে অফিস হওয়ার কথা সেখানে একটি সিডির দোকান। নাম “রফিক সাউন্ড সিস্টেম”! হালকা পাতলা একটি ছেলে বসে আছে। মনে হচ্ছে, এই দোকান নিয়ে সে মহা বিরক্ত।
নীরা এগিয়ে গেল।
—আলাউদ্দিন বলে একজন আমায় এখানে দেখা করতে বলেছিলেন। তিনি কি আছেন?
ছেলেটা নীরার কথার জবাব দিলো না।
—আমার এখানে একটা কাজে আসার কথা ছিল, মিউজিক ভিডিওর জন্য। আমার নাম নীরা।
ছেলেটা কিছু না বলে দোকানের ভেতরে সাইড দিয়ে একটা চিকন রাস্তা দেখিয়ে বললো,
—এদিক দিয়া ভেতরে যান। বস ভেতরে আছেন। আপনে সামনের ওয়েটিং রুমে বসবেন। কাজ চলতাছে একজনের।
—ভেতরে যাবো না আমি। এখানেই অপেক্ষা করবো। আপনার বসকে ডাকুন।
ছেলেটা এবার একটু গুরুত্ব দিলো নীরাকে।
—ভিতরের জিনিস দেখানোর কাজ করতে পারবেন আর দোকানের ভিতরে যাইতে পারবেন না। এটা কি কথা! কাজ করলে ভেতরে যান, নাইলে ফুটেন। এরকম ফালতু কাজ করতে পারেন আবার দেমাগ। হুহ..
ছেলেটা মুখ থেকে একগাদা থুথু ফেললো নীরার সামনে। বিরক্তি ছেলেটার চোখ মুখ আরো কুঁচকে এলো।
নীরা ছেলেটার কথা বুঝার চেষ্টা করলো। চৌদ্দ-পনেরো বছরের ছেলে কিন্তু চেহারাটা একদম মেয়েলি ধরনের। চোখে মুখে যেন জীবনের প্রতি প্রচন্ড রাগ। এই পরিস্থিতির সবটার জন্য যেন সে দায়ী! সে কি বুঝাতে চাইছে? নীরার চলে যাওয়া উচিত? ছেলেটি কি কোনোভাবে প্রচ্ছন্ন নিষেধ বুঝাচ্ছে?
—এখানে কি হয়?
—জেনে আসেন নাই?
—জি না।
—ঘন্টা রেটে নীল ফিলিম। আপনের মুখ দেখানো হবে না, শুধু বডি। এর উপরও রেইট আছে। যে যতদূর দেখায়। কিলিয়ার?
নীরার গা শিউড়ে উঠলো। ছিঃ….
—এখন কি হচ্ছে?
—একটা স্কুল আইটেম আনা হইছে তার শূটিং চলতাছে। মেয়েটারে এরা মাইরা শেষ.. বালের দুনিয়া। এই দুনিয়ায় পেডের জ্বালায় কত কি যে দেখন লাগতাছে।
নীরার গলায় দম আটকে এলো।
—আমায় এক গ্লাস পানি দিবেন?
ছেলেটা পানি দিলো না। পানির বোতলটা বরং একটু সরিয়ে রাখলো।
—এরকম করে মেয়েদের ক্ষতি করা কি ঠিক? এসব কাজে পুলিশ বাঁধা দেয় না?
—-পুলিশের অত টাইম নাই।
—এই বিল্ডিংটার পুরোটাতেই বোধহয় এরকম কাজ হয়, তাই না? কেউ কি অভিযোগ করে না?
—শূটিং এ বেশির ভাগেরই মুখ দেখানো হয় না। ঝামেলা কিসের? এর মাঝে সবাইই নিজের মতে কাজ করে। মুখ না দেখাইলে মাবুদের সিষ্টি সব একরকম।সব কামই একজাত। আপনে কাজ করলে বসেন, নাইলে ভাগেন। সামনে দাঁড়াইয়া ভ্যাঁন ভ্যাঁন কইরেন না। পাবলিক টের পাইলে ঝামেলা।
নীরার প্রচন্ড রাগ হলো। রাগে গা রিঁ রিঁ করতে লাগলো। এরকম একটা কুৎসিত কাজে এরা মেয়েদের ডাকে কিভাবে? কি করে এত সাহস হয় এদের? প্রকাশ্যে এমন নোংরামো। এদের নীরা কিছুতেই ছাড়বে না। নীরাকে ডেকে আনার একটা মিনিমাম শাস্তি এদের পাওয়া উচিত। মিনিমাম শাস্তি। নীরা অত সোজা মেয়ে না। অত সহজে তো সে ছাড়বে না।
—ভেতরে কয়জন আছে? মানে বেশি লোকজন কিনা?
—দুইজন, মাইয়াসহ তিনজন। কামের সময় মানুষ কম! বেশি মানুষ, বেশি দিগদারী। মানুষই সব সমস্যার মূল।
ছেলেটি দরকারের চেয়ে বেশি কথা বলছে। কমন সাইকোলজি বলে, দরকারের চেয়ে বেশি কথা বলা মানুষগুলো অতটাও বিপজ্জনক নয়। এদের কনভিন্স করা সহজ।
নীরা ছেলেটিকে এবার তুমি করে বললো,
—তোমার নাম কি?
ছেলেটি জবাব দিলো না।
—তোমার নাম রফিক তাই না? এই দোকনটা কি তোমার নামে?
—আমার নাম বেলাল। রফিক আমার বসের নাম।
—বেলাল, একটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনো। আমি তোমাকে এখন একটা কঠিন কথা বলবো, মাথা ঠান্ডা রেখে শুনো।
নীরা শক্ত করে ছেলেটার হাত চেপে ধরলো হঠাৎ।
—আমার কাছে পঁচিশ হাজার টাকা আছে বেলাল, আমি তোমাকে টাকাটা দেবো। এক্ষুণি দেবো। এই দেখো।
নীরা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দেখালো।
—তুমি আমায় একটু সাহায্য করো। আমি পুলিশের লোক। গোপন সংবাদে এখানে এসেছি। আমার টিম নিচে ওয়েট করছে।
ছেলেটার চোখ চকচক করছে। যেন এই কথাটা শোনার জন্য সে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছে।
বেলাল নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।
—আমারে টাকা দেখাইবেন না। টাকার লোভ এই বেলালের নাই।
—আচ্ছা, টাকা নিও না। সাহায্য করো..
—এদের কাছে কিন্তু চাক্কু আছে ম্যাডাম।
নীরা ব্যাগ থেকে ব্লিচিং পাউডারের প্যাকেট বের করলো।
—আমার কাছেও অস্ত্র আছে। এতে হিরোইন আছে, এক মুঠো হাতে নিয়ে হাতে নিয়ে শুধু একজনের নাকমুখে চেপে ধরবে। পারবে না?
বেলাল এক খাবলায় নীরার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে নিলো,
—আরেক জনরে কি করা?
—সেটা আমি দেখবো। শুধু তুমি এটুকু সাহায্য করবে। পারবেনা? রেডী তো?
—ম্যাডাম, আপনে কি দারোগা না ওসি?
—আমি এনএসআই র মানে গোয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার ।
বেলাল মহাউৎসাহে বললো,
—চলেন… ফাইট শুরু।
নীরা ওড়ানাটা পুরো মুখে বেঁধে নিলো। এসিডের ব্যবহার করতে হবে, মুখে পড়লেই সর্বনাশ। এই প্রথম নীরার খুব আনন্দ হচ্ছে, সে নিজের অভিনয় দক্ষতা দেখানোর মতো একটা কাজ পেয়েছে।
নীরা খুব সাবধানে এগিয়ে গেল। গ্লাস টেনে খুলতেই দেখলো, প্রায় অর্ধমৃত একটা মেয়েকে নগ্ন করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে বিছানায়। পাশেই পড়ে আছে তাঁর স্কুলের ইউনিফর্ম, স্কুলের ব্যাগ, আইডি কার্ড। চেংরা টাইপের লম্বা আর ভদ্র পোশাক পরিহিত একটি ছেলে পাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরায় শ্যূট করছে। অন্য আরেকটি লোক, মাঝারি বয়সের। লোকটির হাতে ভেজা তোয়ালে, সে মেয়েটির পায়ের তলার ময়লা মুছে দিচ্ছে।
নীরা বিড়বিড় করে বললো, তোদের আমি ছাড়বো না।
বেলাল বিরক্তি ভরা গলায় ডাকলো,
—বস, এই বেডী খুব জ্বালাইতাছে। বলতাছে এর শূটিং আগে করতে। জোর কইরা ভেতরে আসতে চাইলো।
নীরা মাতাল ভঙ্গিতে বললো,
—আমার আগে, অন্যসব বাদ। তাড়াতাড়ি কর শালারা…
রফিক বলে লোকটি ধমকের গলায় বললো,
—সিরিয়ালে বসতে বল শালীরে। নেশা কইরা এর হুঁশ নাই মনে হচ্ছে। পানি দে চোখে মুখে…. মুখ ঢাকা ক্যাঁন? মুখ খুইল্লা দেখ, নতুন না পুরাণ আইটেম।
বেলাল এক মুহূর্তেই ঝাপিয়ে পড়লো রফিক বলে লোকটার উপর। নীরাও দেরি করলো না। আজ সে সত্যিকারের কাজ করার মতো একটা জায়গা পেয়েছে। আজ সে মনেপ্রাণে কাজ করবে। অভিনয়ের কাজ, তার সাধারণ জীবনের বাইরের কাজ। কোথাও ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দ করছে। দশটা বেজে গেছে… অনেক রাত…
আজ বাড়ি ফিরতে নীরার সত্যিই অনেক দেরি হবে!
তামিম এই নিয়ে মোট পাঁচটা থানার লোককে কাজে লাগিয়েছে। কোনো খবরই মিলছে না ইতুর। ঝিগাতলার কাছাকাছি ওর ফোন নাম্বারটা ট্রেস করা গেছে, সন্ধ্যা ছটার দিকে। এরপর থেকে মোবাইল সুইচ অফ! তামিম ঘামতে লাগলো। একছুটে এখন ঢাকা চলে যাওয়া দরকার ছিল। ইতুর না ফেরার খবরটা পেয়েছে সে রাত এগারোটায়। এখন রাত সাড়ে বারোটা। মোবাইল স্ক্রিনে ইতুর ছবিটার দিকে তাকিয়ে তামিম একটা শুকনো ঢোঁক গিললো। মাঝে মাঝে জীবন এত অর্থহীন কেন মনে হয়? বেঁচে থাকাকে কেন এত বোঝা মনে হয়? এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে, চাকরিটা ছেড়ে দেওয়া উচিত। এই চাকরির কোনো মানে নেই। কান্না দলা পাকিয়ে এসে গলায় আটকে আছে। গলার কাছাকাছি বুকে ব্যথা করছে। সুঁচালো তীব্র ব্যথা। ইতুর বয়ফ্রেন্ড জিজকেও পাওয়া যাচ্ছে না। সেই ইতুকে নিয়ে যায়নি তো? শ্বাস নিতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন? বাতাসে অক্সিজেন কি ফুরিয়ে গেছে?
রিতু আবার ফোন করেছে। তামিম নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো।
—হ্যালো রিতু, আমি কন্ট্রোল রুমে রিপোর্ট করে দিয়েছি। দশজনের একটা টিম বের হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। আর কোনো চিন্তা নেই… এরা খুঁজে বের করবেই!
—ভাইয়া, ইতুকে পাওয়া গেছে। ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছে। রনি নামের একজন তিনি নাকি ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট, ফোন করে আমাদের জানালেন। আমরা সেখানেই যাচ্ছি।
—তাঁর পুরো নাম কি জিজ্ঞেস করেছিস?
—না। আমরা গাড়িতে আছি ভাইয়া। যাচ্ছি সেখানে। ইতু নাকি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। তুই আসছিস তো ভাইয়া?
—আমি কাল বারোটার আগে লিভ পাবো না রিতু। কোনোভাবেই না। বি স্ট্রং মাই ব্রেইভ সিস্টার। তোকেই সব সামলাতে হবে। আমি কাল দুপুরেই আসছি।
হারুন গোমড়া মুখে পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
—স্যার, প্রাইম মিনিস্টার স্যারকে একটা ডিরেক্ট এপ্লিকেশন দিয়ে দেখবেন?
—না, হারুন সাহেব। আপনি বরং এক কাজ করেন, আপনি চলে যান। এখনি রওনা হোন। ড্রাইভারকেও নিয়ে যান। একা এত পথ ড্রাইভ করা ঠিক হবে না।
তামিম উঠে দাঁড়ালো। গলা শুকিয়ে আছে, পানি খাওয়া দরকার। নীরাকে একটা ফোন করতে ইচ্ছে করছে, তাকে জানালে কি সে ইতুকে একটু দেখতে যাবে? একটু কি গিয়ে ইতুর পাশে বসবে? অ্যাক্সিডেন্টে কি ইতুর বেশি লেগেছে?
তামিম নীরার ফোনে কল করলো। এতরাতে নীরা ফোন ধরবে তো?
বেলাল শুকনো চোখমুখ করে হসপিটাল প্যাসেজে বসে আছে। তার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। কেউ তার খেয়ালে নেই। মেয়েটার পরিবার বোধহয় বেশ বড়লোক। এরা এসেই পুরো হাসপাতালের সব ডাক্তার ডেকে জমিয়ে নিয়েছে।
বেলাল বিড়বিড় করে বললো,
—যত্তসব আহলাদের ঢং। এত্তারা মাইয়া হারাই যাইবার সময় খেল নাই, অহন আদর *দায়..
নীরা নিশ্চিত হবার জন্য আবার জিজ্ঞেস করলো।
—আপনি কনফার্ম তো রনি ভাই?
—হান্ড্রেড পার্সেন্ট কনফার্ম। মেয়েটির রেপ হয়নি। এরা ইনজেকশান দিয়ে ড্রাগ দিয়েছে শরীরে। মারধর করেছে অথবা প্রচুর ধ্বস্তাধস্তি হয়েছে। রিপোর্ট এসে গেছে। শফিক নিজে কথা বলেছে আমাদের স্যারের সাথে।
নীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
—মেয়েটার পরিবারকে কিছু বলা হয়েছে?
—যতটুকু আমরা করেছি ততটুকুনই। বাকিটা মেয়েটার সেন্স ফিরলেই জানবে। এদের বোধহয় অনেক উপরে হাত আছে, বুঝলে নীরা? সব ডক্টর এরা এক করে ফেলেছে। মেডিকেল বোর্ড বসাচ্ছে।
—হতেও পারে রনি ভাই। আচ্ছা, ওই মেয়েটার ডুপ্লিকেট আরেকটা মেয়ে দেখলাম।
—ও হ্যাঁ.. ওটা ইনজুরড মেয়েটার বোন। টুইন.. একদম কার্বন কপি। মেয়েটা খুব কাঁদছে।
নীরা ঘড়ি দেখলো। একটা বাজে। বাড়ি ফেরা দরকার। মেয়েটার গার্জিয়ান যখন এসেছে এরাই সব সামলাক। নীরার বড্ড ক্লান্ত লাগছে।
বেলালকে টাকাটা দিয়ে বিদায় করা দরকার। বেলাল চেয়ারে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছে।
নীরা ডাকলো,
—বেলাল, উঠো। এই নাও তোমার টাকা। মেয়েটার মা চলে এসেছেন, এখন আর চিন্তা নেই।
বেলাল বিরস মুখে বললো,
—ক্ষুধা লাগছে আমার। কিছু খাওয়ান।
—এখানে তো কিছু পাবে না এতরাতে। বাইরে গিয়ে খেয়ে নিও।
বেলাল হাত উ্চু করে আড়মোড়া ভাঙলো।
—একইরকম আরেকটা মেয়ে দেখলাম।
—হুঁ। জমজ বোন মেয়েটার।
বেলাল উঠে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে নীরার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে গুণে দেখলো।
সেখান থেকে দশ হাজার টাকা রেখে বাকিটা নীরাকে ফেরত দিয়ে বললো,
—আল্লাহর কি আচানক সিষ্টি। দুই মাইয়া একরকম। একটার ভিডিও ফাঁস হইলে দুইডারই লাইফ শেষ ছিল। পাবলিক বুঝতোও না কার ভিডিও ফাঁস হইছে!
নীরা বিস্মিত চোখে বেলালের দিকে তাকালো।আসলেই তো! এরকম তো সে ভাবেনি। দুই বোনেরই ক্ষতি হতো। কি ভয়ানক ব্যাপার!
—সবকিছু জ্বলবে তো? আগুনটা ভালো করে দিয়েছিলে তো বেলাল?
—সব পুইরা শ্যাষ ম্যাডাম। পুরা দোকান বিনাশ।কেরোসিনের আগুন ম্যাডাম, এতক্ষণে পুরা বিল্ডিং ই শেষ মনে হয়।
বেলাল হাসলো। নীরা আরেকবার লম্বা করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
অনেক হালকা লাগছে নিজেকে তার। নীরার মোবাইল বাজছে। কে ফোন করেছে এতরাতে?
নীরা মোবাইল স্ক্রিনে তাকালো। ফোন করেছে তামিম। এই লোকটা তো দেখি পুরাই মাথানষ্ট! নীরা ফোন কেটে দিলো। আহত মেয়েটির মা আর বোন এগিয়ে আসছে। নীরা বেলালকে চোখ ইশারায় দ্রুত বেরিয়ে যেতে বললো।
রনি ভাইও সাথে আসছেন। নীরার ফোন অনবরত বাজছে।
ভদ্রমহিলা নীরার সামনে এসে ক্লান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন।
রনি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বললো,
—ইনি ইতুর মা। ওই যে ইতু, বুঝলে নীরা।
নীরা সালাম দিলো। জবাবে ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন শুধু। পাশের মেয়েটি দেখতে অবিকল ইতুর মতো। তবে একটু ব্যতিক্রম আছে, তাঁর উপরের ঠোঁটের মাঝখান বরবার উপরে নাকের নিচে তিল আছে। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখমুখ ফুলে আছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
—নীরা আপু, আপনার মোবাইল ফোন বাজছে।
নীরা একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল বোধহয়। চমকে উঠে আবার ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করলো। তামিম শয়তান ব্যাটা ফোন করছে অনবরত।
নীরা এবার ফোন রিসিভ করলো,
—হ্যালো শুনুন, এখন কথা বলতে পারবো না। ব্যস্ত আমি। মিটিং এ আছি। নীরা ফোন রেখে সুইচ অফ করে দিলো।
ভদ্রমহিলা এবার কথা বললেন,
—নীরা, আমি তোমাকে সংক্ষিপ্ত করে কিছু কথা বলবো। বেশি কথা বলার মানসিকতায় যে আমি নেই তা তুমি জানো।
নীরা হেসে বললো,
—আমরা বরং পরে কথা বলতে পারি ম্যাডাম। আপনি এখন মেয়ের কাছে গিয়ে বসুন।
ভদ্রমহিলা হাত দিয়ে নীরাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
—তুমি আমাদের যে সাহায্য করেছো, তার বিনিময়ে আমরা তোমাকে এর সমান কিছুই দিতে পারি না। এর সমতুল্য কিছু নেইও আমাদের কাছে। তবে হ্যাঁ একটা জিনিস আমরা তোমার জন্য করতেই পারি। তা হলো, তোমার এমন কোনো দরকার বা প্রয়োজন যেটা তোমার চাই কিন্তু নিজের সাধ্যতে সেটা করতে পারছো না। এরকম কিছু যদি তোমার চাইবার থাকে বলো, মনে করো এই মুহুর্তে এই জিনিসটা আমি তোমার কাছে চাইছি।
নীরা ঠান্ডা গলায় বললো,
—আমার কিছু চাই না ম্যাডাম। আপনি আপনার মেয়ের কাছে যান। জ্ঞান ফিরলে সে হয়তো অনেক কিছু বলবে।
ভদ্রমহিলার গালে বেয়ে এবার চোখের পানি কিন্তু কণ্ঠ একদম দৃঢ়,
—আমি যদি তোমার জন্য সেরকম কিছু না করি, আমার মেয়েটা রাগ করবে। জ্ঞান ফিরলে সে যাতে জানতে পারে, তোমায় ধন্যবাদ দেওয়ার মতো আমরা কিছু একটা করেছি। ভদ্রমহিলা ব্যাগ থেকে চেকবই বের করলেন।
নীরা হাই তুলতে তুলতে বললো,
—আমার কিছু চাই না ম্যাডাম। তবে এই যে, মাহবুব রনি। ইনিও আপনার মেয়ের জন্য যথেষ্ট করেছেন। রনি ভাই’র একটা ছোট্ট সমস্যা আছে, ইনি একজনকে ভালোবাসেন। বিয়ে করতে চান। থাকার জায়গা নেই, মা -বাবাও নেই। বেচারা নিজের ভালোবাসার কথা বলতেও পারছেন না। কিছু করতেও পারছেন না। আপনি যদি আসলেই কিছু করতে চান, আপনার যদি সেই সামর্থ্য থাকে, এই বেচারার জন্য করুন। বেচারার ভালোবাসার জন্য করুন।
রনি স্তব্ধ ভঙ্গিতে মুখ হা করে নীরার দিকে তাকিয়ে রইলো।
নীরা বলতেই থাকলো।
—তিনি আমার বিধবা ভাবীকে ভালোবাসেন।আমার বাবার ভয়ে বলতে পারছেন না। আমি জানি ইনি ভাবীকে অনেক ভালো রাখবেন।
সেলিনা কঠিন গলায় বললেন,
—আমি ব্যবস্থা করছি, এক্ষুণি সব ব্যবস্থা করছি।
রনি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে পড়লো পাশের চেয়ারে।তাঁর চোখের পাতা ঘনঘন পড়ছে।
নীরা আর সেখানে দাঁড়ালো না।
হাসপাতালে সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসতেই দেখলো শফিক দাঁড়িয়ে। তাঁর হাতে বই, সে পড়ছ খুব মনোযোগী হয়ে। নীরার মনে হলো, এটা তার আগের শফিক ভাইয়া। একদম প্রথমের, যার জীবনে কোনো দুর্ঘটনা নেই।
নীরা মৃদু স্বরে ডাকলো,
—-তুমি হোস্টেল যাবে না ভাইয়া?
শফিক বই বন্ধ করে তাকালো।
—বেলালকে এগিয়ে দিয়ে দাঁড়ালাম। ভাবলাম,
তুই এতরাতে একা বাড়ি ফিরবি, তোকে সাথে নিয়ে যাবো বলে অপেক্ষা করছি।
—একা আমি একদম ভয় পাই না, তুমি জানো ভাইয়া।
শফিক হাসলো।
—একাই যাবি?
—হুঁ। তোমার জন্য আজ এতগুলো শপিং করেছি ভাইয়া। কাল পেয়ে যাবে।
শফিক হাত বাড়িয়ে বললো,
—নীরা, একটু কাছে আসবি? তোকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিই না কতদিন হলো!
নীরা ভাইয়ার কাছে এগিয়ে গেলো না। শফিক এগিয়ে এসে নীরার মাথায় হাত রাখলো। নীরা ঢোঁক গিলে নিয়ে কান্না আটকালো।
শফিকের চোখ ছলছল করছে, তবে তাঁর মুখে হাসি। ইতু যে মি. তামিমের বোন এই চমৎকার তথ্যটি নীরাকে সে এখনি বলবে না। এটা নিয়ে একসময় সে নীরাকে ক্ষ্যাপাবে।
নীরা বিরক্তি দেখিয়ে বললো,
—তোমার স্নেহ-মমতা কি শেষ হয়েছে ভাইয়া? আমি বাড়ি যাবো।
শফিক নীরার মাথা থেকে হাত সরিয়ে বললো,
—মি. তামিম তোকে এত ফোন করছেন, ধরছিস না কেন?
নীরা অবাক চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো।
কিরকম অসভ্য লোকরে বাবা! ভাইয়াকে পর্যন্ত খবর দিয়ে দিয়েছে!
এই লোককে নীরা একদম ছাড়বে না। এর মাথার বিষ নীরা নামিয়েই ছাড়বে। হুহ্…
#পর্ব_১৬
তামিম খুবই বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে ইতুকে দেখছে। একদিনের ব্যবধানে তাঁর ছোট্ট বোনটি যেন আকাশ পাতাল বদলে গেছে। ইতু গুটিসুটি মেরে জানালার ধারে বসে আছে। তাঁর হাতে কফিমগ কিন্তু সে কফিতে চুমুক দিচ্ছে না।
তামিম এগিয়ে গিয়ে ইতুর হাত থেকে কফিমগটা নিয়ে নিলো।
—তুই না খেলে আমিই খাই বরং। শুধু শুধু ঠান্ডা করছিস।
ইতু কফিমগটা ছাড়লো না।
তামিম ইতুর পাশাপাশি বসলো।
—-একটা ছেলে সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা একাউন্ট খুলে নিলো। আর তাতে তোকে বন্ধু বানিয়ে বললো,
আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র; ফিল্ম ও টেলিভিশনে পড়ছি। আর তুই অমনি তার বন্ধু হয়ে যাবি?
—আমি কেনই বা ভেবে নিবো সে মিথ্যা বলছে?
—সত্য ধরে নিলি কোন লজিকে?
—সে সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্য দশজনের সামনে নিজের মিথ্যে পরিচয় দিবে কেন? এটা তো লজ্জার।
—ইতু, সোশ্যাল মিডিয়া হলো এমন একটা জায়গা যেখানে আমরা মিথ্যেগুলো সহজে বলতে পারি। এখানে লজ্জা পাওয়ার কোনো চান্সই নেই।
ইতু মলিন চেহারা করে হাসলো।
—কোথাও বেড়াতে যাবি ইতু? চল, ঘুরে আসি।
—না ভাইয়া। আমি আর কোথাও বেড়াতে যাবো না।
তামিম ঘর ছেড়ে বাইরে এলো। ইতুর একা থাকা একদম ঠিক না এখন। রিতুকে স্কুল থেকে ক’দিন লিভ করিয়ে নিতে হবে।
হারুন ফোন করেছে, তামিম ফোন ধরলো না।
কথা বলতে ইচ্ছে করছে না একদম।
হারুন মেসেজ করেছে, “নীরা ম্যাডাম একটা বিউটি পার্লারে আছেন। তিনঘণ্টা ধরে ওয়াচম্যান অপেক্ষা করছে। এখনো বের হননি।”
তামিমের রাগ লাগলো। প্রচন্ড রাগ। একটা মানুষ কন্টিনিউয়াস ফোন করে যাচ্ছে আর তিনি কিনা মোবাইল অফ করে দিব্যি পার্লার ঘুড়ে বেরাচ্ছেন! এই মেয়েকে তামিম পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেবে।
তামিম হারুন সাহেবকে ফোন ব্যাক করলো,
—হ্যালো হারুন সাহেব, আপনি বিউটি পার্লারের এড্রেসটা মেসেজ করুন তো।
—জি স্যার এখনি করছি। স্যার, আরেকটা কথা ছিল।
—বলুন।
—স্যার নীরা ম্যাডামের কলেজের টিচার ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাকে। কিন্তু তিনি নাকি ফোন করে সাফ বলে দিয়েছেন, তিনি আর পড়াশোনা কন্টিনিউ করবেন না।
—ওহ.. ওকে আই সি.. পড়াশোনা সে কিভাবে না করে দেখছি আমি।
—স্যার, আমি বলছিলাম কি আর পড়াশোনা না করাই ভালো। কম পড়াশোনা করা মেয়েগুলো বউ হিসেবে আদর্শ হয়।
—নীরা ম্যাডাম আদর্শ বউ হলে আমার লাভটা কি?
—জি, না মানে, জি স্যার… জি জি….
তামিমের এমন কথায় হারুন হতভম্ব হয়ে গেল।
স্যারের লাভটা কি মানে? স্যার কি বলতে চাইছেন নীরা ম্যামকে কি তিনি পছন্দ করেন না? ও মাই গড! স্যারের মতলব তাহলে কি?
বিউটি পার্লার থেকে বেরিয়ে নীরার লজ্জা করতে লাগলো। আশেপাশের লোকজন কি তাকিয়ে দেখছে তাকে? নীরা দ্রুত হেঁটে সোজা লিফটের দিকে এগিয়ে এলো। ডিরেক্টর সাহেবকে ফোন করে নিতে হবে একটা। আজকের কাজের আপডেট দিতে হবে।
লিফটে ঢুকেই, নীরা একটা বড়সড় শক খেলো।পেছনে মি. তামিম দাঁড়িয়ে। তিনি নিশ্চয় একটা চুমু খাবেন এখন। নীরা কি ব্যাগ থেকে ছুড়ি বের করবে? কতবড় শয়তান! একদম তক্কে তক্কে লিফটে বসে আছে।
নীরা খুব সাবধানে ব্যাগের চেইনটা খুলে নিলো।ছুড়িটা হাতে নিতেই নীরা কেঁপে উঠলো। তামিম ততক্ষণে পিস্তল ঠেকিয়ে ধরেছে নীরার কোমরে।
—মিস নীরা, ডোন্ট মুভ…
নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগের চেইনটা বন্ধ করে হাত দুটো উপরে তুলে নিলো। শুকনো গলায় বললো,
—একটা চুমু খাবেন প্লিজ। এর বেশি না।
তামিম পেছন থেকে টেনে ধরলো নীরাকে। নীরার যে কি ভয়ানক সুড়সুড়ি তামিমকে কি বলবে?
নীরা কাঁপা কাঁপা গলায় আধো স্বরে বললো,
—এখানে ওখানে হাত দিবেন না। আমার সুড়সু্ড়ি আছে। প্লিজজজজ…
তামিম পেছন থেকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নীরাকে।
—অনুরোধ যখন করছেন তাহলে একটা চুমু খেয়েই ফেলি।
তামিম একটা চুমুতেই থামলো না। সে বরং জামার পেছনের জিপটা খুলে নিচ্ছে…
নীরা নড়ে উঠলো একটু,
—-নড়াচড়া মানা করেছি না। উফ্…. একটা গুলি করবো যে কেউ আওয়াজও পাবে না।
নীরা চোখ বন্ধ করে মনে মনে একটা অকথ্য গালি দিলো তামিমকে। লিফটের দরজাটা একবার খুলে যাক, সে চামড়া শুদ্ধু তুলে নেবে এর… বদমায়েশ। উফ্ শেভ করেনি নাকি? গলার কাছে দাঁড়ি খোঁচাচ্ছে। তামিম গাঢ় করে গাল ঘষলো নীরার গালে।
নীরা বিড়বিড় করে বললো,
—দাঁড়ির খোঁচায় দাগ হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। আস্তে ভাই… গালে দাগ হলে ঝামেলা আছে।
তামিম বাঁ-হাত বাড়িয়ে লিফটের সুইচটা আবার টিপে দিলো। লিফট আবার উপরে উঠছে।
নীরা দাঁতে দাঁত চেপে পাথর হয়ে আছে।
—গাল মিষ্টি মিষ্টি লাগছে কেন? কিরকম একটা মিষ্টি গন্ধও… সো সুইট….
—গাল মিষ্টি না। ফেশিয়াল করিয়েছি মাত্র। ফেশিয়ালের পর এরা একটা ক্যাপসুল মাখিয়ে দিয়েছে। এটা আধঘন্টা রেখে মুখ ধুয়ে নিতে হবে পরে। এজন্য মিষ্টি মিষ্টি লাগছে।
—আগে বলেননি কেন? আমি সেটা খেয়ে ফেললাম। পেট খারাপ করে যদি?
তামিম পিস্তলটা আরেকটু দাবিয়ে চেপে ধরলো,
—এন্টিকিসিং মেডিসিন মেখে ঘুরে বেরানো হচ্ছে এখন, তাই না? থু… আমার কি পছন্দ না বলতে তো পারেন।
নীরা জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকলো।
—পিঠের চেইনটা বন্ধ করুন। পায়ে ধরি আপনার।
চেইন বন্ধ করতে হলো না। ইয়েস! তিনতলায় এসে লিফটের দরজা খুলে গেছে।
নীরা এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলো। তামিম পাশে পাশে আসছে।
—আপনি এমন কেন করছেন আমার সাথে? এত অসভ্যতা! ছিঃ…
—আমার ফোন ধরছেন না কেন? ফোন কেটে দিয়ে মোবাইল অফ। আমার রাগ লাগছে তাতে…
—আমার ফোন, আমার ইচ্ছা। শুনুন আপনি যেটা ভাবছেন, আমি কিন্তু সেটা নই। দরিদ্র, ভঙ্গুর পরিবারের মেয়ে… ভেবেছেন ধরে ধরে চুমু খেয়ে নিলে আমি ভয়ে কাউকে কিছু বলবো না। এরকম কিন্তু নয়, আমি পুলিশে কমপ্লেইন করবো। আমি প্রতিবাদ করতে জানি।
—সেটা করছেন না কেন?
তামিম হাত বাড়িয়ে নীরার হাতটা টেনে ধরলো।
—মিস নীরা, আমরা পুলিশ কমপ্লেইনের ব্যাপারে বসে কথা বলতে পারি তো।
নীরা হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো না, একমুহূর্ত ভাবলো বরং। এই লোককে ভয় দেখিয়ে পিছু ছাড়ানো যাবে না। কাবু করতে হবে অন্যভাবে। অন্য প্যাঁচে ফেলতে হবে। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল।
—চলুন বসেই কথা বলি বরং।
তামিম পিস্তলটা ক্যারিয়ারে রাখতে রাখতে বললো,
—আমার এখন ডিউটি টাইম অথচ কাজ ফেলে আমি আপনার কাছে বসে আছি।
—কেন বসে আছেন?
—আপনি ফোন ধরেননি বলে। ফোন বন্ধ করে সুখী হয়ে হাঁটছেন বলে।
নীরা নিজেকে ঠান্ডা রাখার জন্য লম্বা করে শ্বাস নিলো। সে দুদিন পর একটা নামীদামী কোম্পানীর হয়ে কাজ করবে। পাবলিক প্লেসে নো ঝামেলা।
দুটো কোল্ড কফি বলা দরকার। নীরার বলতে হলো না; তামিমই অর্ডার দিলো।
—আপনি আমার কাছে যেটা চান সেটা আমি দিতে পারবো না।
—কেন?
—আমাদের দু’জনের ক্লাস আলাদা।
তামিম হাসলো।
—যত্তসব বোকা বোকা কথা!
—মোটেও বোকা বোকা কথা না। আপনি কি জানেন মি. তামিম আমরা ঢাকায় যে বাড়িটিতে থাকি, সেটি আমাদের না। আমাদের গ্রামেও কোনো বাড়ি নেই এখন। সোজা কথায়, আমরা ভাসমান জনগোষ্ঠী।
—তাতে সমস্যা কি?
—আরো শুনুন, শরবত বিক্রির আগে আমার বাবা কারওয়ান বাজারে সব্জি বিক্রি করতেন। আমার বড় দুই ভাই বাবার দোকানে ছিলেন সাহায্যকারী। আধাপঁচা সব্জিগুলো আমরা কখনোই বিক্রি করতাম না। এগুলো আমরা বেছে বাড়ি নিয়ে আসতাম, নিজেরা খেতাম। বুঝতে পারছেন? বস্তি ক্যাটাগরির জীবনযাত্রা ছিল। এসব দেখে আমাদের ফুফু মাসে মাসে কিছু টাকা দিতে থাকলেন।
—আমাকে এসব কেন বলা হচ্ছে? আমি এসব বাংলাপিডিয়া শুনতে চাই না।
—শুনতে হবে, এই যে আপনার আমাকে চুমু খাবার এত সাধ.. সে জন্য শুনতে হবে। আমাদের এত অভাবেও দুটো ভালো জিনিস আমাদের ছিল। তা হলো, আমার দুই ভাইয়ের ব্রেইন। তাঁরা দুজনেই পড়াশোনায় এত ভালো ছিলেন যে, বলার বাইরে। খাতা কলম নেই, বই-টেবিল নেই তাও বছরশেষে সেরা রেজাল্ট। বড় ভাই’র যখন চাকরি হলো, আমরা ভাবলাম আমাদের স্ট্যাটাস বুঝি বদলে গেল কিন্তু মোটেও কিন্তু তা নয়। ভাইয়া মারা গেলেন রহস্যময় রোড অ্যাক্সিডেন্টে। আমাদের জাত আবার নেমে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমরা শরবত বিক্রি করতে শুরু করলাম। সেই শরবতের ব্যবসাও এখন শেষ।
—আপনি এসব তথ্য আমাকে শোনাচ্ছেন কেন?
—কারণ আপনি যেটা চান, সেটা কখনোই সম্ভব নয়!
—অবশ্যই সম্ভব। আমি জানি মিস নীরা, আপনি একদিন অনেক নামীদামী মডেল হবেন। অনেক টাকা হবে আপনার। দামী গাড়িতে চড়বেন।
—ওওওওওও.. তার মানে আমার টাকা হবে দেখেই পিছু নিয়েছেন। এজন্যই টার্গেট ধরেছেন। ওহো…..
কি সাংঘাতিক ধান্ধাবাজ আপনি। আমি যদি মডেল হয়ে বড়লোক হই, তাহলে আমায় বিয়ে করবেন। আর এখন আমি আপনার প্রোডাক্ট, তাই না?
—উফ্। সেরকম কিন্তু নয়! বেশি কথা বলেন আপনি। আমি সবসময় আপনাকে মিস করি। সবসময় আপনার কাছে এলে আমার হার্টবিট এবনরমাল হয়ে যায়।
নীরা উঠে দাঁড়ালো।
—টাকার লোভে এত প্রেম তাই না? হবো না আমি মডেল। রাস্তায় ভিক্ষে করবো এখন থেকে। দেখি বিয়ে করে দেখান আমাকে। চুমু খান আমাকে। তখন আমায় আদর করতে কেমন মন চায় দেখি!
—আপনি যেরকম, সেরকম না হলে আমি হয়তো আপনাকে আমার জীবনে বিশেষভাবে ভাবতাম না। আমি কোনো কিছুতে প্রথম পছন্দ ছাড়া দ্বিতীয়….
নীরা তামিমের পুরো কথাটা শুনলো না। সে পাশের টেবিলে গিয়ে সত্যি সত্যি একটা লোকের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
—কাকাগো, আল্লাহর নামে দুইটা টাকা দেন। ভদ্রলোক অবাক চোখে নীরার দিকে তাকিয়ে আছেন।
নীরা আবার কাকুতির স্বরে বললো,
—চাচাগো, দুইডা ভিক্ষা দেন। ভাত খাবো।
ভদ্রলোক ভয়ার্ত গলায় বললেন,
—সত্যিই টাকা দিবো?
নীরা ধমক দিলো,
—আমি কি আপনার শালী যে ঢং করবো? ভিক্ষা চাই, ভিক্ষা দেন। নাকি ভিক্ষা নাই? না থাকলে বলেন মাফ কইরা দিবো।
ভদ্রলোক একশো টাকার একটা নোট বের করে ভয়ে ভয়ে নীরার হাতে দিলেন।
নীরার আকস্মিক আচরণে তামিম হতভম্ব।
নীরা একশটাকার নোটটি নিয়ে তামিমের কাছে এগিয়ে এলো,
—এটা আমার জীবনের প্রথম ভিক্ষার টাকা। এই এখন থেকে আমি ভিখিরী নীরা। আমি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করবো। দেখি, বিয়ে করুন আমায়। তারপর চুমু খেতে মন চাইলে হাজারটা চুমু খাবেন তখন।
তামিম কোনো কথা না বলে হা করে তাকিয়ে আছে।
—আপনার আসলে আমাকে সারাজীবনের বউ হিসেবে পছন্দ না, চুমু খাবার জন্য রাস্তার সস্তা মেয়ে ভাবেন আমায়। বিয়ে করে সাথে নিয়ে চলার মতো ভাবেন না। আমি কিন্তু মোটেও তা নই। আমি আমার মতো মি. তামিম। আমার শ্রেণীর কাউকেই আমি বিয়ে করবো। তাঁর সাথে সম্পর্কে আমার কোনো দ্বিধা থাকবে না। তাঁরও থাকবে না। মি.তামিম, সমান্তরালে তাকাতে কোনো কষ্ট নেই। উপরে-নিচে তাকাতে গেলে চোখে ব্যথা করে। শফিক ভাইয়ের অবস্থা বুঝুন। বেচারা উপরে তাকাতে গিয়ে দৃষ্টি পু্ড়ে গেছে। নিজের সন্তানের মুখ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে না।
তামিম মুখ হা করে তখনো দাঁড়িয়ে।
নীরা একটা তৃপ্তির হাসি হাসলো। যাক্… পাগলটাকে থামানো গেছে এবার।
নীরা গটগট করে হে্টে চলে এলো। এবার আর অন্তত ব্যাটা ঝামেলা করবে না। যাক্ বাবা.. বাঁচা গেল….
তামিম চট করে রিতুকে একটা ফোন করলো,
—হ্যালো রিতু, মাকে একটু জিজ্ঞেস করতো আমি যদি এক্ষুণি বিয়ে করে ফেলি, মা কি বেশি রাগ করবে?
—এক্ষুণি বিয়ে করবি?
—হুঁ। তুই মাকে একটু ডেকে জিজ্ঞেস করতো।
—মা ছাদে ভাইয়া। আমি যেতে পারবো না এখন, পড়ছি আমি। তুই বাবাকে বল না, বলে বিয়ে করে ফেল।
—উফ্, বাবাকে ফোনে পাচ্ছি না। তুই মাকে বল… যা.. দৌড়ে যা রিতু। পাত্রী চলে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি কর প্লিজ। তোকে আমি দশ হাজার টাকা দিবো। যা…
—আচ্ছা যাচ্ছি। তুই বরং পাত্রীকে ধরে আটকা।
রিতু হাসছে। শব্দ করে হাসছে।
তামিমের মাথা ভনভন করছে। সাক্ষী লাগবে, হারুনকে বলতে হবে।
—রিতু একটু কুইকলি যা… প্লিজ বোন…
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা