#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৬_ও_১৭
#পর্ব_১৬
-আমিও তো একটু আর্লি চলে এসেছি।
রিজওয়ান হাতের ফোনটা টেবিলে রেখে বললো,
-কি বলবো? লাইট কিছু নাকি…
রিমি না সূচক মাথা নাড়লো।
-অন্তত দুটো কফি বলি?
-একটা বলুন। আমি কিছুই খাবো না, পান খেয়েছি। এই দেখুন…
রিমি জিভ বের করে দেখালো।
রিজওয়ান শুধু একটা কফিই বললো নিজের জন্য। তারপর রিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপনি এসেছেন, এ বিষয়টা অনেক সহজ লাগছে আমার কাছে।
রিমি চুপচাপ বাইরে দেখছে। তিনতলায় রেস্তোরায় এই টেবিলটা ঠিক রাস্তার পাশে, কাঁচ গলে বাইরে তাকালেই ব্যস্ত শহর….
রিমি বাইরের দিকে তাকিয়েই বললো,
-আমার নিজের দরকারে এসেছি। কিছু বলার ছিল।
তারপর বেশকিছুক্ষণ দুজনেই চুপ! ওয়েটার এসে কফি রেখে গেল।
রিজওয়ানই নীরবতা ভাঙলো,
-আপনার বান্ধবী এলো না যে? বিরক্ত?
-মনে হয়।
রিমি মলিন হাসলো। রিজওয়ান কফিতে চুমুক দিচ্ছে। বাইরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে রিমি অস্পষ্ট করে বললো,
-আপনাদের মত ফ্যামিলি থেকে একটা বিয়ের প্রপোজাল মানে একটা মেয়ের অনেক সৌভাগ্য। কেউ জ্ঞানত ফিরিয়ে দেবে না সেটা।
রিজওয়ান কফিমগটা টেবিলে রেখে ঘুড়াতে লাগলো ওটা….
-তাহলে আপনি কেন ফিরিয়ে দিচ্ছেন?
রিজওয়ানের স্পষ্ট কণ্ঠে ধারালো জেদ।
-সেদিন আপনার ফোন থেকে এসএমএসটা দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম রিজওয়ান সাহেব। আর ভয়ও… সত্যি বলতে কি, আপনি পারমিশন চাইলেন প্রপোজাল দেবার আগে, সেটার জবাব দিতেই আজ…
রিমি এবার উঠে গিয়ে সামনে দাঁড়ালো। পিঠের লম্বা বিণুনিটা অগোছালোভাবে উল্টে আছে। বিণুনির মাথায় সে কিছু বাঁধেনি। বেণীটা খুলে খুলে যাচ্ছে।
ঘাড়ের কাছের দিকটা কোমলমত, ফর্সা। ছিপছিপে শরীরে কালো জামায়, রিমিকে পুরো….
রিজওয়ানের বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠলো যেন। বড় গল্প বলবার আগে মানুষ যেরকম শুরু করে রিমিও ঠিক তেমনি বলতে লাগলো,
-আমার বড় দুটি যমজ বোনের যখন জন্ম হয়, সে সময় মায়ের একটা ক্রিটিকাল সমস্যা হলো। অদক্ষ দাইয়ের হাতে বাচ্চার জন্ম, বুঝেনই তো? কিছু একটা ভুল হয় তখন। মায়ের কঠিন সমস্যা হলো, যার ফলাফল প্রস্রাব লিকেজ হয় সারাক্ষণ। ডাক্তারদের ধরনা দিলে বললো, এর সলিউশান অনেক টাকায় অপারেশন এবং মাত্র ৪০% সম্ভাবনা সাকসেসফুল হবার। মেয়েদের এরকম সমস্যায় বিচ্ছিরি ব্যাপার।স্বামীর সাথে একটা সুস্থ স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্ক যে বজায় থাকেনা, বুঝতেই তো পারছেন? তৈরি হলো লোয়ার মিডিল ক্লাস ফ্যামিলি ক্রাইসিস! বাবা ঠিক করলেন বিয়ে করবেন। মা বাবাকে ধরে রাখতে
বুদ্ধি আটলেন, বোকা বুদ্ধি। আরেকটা বেবি নিতে চাইলেন, আমি হলাম। সমস্যা বাড়লো মায়ের। তাও হলোনা, বাবা আবার বিয়ে করতে চাইলেন। মা নিরুপায় হয়ে প্রথমে অনুমতি দিলেও পরে মেনে নিতে পারলেন না… আর…
-মিস রিমি, আমার কিন্তু কোনো ব্যাখ্যার দরকার নেই। যা অন্য একটা মানুষের জন্য লজ্জার, বেদনার, তা আমার জন্যও কিন্তু! আপনি বসুন না। আমরা বরং আপনার বিজনেস নিয়ে কথা বলি… কিভাবে কি করলে ভালো হয়….
রিমি বসলো না।
-কথাগুলো আপনাকে বলতে পারলে আমার ভালো লাগবে। কাউকে বলা হয়নি আগে।
রিমির গলায় আকুল আবেদন। রিজওয়ান আবার কফিটা হাতে নিয়ে বসলো। বলুক না….
-বাবার নতুন বিয়ে করা বৌ মায়ের চোখের সামনে, মা বললেন বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। আমার পাগল বাবা আমার অতি অভিমানী মাকে বাড়িটা দিয়ে চলে গেলেন নিজেই। মায়ের কঠিন শর্ত বাবা যেন কখনোই আর যোগাযোগ না করেন। মা আমাদের সঙ্গে নিয়ে আত্মহত্যারও হুমকি দিলেন। ব্লাইন্ড সেন্টিমেন্ট। তবে বাবা যাবার সময় মায়ের আর বাবার ভালোবাসার চমৎকার একটি সমন্বয় সাথে নিয়ে গেলেন, তা হলো আমার বড় যমজ বোনদের একজনকে। তারপর মা টুকটাক কাজ করে সংসার চালাতে লাগলেন। দুটো মানুষ, সম্পূর্ণ দুই জায়গায়। আলাদা জীবন চলতে থাকলো….
রিমি একটুক্ষণের জন্য থামলো। ফোন বাজছে রিমির ব্যাগে। শোয়েব কল দিয়েছে। রিমি ফোন কেটে দিলো। শোয়েব সাথে সাথেই টেক্সট করলো,
“আই’ল কিল ইউ।”
রিমিও টেক্সট রিপ্লাই করলো, “আই’ল কিল ইউ টু”
ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে রিজওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-সরি।
রিজওয়ান মৃদু মাথা নাড়লো।
রিমি আবার ঠিক আগের জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে থাকলো,
-আমাদের সেই একপেশে জোড়াতালির অদ্ভূত সংসারে আবার বিপদ এলো। কলেজে উঠে আপা প্রেম করে একজনকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলো। আমার একলা অসহায় মা দুঃখে তখন পাগলপ্রায়।আমি তখন হাইস্কুল লেভেলে! মা কাজ কর্মের পরিমাণ কমিয়ে দিলেন। জীবনে বেঁচে থাকবার ইচ্ছা তাঁর মরে গেল। কিন্তু মরতে পারলেন না আমার জন্য। সমস্ত মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেললেন। অবস্থা এত খারাপ হলো যে মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
রিজওয়ান পকেট থেকে টিস্যু বের করলো।চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে কেন তাঁর? অথচ রিমি বলে যাচ্ছে কত স্বাভাবিকভাবে।
-খাবারের টাকা নেই, মায়ের চিকিৎসার টাকা নেই… কি যে অবস্থা। শুধু ক্ষিধে মেটাতে আয় রোজগারের চেষ্টা তখনি শুরু করি আমি। টুকটাক টিউশনি শুরু করলাম। মাকে সাপোর্ট দিতে চাইলাম। মাও যেন একটু স্বস্তি পেলেন। এর মধ্যে আপা এসে আবার ক্ষমা চেয়ে আমাদের সাথে স্বাভাবিক হলেন। দুলাভাইও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
কিন্তু ওই যে বলেনা, দুঃখে যার জীবন গড়া তার আবার সুখ কিসের? হুট করে দুলাভাই মারা গেলেন ডায়রিয়া হয়ে। ভাবা যায়? ভাগ্য বলে কথা!
-ডায়রিয়া। এটাও?
রিমি রিজওয়ানকে শেষ করতে দিলো না।
-আপা তখন স্থায়ীভাবে সংসারে এসে যোগ হলেন। একা নয়, নতুন প্রাণ সাথে করে। আমি আমার আয় রোজগারের যুদ্ধ এবার মহাউৎসাহে দ্বিগুণ করে দিলাম। নিজেকে মানুষ ভাবা ছেড়ে দিয়ে রোবট ভাবা শুরু করলাম। এতে লাভ হলো অনেক। সাধ আহলাদ কমে গেল, মান অপমান বোধ কমে গেল।সব কাজ করাটা সহজ হয়ে গেল। ভালো মন্দ সত্য মিথ্যা সব সমান লাগতে থাকলো।
এটুকু বলে রিমি বসলো এসে টেবিলে। পানি খেয়ে নিলো এক গ্লাস, যেন অনেকটা পথ হেঁটে এসে একটু জিরিয়ে নিলো।
রিজওয়ান মেয়েদের মত হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে! রিমি যেন ব্যাপারটা খেয়ালই করলো না।
-জানেন, আমার সেই রোবট হওয়া জীবনে অনুভূতিরা জোর চালিয়ে ফিরে এলো, তবে একা নয়! আমার বোনও এলো… বাবা আর্থিকভাবে অনেক উঁচুতে এখন। বোন কম্পিউটার সায়েন্স পড়ছে। আমি খুঁজে পেলাম চমৎকার এক দেবদূতকে আমার জীবনে। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ালো, সেই দেবদূতকে আমার বোন…..
এবার রিমি একদম চুপ করে রইলো। আর বলতে ভালো লাগছে না তার। গা গুলাচ্ছে।
-সম্পর্কগুলো কেন এরকম জটিল হয়ে গেল। ঠিক করে নেওয়া যায় না এখন, মিস রিমি?
-সব কি অত সহজ? মায়ের এতদিনকার অভিমান, বাবার জেদ। পরিস্থিতি এখন অনেক বদলে গেছে। বাবার নতুন জীবনে দুই ছেলে। কিছুই সহজ নয় আর….. সম্ভবও নয় হয়তো…
-আপনি আপনার দায়িত্বের জন্য নিজের কথা ভাবছেন না কেন? এসব করে করে নিজে তো সত্যিই…
রিমি এবার ওয়েটার ডেকে একটা কফি বললো। গা গুলানোটা যদি কাটে তাতে….
-এর কোনো ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। রিজওয়ান সাহেব.. এটাই হয়তো আমার জীবন। এভাবেই বোধহয় সব ঠিক চলছে। মা বাবার অভিমানের জায়গাটা এখন আর শুধু অভিমানে নেই, এই এতটা বছরে হিসেব অনেক বদলে গেছে… অনেক…
রিমি ঘড়ি দেখলো। দু-ঘন্টা হয়ে গেছে প্রায়। কফিটা দ্রুত চুমুকে শেষ করে বললো,
-আজ যাই, রিজওয়ান সাহেব। আবার দেখা হবে। আপনাকে কিন্তু বিজনেস ব্যাপারে হেল্পের জন্য নক করবো এখন থেকে।
-কি যে বলেন না? আপনার বিজনেস দাঁড়ালে বরং আমার ব্যাংকটা বাঁচে….
রিমি বিলটা ফাইলে রাখতে রাখতে বললো,
-আল্লাহ যেন সত্যিই আপনাকে একটা ডাক্তার বৌ দেয়। মন থেকে দোআ করলাম।
রিজওয়ান খোঁচা মারার ভঙ্গিতে বললো,
-তবে এটা শিওর থাকুন আপনার আগে বিয়ে আমি করছি না। পরে দেখা যাবে… ঠকে গেছি।
রিমি মিষ্টি করে হেসে বেড়িয়ে গেল।
রিজওয়ান বিড়বিড় করে বললো,
-এই সন্ধ্যাটা সত্যিই অনেক আলাদা কাটলো আপনার সাথে।
রিমি সেটা শুনতে পেলো না। রিজওয়ান রিমির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েই আছে। এই এতটুকু মেয়ে অথচ প্রতি মুহূর্ত কত চ্যালেঞ্জ সাথে নিয়ে বেঁচে যাচ্ছে। সম্পর্কের দাম প্রতিটা মুহূর্তে দিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা সে কি কোনোদিনও নিজের কথা ভাবার ইচ্ছে করবে? রিজওয়ান তো শুধু অপেক্ষা করতে চায়….
আচ্ছা, এরকম ছেলে হলে তো একে বীরপুরুষ বলা যেত, এরকম মেয়েকে কি বলা যায়? বীর মহিলা? রিজওয়ান মুখ কুঁচকে ভাবতে লাগলো…..
লোনের টাকাটা যে রিজওয়ান ব্যাংক থেকে দেয়নি, কেউ একজন রিজওয়ানকে দিয়ে রিমিকে দিয়েছে,
রিমিকে কি বলা উচিত ছিল?
#পর্ব_১৭
নাসিমা কি করবেন বুঝতে পারছেন না। পৃথিলার ঘনঘন এ বাড়িতে আসা তাঁর ভালো লাগছে না। মা ডেকে ডেকে এখন এসে নাসিমাকে নিয়ে যেতে চাইছে।পুরোনো সব ভুলো শুধরে সব এক করতে চাইছে। নাসিমা মোটেও পুরোনো মানুষটাকে চান না। কিন্তু নাসিমা ফিরে না গেলে পৃথিলা এসে এখানেই থাকবে বলছে। এও কি সম্ভব? এতদিনের সংসারে কটা টাকা হাতে করে “উড়ে এসে জুড়ে বসা”। সিমিটাও সারাক্ষণ পৃথি পৃথি বলে অজ্ঞান। এত কিছু যে ঘটছে, তাও তিনি রিমিকে কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছেন না। নতুন ব্যবসা ব্যবসা করে মেয়েটার নাওয়া খাওয়া বন্ধ। দুমাস হয়ো গেল প্রায়, মেয়েটা যে এত খেটেখুটে কি ব্যবসা করছে কে জানে?
এদিকে সিমির ছেলের একটা আকীকা অনুষ্ঠান করা দরকার। সিমিটা তো পৃথিলার সাথে এ নিয়ে কথাও বলে ফেলেছে। পৃথিলার টাকায় এই অনুষ্ঠান করাটা তাঁর একদম ভালো লাগছে না। সিমিটা তাঁর নিজের মেয়ে ভাবাই যায় না। এত লোভী কেন মেয়েটা? অথচ রিমিটা… নিজের দিকে তাকায় পর্যন্ত না। নাসিমার মন খারাপটা আরো বেড়ে গেল। কাল অনেক রাতে ফিরেছে রিমিটা। ফিরে আরও অনেকক্ষণ কাজ করেছে। সকালে উঠে ঘরটর ঝেরে মুছে এখন রান্না বসিয়েছে। ও’র শরীরটা কি বিশ্রাম চায় না?
সিমি আহলাদীভাবে বাবুকে নিয়ে বারান্দায় বসে আছে। সারাক্ষণ শুয়ে বসে আরাম। সিমিটাকে কিছু কঠিন করে কথা বলা দরকার! একা রিমি আর কত? এভাবে চললে তো মেয়েটা ফট করে মরে যাবে।
নাসিমা এগিয়ে গিয়ে একটু রেগেই কথাটা সিমিকে বললেন,
-রিমির সামনে কথাবার্তা বলার সময় তো ভাববি?দুদিনে পৃথিলা তোর সব হয়ে গেল? টাকা দেখলেই, ছিঃ… এত নীচ্!
-ঘ্যানঘ্যান করবে না মা। এই এতটা দিনে কি কোনো একটা পছন্দমত জিনিস রিমি আমায় দিয়েছে? শুধু নুন ভাতের যোগান দিয়েছে বলে… এই যে নিজে ব্যবসা শুরু করলো, এত টাকা সে পেলো কই? এতদিন তো বললো, টাকা নেই। লোন তো এতো সোজা না। সব জমিয়েছে বুঝলে? এখন দেখেছো, কত স্মার্ট হয়ে চলছে। খুব রোজগার হচ্ছে মা বুঝলে?
-ব্যবসার তো মাত্র কিছুদিন গেল, এখনি তুই এভাবে বলছিস! তাছাড়া মেয়েটা যে দু হাতে সংসারে ঢালছে, তা দেখছিস না… তোর বাবুরই তো এই এত কিছু লাগে…..
নাসিমার কথা শেষ হবার আগেই সিমি ব্যস্ত হয়ে ফোন করলো পৃথিলাকে।
-হ্যালো, এই পৃথি জানিস, বাবুনা….
নাসিমার রাগে মাথা ভনভন করছে। তিনি বারান্দা থেকে সরে এলেন। তিনি সিমির সামনে থেকে উঠে গেলেন। নতুন বাচ্চার মা না হলে সিমিকে তিনি এই মুহূর্তে লাথি দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিতেন। রিমি তার ভেসে যাওয়া জীবনে হাল ধরেছে। যে বয়সে মানুষ পৃথিবীর রংগুলোকে, আলোগুলোকে চোখ মেলে দেখে, সেই বয়সে সে পাক্কা সংসারীর মত নিজেকে ঢেলে দিয়েছে। এই এতটা দিনে মেয়েটা ভালো করে খায়নি, ঘুমোয়নি। কত রাত না খেয়ে শুয়েছে তার হিসেব নেই। এক টুকরো আস্ত মাছ সে খায় না, সে ভাবে এটা তার অপরাধ। মাছ মুরগী না খেতে খেতে এমন অভ্যাস হলো যে, এখন জোর করে একটু খেলেই পেট খারাপ করে! এই যে পড়াশোনা চালাচ্ছে বই কিনে নি, ধার করে চালাচ্ছে। কষ্টে কান্না দলা পাকিয়ে গলা পর্যন্ত এলেও মেয়েটা স্বাচ্ছন্দ্যে গিলে নিয়েছে। রিমির নিজের বয়স কত? এখন ২০না ২১? ১৪ বছরের জীবন থেকে তার ৪০ বছরের ভার….
আর এখন দুটো ভালো কাপড়চোপড় দিয়ে অন্য কেউ সব কর্তৃত্ব নিতে চাইছে! তিনি কিছুতেই তা হতে দেবেন না। রিমিকে নিয়ে দরকার হলে তিনি অনেক দূরে চলে যাবেন। দরকার হলে, নিজের প্রতিটা অঙ্গ বিক্রি করে মেয়েটাকে ভালো বিয়ে দিবেন!
নাসিমার মাথা ধরে গেল। রিমি রান্নায় ব্যস্ত। নাসিমা উঁকি দিয়ে বললেন,
-এক কাপ চা দেনা রিমি, মাথা ধরেছে।
-পারবো না মা, রসুন হাতে। তুমি করে নাও।
নাসিমার মাথা ধরাটা যেনো আরো বেড়ে গেল।
-মা, আমি কিন্তু দুপুরেই বেরুবো। ফিরতে অনেক রাত হবে। নাও ফিরতে পারি, ডেলিভারি আছে অনেকগুলো। মা জানো, ৭০পিসের যেই আইটেমটা আমরা গত সপ্তাহে নিয়েছি সেটা এখন পর্যন্ত ৮০০পিসের উপরে ডিমান্ড আসছে… ব্যবসাটা বোধহয় দাঁড়িয়েই গেল! একটা নিজস্ব গাড়ি থাকলে ভালো হতো মা।
-রিমি, সিমির বাবুর জন্য একটা অনুষ্ঠান করতে বলছে। আকীকা….
মায়ের কথা শেষ না হতেই রিমি বললো,
-মা কয়েকটা দিন পরে করি? আমি খুব ব্যস্ত মা। একটু সময় দাও। একটা বড় অনুষ্ঠানের প্ল্যান আমি মাথায় রেখেছি। জানো মা আমি তো প্ল্যান করেছি, অনুষ্ঠানে আপাকে একটা স্বর্ণের চেইন দিবো। গয়না গয়না করে মাথা খায় দেখোনা?
এটুকু বলে রিমি চোখ বন্ধ করলো, আপার বাবুর অনুষ্ঠানে সে আরেকজনকে একটা বিশেষ উপহার দিবে। সেই উপহারটা দেখে মানুষটা কেমন চমকে যায়, সেটা দেখতেই রিমির যত আগ্রহ…..
নাসিমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জড়তা যুক্ত কণ্ঠে বললেন,
-পৃথিলা নাকি বলেছে সিমিকে ও বাড়িতে নিয়ে যাবে। সিমিটাও তো বুঝিস…
রিমি এক সেকেন্ডের জন্য মায়ের দিকে তাকালো।
নাসিমা আবার বললেন,
-বোনের জন্য এত ভালোবাসা, তো এ বাড়িতে এসে থাক না। তা সে থাকবে না। কারণ, সুখ বিসর্জন দিতে কেউ রাজি নয়! বোনকে নিয়ে যাবে, আমাদের নিয়ে যাবে। আমি তো বলে দিয়েছিই, কোথাও যাবো না আমরা।
রিমি কিছু না বলে নিশ্চুপ কাজ করতে থাকলো। মাথা কেনো ভোঁ ভোঁ করছে তার! কান দিয়ে গরম ধোয়া কেন বেরুচ্ছে?
দুপুরে রিমি বেরিয়ে যাবার সময় সিমি পিছু ডাকলো।
-তুই কিরে রিমি? বাবুটাকে একটু কোলেও নিস না। এত ব্যস্ত তুই। নতুন ব্যবসায়ী…. কি যে করবি, জানি তো। ব্যবসা অত সহজ না। ছেলেরাই পারেনা… আর তুই তো সেদিনকার বাচ্চা মেয়ে!
-এসব আহলাদ ফাহলাদের টাইম আমার নাই। তোর যেন এদেশে একলাই বাবু হয়েছে। যত্তসব..
-মুখ সামলে কথা বল রিমি। আমি কিন্তু দেখছি, বাবু হবার পর থেকেই তোর অবহেলা। পৃথি তো বাবুর জন্য রাতে দশবার করে ফোন করে… আর তুই? চলে যাবো, থাকবো না আর এখানে। অনেক সহ্য করেছি। একটু রোজগার করিস বলে…..
সিমি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছে।
রিমি গ্যাস বিলের টাকাটা টেবিলের উপর রেখে
বেরিয়ে গেল। হাঁটতে ভালো লাগছে না আজ রিমির। এত কেন শরীর খারাপ লাগছে তার? জ্বর আসবে? টিউশন পড়িয়ে আজ সে আর দোকানে যাবে না। বাড়িই ফিরবে। হাত-পা যেন থেমে থেমে যাচ্ছে।
রিংকু ঝিংকুকে পড়াতে এসে রিমি শুনলো,
শোয়েব এসেছে গতকাল রাতে। শুনেই রিমির গা কাঁপছে। রিমি বিড়বিড় করে বললো, আল্লাহ আমাকে বাঁচাও! চুপচাপ বেরিয়ে যেতে পারলেই হলো। সেটা সম্ভব হলো না। রেহেনা ম্যাডাম এসে বললেন,
-রিমি শোয়েব ডাকছে। শুনে আসো। তোমার বিজনেস নিয়ে নাকি কথা আছে।
রিমি এবার নিজের কপালে নিজেই হাত দিয়ে বললো,
-ওহ আমার বোধহয় এইবার জ্বর এসেই গিয়েছে। কয় ডিগ্রী। ১০৫ডিগ্রী নিশ্চয়?
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা