হলিডে #পর্ব_১৯_ও_২০

0
332

#হলিডে
#পর্ব_১৯_ও_২০

#পর্ব_১৯

নীরা গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছে। মানে কি? সে কি তামিমকে কিছু বলতে চায়? আচ্ছা নীরার কি মত পাল্টেছে??ট সে কি তামিমকে আদর করতে চায়?ভাবতে ভাবতে তামিম আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লো।

তামিম গাড়িতে উঠবার আগে একটু থেমে পেছন ফিরে তাকালো। নীরা শাড়ির আঁচল গায়ে ভালো করে মুড়িয়ে নিয়েছে। চাদর নেই সাথে এবার। চুলটা এবার বেণী করা। কখন বাঁধলো? চোখের

ভ্রু

এত টানা লাগছে কেন? প্লাক করেছে? নীরা চুলের বিণুনীটা পেছনে ফেললো। চোখে কাজল না থাকায় চোখগুলো শান্ত আর স্থির দেখাচ্ছে। নীরার গায়ের রংটা গোলাপীর কাছাকাছি বোধহয়। রূপালি বর্ডারের গোলাপী শাড়িতে তাকে দেখাচ্ছে লজ্জাবতী ফুলের মতো স্নিগ্ধ! শুধু সকালের একটু কুয়াশা গায়ে পড়লেই পুরো ব্যাপরটা একদম স্বপ্নময় বাস্তবতা হয়ে দাঁড়াতো।
তবে নীরার দৃষ্টি মাটির দিকে।একটু পরপর সে কেঁপে কেঁপে উঠছে। নীরা কি কাঁদছে? তামিমের একবার মনে হলো, কাছে গিয়ে মুখটা তুলে ধরে জিজ্ঞেস করে, তোমার কি হয়েছে? পরক্ষণেই মনে হলো, থাক্; এত অধিকার কই আমার? অথচ বিয়ে করার আগে কোনো দ্বিধা ছিল না।

নীরাই কথা বলল প্রথম,
—শফিক ভাইয়াকে নিয়ে কি আপনি কোনো এক্সপেরিমেন্ট করছেন? নতুন সম্পর্কে ঠেলে দিচ্ছেন না তো?
নীরার এমন প্রশ্নে তামিম চমকে গেল হঠাৎ!
—দেখুন উনি নতুন করে কোনো মেন্টাল শক আর নিতে পারবে না। আমরা যদি আমাদের এই ভাইটিকেও হারাই তাহলে কিন্তু সব শেষ।
তামিম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ওহ….. ভাইয়ের কথা বলতেই এসেছেন উনি! তামিমের জন্য নয়।
নীরা তামিমের আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো। এবং তামিমকে শতগুণ বিস্মিত করে দিয়ে বললো,
—আপনি আমাকে দেনমোহর কত টাকা দিয়েছেন? —-পাঁচলক্ষ একটাকা।
—-এই টাকাটা তো আমার পাওনা। টাকা দিলেন না যে?
তামিম ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।
—দেনমোহরের টাকা চাই আপনার?
—এটা তো নিয়ম। আইনত, ধর্মত এটা আপনার অবলিগেটরি। দিতে হয়…
—আমার সাথে এখন কোনো ক্যাশ নেই।
—কাল দিয়ে দিন তাহলে। আমি রনি ভাইয়াকে আপনার অফিসে পাঠাবো। হাতে হাতে দিয়ে দিবেন। পুরোটা দিতে পারবেন তো?
তামিম খুব দ্রুত মাথা নাড়লো,
—অবশ্যই পারবো। অবশ্যই দিয়ে দিবো আমি, অবশ্যই….
—শাড়ি, গয়না কিছু দিবেন না? এই ধরেন গলার, কানের?
—জি মানে? জি জি অবশ্যই দিবো।
—একটু তাড়াতাড়ি দিলে ভালো হয় আমার!
—আচ্ছা, আচ্ছা তাড়াতাড়িই দিবো।
নীরা এগিয়ে এসে তামিমের হাত ধরে টেনে একটু ঘুরিয়ে দিলো। পেছন থেকে পাঞ্জাবীটা টেনে দিয়ে বললো,
—কাপড়চোপড় ঠিক করে হাঁটবেন। পুরো পাঞ্জাবী উঠে ছিল। জিন্সের উপর দিয়ে আন্ডারওয়ারের বেল্ট দেখা যাচ্ছিলো। নাকি ওটা আমাকে দেখাতেই বের করে রেখেছেন? ছিঃ… বিয়ে করেছেন বলে আমার মাথা কিনে নেননি যে যা খুশি আমায় দেখিয়ে বেড়াবেন। আমাকে কিচ্ছু দেখাতে হবে না আপনার।
আমি সব জানি।
তামিম মনে মনে একটা বিশাল চিৎকার দিলো। সব জানে, মানে কি? দেখলো কখন?
তামিম তোতলাতে তোতলাতে বললো,
—কিভাবে জানেন?
—হারুন সাহেব যখন এসেছিলেন, তিনিই তো বলে গেলেন।
তামিমের গলা শুকিয়ে আসলো। হারুন সাহেবও জানে! হচ্ছেটা কি? অবশ্য দেখতেও পারে, তামিমের ঘুমোনোর ধাঁচ ভালো না। কতরাত কাজের শেষে সে অফিসেই ঘুমিয়ে নিয়েছে।
তামিম বিড়বিড় করে বললো, আমার খুব ভয় করছে।খুব লজ্জাও করছে।

হারুন মাথায় হাত দিয়ে হা করে বসে আছে।
তামিম আবারো বললো,
—মুখের হা বন্ধ করুন হারুন সাহেব। হা করে থাকলেই তো আর টাকা ফেরত আসবে না। আপনার কথায় বিয়ে করলাম। দেনমোহরের টাকার জন্য অল্পের জন্য বউ বুকে ছুড়ি বসায়নি।
—পুরো টাকাটা না দিয়ে কিছু টাকা হাতে রাখা দরকার ছিল স্যার। একটা ফোন যদি আমায় দিতেন তখন স্যার।
—ফোন আর কি দিবো বলুন? আপনি তো আমার সব কথাই নীরাকে বলে এসেছেন…. কত আশা দিলেন, আদর্শ বউ হবে। এখন যান গয়না কিনুন, শাড়ি কিনুন!
হারুন দিশেহারা ভঙ্গিতে থুতনি চুলকালো। এতো ভাল মানুষটা আজ শুধু তার কারণে ধরা খেয়ে গেল।
—স্যার, ওসি সাহেবদের কিছু জানাবো? জানিয়ে অবিশ্যি লাভ নেই। ডিমান্ড যা করছে, সব তো লিগ্যাল ই। কি সহজ সরল সুন্দর মেয়ে? আর ভেতরে দেখো! স্যার, আমি কি একবার যাবো? গিয়ে জিজ্ঞেস করবো মূল উদ্দেশ্যটা কি?
—দেখুন, আপনার মেয়ে এখন আপনিই দেখুন হারুন সাহেব। আমার টাকা গেছে যাক্। বউ যদি খোয়া যায়, আপনাকে কিন্তু আমি ছাড়বো না।
টাকা নিন, এখন গিয়ে শপিং করুন।

মেয়েটাকে হারুন কত বুঝিয়ে বলে এলো সে, স্যার বড়লোক বাড়ির বড় চাকরি করা ভালো ছেলে। বিয়ে করে আপনার লাভই হলো। আর মেয়েটা? পৃথিবীতে আসলে বিশ্বস্ততার জায়গাই নেই। কোনদিন হয়তো স্যারের বাড়ির দলিলটা চেয়ে বসবে… অহোহোহোহো…..
হারুন আরো চিন্তিত হয়ে পড়লো। তাঁর শরীর ঘামছে। নীরা মেয়েটা এত ঝামেলা করবে জানলে, এই বিয়েতে সে কোনোভাবেই উকিল দিতো না।
তবে এই বিয়ে থেকে তার নিজের কঠিন শিক্ষা হয়েছে। সে নিজের বিয়েতে অল্প পরিমাণে কাবিনের টাকা নির্ধারণ করবে। খুবই অল্প! খোয়া গেলে যাতে একমাসের বেতন যায় কেবল।

জুস কর্নারের জন্য মোটামোটি সব রেডী হয়ে গেছে। আর দুদিন পরই ওপেন করা যাবে। জুস কর্নারটার সামনে দাঁড়িয়ে নীরা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
আচ্ছা, এর নাম কি দেওয়া যায়? পরিচিত কোনো ব্যক্তির নামে হলে ভালো হয়।
ভাবতে ভাবতে নীরার হঠাৎ মনে হলো, “ইতু জুস কর্নার” নামদিলে কেমন হয়? উফ্ মেয়েটাকে একবার দেখে আসা যাক। সেদিনের পর মেয়েটা কেমন আছে কে জানে? যাবার আগে একটা ফোন করার কি দরকার আছে? বড়লোক মানুষ, এপয়েনমেন্ট ছাড়া এরা এলাউ করবে কিনা সন্দেহ!
নীরা ভীষণ হেজিটেশান নিয়ে ফোন ডায়াল করলো।
সেলিনা ফোন ধরেই কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,
—নীরা মা গো আমার তো বিরাট সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমার ছেলে আমার বুকে ছুড়ি মেরে দিয়েছে।নিজের পেটের ছেলে, নিজের বুকেই কোপ দিলো।
—জি মানে… জি আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হ্যালো..
—কি আর বুঝাবো বলো, ছেলেকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। ছেলেটা সব মাটি করে দিয়েছে। এক ফকিরনির জন্য সে তাঁর মাকে ভুলে গেছে। ফকিরনি বেটির প্রেমে সে এখন দিওয়ানা! বলো মা, এমন ছেলে আমার কি দরকার?
—আন্টি আসলে কি হয়েছে বলুন তো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।
—আমি সেন্ট্রাল ক্লিনিকে ৫০৭ নাম্বার বেডে আছি। এসে দেখে যাও মা, কিভাবে মারা যাচ্ছি আমি। মরার আগে বোধহয় তোমার ঋণ শোধ করে যেতে পারলাম না গো মা, ক্ষমা করে দিও আমাকে।
নীরা ফোন রেখে সেন্ট্রাল ক্লিনিকের দিকে রওনা হলো। এই তো সেদিন ভদ্রমহিলা কত সুস্থ ছিলেন, দু-চারদিনে কি এমন হলো যে, বেচারী মরে যাচ্ছেন?

সেন্ট্রাল হোম ক্লিনিকের ৫০৭ নাম্বার রুমে এসে নীরা যা দেখলো, তা হলো সেলিনা আয়েশ করে স্যূপ খেতে খেতে টিভি দেখছেন। টিভিতে হিন্দি মুভি চলছে। অমিতাভ জি ভালোবাসার জন্য মায়ের গলা ধরে কাঁদছেন। তাঁর পাশে আর একজন বয়স্ক মহিলা, তিনিও কাঁদছেন এবং ইতু না ইতুর বোন বুঝা যাচ্ছে না, সে পাশের বেডে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে।সেলিনার বেডের পাশের পুরো টেবিল ভর্তি হয়ে আছে একশো রকম ফলের জুসে। সবুজ জুসটা কোন ফলের জেনে নিতে হবে। দোকানে চলবে ভালো।
নীরাকে সেলিনা নিজের কাছে ডাকলেন, পাশের বয়স্ক মহিলাকে ইশারায় মুভি পজ করতে বললেন এবং তারপর নীরার হাত ধরে বিলাপের সুরে বলতে লাগলেন,
—বুঝলে মেয়ে, এই জীবন সংসার সব মিছে। ছেলের বাবার কাছেও তো কোনোদিন কোনো দাম পেলাম না। ছেলেটাকে নিয়ে ছিল যত স্বপ্ন! সেই ছেলেও বুঝলে, আমায় না জানিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। সে এক ফকিরবিবির প্রেমে মজনু হয়ে গেছে।
নীরা ভদ্রমহিলাকে কিভাবে স্বান্তনা দিবে বুঝতে পারলো না। তার নিজেরও তো হুট করে বিয়ে নামক বস্তুটা হয়ে গেল। তার নিজের দুঃখ বলারই তো জায়গা নেই। সেলিনা শব্দ করে কাঁদছেন। নীরা সেলিনার পিঠে হাত বুলাতে লাগলো। আহারে, বেচারীর ছেলে এত বড় কষ্ট কি করে দিতে পারলো?
—শোনো মা, ইতু বাড়ি আসার পর থেকে মেয়েটার সবসময় মনখারাপ থাকে। আমি ভাবলাম কি, ভাইয়ের বিয়েটা ঘটা করে ঘটিয়ে দিবো, আনন্দ ফুর্তিতে মেয়েটা শকটা কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু চোরের বাচ্চার জন্য আর হলো কই? কত বড় ডাকাত চিন্তা করো বিয়ে করে এসে আমায় আবার বলে, তাঁর বউ তাঁর চোখে সেরা। আমি কি ঠিক করেছি, জানো মা, বদটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বউটাকে বাড়িতে আনবো। তারপর খুনতি গরম করে দু-জনের দু-গালে দুটো দাগ দিয়ে বলবো, এই নাও আমার দোয়া। তোমরা ভালো থাকো। তুমি কি বলো?
নীরা কোনোরকমে বললো,
—জি….জি..
—আমি তো শালীর বেটিরে ঐখানেও দাগ দিবো.. বুঝলেনা….
নীরা প্রসঙ্গ পাল্টালো,
—ইতু কেমন আছে আন্টি?
—ভালোই আছে, তবে একটু চুপচাপ বেশি থাকে।আচ্ছা, তোমার ভাবীর কি খবর? সে বিয়েতে রাজী তো?
—জি জি একদম। ভাবী বাবার সব কথাতেই রাজী।
সেলিনার বিলাপ আবার শুরু হলো,
—দেখো, পরের বাড়ির একটা মেয়ে শ্বশুরের কথায় চোখ বন্ধ করে বিয়ে করছে আর আমার গাধাটা দেখো, ফকিরনির লেজ ধরে ঘুরছে। আমার তো এখন খানিকটা সন্দেহ হচ্ছে, আমার পেটের ছেলেই তো নাকি হাসপাতালে বদলে গেছে?
—আন্টি এই প্যাকেটটা ইতুর জন্য। বলবেন, আমি একদিন ওকে বাসায় দেখতে যাবো।
—বাসায় গিয়ে আর কি-ইবা দেখবে মা? সংসারে তো ছেলে নতুন নাচুনে ঢুকাচ্ছে। দেখবে সে নেচে নেচে বলছে, আমার আল্লাহ নবীজির নাম।
নীরা কি কথা বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। এরকম অবস্থায় কি বলতে হয়?
সেলিনা আবার বলতে লাগলো,
—আচ্ছা, শোনো নীরা মা, তোমায় একটা অনুরোধ করি। যদি আমি মারা যাই, আমার মেয়ে দুটোকে একটু দেখো। বুঝলে.. বলা তো যায় না, ফকিরনিটা দেখা যাবে আমার মেয়ে দুটোর হাতে হয়তো ভিক্ষার থালা ধরিয়ে দিয়েছে… মেয়ে দুটো ফুটপাতে গড়াগড়ি খেয়ে বলছে, আমার….
—আমি অবশ্যই দেখবো আন্টি। আপনি অত টেনশান করবেন না প্লিজ! আজ আমি যাই বরং।
আসবো আরেকদিন।
কাঁথার ভেতর থেকে ইতুর মতো মেয়েটি এবার মাথা বের করে নীরার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
—হাই নীরাপু, তুমি ভালো আছো? তোমায় দেখতে নতুন বউয়ের মতো প্রিটি লাগছে, ওয়াও!
নীরা একটু চমকে গেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
—ওহ্! তাই নাকি? তবে তোমার নাকের নিচের তিলটা বেশি প্রিটি।
ঋতু হাসলো। সেলিনা এক নাগারে শব্দ করে কেঁদে যাচ্ছেন।
নীরা আর সেখানে দাঁড়ালো না। ভদ্রমহিলার কথাবার্তায় কোনো ব্যালেন্স নেই। কি বলতে আবার কি বলে দেন!

মানুষের জীবন কি অদ্ভূদ! এত টাকাপয়সাওয়ালা মানুষ অথচ ছেলে বউ নিয়ে মা’কে ভুলে গেল। নীরা বিড়বিড় করে বললো, আল্লাহ আমার শত্রুর মায়েরও যেন এমন কষ্ট না হয়।

#পর্ব_২০

হারুন নিশ্চিত হবার জন্য আবারও জিজ্ঞেস করলো,
—আমি গিয়ে দিয়ে আসবো স্যার?
—অবশ্যই আপনি যাবেন, রাক্ষসী মেয়ে আপনার! আমি নিয়ে গেলে দেখা যাবে বলছে, এই গয়নায় হচ্ছে না আমার। গয়নার দোকান চাই।
হারুনের এই মুহূর্ত মরে যেতে ইচ্ছে করছে। জীবনে কোনো বিয়েতে সে আর উকিল হবে না। উকিল কেন; জীবনে কোনো বিয়ের আলাপেও সে যাবে না।
হারুন খুবই অসহায়ভঙ্গিতে শপিং ব্যাগগুলো হাতে নিলো। উফ্, পা এত কাঁপছে কেন? হারুন বেরিয়ে যেতেই তামিম ঘড়ি দেখলো। রাত নটা। নীরা নিশ্চয়ই এখন বাড়িতে আছে।

আগামী ৬তারিখে সৌদিআরবের একটা টিম আসছে বাংলাদেশে। সিকিউরিটি প্লানটা নিয়ে বসতে হবে।
অনেক কাজ…. বিয়ে বিয়ে করে কাজ অনেক জমে গেছে।

তামিমের ঘুম ভাঙলো রাত তিনটেয়। ফোনের রিংয়ে। এত রাতে কে ফোন করেছে? নীরা? বেচারি হয়তো গয়না পেয়ে ধন্যবাদ দিতে ফোন করেছে।
তামিম চোখ বন্ধ রেখেই ফোন রিসিভ করলো,
—হ্যালো……
—মি. তামিম আপনি কি ভালো আছেন?
তামিম তড়াক করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ফোন করেছে নাফিসা!
—জি ম্যাম, জি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
—আমি খুবই ভালো আছি মি. তামিম।
—জি জি ম্যাম।
—এতো জি জি করছেন কেন? আপনি কি ঘুমিয়ে ছিলেন?
—জি ম্যাম, হ্যাঁ মানে…
—ওহ্ এখন তো রাত বাংলাদেশে, ফোন করাটা ঠিক হয়নি বোধহয়!
—জি না ম্যাম, আপনি বলুন। আমি ঠিক আছি।
তামিম গ্লাস থেকে একটু পানি খেয়ে নিলো।
—মি. তামিম আপনি হয়তো খেয়াল করেননি, আমি আপনাকে বলেছি আমি খুবই ভালো আছি। এখন জিজ্ঞেস করুন, কেন “খুবই” ভালো আছি।
তামিম কিছু জিজ্ঞেস না করে চুপ করে থাকলো।
—মি. তামিম আমি একটি চমৎকার সময় পার করছি। মি. শফিক একজন অসাধারণ মানুষ। খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ! তিনি আমাকে তাঁর ভাবীর বিয়েতে আসবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
—কিন্তু উনার ভাবীর বিয়ে তো এখনো ফাইনাল হয়নি ম্যাম।
—-সেজন্যই তো… একটা ইন্টারেস্টিং লজিক শুনুন, পরিবারের যে ব্যাপারগুলো আমরা করবো বলে প্ল্যান করি, তা সাধারণত আমরা আগে থেকেই খুব কাছের কেউ ছাড়া শেয়ার করি না। একদম ঠিক হয়ে যাবার পর আমরা সবাইকে জানাই। কিন্তু যারা আমাদের খুব কাছের, তাদের কিন্তু আগে থেকেই বলি, হোক না হোক.. বলি কিন্তু!

তামিম একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, কই নীরা তো লাবণী ভাবীর বিয়ের কথা তামিমকে একবারও বলেনি। তার মানে কি নীরা তাকে একটুও আপন ভাবে না?
—হ্যলো, শুনছেন তো? আমি ঠিক করেছি বিয়েতে আসবো, তবে তাঁর সাথে আরেকটি খবর আছে, আমাদের ইউনিভার্সিটিতে স্টুডেন্টদের ভালো কিছু ওয়ার্কশপ নিয়ে একটা ফেস্টিভাল হতে যাচ্ছে।ইয়ারলি ফেয়ার। সেখানে ডিজাইনের উপর করা আমার বেশ কিছু কাজ সিলেক্ট হয়েছে। ইউনিভার্সিটি এবছর আমাকে ডিজাইন কুইন এওয়ার্ডটা দিচ্ছে।
—বাহ্।দারুন খবর! অভিনন্দন ম্যাম।
—মি. তামিম আমি চাচ্ছি, শফিক সাহেব এসে এই ফেস্টিভালটা ঘুরে যাক। কিন্তু এব্রোডে যে উনি আসবেন; বেচারার পাসপোর্ট পর্যন্ত নেই। আপনি কি কাইন্ডলি উনার ব্যাপারগুলো একটু দেখবেন?
তামিম দু-সেকেন্ড চুপ করে থাকলো,
—ম্যাম, আমি অবশ্যই উনার পাসপোর্টের ব্যাপরটা দেখছি। কিন্তু আমার একটা ছোট্ট রিকোয়েস্ট আছে…
তামিম কথা শেষ করতে পারলো না।
নাফিসা হেসে বললো,
—আপনার রিকোয়েস্টটা কি আমি তা জানি, মি. তামিম। আপনি বলতে চাচ্ছেন, মি. শফিককে নতুন করে এমন কিছুই ভাবানো যাবে না, যা তাঁর জীবনে পাস্ট ইন্সিডেন্ট টার রিপিটেশন ঘটায়। কি ঠিক বললাম তো?
ফোনের এ পাশে তামিম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো,
—আমি জানি আমি একদম ঠিক বলেছি। আপনাকে বলেছিলাম না, আমি আগে থেকেই অনেক কিছু বলে দিতে পারি।
নাফিসা শব্দ করে হাসতে লাগলো।
—আপনি একদম চিন্তা করবেন না তামিম সাহেব, আমি এমন কিছুই তাকে ভাবাবো না। আই হ্যাভ এ বিউটিফুল ফিলিং ফর হিম। হি ইজ রিয়েলি এ ভেরি নাইস গাই। আই হার্ডলি মিন ইট।
—আমি সব এরেঞ্জ করছি ম্যাম। কবে নাগাদ যাওয়া হতে পারে?
—আপনি বোধহয় এখনো আমাকে ভরসা করতে পারছেন না। আমি কিন্তু খুব কম মিথ্যা কথা বলি. মি. তামিম।
—সেরকম কিছুই কিন্তু নয় ম্যাম। উনার জীবনে এত চরম পর্যায়ের দুর্ভোগ গেছে যে, সেই ভয় থেকে আমি বলছিলাম। তারপরও স্যরি ম্যাম।
—একদম স্যরি হবেন না। এটা আপনার ভালোমানুষি বরং। আচ্ছা, তাহলে রাখছি । এন্ড বাই দ্য ওয়ে থ্যাংকস। আই থিংক, নাউ আই হ্যাভ এ অপশন টু লাভ ম্যাডলি। তাহলে দেখা হচ্ছে বিয়েতে! ভালো থাকুন।
—আপনিও ভালো থাকুন ম্যাম।
তামিম ফোন রেখে গ্লাসের বাকি পানিটা ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। একি? সে এতক্ষণ অফিসেই ঘুমিয়ে ছিল নাকি? কাজ করতে করতে টেবিলেই ঘুম। এই অভ্যাসটা বুঝি আর গেল না।
আচ্ছা, হারুন তো কোনো ফোন দিলো না। সে কি নীরাকে পেয়েছে? নীরা কি আরো শাড়ি চায়?
তামিম আবার টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়লো।

আরিফুর রহমান সাহেব নিজের পুরো ডিরেকশান লাইফে এমন কাউকে পাননি! এত এত স্টার কাজ করেছে তাঁর ডিরেকশানে। এই মেয়েটা জীবনের প্রথম শট দিলো আজকে। একটা টেকে ওকে। ভাবা যায়? প্রতিটা সিনে এর ম্যাক্সিমাম তিনটা টেক, এর বেশি নয়। তবে টেক দেওয়ার আগে সে টাইম নিয়ে রিহার্সাল করছে। জীবনে প্রথম টিভিসি অথচ মেয়েটার কাজের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, এই লাইনে তাঁর একযুগ কেটে গেছে। তিনটা টিভিসি’র জন্য তিনি দু-সপ্তাহ ভেবেছিলেন। মেয়েটা যেরকম ট্যালেন্ট, তাতে মনে হচ্ছে দুদিনেই কাজ কমপ্লিট হয়ে যাবে। আরিফ সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, এই মেয়ে অনেক দূর যাবে। শুধু ঠিকঠাক ট্রাকে একে ডিরেক্ট করে নিয়ে যেতে হবে।
নীরা আবার দরজায় দাঁড়িয়ে বললো,
—আই এম রেডী স্যর।
আরিফ সাহেব হেসে বললেন,
—তুমি তো দেখছি ডিরেক্টরের আগে রেডী। ভেরী গুড! লেটস গো…

নীরার বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে গেল। লাবণী এখনো জেগে আছে।
—তুমি ঘুমোওনি ভাবী?
—নীরা কি কান্ড হয়েছে দেখো। তামিম সাহেব এতগুলো গয়না আর শাড়ি পাঠিয়েছেন। সবগুলো তো পিওর গোল্ডই মনে হচ্ছে। এই দেখো নীরা।
নীরা জুতোর বেল্ট খুলতে খুলতে বললো,
—ওহ্।
—তুমি শুধু ওহ বলছো? এতটাকার গয়নাগাটি তিনি তোমাকে পাঠালেন, মানে কি?
—ধুত ভাবী, আমাকে কেন পাঠাবে? তুমি ভাই বানিয়েছো, হয়তো বোনের বিয়ে বলে এসব পাঠিয়েছে।
—কিন্তু হারুন সাহেব যে বললো, তোমাকে দিতে! বারবার করে বললো।
—ভুল করে বলেছে। তোমার বিয়ে, শাড়ি গয়না দরকার কার? তোমার, তাহলে? আর তাছাড়া বাবা যে টাকা খরচা করে এসব দিতে পারবে না তোমায়, তিনি হয়তো বুঝেছেন। বড়লোক মানুষ ভাবী, সেঁধে যখন দিয়েছে, নিয়ে নাও।
লাবণী নীরার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। এত সুখ, এত আনন্দ তাঁর জীবনে কেমন হুড়মুড় করে আসছে। এত ভালো সময়, এত ভালো জিনিস!
ইশ্.. নীরাটার যদি একটা ভালো ঘরে সম্বন্ধ হতো! কত খাটাখাটনিই না করছে মেয়েটা।
—এই নীরা, তুমি কিছু নাও না। এত কিছু তো আমার লাগবেই না। এই নাও এই দুটো শাড়ি তোমার, এই সেটটা তোমার, আর এই চুড়িগুলো…
—-তুমি দেখি সব আমাকে দিয়ে দিচ্ছো? রাখো, এখানে রাখো।
নীরা একটা শাড়ি তুলে নিয়ে বললো,
—ব্যস আমার চলবে। ভাবী চট করে একটু ভাত বাড়ো তো… খিদে পেয়েছে!
নীরা গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে কলতলার দিকে রওনা হলো। আজ লম্বা সময় নিয়ে সে গোসল করবে। মডেলিং জগতে আজ থেকে তার কাজের শুরু.. সেলিব্রেশন দরকার।
গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে নীরার হঠাৎ মনে হলো, তামিম তাকে দেখছে। এই যে পেছন থেকে চোখ বড়বড় তাকিয়ে আছে, এক্ষুণি হয়তো এসে পিঠে একটা চুমু খেয়ে নেবে। নীরা তাৎক্ষণিক গোসল থেকে উঠে দাঁড়ালো। উফ্! এই লোকটা চিন্তা ভাবনায় সবসময় জ্বালাচ্ছে।

লাবণীর বিয়ের ডেট ঠিক হয়েছে। সেলিনা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এসেছেন। হোক না রনি তাঁর পাতানো ভাইপুত্র। তাও তো… বিয়েতে তো একটা দায়িত্ব আছে নাকি? হাসপাতালে বসে বসে তো আর কাজ হচ্ছে না। তিনি ঠিক করেছেন, ছেলেটাকে এই বাড়িতে এনে রাখবেন। বিয়ের বর; মেস থেকে তো আর বরযাত্রী যেতে পারে না। ইতু ঋতুও একটা সঙ্গ পেলো। আপন ভাইয়ের বিয়ে তো আর খেতে পারলো না। পাতানো ভাইয়ের বিয়েতেই মজা করুক। তাছাড়া ইতুর বাবার স্ট্রিক্ট অর্ডার আছে, কেনোকিছুতে যাতে ত্রুটি না হয়। কমতি নাহয়।

সেলিনা বিয়েটা নিয়ে ছেলেকে শিক্ষা দেবার একটা সূক্ষ্ম প্ল্যান করেছেন। প্ল্যানে ধাপ দুটো, প্রথম ধাপে বিয়েতে একটা গ্রান্ড করে অকেশান হবে, তামিমের দেখে যাতে বুক ফাটে… হায়রে মাকে রাজি করিয়ে বিয়ে করলে তো এমন অনুষ্ঠান আমারও হতো!
দ্বিতীয়ত, তামিমকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বউটাকে বিয়েতে দাওয়াত করে আনবেন। তারপর এক ফাঁকে গরম খুনতি দিয়ে গালে একটা দাগ দেবেন। ছোট্ট করে একটা দাগ। শত হোক ছেলের বউ, বেশি দাগে গাল যদি খারাপ হয়ে যায় আবার!
উফ্! ভাবতেই কি ভালো লাগছে…. সেলিনার ঠোটে চিকন একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে ড্রাইভারকে ডাকলেন। নীরার জুস কর্নারের ওপেনিং আজকে। যেতে হবে সেখানে।

জুস কর্নারের ওপেনিং এ এসে সেলিনার বিস্ময়ে চোখে পানি এসে গেল। দোকানের নাম, ইতু জুস কর্নার! তাঁর নিজের মেয়ের নামে। ইশ্ এরা কত ভালো মানুষ!
সোবহান সাহেব তাঁর দিকে আন্তরিকভাবে কাছে এগিয়ে এলেন,
—আপা, আপনার মেয়ের নাম দিয়েছি বলে অপরাধ নেবেন না। আমার নীরা মা শখ করে নামটা রেখেছে।
সেলিনা চোখের পানি আলগোছে মুছে নিলেন।
—না না কি যে বলেন না.. এটা তো আনন্দের। নীরাও এগিয়ে এসেছে।
তাঁর পরনে গাঢ় নীল জামদানী। কি যে সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে!
সেলিনা মনে মনে বললেন, মাশাআল্লাহ!
—আন্টি আসুন, ফিতে কাটবেন। ইতু নামের ফিতে তো, আপনাকেই দিয়েই হোক শুরু।
—রনি কই মা? ওকেও ডাকো। আমার নিজের ছেলেতো আর আমার ছেলে নাই, রনিকে নিয়েই ফিতেটা কাটি। দিওয়ানা মজনু তো এখন রাস্তার মোড়ে বউয়ের থালা ধরে আছেন…. হুহ…

নীরা আরেকটু কাছে এসে সেলিনার বাঁ-হাত আলতো করে ধরলো,
—ছেলের কথা বাদ দিন আন্টি। ওসব মনে করলেই মন খারাপ। চলুন, রনি ভাই আছেন তো। আসুন ভেতরে আসুন আগে।
নীরা মিষ্টি করে হাসলো।

আহা্, নীরার মতো একটা মেয়েকে যদি তাঁর ছেলের বউ করতে পারতেন!

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here