#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_১১
শোয়েব টাইটা বাঁধতে বাঁধতে বললো,
-এত শর্ট নোটিসে তুমি এখানে চলে আসবে, ভাবিইনি পৃথি…
পৃথিলা হাসলো। ব্রিক রেড শার্টের সাথে, শোয়েব একটা ডার্ক ব্লু টাই পরেছে। শার্টের দামী পাথরের বোতামগুলো, যেন হীরের মত জ্বলছে! এত ভালো চয়েস কেন শোয়েবের? ঝাঁকড়া চমৎকার চুলগুলো দু-হাতে হালকা জেল ঘষে পেছনের দিকে শোয়েব হালকা ব্রাশ করে নিলো। খাড়া নাকটায় একটু ক্রিম মিশে লাগেনি এখনো। জোড়া ভ্রুঁ, চওড়া কপাল; এত কেন হ্যান্ডসাম শোয়েব। পৃথিলা নাকের ক্রিমটা ইশারায় মুছতে দেখালো শোয়েবকে।
ড্রেসিং টেবিলএর উপর থেকে পারফিউম নিয়ে শোয়েবের হাতে দিতে দিতে পৃথিলা বললো,
-এই যে হুট করে সিলেট দেখতে মন চাইলো; সাথে তোমাকেও।
পৃথিলার দেওয়া পারফিউমটটা শোয়েব স্প্রে করলো না, অন্য একটা নিয়ে করলো।
-বাহ্ তোমার তো পারফিউম স্প্রের ভঙ্গিটাও মডেলদের মত!
শোয়েব একটা একপেশে হাসি হাসলো।
-তুমি ফিরবে কখন শোয়েব? আর লাঞ্চ?
শোয়েব আবার নিজেকে আয়নায় দেখলো। জুতোটা ভালো লাগছেনা, চেঞ্জ করতে হবে আবার। বিরক্তি নিয়ে জুতো খুলতে আবার বিছানায় বসলো।
-আমি গাড়ি বলে দিচ্ছি; তোমরা ঘুড়ে নাও সারাদিন, ডিনারে দেখা হবে পৃথি। খুব ব্যস্ততা আমার।
পৃথিলা শাড়ির আঁচলের একটা কোণা আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বললো,
-জানো শোয়েব, তোমায় আমি একটা চমৎকার বুদ্ধিমান ছেলে ভাবতাম। এখন তো দেখি মহাবোকা। কাউকে এভয়েডটাও ঠিকঠাক করতে পারোনা!
শোয়েব মনোযোগ দিয়ে জুতোর ফিতেটা বাঁধছে। পৃথিলা শাড়ির নিচের পাড়টা আবার ঝাড়লো। এখানে এসে সকালে ঝিল দেখতে বেরিয়েছিলো। ঝিলের পানিতে নেমে শাড়ি ভিজে গেছে একটুখানি। ভিজেটা বিচ্ছিরি ঠেকছে এখন। সিলেটে এসেছে পৃথিলা দুদিন হলো। বন্ধুদের সাথে রিসোর্ট ছিল। আজ সকালেই দেখা করতেই এলো শোয়েবের সাথে। কিন্তু শোয়েব কাজের অজুহাতে বেরিয়ে যাচ্ছে!
-তোমার শাড়ি ভিজে গেছে নাকি? জলকেলি খেলে এলে ?
-তোমার বাসার কাছেই এত চমৎকার ঝিল বলোনি কেন আমাকে? আমি তো প্রথমে এসেই ঝিলে পা ভেজালাম।
-ঝিলটা আসলেই চমৎকার পৃথি। এখানে দেখার মত আরো অনেক কিছুই আছে, মিনিসাইজের পাহাড়ি অনেক বিউটিফুল ঝর্ণা আছে।
-তুমিও সাথে চলো না শোয়েব, দেখাবে….
শোয়েব জুতোটা পরে ইজি হয়ে দাঁড়ালো। শার্টের ইনটা আবার স্মুথ টাচ দিতে দিতে বললো,
-পৃথি তুমি কি জানো, তোমার সাথে যে ঘুড়ে বেড়াবে সে আরো চমৎকার হবে আমার থেকে? লাইক রাজপুত্র, কোমরে তরোয়াল, পরনে শাহী লেবাস, মাথায় রাজ মুকুট, শান দেওয়া গোঁফ! তীক্ষ্ণ চাহনি। চেহারায় অন্যরকম জৌলুস। সামথিং ভেরি স্পেশাল…..
পৃথিলা একটু কাছে এগিয়ে এলো শোয়েবের।
-ফাজলামো কেন করছো? সেটা তুমি কেন নও?
-এই জবাবটা আমার কাছে নেই পৃথি… আমার কি চাই; আমি নিজেই তা কনফার্ম নই।
-কিন্তু তুমি কি চাও, সে বিষয়ে আমিতো কনফার্ম! আমি অমন করে সব ভাবতে পারি………
-যেটা আমি জানিনা, সেটা তুমি জানো? এটা বিশ্বাস্য?
পৃথিলা একটু মলিন করে হাসলো!
-জানো, শোয়েব ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর আমায় নিয়ে ২টা নতুন রেকর্ড হলো। সেটি হলো, গত পাঁচবছরেরে মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছাত্রী এবং সর্বোচ্চ লাভ প্রপোজাল আমি পেয়েছিলাম। সবাই হাসতো এ নিয়ে। কিন্তু আমার ক্যারেক্টার ঝকঝকে, কারো সাথে আমি রিলেশানে জড়াইনি। পাত্তা দিইনি। রূপ, গুণ, টাকা কোনটাই আমার কম নয়। আমি জানি আমার যোগ্যতা বলে আমি কাউকে বেছে নিবো। আমাকে বেছে নেবার মত আমি অত দুর্বল নই। তোমার সাথে পরিচয় দু-বছরের। আমার দুনিয়াই পাল্টে গেল; সবকিছুতে তুমি, তোমাকেই চাই। কেন এমন হলো বলোতো? নিজেকে বারবার ছোট করতে আমারও ভালো লাগেনা কিন্তু…..
-ওটা তোমার ইগো পৃথি। আমি হ্যাঁ বলে দিলেই দেখবে, তোমার ইগোতে আর লাগবেনা।
-তুমি এখন আর ভালোবাসলেও আমি নিতে পারবোনা শোয়েব। এখন হ্যাঁ বললে ইগোতে আরো বেশি লাগবে।
-মানে?
-মানে হলো, তুমি আমাকে আর ছাড়বার সুযোগই পাবেনা। এভয়েড তো অনেক দূরে। আমি নিজেই তোমার ব্যাপারে এখন শিওর। আমরা সাধারণ বন্ধুই ভালো।
শোয়েব হাঁ করা মুখ নিয়ে পৃথিলার দিকে তাকিয়ে রইলো।এই এতদিনের পৃথিলাকে আজ তাঁর বড় অচেনা লাগছে। অনেক দূরের, অনেক আলাদা।
-আমরা দুপুরেই চলে যাচ্ছি শোয়েব। কথাগুলো তোমাকে সামনে থেকে বলতে ইচ্ছে করলো। ফোনে বলিনি সে জন্য……
শোয়েবের এই প্রথম পৃথিলাকে খুব ভয় করতে লাগলো।আর নিজেকে অপরাধী… তাও অনুরোধের মত করে বললো,
-তোমরা থাকো পৃথি, আমরা একসাথে বেরুবো বেড়াতে।একসাথে লাঞ্চ..
-না শোয়েব। আমি খুব অল্প সময়ের জন্য এসেছি। পরে আসবো, তবে নতুন কাউকে নিয়ে। তখন তুমি চাইলেও বেড়ানো যাবেনা আর একসাথে।
পৃথিলা রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলো।
-আমি কি কোনোভাবে তোমায় কষ্ট দিয়েছি পৃথি! কোনো মিসবিহেভ? আমি তো পাগলাটে জানো তুমি। আগা গোড়া ঘাড়ত্যাড়া। ঐ একটা স্বভাবেই অনেক আনন্দ আমার হয়নি… প্লিজ…
-আচ্ছা, একটা ছোট্ট প্রশ্নের জবাব দাও তো যদি উত্তর দিতে পারো, ডেফিনিটলি থাকবো… বলো তো শোয়েব আমাদের বাসা কোথায়? মানে ঢাকার কোথায় আমি থাকি? আমাদের বাড়িটা কেমন? দোতলা না তিনতলা?
-আজগুবি প্রশ্ন! আমি গিয়েছি নাকি কখনো? গেলেই না…..
-সেদিন তুমি যখন রাতে রিমি ম্যামকে ছাড়তে যাও, তোমায় কিন্তু উনি উনার বাসার রাস্তা দেখিয়ে দেন নি। অথচ তুমি একটানে চলে গেলে! অথচ তুমি বলেছো, রিমির সাথে কখনোই আলাপ ছিল না আাগে। আলাপ না থাকা একটা মানুষের বাসায় গভীর রাতে……
শোয়েব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, পৃথিলা হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললো,
-তুমি উনার বাসা চেনো বা আগে গিয়েছ, তাতে আমার কোনো কৌতূহল নেই; কিন্তু ব্যাপারটা হলো অন্য! যে নারীকে তুমি অন্য নারীর ব্যাপারে বলতে দ্বিধা করো, আমি তোমার জীবনে এমন নারী হয়ে থাকতো পারবো না শোয়েব। আমি যার হবো, সে অন্য নারী সম্পর্কিত সব আমায় বলতে পারবে; এটুকু সমীহ সে আমায় করতেই হবে.. নাহলে যে ছোট হবো আমি।
শোয়েব তোতলাতে তোতলাতে বললো,
-আসলে, রিমি যে আমাদের বাসায় পড়াতে আসে সেজন্যই চেনা… মানে হয়েছে কি, ঠিকানা তো…..
ছলছল চোখে পৃথিলা শোয়েবের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো!
-আমি তোমার জীবনে পাটরানি হতে চেয়েছিলাম, প্রধান রাণী। তুমি রাজা, তুমি যোগ্য থেকেও যোগ্যতম.. তোমার শত রাণী থাকতেই পারে, কিন্তু তোমার রাণী একমাত্র আমি হতে চেয়েছি…
শোয়েব ঘামছে। অসহায় লাগছে, নিজের উপর রাগ হচ্ছে, জেদ হচ্ছে, একই সাথে করুণা হচ্ছে… পৃথিলা এতদিনে তার সামনে যা বলেছে, করেছে সব স্পষ্ট! অথচ সে নিজে নিজের কাছেই আজ অস্পষ্ট! উফ্
-শোয়েব, কখনোতো মিথ্যে বলোনি আমাকে, তাই আজ বলাটা আমি বুঝতে পারছি…..
শাড়ির কুঁচিটা আবার ঝারলো পৃথিলা। ভিজে শাড়ির পাড় থেকে কয়েক ফোঁটা পানি পড়লো মেঝেতে। শোয়েবের গায়ে করা স্প্রেটা নিয়ে ভালো করে স্প্রে করলো নিজের কাপড়ে।শোয়েব প্রায় ফিসফিস করে বললো,
-ওটা তো ছেলেদের…
-আজ ছেলে হতে মন চাইছে, তোমার মত ছেলে..
বলে শোয়েবের দিকে তাকিয়ে বা চোখটা টিপলো..
ব্যাগটা হাতে নিয়ে আঁচলের কার্ণিশ ধরে পৃথিলা আর কিছু না বলেই বেড়িয়ে চলে গেল।
শোয়েব বিস্মিত ও হতাশ দৃষ্টিতে পৃথিলার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। এতদিন সে পৃথিলাকে টোটালি একটা বোকা মেয়ে ভাবতো। এই প্রথম শোয়েব বুঝতে পারলো পৃথিলা মোটেও বোকা নয়, বেশ ধারালো বুদ্ধির একটা মেয়ে। পৃথিলার অনুভূতি খুবই প্রবল!
রিমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
-হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন? আমি রিমি বলছিলাম, ওই যে রিংকু ঝিংকুর টিচার!
শোয়েব জবাব দিলোনা।চুপচাপ শুনে গেল,
রিমি এবার আরো চেঁচিয়ে,
-শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো, আমি রিমি। ওই যে, বেঁহুশ হওয়া.. হ্যালো হ্যালো… শোয়েব ভাইয়া… আপনি কি শোয়েব ভাইয়া, এটা কি…
শোয়েব এইবার কথা বললো,
-চিনতে পেরেছি আপু, ওই যে… আপনি রেস্টুরেন্টে মুখের নুডলস বের করে প্লেটে রেখেছিলেন, সেই আপুটা না? ওই যে গামছাওয়ালী? আর ওই যে রান্নাঘরের ভাল্লুক…. বলুন বলুন…. কি দরকার বলুন? গামছা বেচবেন? ক পিস?
রিমি ফোন কেটে দিলো। সর্বনাশ!
শিউলি রিমির গায়ে ধাক্কা দিলো।
-কিরে ফোন কেটে দিলি! চিনতে পারেনি? তোর রেহেনা ম্যাডাম বলেনি?
রিমি স্তব্ধ হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়েই আছে।
-উফ্ ফোন করনা আবার! একটা গ্যারান্টার হবে, এত দাম কেন দেখাচ্ছে? আসতে না পারলে, নাহলে ব্যাটার পরিচিত কাউকে বলে দিক না একটু। না পারলে না করুক… আমরা অন্য জায়গায় যোগাযোগ করবো…..
রিমির মোবাইল আবার বেজে উঠেছে। অপরিচিত নাম্বার!
-হ্যালো…..
-হ্যালো রিমি, রিমি, মা বলছি। সিমির হঠাৎ করেই শরীর খারাপ করেছে, খুব। একটু একটু রক্তপানি ভাঙছে… কিন্তু ব্যাথা নেই। মনে হয় হাসপাতালে নিতে হবে…. তুই কোথায়? হ্যালো, রিমি….
রিমি ফোন কেটে দিয়েই শিউলিকে কিছু না বলে ছুটে বেড়িয়ে গেল….
শিউলি পিছু ডাকলো,
-এই রিমি কার ফোন? যাচ্ছিস কেন? জুতো ফেলে যাচ্ছিস তো….. রিমি….
রিমি প্রাণপণে ছুটছে। তার এক্ষুণি বাড়ি পোঁছাতে হবে। আপার কিচ্ছু হতে দেবে না সে…কিচ্ছু না। কত টাকা আছে যেন ঘরে? টাকার যোগাড় করতে হবে…..
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা