#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_৬_৭_৮
#পর্ব_৬
রিমির ঘুম ভাঙলো রাত প্রায় ৩টার দিকে। ঘুম ভাঙার পর সে যে দৃশ্যটা দেখলো তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তাকে একজন জাপটে ধরে ঘুমুচ্ছে। লোকটার ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে রিমির গালে মুখে। ভয়ে রিমির আত্তা শুকিয়ে গেল, চিৎকার বেরুচ্ছে না গলা দিয়ে। মৃদু আলোতে সে লোকটাকে ঠিক দেখতেও পাচ্ছে না। এটা কোথাকার ঘর? সে কোথায় আছে এখন? রিমি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে লোকটাকে ঠেলে ধরে গলার স্বর কোনোরকম টেনে বললো,
-আপনি কে? কে আপনি?
শোয়েব ধরফর করে উঠলো। দ্রুত উঠে গিয়ে লাইট জ্বালালো। আর রিমি তখনি মানুষটার পুরো মুখটা দেখতে পেলো। ইয়েস! মনে পড়েছে, এই ছেলেটাকে তো রিমি ক্ষণিকের বিশ্রামাগারে দেখেছিলো। রংচং মাখা।
আচমকা ঘুম ভাঙায় শোয়েবের চোখ জ্বলছে। নিজের দিকে তাকিয়ে শোয়েব আরও হতভম্ব হয়ে গেল, ইন্নালিল্লাহ! সে আছে খালি গায়ে। শার্ট কখন খুললো সে? শোয়েব মনে মনে দোয়া পড়তে আরম্ভ করলো। আর কিছু কি করেছে সে? শার্ট কোথায়? শোয়েব বেডের পাশে ফ্লোর থেকে দ্রুত শার্টটা তুলে নিয়ে পড়তে পড়তে বললো,
-আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছিনা আপু। আমার দ্বারা একটার পর একটা ভুল হচ্ছে কেন আজকে? লা ইলাহা ইল্লা……
রিমি নিজেকে সামলে উঠে বসলো। শোয়েব কাকুতি মিনতির সুরে আবারও দু-হাত জোড় করে বলতে শুরু করলো,
-বিশ্বাস করুন আপু, আমি এই টুলে বসে ঘুমিয়েছিলাম।বিছানায় কিভাবে চলে গেলাম তাই তো বুঝতে পারছি না।আপনি হয়তো আমায় খুব খারাপ ভাবছেন, আসলে আমার মেজাজ আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা বলেই আজ এ অবস্থা… বিশ্বাস করুন, আমি বখাটে গুন্ডা নই… আমি একজন আর্কিটেক্ট। আমার নাম শোয়েব, আমার বাবা একজন নামকরা….
তাড়াহুড়ো করে বোতাম লাগাতে গিয়ে শোয়েব এলোমেলো বোতাম আটকালো শার্টের!
রিমির লজ্জা ও অস্বস্তি লাগছে। ভীষণ লজ্জা! ছেলেটা তাকে পুরো গভীর করে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলো। ছেলেটার নাক মুখটা রিমির গলার কাছে ছিল, অর্ধেক উপর হয়ে লেপ্টে শোয়া। এর মাঝে একটা হাত ছিল…… ছিঃ…
রিমি নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। খুব নিচু আওয়াজে বললো,
-আমার বাড়ি যেতে হবে। মা হয়তো ভীষণ চিন্তা করছেন । স্যালাইনটা খুলে দিতে বলুন প্লিজ..
-বলছি, বলছি
বলে শোয়েব ব্যস্তভাবে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল।
হসপিটালের ঝক্কি ঝামেলা সেড়ে, ভোর পাঁচটা নাগাদ শোয়েব রিমিকে নিয়ে তার বাড়ি পৌঁছালো। রিমির মা বারান্দায় বসেছিলেন। রিমি, শোয়েবকে কিছুই না বলে চুপচাপ সোজা ঘরের ভিতরে চলে গেল। শোয়েব অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। নাসিমা বিব্রতভাবে বললেন,
-আপনি আসুন, ভিতরে আসুন। রিমি রাতে ফেরেনি বলে… আমি চিন্তায়।
শোয়েব নাসিমার পেছন পেছন ঘরে এলো। যে ঘরে সে বসেছে সে ঘরে আসবাবপত্র বলতে, একটা বিছানা, একটা ছোট্ট চারপায়া টেবিল এবং দুটি চেয়ার। বিছানার স্ট্যান্ডে কাপড়চোপড় অজস্র। সমস্ত জিনিসগুলোই জীর্ণও পুরোনো কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার সবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। শোয়েবকে বসিয়ে নাসিমা ভেতরে চলে গেলেন। তাঁর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। রিমি এত সুন্দর একটা ছেলের সাথে গাড়ি করে! মানে কি? কোথায় ছিল? ছেলেটা কি রিমির পূর্বপরিচিত?
রিমি কলতলায় গোসল করছিলো। নাসিমা পাশে গিয়ে বললেন,
-ছেলেটাকে কি দিই বলতো? ঘরে তো কিছুই নেই..
রিমি জবাব দিলো না। চুপচাপ গা ঘষছে সে….
নাসিমা আবারও বললেন,
-বসে আছে তো, নাস্তাপানি কিছু দেওয়া তো দরকার নাকিরে?
রিমি গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে বললো,
-বসিয়েছো কেন মা? বসবার তো কোনো দরকারই নেই। চলে যেতে বলো।
নাসিমা কলতলা থেকে ঘরে চলে এলেন। মুড়ি দেয়া যায়, সাথে পানি। নাসিমা শোয়েবের সামনে মুড়ির বাটিটা রাখতে রাখতে বললেন,
-আসলে রিমি তো কখনো এরকমভাবে রাতে বাইরে থাকেনি…. আমার ঘুম হয়নি, ভাবলাম বিপদ বুঝি হলো মেয়েটার…
শোয়েব কি বলবে বুঝতে পারছেনা। বললেই বা বিশ্বাস করবে কি? তাও বাটি থেকে এক মুঠো মুড়ি নিয়ে মুখে পুড়তে পুড়তে শোয়েব বললো,
-আসলে একটা ব্লান্ডার হয়ে গেছে বড়! রিমি আপুকে আমি গতকাল সন্ধ্যায় বৃষ্টির সময়ে….
শোয়েবের কথার মাঝখানেই রিমি ঘরে এলো। গামছায় চুল মুড়ানো! গা ভালো করে মোছা হয়নি, সবুজ জামার বিভিন্ন অংশ ভেজা, গাঢ় সবুজ ছোপ ছোপ হয়ে আছে। মুখের মধ্যে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। চোখের ব্রু এবার সমান গুছানো। ঘন পাপড়ির জন্য চোখ দুটোকে আরো গভীর দেখাচ্ছে। কোনো গয়না নেই, ওড়নার লেইসটার জন্য মুখের কাছটা গয়নাময় হয়ে উঠেছে। থুতনির গর্তটা আরো নরম সুন্দর দেখাচ্ছে।
আচ্ছা লক্ষী প্রতিমা দেখতে কেমন? এরকম?
-একি? আপনি এখনো যাননি? ছটা বেজে যাচ্ছে তো! মা উনাকে কেন বসিয়ে রেখেছো বলোতো?
শোয়েব থতমত খেয়ে বললো,
-হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি তো…….
শোয়েব একরাশ মনখারাপ নিয়ে বেড়িয়ে এলো। আর বেড়িয়ে আসবার পরই মনে হলো, রিমির চুলে বাঁধার গামছাটা একটু ফুঁটো ছিল।
#পর্ব_৭
রেহেনার কিছুই ভালো লাগছে না। শোয়েবের জ্বরের বাহানায় পৃথিলা মেয়েটা দুপুর থেকেই বসে আছে।এই সুযোগে মেয়েটা যদি শোয়েবের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ফেলে, এই চিন্তায় রেহেনা এই বাহানায় সেই বাহানায় শোয়েবের কাছাকাছিই থাকছেন। রান্নাবান্না কিছুই করা হয়নি, রিমি মেয়েটাও আজ পড়াতে আসছে না। ব্যাপার কি? সব ঝামেলা একসাথে! উফ্!
রেহেনা আবার শোয়েবের ঘরে এলেন। পৃথিলা বিছানায় শোয়েবের ধার ঘেঁষে বসে বই পড়ছে। রেহেনার গা জ্বলে উঠলো, বুইরা জোয়ান মেয়ে ছেলের সাথে ঘষাঘষি।
রেহেনা শোয়েবের কপালে হাত দিয়ে আঁৎকে উঠলেন। ধুম জ্বর! আদুরে গলায় ছেলেকে ডাকলেন,
-একটু উঠে বস না বাবা। গা স্পঞ্জ করে দিই একটু।
শোয়েব বাধ্য ছেলের মত উঠে বসলো। রেহেনা চোখের ইশারায় পৃথিলাকে যেতে বললেন,
পৃথিলা হেসে বললো,
-থাকি না আন্টি, কি সমস্যা? এই শোয়েব, আমার সামনে খালি গায়ে হতে লজ্জা করবে তোমার?
শোয়েব মাথা নাড়লো। পৃথিলা বিছানায় সড়ে বসলো।
রেহেনা যথাসম্ভব পৃথিলার চোখ আড়াল করে ছেলের গা মুছাতে থাকলেন। শোয়েব অস্পষ্ট করে বললো,
-মা, আস্তে দাও। লাগছে তো…
পৃথিলা এগিয়ে এসে বললো,
-আমি করে দিই আন্টি?
রেহেনা হাতের ভেজা তোয়ালেটা আরো টাইট করে আঁকড়ে ধরে বললেন,
-আমি করছি তো। তুমি বসো গিয়ে!
পৃথিলা মিষ্টি করে হেসে মাথা নাড়লো। গা মুছিয়ে শোয়েবকে শুইয়ে দিয়ে রেহেনা বেড়িয়ে এলেন।
পৃথিলা শোয়েবের সিথানের কাছে আবার বসলো।
-তোমার বুকে এত সুন্দর তিল আছে। ইশ্ আমার তো দেখেই নাক ঘষতে ইচ্ছে করছিলো। পিঠেও তো অনেক তিল। জ্বর কমুক, একদিন সব তিল গুণে দিবো।
শোয়েব কাঁথার ভিতর মাথা ঢুকিয়ে বললো,
-পৃথি তুমি বাতিটা নিভিয়ে বরং ভাবীর ঘরে গিয়ে বসো, আমি ঘুমোবো এখন।
-কেন? আমি থাকলেই বা কি? আমি তো ডিস্টার্ব দিচ্ছি না।
-তোমার নিঃশ্বাস নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড আমার ঘরের বায়ু দূষিত করছে, এটাই তো যথেষ্ট ডিস্টার্ব।
পৃথিলা কষ্ট পাওয়া অসহায় চোখে তাকালো। বাতিটা নিভিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস করে বললো,
-বিয়েটা হয়ে যাক বাবুসোনা, তারপর দেখবে এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড তোমার অক্সিজেন হয়ে দাঁড়িয়েছে…..
পৃথিলা শোয়েবের ঘর থেকে বেড়িয়ে সোজা নিচের ড্রয়িংরুমে এসে বসলো। শোয়েবের ঘরে যে তার বসা হয়নি, জানুক সবাই। আব্দুস সালাম সাহেব বসে চা খাচ্ছিলেন, পৃথিলাকে দেখেই হেসে বললেন,
-হেই বিউটিফুল কুইন! তোমার কিংয়ের কি অবস্থা? একটু জ্বরেই কুপোকাত!
পৃথিলা সোফায় পা তুলে বসলো। মলিন মুখ করে জবাব দিলো,
-জ্বর না অন্য রোগ! সারাক্ষণ শুধু কাঁথায় মুখ লুকিয়ে থাকা। বিয়ের পর এরকম করলে আমি কিন্তু তোমার ছেলেকে কঠিন মার মারবো। শক্ত মার……
আব্দুস সালাম লাকি বুয়াকে ডাকলেন,
-পৃথিমামণিকে একগ্লাস লাচ্ছি দাও। মাথা গরম হয়ে আছে। আমি শোয়েবকে বকে আসি যাই….
পৃথিলা শব্দ করে হেসে বললো,
-তুমি কিভাবে আমার মনের কথা সবসময় বুঝে ফেলো আংকেল, বলোতো?
আব্দুস সালাম সাহেব জবাব দিলেন না, হেসে উপরে চলে গেলেন। পৃথিলা আয়েশীভঙ্গিতে কাত হয়ে সোফায় শুয়ে পড়লো… আজ রাতে সে বাসায় যাবেনা… শোয়েবকে অসুস্থ রেখে সে কোথাও গিয়ে শান্তি পাবে না…..
#পর্ব_৮
ক্ষণিকের বিশ্রামাগারে রিমি পড়াতে এলো গুণে গুণে ঠিক তিন সপ্তাহ পর। রেহেনা ম্যাডাম ফোন করে করে কান ঝালাপালা করে ফেলেছেন। শেষ অবধি বললেন, না আসলে বাড়ি চলে আসবেন। বাধ্য হয়ে রিমির আসতে হলো তাই। তবে এতদিন যে রিমি আসেনি তা কোনো কারণ ছাড়াই। আসতে ইচ্ছে করেনি। এবাড়ির শোয়েব ছেলেটার সাথে তাঁর সেদিন এরকম বিচ্ছিরি একটা ঘটনা হলো, সেটার জন্য একটু ভয় ছিল অবশ্য মনে, শোয়েব কি বাড়িতে এসে বলেছে সবাইকে!?
রেহেনা ম্যাডামের ফোনে বুঝা গেল বলেনি এতদিনেও। তাহলে নিশ্চয় আর বলবেও না!
রিমি আজ আসলো প্রায় লুকিয়ে! শোয়েব ছেলেটা বাড়িতে নেই তো? সে খুব সাবধানে এসে রিংকু ঝিংকুর ঘরে ঢুকে পড়লো। রিংকু ঝিংকু ভালো জামাকাপড় পরে রেডী হচ্ছে। রিমি বসতে বসতে বললো,
-কোথাও যাবে নাকি তোমরা?
রিংকু ঝিংকু জবাব দিলোনা। ইশারায় হোয়াইট বোর্ডে ডিরেক্ট করলো। সেখানে বড়বড় করে লিখা,
“ও রিমি ওরিমি
আসোনা কেন তুমি?
রাগ করেছি আমরা,
তুমি একটা ভোমরা!”
রিমি হেসে ফেললো। দুহাতে কান ধরে বললো,
-আর এমন হবেনা। সরি… এই যে জিভ কাটলাম।
রিমির কানধরা থাকতেই ঘরে এলো হলুদ শাড়ি পরা অপূর্ব সুন্দরী একটা মেয়ে। মেয়েটার ছোট ছোট কাঁধ পর্যন্ত ব্রাউন ডাই করা চুল। কি ফর্সা! চোখে গাঢ় কাজল, ঠোটে চমৎকার ব্রাইট রেড লিপস্টিক, কপালে হলুদ টিপ। হলুদ শাড়ির সাথে ব্লাউজ পরেছে সবুজ। ইশ্ কি মিষ্টি লাগছে দেখতে! হাতের চুড়িগুলো নিশ্চয় হীরের। পায়ে দামী হাই হিল। অত উঁচু জুতু পরে শুধু ফিল্মের হিরোইনরা হাঁটতে পারে, এই মেয়ে কিভাবে হাঁটে? শাড়িটার পাড় পেছন দিকে ভাঁজ হয়ে উঠে আছে। রিমির তাৎক্ষণিক ইচ্ছে করলো মেয়েটার শাড়ি ঠিক করে দেয়! কিন্তু দেয়া গেল না, এর আগেই চমৎকার মিষ্টি কণ্ঠে মেয়েটা বললো,
-হেই মিস, আমি পৃথিলা। রিংকু ঝিংকুর হবু ছোটমা! ভালো আছেন?
রিংকু ঝিংকু একসাথে বললো,
-রিমি মিস, ইনি আমাদের ছোটচাচার বৌ হবেন।
রিমি তখনো হা করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। ইশ্ মেয়েটার গা থেকে কি সুন্দর ফুলেরগন্ধ। আহারে! নিশ্চয় অনেক দামী পারফিউম!
পৃথিলা আবার বললো,
-হেই মিস ভালো আছেন আপনি?
এবার রিমির হুঁশ হলো; সানন্দে হাত বাড়িয়ে বললো,
-আমি রিমি! রিমি সুলতানা।
পৃথিলা রিমির হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে বললো,
-জানি আমি, এরা বলে খুব আপনার কথা। আপনি আসেননি কেন এতোদিন? আপনার ছাত্ররা তো অনশনে যাবেই ভেবে ফেলছিলো।
নিজের গায়ের ওড়নাটা গুছিয়ে নিতে নিতে রিমি আড়ষ্টভাবে বললো,
-এই তো একটু ব্যস্ত ছিলাম…..
-ম্যাডাম, আজ তো আপনার স্টুডেন্টদের ছুটি লাগবে! আমরা বাইরে যাচ্ছি সবাই। বেড়িয়ে টেড়িয়ে একদম ডিনার করে….
রিমি হেসে বললো,
-ছুটি মঞ্জুর করা হলো।
পৃথিলা একহাত সামনে এনে মজা করার মত করে বললো,
-আপনার যথেষ্ট দয়া গুরুমা!
রিমি সশব্দে হেসে উঠলো।
রিমি রিংকুর শার্টের কলার ভাঙতে ভাঙতে বললো,
-আপনারা সবাই যাচ্ছেন নাকি?
রিমির কথার মাঝখানেই লীনা দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে বললো,
-পৃথি! হলো তোদের?
তারপর রিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
-ম্যাডাম, আপনিও চলুন না আমাদের সাথে। একটু শপিংমল ঘুরে আসবেন, আজ তো এমনিতেই আপনার পড়ানো নেই, ফ্রি তো নিশ্চয়?
রিমির হিজিবিজি লেগে গেল। বাইরে বেড়াতে যাওয়া? শপিং? তাও এদের সাথে? কিন্তু মন তো চাইছেও। বড়লোকদের সাথে ঘুরবার মজাও নিশ্চয় বিশাল।
-আপনি সাথে আসলে, রিংকু ঝিংকুর ভালো লাগবে।তাছাড়া….এতদিন পরে এলেন, একটা সেলিব্রেশন…..
রিমি আগ্রহের সাথে লীনার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আমার এই ড্রেসে হবে, ম্যাডাম?
পৃথিলা হেসে বললো,
-ড্রেস ইজ নো মেটার। শেখ সাদী বলছেন, পোশাক ইজ এ বাহুল্য! আর এই পোশাকেই আপনাকে খুব চমৎকার দেখাচ্ছে, ( এক চোখ টিপে বলল) একদম ফাটাফাটি!
রিমি লজ্জিত ভাবে হাসলো।
পৃথিলা যে কি বলেনা? সুন্দর মেয়েদের সবকিছুই কত সুন্দর!
এরা ঠাট্টা করলেও মনে হয়, মিষ্টি কবিতা পড়ছে….
তবে বেড়াতে বেড়িয়ে একটা জিনিস রিমিকে খুব স্বস্তি দিলো। পৃথিলা মেয়েটা সারাক্ষণ শোয়েবকে ব্যস্ত রাখছে।এই গল্প, সেই গল্প!
রিংকু ঝিংকুর ঝামেলায় রিমিকে শোয়েবের সামনে পড়তে হয়নি! কয়েকবার অবশ্য মুখোমুখি হবার কয়েকটা চান্স ছিলো, রিমিও খুব কৌশলে এড়িয়ে গেছে। রিংকু ঝিংকুর ঝামেলায় সাথে আছেন রেহানা ম্যডামও। সবকিছুতেই এরা চারজন। রেহানা ম্যাডামের প্যানপ্যান, এটা নিবো না, ওটা নিবো না। টয়েলেটে যাবো একটু পরপর, দু-ঘন্টায় গিয়েছেন ৬বার। রিংকু, ঝিংকুর প্যান প্যান, এটা খাবো, ওটা খাবো…….পুরো শপিংমলটা খেয়ে ফেলার উপক্রম!
লীনা ম্যাম কন্টিনিউয়াস সোহান স্যারের হাত ধরে আছেন। যেন মাত্র বিয়ে হয়েছে তাদের। সব শপিংব্যাগ সোহান স্যারের হাতে। পৃথিলা মেয়েটা শোয়েবকে ঘিড়ে রয়েছে। জিনিসপাতি কেনার মাঝে মাঝে কিছু একটা গল্প করে হাসিতে ফেটে পড়ছে। দুজনকে কি দারুণ মানিয়েছে! রিমির হঠাৎ ই মন খুব খারাপ লাগলো। সিমি আপাকেও দুলাভাইর সাথে এমন মানাতো। পাশাপাশি যখন হাঁটতো দুজনে, মনে হতো, সোনায় সোহাগা!
যতবার আপা দুলাভাইর সাথে রিমি বাইরে গেছে, প্রতিবারই দুলাভাই রিমি সিমিকে একরকম কিছু না কিছু একটা কিনে দিয়েছেন।
আজকের শপিং এ রিমিও একটা প্যাকেট অবশ্য পেয়েছে, তবে কি আছে তাতে? খুলে দেখা হয়নি।
রিমির ভাবনায় ছেদ পড়লো, রেহানা ম্যাডামের ডাকে।
-তুমি কি খাবে বলোতো? এখানে তো দেশি কিছু রাঁধে বলে মনে হয়না।
ক্ষিধেয় তখন রিমির পেটের ভিতর ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। ভাত আর শুটকির ভর্তা হলেই এক গামলা খাওয়া যাবে এমন অবস্থা, তারপরও যেনো খাবার কোনো আগ্রহই নেই, রিমি এমনভাবে মুখ করে বললো,
-আপনারা যা খাবেন, তাই….
-আমরা আর কি খাবো বলো? এখানে তো নুডলস ছাড়া কিছুই চিনতে পারছিনা। আমাদের নুডলসই বলি। ওরা পোকামাকড়ের স্যূপ, যা খায়, খাক। কি বলো?
রিংকু ঝিংকু একসাথে বললো,
-ওকে, ওকে।
রিমিদের ঠিক ২টেবিল সামনে বসেছেন, বাকিরা।
রেহেনা ম্যামের অবশ্য খাওয়া হলো না।নুডলস তিনি ঘাটাঘাটি করেই গেলেন। বিড়বিড় করলেন, কি না কি হোটেলরে বাবা, বিদেশী শেফ সব! কোনহাতে ধরে?কোনহাতে রাঁধে? টয়েলেটের পর এরা পানি নেয় না টিস্যু, কে জানে? ছিঃ থু।
রিমির এত ক্ষিধে ছিল নিজের প্লেটের পুরো নুডলস সে সাবাড় করে ফেললো, একদম শেষটুকু মুখে নিয়ে তাঁর মনে হলো, বড়লোকি ভদ্রতা হলো খাওয়ার পর প্লেটে একটুকু রাখা। রিমি তো রাখেনি। ও মাই গড! রিমি এদিক ওদিক তাকালো, সবাই যে যার মত খাচ্ছে। রিমি খুব সাবধানে মুখেরটুকু বের করে প্লেটে রেখে দিলো। যাক্ বাবা। ভদ্রতা রক্ষা হলো তাহলে!
রাতে ফেরার পথে রিমি বারবার করে বললো,
-আমি একা পারবো যেতে!
তাও পৃথিলা জোর করলো। আমি আর শোয়েব
আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবো।
ফেরার পথে রিমি বসেছিলো পেছনে। শোয়েব কোনো কথাই বললনা। কথা হলো, রিমি আর পৃথিলার মাঝে। পৌঁছুবার পর শোয়েব শুধু আস্তেগলায় বললো,
-এসে গেছি, রিমি ম্যাম।
রিমি নামবার সময় বললো,
-ধন্যবাদ, শোয়েব ভাইয়া। আপনারা আমার জন্য এত রাতে কষ্ট করলেন।
পৃথিলা হেসে বললো,
-কষ্ট না সুযোগ বলুন ম্যাম। এই যে আপনাকে নামিয়ে দিয়ে এখন আমরা একটু পারসোনাল সময় বেশি পাবো…..
ইচ্ছে করেই তো এলাম; আজ তো প্রথমে শোয়েব বেরুতেও চায়নি। এখন দেখুন, এতরাতেও মহাউৎসাহে ড্রাইভ করছে……
তারপর শোয়েবের দিকে আহলাদী গলায় বললো,
-তুমি উনাকে ঘর পর্যন্ত দিয়ে আসোনা শোয়েব।
শোয়েব দৃঢ়কণ্ঠে বললো,
-তুমি যাও পৃথি, বসছি আমি….
রিমি আঙ্গুলের ইশারায় বেস্ট অফ লাক দেখিয়ে একাই চলে এলো……
আজ তার অনেকদিন পর ভালো লাগছে, ভীষণ ভালো।
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা