হলিডে #পর্ব_১৭_ও_১৮

0
343

#হলিডে
#পর্ব_১৭_ও_১৮

#পর্ব_১৭

—আচ্ছা ভাইয়া এক্ষুণি কেন বিয়ে করছিস বলতো? আমার পরীক্ষার পর করতে পারতি।
—আমার তিনি রাগে ভিক্ষা করা শুরু করে দিয়েছে। এই মাত্র ভিক্ষা করলো। প্রথম ভিক্ষা পেলো ১০০ টাকা।
—একবারেই ১০০টাকা! বলিস কি!
—হুঁ… তুই মায়ের কাছে এসেছিস? জিজ্ঞেস কর না মাকে…
সেলিনা টবের গাছের মাটি নিরিয়ে দিচ্ছেন।
রিতু ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—কথা বলো মা, ভাইয়ার জরুরি কথা আছে। তোমার ডিসিশন দরকার।
—-দেখছিস না কাজ করছি; হাতে মাটি। কি বলছে?
—ভাইয়া যদি এখনি বিয়ে করে ফেলে তুমি কি বেশি রাগ করবে?
—রিতু ফাজলামো বন্ধ। কি কথা ঠিক করে বল।
—এটাই কথা মা। ভাইয়া এখনি একটা ভিখিরীনিকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। খুবই ভালো মানের ভিখিরি। সে একবারেই ১০০টাকা ভিক্ষা পায়। ঢাকা শহরে এরকম রেয়ার ভিক্ষুক আর পাবে না।
—হ্যালো রিতু, রিতু মা কি বলছেরে?
—মা কিছু বলছে না ভাইয়া। হা করে আছে। তুই বরং বিয়ে করে ফ্যাল। মা নিশ্চয় ভালো ভিক্ষা পাচ্ছে, এমন বউকে নিয়ে রাগ করবে না।
তামিম ফোন রেখে দিলো।
নীরাকে ডাকা দরকার। চলে যাচ্ছে সে।
তামিম এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ালো।
—মিস নীরা, আপনি কি এখন চলে যাবেন?
—হুঁ। ভিক্ষা করবো বললাম না, ভিক্ষা করতে যাচ্ছি।
—আমিও আপনার সাথেই আসছি। ভিখিরি নীরাকে বিয়ে করবো, সিদ্ধান্ত ফাইনাল।
নীরা দ্রুত হাঁটতে লাগলো। মি. তামিম নিশ্চয় নীরাকে একটা ফলস পজিশানে ফেলতে চাচ্ছেন। নীরা একদমই তা হতে দেবে না। একদমই না। সে খুব স্মার্টলি সব ট্যাকল করবে।
—আপনি বিয়ের জন্য রেডী তো মিস নীরা? আমরা এখনি বিয়ে করবো কিন্তু।
নীরা অবজ্ঞা সূচক হাসলো।

তামিম ব্যস্ত হয়ে হারুনকে ফোন করলো।
—হ্যালো হারুন সাহেব, চারজন সাক্ষী লাগবে আমার। এখনই ম্যানেজ করতে পারবেন?
—জি স্যার, জি মানে… সাক্ষী কেন?
—আমি বিয়ে করবো হারুন সাহেব। আপনি সাক্ষী নিয়ে কলাবাগান কাজী অফিসে আসুন।
—স্যার, আপনি বিয়ে মানে স্যার.. কাকে বিয়ে করছেন?
—মিস নীরাকে বিয়ে করবো এখনি। আপনিই তো বললেন, মিস নীরার পড়াশোনা কম। আদর্শ বউ হবে, সেজন্য ভাবলাম বিয়ে করে ফেলি।
হারুন লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলতে লাগলো। তার এক পরামর্শে স্যার সরাসরি বিয়ে পর্যন্ত চলে গেলেন! এও কি সম্ভব?
—আমি তো স্যার… আসলে এমনি… স্যার….
—আপনি সাক্ষী নিয়ে আসুন তো।
—স্যার ধানমন্ডি থানার ওসি সাহেব সাথে আছেন আমার, উনাকে নিয়ে আসি? ওসি মানুষ, সাক্ষী দিলে বিয়ে মজবুত হবে স্যার!
—যাকে খুশি নিয়ে আসুন, তবে ম্যাক্সিমাম এক ঘন্টার মাঝে যাতে সব এরেঞ্জ হয়।
তামিম ফোন রেখে হেসে এসে নীরার মুখোমুখি দাঁড়ালো,
—ওগো ভিখিরীনী…. চলো বিয়ে করে ফেলি।
নীরা তামিমের হাভভাব বুঝবার চেষ্টা করছে। তিনি আসলে কি চাইছেন? ভয় দেখাতে? নীরার মনোবল ভেঙ্গে দিতে? আসলে নীরা যে ভুল সেটা প্রমাণ দিতে? তিনি কি নীরার বিরুদ্ধে মানসিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন? নীরা দ্রুত চিন্তা করতে লাগলো। তামিম সাহেব কি চাইছেন? তাঁর ধারণা কি? নীরাকে ভয় দেখানোই কি তাঁর উদ্দেশ্য? এরকম যদি হয়, তাহলে তাঁর জেনে নেওয়া দরকার যে, নীরা কাউকে ভয় করে না। কিচ্ছু ভয় করে না।
—কি হলো? বিয়ের কথা বলে এখন কি ভয় পাচ্ছেন? মিস নীরা, আমি আসলে দেখতে চাই কোনদিকে তাকালে কষ্ট হয়- উপরে না নিচে? নাকি সমান্তরালে?
—ভয় পাবার তো কিছু নেই। চলুন, বিয়ে করা যাক।

নীরা মনে মনে একগাল শান্তির হাসি হেসে নিলো। ব্যাটা স্নায়ুযুদ্ধের যে লড়াইটা করতে চাচ্ছিস, সেই লড়াইয়ে তুই গো হারান হারবিরে পাগলা!
নীরা খুব সাবলীল ভাবে তামিমের গাড়িতে বসলো। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।
—মিস নীরা, আপনি মুখটা ধুয়ে নিবেন একটু। আধঘন্টা হয়ে গেছে ক্যাপসুলটা বেশি শুকিয়ে হার্ড হয়ে গেলে স্কিনের ক্ষতি!
কথাটা বলে, তামিম একটু ঝুঁকে আসলো নীরার মুখের দিকে। নীরা একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল, তামিমের চোখ দুটো আনন্দে চকচক করছে। অর্থাৎ ব্যাটা ধরেই নিয়েছে, সে খেলাটায় জিতেই গেছে।
—দিন পানির বোতলটা দিন, মুখ ধুয়ে নিই।

গাড়িতে বসে নীরা চোখ বন্ধ করে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে লাগলো এই লোকটার আবেগ এত প্রবল কেন? তিনি কেন বুঝতে চাইছেন না, অসম ভালোবাসার যেই নট উনি বাঁধতে চাইছেন সেই নট খুলবার জন্য অলরেডী এই সমাজের প্রতিটা পরিস্থিতি মুখিয়ে আছে। তিনি আছেন একটা ঘোরের মধ্যে; এই ঘোর তাঁর মধ্যে দাসত্ব এনে দিয়েছে। তিনি এখন ভালোবাসা নামক ঘোরের দাস হয়ে আছেন। এর থেকে বের হবার একটাই রাস্তা, প্রচন্ড বাস্তবতার শক। কঠিন কোনো সিচুয়েশানে তাকে ফেলতে হবে।
অসম ভালোবাসার একটা তীব্র ভয়ানক রূপ সে খুব কাছ থেকে দেখেছে তার জীবনে। শফিক ভাইয়াকে যখন একদিনের রিমান্ডের পর কারাগারে দেয়া হলো, তখন বাবার সাথে সে ভাইয়াকে দেখতে গিয়েছিলো। শফিক ভাইয়া ঠিকমত দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিলেন না। নীরাকে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে শফিক ভাইয়া হেসে বলেছিলেন,
—এরা একটা বেঞ্চে উপুর করে শুইয়ে বেঁধে ফেলে বুঝলি! তারপর পায়ের তলায় খুব মারে জানিস??মারের কি টেকনিক! পায়ের পাতা মাটিতে ফেলতে পারছি না। এই দ্যাখ, মাটিতে লেপ্টে বসেই পস্রাব পায়খানা করছি। দ্যাখ…
বাবা কথা বলতে পারেননি একটাও। শফিক ভাইয়া
বাবার হাত ধরে খুব করে বলেছিলো,
—কিছু টাকাকড়ি দিও যেও এদের বাবা। একটু যাতে কম মারে। কি সব ইনজেকশন দিচ্ছে, বুঝোই তো…
সেই রাতে বাসায় ফিরে নীরার মনে হয়েছিলো সে নিজের কিডনি বেচে দিয়ে ভাইয়াকে ছাড়িয়ে আনবে। তারপরে তারা বর্ষা ভাবীর সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেছে, কাজ হয়নি। ভাইয়াকে তিনমাস জেল খাটতে হয়েছিলো। জেল থেকে শফিক ভাইয়া ফিরলেন বদ্ধ পাগল হয়ে, অন্যরকম হয়ে।
মি. তামিম কি ভালোবাসার এই দুঃসহ রূপটার কথা জানেন? ভালোবাসা নামক দুর্বহ বোঝা বয়ে বেড়াতে গিয়ে শফিক ভাইয়ার মেরুদণ্ডই ভেঙ্গে গেছে।ভালোবাসা শব্দটা নিজেই হয়তো জানে না, তাঁর উল্টো পিঠে কত কষ্টবাসা!

—মিস নীরা, আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?
নীরা চোখ বন্ধ করেই বললো,
—-না।
—আমরা ধানমন্ডি ৩২ এ চলে এসেছি। এখানে কিন্তু ভিক্ষা করা যাবে না, এটা ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা।
—আমাদের তো বিয়ে করতে যাবার কথা।
—সেখানেই তো যাচ্ছি…..
নীরা মৃদু হাসলো।

কাজী অফিসের সামনে এসে তামিম গাড়ি থেকে নামতেই হারুন বললো,
—-বিয়ের সব রেডী স্যার। চারজন সাক্ষীই স্যার অতি মজবুত! রমনা থানার ওসি, ধানমন্ডি থানার ওসি, গুলশান থানার ওসি, আর বনানী থানার…
—হারুন সাহেব, আমি বিয়ে করতে এসেছি। পুলিশ নিয়ে কোনো অপারেশনে আসিনি যে, সব পুলিশ নিয়ে আসবেন। আপনি একজন সাক্ষী হলেই পারতেন।
—স্যার, আমি হবো উকিল বাবা। আপনার সাথে এই অধমের একটা আত্মীয়তার সুযোগ পাওয়া গেল। আমি স্যার সামান্য কিছু উপহারও এনেছি।
তামিম অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে হারুনের দিকে তাকালো। বিয়ে নিয়ে তো এর মহাউৎসাহ দেখা যাচ্ছে।
—আমার মাত্র একবার বলায় আপনি নীরা ম্যামকে বিয়ে করবেন ডিসিশন করলেন, আমার স্যার শুনে কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেছে। এই দুনিয়ায় আমি কাউকে কখনো কথা শুনাতে পারিনি। আমার নিজের মা, তাকে বললাম মা চাচাতো বোন বিয়ে করবো না; এর চেয়ে কানা-কুরা-লেংরা বিয়ে করিয়ে দিন। মা কথা শুনলেন না। বিয়ে ঠিক করলেন চাচাতো বোনের সাথে। সামনের ডিসেম্বরে বিয়ে স্যার। সেখানে আপনার মতো একজন মানুষ….
হারুনের গলা ধরে এসেছে।
—দেখি কি উপহার এনেছেন? দিন তো হারুন সাহেব।
হারুন প্যাকেট খুলে একটা পাগড়ী বের করে দিলো।
—আমি এরকম অফিশিয়াল গেট আপের সাথে পাগড়ী পরবো?
—বিয়ের দিন পাগড়ী পরতে হয়। শেরওয়ানির কথা একদম মনে নেই স্যার। আর স্যার এটা নীরা ম্যাডামের জন্য।
হারুন আরেকটা প্যাকেট বের করলো।
—স্যার নীরা ম্যাডাম কই?
তামিম পাগড়ী মাথায় দিতে দিতে বললো,
—উনি ঘুমোচ্ছেন গাড়িতে।
হারুন মাথা চুলকালো। যেই মেয়ের বিয়ে সে এখন ঘুমুচ্ছে? ঘুমুচ্ছে কেন? স্যার কোনোরকম দুই নম্বরি করেননি তো? ঔষধ ফৌষধ দিয়ে হতে বেঁহুশ করে তুলে এনেছেন, এমন নয়তো? না না এমন হবে কেন? স্যার কত ভালো মানুষ!
—মিস নীরা, নীরা… উঠুন আমরা চলে এসেছি। উঠুন…..
নীরা চোখ খুললো। সাদা শার্টের সাথে পাগড়ী মাথায় তামিম সাহেব তাকে ডাকছেন। মানে কি? সে কি স্বপ্ন দেখছে? চিন্তা করতে করতে কি সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো?
ও মাই গড!
—মিস নীরা, সবাই অপেক্ষা করছেন। আমরা কাজী অফিস এসে গেছি, উঠুন।
নীরা চোখ কচলে উঠে দাঁড়ালো। পরিস্থিতি পুরো নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছে। তামিম সাহেব সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। হুঁহ… এতগুলো পুলিশের গাড়ি কেন?
কাজী অফিসে ঢুকে নীরা পুলিশের একটা টিম দেখতে পেলো। এসবের মানে কি?

রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার আগে নীরা বিড়বিড় করে বললো,
—আমি বিয়ে করবো না।
জবাবে তামিমও চাপা স্বরে বললো,
—এখানে যারা আছেন, সবাই উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার। এদের সাথে ধানাই-পানাই চলবে না।
নীরা বাঁ-হাতে তামিমের কোমরের কাছে শার্ট খামচে ধরে বললো,
—আমরা কি পুলিশ স্টেশনে বিয়ে করছি?
—না কাজী অফিসে। পুলিশেরা বিয়ের অতিথি।
তারপর আর নীরা কথা বলেনি। ধানমন্ডি থানার ওসি সাদিকুর রহমান সাহেব তামিমের প্রতি আবার খুবই আন্তরিক। অন্তরঙ্গতায় গদগদ হয়ে তিনি বললেন,
—এটা ছোট্ট গিফট আপনাদের জন্য। হুট করে তো তাই প্ল্যান করে কিছু দিতে পারিনি।
—আপনাকে এমনিতেই অনেক ধন্যবাদ। কষ্ট করে এলেন।
সাদিক সাহেব হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন তামিমের দিকে। গলার স্বর নিচু করে বললেন,
—আচ্ছা, এত ইমার্জেন্সি বিয়ে; কোনো প্যাঁচ নাকি? আপনি স্মার্ট অফিসার, একটু কেয়ারফুল থাকবেন না! একশোরকম কন্ট্রাসেপটিভ পাওয়া যায় এখন বাজারে। তাও ভালো হয়েছে, প্রথম একটা বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেলে অবশ্য নিশ্চিন্ত। বাচ্চা হলে পরে মেয়েদের তেজও একটু কম থাকে।
তামিম কথা শুনে যেন ভীষণ খুশি হয়েছে এমন ভাবে মাথা নাড়লো।
—তাই নাকি?
—আরে শুনুনই না, আমার ম্যাডাম প্রথমে তো কথায় কথায় হুমকি; পুরো মহারাণী। এই করো, সেই করো, এভাবে চলতে হবে, টাইমলি বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু অনু হবার পর একদম চুপসে গেছে। আগে মাসে শপিং ছিল চারবার। আর এখন দু-মাসেও বেরোবার সুযোগ নেই। ডাক্তার দেখানোর দরকারে বের হতে গেলেও কাই-কুঁই করে। আপনি অবশ্য একদিক দিয়ে ভালোই করেছেন, প্রথম থেকেই হালুয়া টাইট! নেও বাবা, খেলো এখন।
—জি… জি… সেজন্যই তো.. দোয়া করবেন আমাদের জন্য। আর খেয়াল রাখবেন কথাটা যাতে সিক্রেট থাকে।
—কি যে বলেন না অফিসার.. দশটা লাশ ফেলে দিয়ে গিয়ে হাত ধুয়ে ফেলি, কেউ জানতে পারে না। আর এটা তো বিয়ে। ওকে… তাহলে চলি অফিসার।
বাসায় আসবেন একদিন।
তামিম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

গাড়ির কাছাকাছি পর্যন্ত এসে নীরা একটু থামলো।
তামিম গাড়িতে বসে ডোরটা খুলে দিয়ে বললো,
—গাড়িতে বসো নীরা….
নীরা থমকে গেল। বিয়ে করেই আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেছে। লক্ষণ মোটেও ভালো না।
নীরা পায়ের দিকে তাকিয়ে একমুহূর্ত ভাবলো। ১৪৯০ টাকার জুতো। মেরি ক্লেয়ার, সেমি পিন হিল; কিছুতেই জুতোটা ফেলে যাওয়া যাবে না। নীরা নিচু হয়ে জুতোটা হাতে নিলো এবং জানে-প্রাণে দৌড়াতে শুরু করলো। এই তামিম লোকটার কাছে সে কিছুতেই ধরা দিবে না, কিছুতেই না।
হারুন এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁর হাতে মিষ্টির প্যাকেট।
গাড়ির জানালা দিয়ে হারুন মুখ বাড়িয়ে বললো,
—স্যার, মিষ্টি নিন। নিন স্যার।
তামিম মুখ বাড়িয়ে হা করে হারুনের হাত থেকে মিষ্টি নিলো।
—স্যার আমার মেয়ে কই? তাকেও একটা মিষ্টি খাওয়াবো।
তামিম বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
—আপনার মেয়েটা আবার কে?
—নীরা ম্যাডাম, নীরা মা…. একটু আগেই তো উকিল বাবা হলাম। দায়িত্ব আছে না। তিনি কই?
তামিম গাড়ি স্টার্ট করতে করতে বললো,
—ওই যে পিছনে তাকিয়ে দেখুন, জুতো হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। আপনার বুদ্ধিতে বিয়ে করলাম হারুন সাহেব, আপনার ডেফিনিশনের আদর্শ বউ বিয়ে করে স্বামীকে ফেলে দিয়ে রাস্তায় দৌড়াচ্ছে।
—দৌড়াচ্ছে কেন স্যার?
—কি জানি, হয়তো পালাচ্ছে……
—স্যার, বনানী থানার ওসি সাহেব এখনও আছেন, তাকে দিয়ে এরেস্ট করিয়ে নিয়ে আসি? দু-মিনিট লাগবে। যাবো স্যার?
তামিম হাই তুলতে তুলতে বললো,
—যতই দৌড়াক হারুন সাহেব, লিগ্যালি নীরা এখন আমার ওয়াইফ। আমি কি তাকে এরেস্ট করাতে পারি? বেচারির বিয়ের দিন একটু দৌড়াতে মন চাইছে, দৌড়াক না। হারুন সাহেব, আজ আমি আর অফিসে যাবো না। টায়ার্ড লাগছে। সব ধরনের অফিস ওয়ার্ক ক্যানসেল করিয়ে দিন।

তামিম গাড়ি নিয়ে সাঁ করে চলে গেল। তবে নীরা যেদিকে গিয়েছে, তার বিপরীত দিকে। হারুন মিষ্টির প্যাকেট হাতে সেই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
তাঁর গাধা বুদ্ধির জন্য বেচারা তামিম স্যারের এতবড় ক্ষতি হলো আজ। কেন যে সে আদর্শ বউয়ের সাজেশনটা দিতে গেল। তার আগেই সাবধান হওয়া উচিত ছিল। বুঝা উচিত ছিল, যে মেয়ে ছুড়ি হাতে তাড়া করে হারুনের সর্বনাশ করে দিয়েছিলো, সেই মেয়ে তো বিয়ের পর এভাবেই রাস্তায় দৌড়াবে। হারুন লম্বা একট দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তাঁর নির্বুদ্ধিতার জন্য স্যারের এই জীবন শেষ হয়ে গেল বুঝি…..

হারুন মিষ্টির প্যাকেট থেকে একটা মিষ্টি বিসমিল্লাহ বলে মুখে পুড়লো।
উঁহু মিষ্টিটা এত তেতো কেন লাগছে?

#পর্ব_১৮

নীরা বাড়ি এসেই দেখলো লাবণী শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে ঘরের এমাথা ওমাথা হাঁটছে। রান্নাঘরে কে? ওহ.. মা রান্না করছে। বাবা কখন এলো?
নীরাকে দেখেই যেন লাবণী চিৎকার করে উঠলো।
—খবর জানো নীরা? রনি শয়তানের খবর। জানো সে কি করেছে?
নীরা লাবণীর কথার কোনো জবাব না দিয়ে সোফায় শুয়ে পড়লো ।
—শয়তানটা এতদিন কেঁদে কেটে বললো, তাঁর কেউ নেই। এখন দেখো, কোথা থেকে তাঁর এক ধনী ফুফু হাজির হয়েছে। সেই ফুফু বাবা-মাকে গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে এনেছে। তাদের উদ্দেশ্য রনির সাথে আমার বিয়ে দেয়া। একবার চিন্তা করে দেখো, আমার জুনিয়র ছেলে। ক্লাসমেটের বড় ভাইয়ের বউকে বিয়ে করতে চলে এসেছে!
—রনি তোমার কতবছরের জুনিয়র ভাবী?
—এক বছরের..
—অভিষেক বচ্চন ঐশ্বরিয়া রাইয়ের তিনবছরের ছোট। জুনিয়র বিয়ে করা কোনো সমস্যাই না। মাঝে মাঝে যখন কথা শুনবে না, ধরে চড়-থাপ্পড় দিতে পারবে।
—বলছো কি নীরা? জুনিয়র বলে আমি তাকে বিয়ে করে ফেলবো! বিয়ে করে চড় থাপ্পড় দিবো!
—হুঁ, তাই করা উচিত! জুনিয়র স্বামী মানে সুখী সংসার।
—তুমি এমনভাবে বিয়ের কথা বলছো যেন, বিয়ে পানিভাতের মতো সোজা। বিয়ে কি অত সহজ ব্যাপার নাকি?
নীরা শোয়া থেকে উঠে বসলো।
—ভাবী, বিয়ে পানিভাতের চেয়েও সোজা।
—মানে কি?
—মানে হলো, তুমি দেখবে তুমি ঘুমিয়ে আছো; তারপর যখন তোমার ঘুম ভাঙবে, দেখবে একটা পাগড়ী পরা বর আর একদল পুলিশ বন্দুক নিয়ে তোমায় ঘিরে আছে। তারপর পুলিশের লোকের দিকে তাকিয়ে কবুল বলে তুমি পেপার সাইন করে নিবে। ব্যস, বিয়ে হয়ে গেল। তারপর তুমি দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি চলে আসবে।
লাবণী নীরার দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। তারপর অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললো,
—সিনেমা সিনেমা করে তুমি জীবন নিয়ে সিনেমায় এড করে দিয়েছো। যত্তসব ফাজলামো তোমার!
—ভাবী, তুমি রনি ভাইকে বিয়ে করলে বরং আমাদের সবারই ভালো হবে। বেচারা আমাদেরও খেয়াল রাখবে। দেখা যাবে, উনি আমাদের সাথেই এ বাড়িতে থাকছেন, বাবা-মাকে দেখছেন। অন্তত আমাদের ভালোর জন্য হলেও তোমার রনি ভাইকে বিয়ে করা উচিত।
লাবণী নীরার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো। তাঁর চোখের পলক পরছে না।
—ভাবী, শফিক ভাইয়ার জন্য কিছু কাপড়চোপড় কিনেছিলাম। তুমি কি দয়া করে এগুলো একটু ভাইয়ার হোস্টেলে দিয়ে আসবে? আসার সময় রনি ভাইয়াকেও একটু বকে ধমকে এলে। দুদিন পর যখন বিয়েই করছো, এখন থেকেই টাইট দিয়ে রাখলে।
নীরা উঠে চলে এলো। বাবার সাথে দেখা করা দরকার। টাকা-পয়সার কি অবস্থা কে জানে? জুস কর্নারের কাজ আটকে আছে।

সোবহান সাহেব ভীষণ চিন্তিত হয়ে আছেন। ছেলের বউকে বিয়ে দিতে গেলে কি করতে হয়? নীরার সাথে রনির বিয়ে হলে অবশ্য এত ঝামেলা ছিল না। নিজের মেয়ে বলে কথা। গয়নাগাটি না দিলেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ছেলের বউ? এমনিতেই বেচারী এ সংসারের দরকারে নিজের সব গয়না একে একে বিক্রি করে দিয়েছে। আচ্ছা, ছেলের বউয়ের বিয়েতে কেমন আয়োজন করতে হয়?

নীরা নিঃশব্দে এসে সোবহান সাহেবের পাশে বসলো।
সোবহান সাহেব এক প্রকার চমকেই গেলেন,
—কিরে কখন এলি?
—টাকা এনেছো বাবা?
সোবহান সাহেব শুকনো মুখ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
—তার মানে জায়গা বিক্রি হয়নি?
—জায়গা নেই–ই। কাগজপত্র কিছু ঠিকঠাক মিলছে না। দলিল আছে আমাদের নামে কিন্তু নামজারি নেই। এস এ পরচা, আর এস পরচা এসব কিছু নেই। জায়গার দাগ নম্বর মিলছে না। জায়গা বিক্রি এত সহজ নয় রে নীরা। অনেক ঝামেলা।
নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এরকম খবরই তার সবসময় শুনতে হয়।
—জুস কর্নার কতদূর করলি তোরা?
—আটকে আছে বাবা। মাঝপথে আটকে আছে। টাকা দরকার। না হলে তো সংসারই চলবে না। ভাইয়ার কলেজের কিছু বকেয়া ফিসও বাকি। বেচারা পড়াশোনাটা খুব আগ্রহ নিয়ে শুরু করেছে। এখন টাকার জন্য যদি আবার থেমে যায়, ও মনোবল হারিয়ে ফেলবে।
নীরা উঠে দাঁড়ালো।
সোবহান সাহেব আকুতিভরা গলায় বললেন,
—লাবণী মায়ের জন্য এত ভালো একটা সম্বন্ধ এলো, দেরি করা কি ঠিক হবে? ওরা কিচ্ছু চায় না। তাই বলে বিয়েতে আসা দশটা লোককে অন্তত দুমুঠো ডালভাত তো খাওয়াতে হবে! হাজার হোক আমার বড়ছেলের বউ। আমার কাছে তো সে পরের মেয়ে নয়। একদম অংকুর কালে বিধবা হলো। সখ তো কিছুই পূরণ করতে পারিনি মেয়েটার। কতরাত মেয়েটা একা একা ছাদে বসে কেঁদে কেঁদে রাত পার করেছে, আমি জানিরে মা…
সোবহান সাহেব হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
—দুটো গয়না পর্যন্ত দেবার সামর্থ্য আমার নেই। বেচারী কোনোদিন একটা জিনিসও মুখ ফুটে চায় নি। এখন দ্যাখ আল্লাহপাক হাতে ধরে একটা ভালো ছেলে এনে দিয়েছেন। কোনো জাঁকজমক করে দিতে পারছি না। আমায় তোরা কেন বাবা ডাকিস?
নীরা বাবার হাত ধরলো।
—রনি ভাই ভাইয়ার বদলে ভাবীর জীবনে এসেছে। তিনিই ভাবীর সব শখ পূরণ করবেন, দেখো তুমি।
—তাও তো, মেয়েটা এতটা দিন ধরে সংসারে খাটছে। সুখের সময় বলে কিছু নেই বেচারীর। এখন বিয়েটাও যদি…..
—আমি দেখছি বাবা। আমি চেষ্টা করছি তো! সব ভালো হবে।
নীরা বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ছাদে গিয়ে একটু বসে থাকা দরকার। এত ক্লান্ত কেন লাগছে?

তামিম বসে আছে সেন্ট্রাল হসপিটালের ওয়েটিংরুমে। একটু আগে তাঁর মা মিসেস সেলিনা রহমানকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। কারণ তাঁর প্রেশার হাই। তামিম অনেকক্ষণ ধরেই মায়ের সাথে দেখা করবার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু ডক্টররা বলছেন,
—পেশেন্ট নিজেই বলেছেন, তামিম নামের কাউকে যাতে এলাউ না করা হয়!
তামিম অনেক কষ্টে রিতুকে ম্যানেজ করে মায়ের কাছে পাঠিয়েছে। দেখা যাক, রিতু কিছু করতে পারে নাকি।মা’কে অবশ্য কনভিন্স করা কষ্টকর। তিনি রেগে থাকলে কারও কথাই শুনেন না।
রিতু এসে বিমর্ষ মুখে বললো,
—মায়ের অতটাও সিরিয়াস কিছু হয়নিরে ভাইয়া! শুধু শুধু চেঁচিয়ে নিজের গলা ভাঙছেন। কড়া ঘুমের ঔষধ দেয়া হয়েছে এখন। তুই বরং বাসায় চলে যা। রাগটা কমুক, পরে কথা বলে নিবি।
তামিম কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো। তাঁর আসলেই হাসপাতালে বসে থাকতে বিরক্ত লাগছে।
—ভাইয়া, ভাবী এখন কি করছে? তুই ভাবীকে ফোন করে বল না, মা তোর বিয়ের কথা শুনে চেঁচামেচি করছে।
তামিম খুব অস্পষ্ট গলায় বললো,
—মা বিয়ে নিয়ে এত কেন রিয়েক্ট করছে বলতো? মা তো আমার বিয়ে নিয়ে সেরকম সেনসিটিভ ছিল না।
রিতু জবাব না দিয়ে হাসলো।
—তোর বিয়ে, মায়ের চেঁচামেচি আর ইতুর ফ্যাঁচফ্যাচনি সব মিলে আমার পড়াশুনা সব ঘেটে দিলিরে ভাইয়া। আমার ফার্স্ট পজিশান বুঝি হাতছাড়া হয়ে গেল।
—রিতু ,তুই কি এখন যাবি বাসায়?
—হুঁ। তবে তোর গাড়িতে যাবো না।
—কেন?
—কারণ আছে।
রিতু মুচকি হাসলো।
—ভাইয়া, তোকে পিংক পাঞ্জাবীতে চমৎকার লাগছে। বর বর লাগছে। কে দিলো? ভাবী?
—না, আমার উকিল বাবা।

তামিম বেরিয়ে এলো। মোবাইলে মেসেজ এলার্ট টোন বাজছে। তামিম পকেট থেকে মোবাইল বের করলো।
নাফিসা তামিমকে একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছে। তা হলো,
“মি. তামিম, মুকুলকে আমি দেশের বাইরে এনে চিকিৎসা করাতে চাই। এখানে অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা আমাকে সাহায্য করবেন বলেছেন। আপনি কি ব্যাপারটা একটু দেখবেন? প্লিজজজজ…
গাড়িতে বসে তামিমের মনে হলো, একবার নীরাদের ওখানে গেলে কি হয়? নীরা কি করছে এখন? আজ তাদের বিয়ের রাত। জীবনের সবথেকে বিশেষ সময়! সে কি নীরাকে ফোন করে বলবে, নীরা একটু বারান্দায় এসে দাঁড়াও না। তোমায় দেখতে ইচ্ছে করছে।

নীরাদের বাসার সামনে এসে তামিম গাড়িতেই বসে রইলো। রাত এগারোটা, এত রাতে কি বাসায় যাওয়া উচিত হবে? একটা ফোন করে দেখা যাক।
তামিমকে ফোন করতে হলো না। নীরা বাইরে বেরিয়ে আসছে। কারণ কি? নীরার পরনে সুন্দর গোলাপী রংয়ের শাড়ি। তবে শাড়ির পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। তার উপরে সে সবুজ চাদর মুড়িয়ে নিয়েছে। চুলের বেশীরভাগটাই মুখের একপাশটা ঢেকে রেখেছে।শাড়ির সাথে মিলিয়ে চুড়ি পরলে তো পারতো! তাঁর কি গোলাপী রংয়ের চুড়ি নেই? এতরাতে সে কি কোথাও বেরুচ্ছে?
নীরা সোজা তামিমের গাড়ির কাছাকাছি এসে
গ্লাসে টোকা দিলো। তামিম নিজেকে সামলে নিলো।
তামিম যে এসেছে, এটা নীরা কিভাবে জানলো? নাকি বউ হয়ে গেলেই স্বামীর মনের কথা সব জানা যায়?
—এত দেরি করে আসলেন যে, আমি আধঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছি। কোনো বিবেক নেই আপনার।
তামিম যথাসম্ভব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
—আরো আগে আসার কথা ছিল নাকি?
—শুনুন, একদম ঢং করবেন না। আমি ঢংগী মেয়ে না। শাড়ি পাঠিয়েছেন, পরেছি। তবে এখন আমি আপনার সাথে কোথাও যেতে পারবো না। বাবা বাড়িতে। আপনি বরং বাড়িতে আসুন। ডিমভুনা করেছি, খেয়ে বিদেয় হোন।
তামিম কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো। তারপর শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

নীরার পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে তামিমের একবার মনে হলো, সে নীরাকে টুপ করে একবার জড়িয়ে ধরে; পরক্ষণেই মনে হলো, যদি চিৎকার দেয়? যে মেয়েরে বাবা! নীরার শাড়ির আঁচল মাটিতে গড়াচ্ছে। তামিম আঁচলটা তুলে ধরলো এবং নীরা সাথে সাথেই পেছন ফিরে তাকালো।
—শাড়ি ধরে একদম টানবেন না, খবরদার! সবসময় খালি দুই নম্বরি।
তামিম মুহূর্তেই আঁচল ছেড়ে দিলো।
নীরাদের বাড়ির পরিবেশ সরগরম। সবাই জেগে আছে। ঘটনা কি? নীরা কি সবাইকে বলে দিয়েছে বিয়ের কথা?
নীরার বাবা সোবহান সাহেব হাসিমুখে বসে টিভি দেখছেন। তামিমকে দেখেই গদগদ কণ্ঠে বললেন,
—আসুন তামিম সাহেব, আসুন। আপনার জন্যই এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা। নীরা বললো, আপনি নাকি ব্যস্ত থাকেন খুব।
তামিম পুরো হকচকিয়ে গেল।
—অত চমকাবেন না, শফিকের মুখে আপনার কথা শুনেছি। নীরাদের কত বড় বিপদ থেকে বাঁচালেন।
আসলে বাড়ি বিক্রির ব্যাপরটা নিয়ে আমি তো পুরো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। নীরা ই আপনার কথা বললো।
তামিম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নীরার দিকে তাকালো।
—বাবা, উনি কিন্তু বেশীক্ষণ বসতে পারবেন না। তুমি বরং বাড়ির জায়গাটার যেসব পেপারস আছে নিয়ে আসো, তিনি দেখলেই বুঝবেন। ততক্ষণে আমি খাবার দিয়ে দিচ্ছি।
এতক্ষণে তামিম মানে বুঝলো। নীরা বাড়ির পরিবেশটা অন্যভাবে সাজিয়েছে। তার মানে তামিমের আসার খবরটা নীরা আগে থেকেই জানতো। কিন্তু এই খবরটা নীরাকে কে দিলো? রিতু?

লাবণী তামিমকে দেখেই প্রায় ছুটে এলো।
—আরে তামিম ভাই আপনি যে জমিজমার কাগজপত্র বুঝেন, সেটা আগে বলতে পারতেন তো? বাবা, এই কাগজপত্রের জন্য বাড়িটা বিক্রি করতে পারেননি। এখন দেখেন, টাকার জন্য জুস কর্নার নিয়ে আমরা ফেঁসে গেছি। রনি বেচারা নিজের যা জমানো ছিল, তাও দিয়ে ঢেলে দিয়েছে।
লাবণী বেশ মন খারাপ করা গলায় বললো,
—আপনি একটু দেখেন না ভাই, জায়গাটা যদি বিক্রি ফিক্রি করা যায়!
তামিম হেসে মাথা নাড়লো।
—সেজন্যই এলাম ভাবী। আচ্ছা, আপনার কি একটা নতুন খবর শুনলাম।
লাবণী তামিমের কথায় খুব লজ্জা পেলো।
—উফ্, নীরা আপনায়ও খবরটা দিয়ে দিয়েছে.. অবশ্য আপনি তো ভাই আমাদের পরিবারেরই একজন! তবে এখনও ডেট ফাইনাল কিছু হয়নি। বুঝেনই তো এখনো ছাত্র সে। তেমন পয়সাকড়ি নেই।ছোট করে অনুষ্ঠান হবে। আপনি কিন্তু অবশ্যই আসবেন।
—অবশ্যই, অবশ্যই…
—কি আর বলবো ভাই, এ বাড়ির লোকও তো আমার শ্বশুরবাড়ির লোক। ও বাড়ির লোকও শ্বশুরবাড়ির। আপনি বরং আমার ভাই হয়ে যান।আমার পক্ষের হয়ে বিয়েতে থাকলেন। আসলে নিজের একজন মানুষ থাকা দরকার। রনি বেচারা, শ্বশুরবাড়ির আদর আর পেলো না। বেচারা.. কত দুর্ভাগা!
কথাটা বলেই লাবণী ভীষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচাতে থাকলো।
—রনি সাহেব মোটেও দুর্ভাগা না। আমি আপনার এখন থেকেই ভাই। বিয়েতে আমি কনেপক্ষ। তবে, আমি কিন্তু রনি সাহেবের গেট আটকাবো। টাকা দিয়ে আসতে হবে, অত সহজে তো আর আমার বোনকে ছেড়ে দিতে পারি না।
লাবণী খুবই লাজুক ভাবে হাসলো,
—টাকা আর কি দিবে বলুন তো? সে তো নিজেই গরীব। জানেন তামিম ভাই, সে কি চাপা! আমাকে তো এতদিন বুঝতেই দেয়নি, আমার জন্য যে এখানে আসে।
লাবণী ভীষণ সুখীভাবে রনির গল্প করছে। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে শব্দ করে হাসছে। তামিম মনে মনে বললো, হে করুণাময়, এই মেয়েটার জীবনটা তুমি অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে দাও!

সোবহান সাহেব জমির কাগজপত্রের ফাইলটা তামিমের হাতে দিয়ে বললেন,
—একটু আন্তরিক চেষ্টা করে দেখবেন। সামনেই বাড়িতে একটা বিয়ে, টাকা-পয়সার খুব দরকার। জায়গাটা বিক্রি করতে পারলে বিশেষ উপকার হবে।
—জি জি আমি অবশ্যই দেখবো।
ডাইনিং টেবিলে নীরা খাবার দিয়েছে। সোবহান সাহেব অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বললেন,
—চলুন তামিম সাহেব, আসুন গরীবের সাথে দুই লোকমা খেতে আসুন। আমাদের অবস্থা তো বুঝেনই! শুধু ডালভাত…
টেবিলের খাবারের কাছাকাছি এসে তামিম মোটামোটি চমকে গেল। সবগুলো তাঁর প্রিয় রান্না। ডিমভুনা, শিমভর্তা এবং টমেটো দিয়ে ইলিশ মাছ… ডাল ভাতের কথা বলা হলেও টেবিলে ডাল দেখা গেল না।
তামিম খাবার টেবিলে প্রায় হুমড়ি খেয়ে বসে পড়লো।
খাবার সময় লাবণী অবাকচোখে বললো,
—আরে তামিম ভাই, আমি তো এতক্ষণ খেয়ালই করিনি আপনার পাঞ্জাবী আর নীরার শাড়ি একদম ম্যাচিং হয়ে গেছে। দু-জনেই গোলাপী। কি কান্ড!

তামিমের নাকে ভাত উঠে গিয়ে সে বিষম খেয়ে ফেললো।
নীরা উঠে এসে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো।
তামিম পানি খেলো না। বরং টেবিলের নিচে বাঁ-হাতে নীরার শাড়ি টেনে ধরলো। নীরা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
নড়লেই শাড়ি খুলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এই লোকটা এত দুষ্টু কেন?
সোবহান সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন,
—কমেছে তো আপনার? এরকম বিষম লাগলে নিঃশ্বাস একটু বন্ধ রেখে ছাড়লেই সব ঠিক। এবারে একটু লম্বা শ্বাস নিন।
তামিম হেসে বললো,
—হ্যাঁ হ্যাঁ কমেছে।
এবং সাথে সাথে নীরার শাড়ির কুচিটা আরো শক্ত করে ধরলো।
সোবহান সাহেব বললেন,
—তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন নীরা? খেতে বোস।
তামিমও সুর মেলালো সাথে।
—আসলেই তো মিস নীরা, আপনি গিয়ে বসুন না। আমি ঠিক আছি।
নীরা নির্লিপ্ত গলায় বললো,
—না বাবা, আমি বরং একটু দাঁড়াই উনার পাশে। আবার যদি বিষম লাগে!

তামিম শাড়ির কুচিটা টেনে ধরেই আছে। কুচির অনেকটাই নেমে গেছে তাতে।
নীরা মনে মনে ভীষণ ভয়াবহ দুটো গালি দিলো তামিমকে।

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here