রোদ্দুরের_বৃষ্টি #পর্ব_১৪_ও_১৫

0
325

#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৪_ও_১৫

#পর্ব_১৪

রিমি টাকার বান্ডেলটা হাতে দিতেই নাসিমা চমকে উঠলেন। ঠান্ডা চিৎকারে বললেন,
-কে দিলো?
-কেউ দেয়নি মা। এটা আমার টাকা। কেউ একজনের কাছে ছিল, আজ পেলাম।
-আজেবাজে কথা বলবি না। কে দিয়েছে ধার?
রিমি একটু এগিয়ে এসে মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধের কাছে মুখটা রাখলো।
-মা, কিছু প্রশ্নের স্পেসিফিক কোনো উত্তর হয় না।একজন দিয়েছে। আমাকে দেয়ার একমাত্র কারণ, আমাকে সবধরনের সাহায্য করাতে তাঁর আনন্দ! সে ঠিক করে নিয়েছে এটা তাঁর দায়িত্ব…..
-কথা পেঁচাবি না, সোজা করে বলতো রিমি…
-সোজা করেই বলছি মা, দেখোতো আমার গায়ে পেঁয়াজ পেঁয়াজ গন্ধ কিনা? মা, আমি ঠিক করেছি এখন থেকে গায়ে দামী সাবান লোশন মাখবো। বিচ্ছিরি গন্ধ হয়….
বলেই রিমি নিজের হাত-গায়ের বিভিন্ন জায়গা শুকতে লাগলো মনোযোগ দিয়ে।
নাসিমা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?

-তুমি কি সত্যিই পৃথিলার ব্যাপারে শিওর?
লীনা খুব আনইজি হয়ে শোয়েবকে প্রশ্নটা করলো।
শোয়েব ব্যাগের চেইন আটকাতে আটকাতে বললো,
-আমি কোনো ব্যাপারে শিওর না ভাবি। তবে একটা ব্যাপারে শিওর। সেটা হলো, এই গ্রিন শাড়িতে তোমায় পুরো প্রকৃতির রাণীর মত লাগছে। আচ্ছা ভাবী ভাইয়ার কি এজন্যই এত ভারী পাওয়ারের চশমা লাগে? তোমার রূপের ঝলকে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে না তো দিনদিন?
লীনা লজ্জা পাওয়া ভঙ্গিতে হাসলো,
-খালি ইয়ার্কি। প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা! আমার কথার জবাব কিন্তু তুমি দাওনি।
শোয়েব সোজা গিয়ে বিছানায় বসলো। পা দুটো পাশের টেবিলটার উপর রেখে বালিশে হেলান দিলো।
-পৃথিলা খুবই চমৎকার মেয়ে। এত চমৎকার একটা মেয়ের জন্য অন্য কারো সুপারিশের দরকার নেই।ওকে যে চাইবে, মুগ্ধ হয়ে চাইবে। বারবার কেন ওর হয়ে কথা বলো? এতে তো ওকে ছোট করা হয়। আমি চাই ও’র যা হবে সব ও’র নিজের গুণেই হবে…..
-ও’র গুণ কি কোথাও কম যে তুমি ওকে চাইছো না?
-এমনও তো হতে পারে, আমিই ও’র গুণের কাছে তুচ্ছ! অযোগ্য…
লীনা হাসলো।
-তুমি কি অন্য কোনো গুণবতীর যোগ্য করে ফেলেছো নাকি নিজেকে?
শোয়েব জবাব দিলো না। লীনা একটু রাগ, একটু অনুনয়ের গলায় বললো,
পৃথিলার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে তোমার কোনো কনফিউশান আছে নাকি? ও’র যে ফ্যামিলির কথাটা…….
শোয়েব আস্তে করে বললো,
-আমি একটু ঘুমিয়ে নিবো ভাবী, রাতে জার্নি আছে তো…..
লীনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেড়িয়ে গেল। শোয়েবটা কেন এমন পাগলাটে, অনুভূতিহীন?

সন্ধ্যায় ঘরে এসে থেকেই শোয়েবের মন কেমন করছে? এত অস্থির লাগছে? কি চাই তার? শোয়েব চেঞ্জ না করেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। রিমিকে ঘরে ঢুকতে দেখেই শোয়েবের রাগ লাগলো। আসার কি দরকার ছিল? দুপুরে আসার কথা ছিল, এসেছে রাত করে। মাথা নষ্ট করে দেয়া ছাড়া কাজ নেই! কোনো কথা শুনবে না মেয়েটা। শোয়েব শুয়ে থেকেই পাশ ফিরে বললো,
-আসার কি দরকার ছিল? একটু পরেই আমি তো হাসপাতাল ঘুড়েই যেতাম। আশ্চর্য!
রিমি দরজাটা বন্ধ করে তাতে পিঠ হেলান দিয়েই দাঁড়ালো। আজ সে শাড়ি পরেছে। এই প্রথম সে গয়না পরেছে, কানে দুল, গলায় ছোট্ট লকেটের চেইন, হাতে চুড়ি। নাকে ফুটো নেই বলে ফুটোকরিয়ে নোজপিন পরে এসেছে! শোয়েবকে আজ সে বলবেই……
-কি ব্যাপার? দরজা কেন বন্ধ করছেন? কি না কি ভাববে সবাই! ভাবী পাশের ঘরেই….
-ভাবাভাবির কি আছে? আপনি মেসেজ করে বলেছেন আসতে। আমি মেসেজ দেখিয়ে দিবো তখন।
শোয়েবের আরো রাগ হচ্ছে।
রিমি আস্তে স্বরে বললো,
-আমি যে এসেছি কেউ দেখেনি। আমাকে তুমি করে বলুন না….
শোয়েব কাঁথা টেনে দিলো গায়ে। তুমি করে বলতে হবে… কি আদিখ্যেতা!
রিমি এগিয়ে এসে শোয়েবের বিছানার পাশে দাঁড়ালো। কিছু বলল না। রিমির সব গুলিয়ে যাচ্ছে। সে ঢোঁক গিললো। এত কেন তেষ্টা পাচ্ছে?
বিড়বিড় করে বললো,
-পানি খাবো….
শোয়েব কাঁথাটা ফেলে দিয়ে উঠলো।
-পানি খেতে আসা হয়েছে? আমি তো ভেবেছি চুমু খেতে..
গ্লাসের পানি এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
-পানি।
রিমি স্থির হয়ে তাকিয়েই আছে শোয়েবের দিকে। মাথা ঘুড়ছে, বাজে চিন্তা আসছে। শোয়েব আবারও বললো,
-পানি।
রিমি অস্পষ্ট করে বললো,
-পানি খাবো না।
শোয়েব কাছে এসে রিমিকে নাড়া দিলো। নাক ধরে টিপে দিতে গেলেই রিমি বললো,
-উফ! ব্যাথা… আজই নাক বিধালাম তো….
এবং বলেই রিমি প্রায় সাথে সাথেই শোয়েবকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। যেন একদম মিশে যেতে চায় সে। শোয়েব আস্তে করে বললো,
-এটা যদি কখনো তোমার আবেগ মনে হয়?
-হবে না, হবে না। আমি সিরিয়াস…. সব করতে পারবো আমি!
শোয়েব একটু সরিয়ে দেবার মত করলো। রিমি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ভারী নিঃশ্বাস ঘনঘন পড়ছে তার!
-লুকিয়ে বিয়ে করে নিবো আমরা চলুন…. আমি ভালোবাসি তো আপনাকে….
শোয়েব দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
-পরীক্ষা দিতে হবে তোমাকে। প্রুফ করতে হবে, শুধু তুমি আমাকেই চাও। যেভাবে চাইলে আমায় তোমাকে নিতে সহজ হবে। আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য সহজ হবে।
রিমির কানের দুল বিঁধছে ঘাড়ের কাছে। শোয়েব প্রায় হেঁচকা টানেই দুলটা খুলে নিলো। রিমি মৃদুস্বরে বললো,
-আহ্!
-এমনও তো হতে পারে, আমার পরিবার, অর্থনৈতিক অবস্থা, আমার চাকরি এসবের কারণেই তুমি আমাকে পছন্দ করছো। আমি চাই, কোনো কারণে নয়, শুধু আমার কারণেই আমাকে ভালোবাসো। আর ভালোবাসা মানে, ভালোবাসার মানুষটাকে স্বস্তিতে রাখা।
রিমি একটু দুরে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রবল অনুভূতিতে কাঁপছে সে। আঁচলের ভাঁজ খুলে অনেকটা নেমে গেছে; গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। চেইনের লকেট উল্টে গেছে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠেই বললো,
-আমি চলে যাবো। আমাকে একটু নিচে দিয়ে আসুন। একা যেতে পারবো না আমি।
শোয়েব এগিয়ে এসে রিমিকে পাথারে করে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। রিমি চোখ বন্ধ করে বললো,
-আমাকে কথা দিতে হবে, আমি যদি চেষ্টা করে না পারি তখন আমি যে কষ্টটা পাবো, তার সমান কষ্ট কিন্তু আপনাকেও পেতে হবে!
শোয়েব পাশে শুতে শুতে বললো,
-কষ্ট তো এখনো কম পাচ্ছি না!
রিমি এবার শোয়েবের নাক টিপে ধরলো….
-আরেকটু শক্ত করে ধরো যাতে মরে যাই। নাহলে,
আমার ইনফরমার যদি আবার ভুল খবর দেয় আমি কিন্তু রাগ করে মারবোও!
রিমি শোয়েবের দিকে এবার পেছন কাত হয়ে বললো,
-এখনি মেরে দিন। আমার তো এখন মরে যেতেই ইচ্ছে করছে।
শোয়েব গায়ের কাঁথাটা ভালো করে জড়িয়ে নিতে নিতে বললো,
-আর আমার শীত করছে।
রিমি ফিশফিশ করে বললো,
-আমি যদি রাতে এখানে থেকে যাই খুব কি ভেজাল হবে?
-ভেজাল হলেও কিন্তু সুখ হবে, তবে স্বস্তি হবেনা। আর সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো।
রিমি গভীর করে চুমু খেলো শোয়েবকে। দীর্ঘ সময় নিয়ে… হাতটা শোয়েবের বুকে ছুঁইয়ে বললো,
-আমি পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় করে আপনাকে বিয়ে করতে আসবো। অমত করলে তখন গলায় ছুড়ি ধরে নিয়ে যাবো। জোর করবো। এই এখানটায় চাবুক মেরে বলবো, নাচ ছেলে নাচ্…….
শোয়েব হেসে ফেললো। বেডসুইচটা অফ করে রিমির কানে কানে বললো,
-আজ রাতের ট্রেন শিওর মিস করবো আমি। পুরো পাগল করে ছেড়েছে আমায়…..

শোয়েবের ফোন বাজছে। পৃথিলা ফোন করেছে!
রিমি ঝপাং করে উঠে বসলো, টুপ করে বিছানা থেকে নেমে পড়লো।
শোয়েব বিরক্ত হয়ে বললো,
-আমি কি ফোন রিসিভ করেছি?
রিমির হাতটা টেনে ধরে বললো,
-কি হলো?
রিমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা বেড়িয়ে গেল।
ভালো লাগছে না তার.. কান্না পাচ্ছে, ভীষণ কান্না।
-রিমি, রিমি কাঁদছো কেন, রিমি দাঁড়াও। রি…. মি…..
শোয়েবের ঘুম ভেঙ্গে গেল। পুরো শরীর ঘেমে গেছে তাঁর।
শোয়েব বিড়বিড় করে বললো,
-খাইশটা মেয়ে, স্বপ্নেও জ্বালাবে; একটু ঘুম যদি শান্তিতে ঘুমোতে পারি…. অলওয়েজ অসম্পূর্ণ রেখে চলে যায় আমাকে….. একবার পাই সুযোগমত “লাইসটু বাইশটু খাল্লাস” করে দিবো…

পাশেই শোয়েবের ফোন বেজে চলেছে, অপরিচিত নাম্বার….. ঘুমের ঘোড়ে এই আওয়াজটাই শুনছিলো সে! শোয়েব ফোনটা হাত বাড়িয়ে নিলো…
এতো রাতে কে?

#পর্ব_১৫

-হ্যালো…
-হ্যালো, হ্যালো মি. শোয়েব বলছিলেন?
-জি
-স্যার আমি রিজওয়ান বলছিলাম। একটু প্রবলেম হয়ে গেছে স্যার! ডিএমসি থেকে বলছে এই এড্রেসে কোনো স্টুডেন্ট তাদের নেই। নাকি তাঁরা ইনফরমেশন দিতে চাচ্ছে না বুঝতে পারছি না।
-আপনি টাকা দিচ্ছেন দুজন তরুণ উদ্যোক্তাকে, নিয়মমাফিক তাঁরা সব জমা দিলেই তো হলো। স্টুডেন্ট কথাটা ইনক্লুডিংয়ের তো দরকার নেই।
-স্যার প্রফেশনে ইনফরমেশনটা লাগে। ডিটেল নিতেই ফোন করা….
শোয়েব ফোন কেটে দিলো। যত্তসব ফাজলামো। সামান্য একটা লোন স্যাংশানে দুনিয়ার তথ্য চাই এদের। শোয়েব তো ব্ল্যাংক চেক সাইন করে দিবেই, তাহলে? শোয়েব আরো মেজাজ খারাপ নিয়ে ফোন করলো রিমিকে। রিমি ফোন ধরেই বললো,
-আপার একটা ছেলে হয়েছে শোয়েব ভাই। ডাক্তার সিজার সিজার বলে এতদিন বসিয়ে রাখলো, সন্ধ্যায় ব্যাথা উঠে নরমালে হয়ে গেল। এখানের ডাক্তার বলছে, হাসপাতালে আর রাখতে হবে না। বাড়ি নিয়ে যেতে বলছে।
-কয়টায় হলো? মা-বাবু ভালো আছে?
-সাড়ে সাতটার দিকে… জানেন, শোয়েব ভাইয়া, বাবুটা না দেখতে ঠিক আপনার মত হয়েছে।
শোয়েব ঘড়ি দেখলো। এতক্ষণে বললো রিমি… একটা ফোনও তো নিজে থেকে করতে পারতো? শোয়েব যে কত চিন্তায় থাকে, মেয়েটা কি বুঝে না? গাধার মত এখন বলছে, বাবুটা নাকি শোয়েবের মত হয়েছে।
-রিমি, বাড়ি কখন যাচ্ছো তোমরা?
-এই তো সকালেই। বিল টিল সব ক্লিয়ার করে ফেলেছি… আপনি আমাকে তুমি করে কেন বলছেন শোয়েব ভাইয়া?
শোয়েব কথাটা এড়িয়ে গেল…..
-রিজওয়ান সাহেব ডিএমসি নিয়ে কি জানি জানতে চাইলো? ডিএমসি এখানে আসলো কিভাবে?
রিমি ফোন রেখে দিলো সাথে সাথে…
আর তখনি মনে হলো, জিজ্ঞেস করার দরকার ছিল মানুষটা সিলেটে নাকি ঢাকায়?

হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসবার পর থেকেই নাসিমার মেজাজ চটে আছে। কোনো কাজ তাঁর হাতে উঠছে না। শরীর অচল লাগছে। যে জিনিস তিনি অনেক আগেই মন পাথর করে মুছে ফেলেছেন, সে জিনিস কেন এত বছর পর আবার আসবে? কেন আবার? সবতো ভালোই চলছিল!
রিমি রান্নাঘরে এসেই তাড়াহুড়োর গলায় বললো,
-মা চুলো কি খালি আছে?
-তুই আমাকে কথা দিয়েছিলি, তুই তোর বাবাকে খুঁজবিনা। তাহলে?
রিমি যেন কথাটা শোনেই নি এমনভাবে বললো,
-মা এক হাড়ি গরমপানি বসাও তো, আপা গোসল করবে। বাবু ঘুমোচ্ছে এখন, এর মাঝেই গোসল সাড়বে….
নাসিমা মেয়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন।
-আমার কথার জবাব দে…
-জবাব দেওয়ার তো কিছু নেই মা। আমি কাউকে খুঁজিনি। ক্ষণিকের বিশ্রামাগারে পড়াতে গিয়ে পৃথিলাকে দেখেছি, তখন কৌতূহল হওয়াতে ঠিকানা নিয়েছি। আর তো কিছুই করিনি।
-তবে হাসপাতালে আজ কেন এলো?
-মা, লীনা ম্যাডামের কাজিন হয়। লীনা ম্যাডাম নিয়ে এসেছেন। বাট তুমি শিওর থাকো, কেউ কিচ্ছু বুঝবে না, জানবে না।
-বুঝবে না মানে? সিমিকে দেখার পর থেকেই কাঁদছিলো। খালি বলছিলো, এই বাবুটাকে দেখে আনন্দে আমার খুব কান্না পাচ্ছে কেন? সিমিকে নাকি কানে কানে একবার বলেছেও, একদম আমার মত কেন আপনি? এখন যদি নিজে থেকে জানতে পারে? যদি….
রিমির হাতে পানির জগ ছিল, মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেল। পৃথিলা যদি সত্যিই খোঁজ নিয়ে জানতে পারে? যদি এসে রিমিকে বলে, এই রিমি তুই তো আমার ছোটবোন, তুই কেন……… রিমি আর ভাবতে পারলোনা। চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।
এত কেন পরীক্ষা দিতে হয় তাকে? এত কেন সমস্যায় পড়ে সে? কই আর কেউ তো অমন পড়েনা….

ব্যাংক থেকে টাকাটা নেবার আগে রিমি খুব জড়তা নিয়ে বললো,
-রিজওয়ান সাহেব, আমরা আসলে ডিএমসির ছাত্রী না। মিথ্যে বলেছিলাম।
রিজওয়ান কথাটা শুনে মোটেও রিয়েক্ট করলোনা।বরং হাসলো ভদ্রভাবে। যেন মিথ্যে বলাটা খুব ভালো কাজ।
পুরোপুরি ফরমালভাবে বললো,
-লোন তো হয়ে গেল। আমি নিশ্চয় আমার ক্লায়েন্টের কাছে একটা কফি এখন আশা করতেই পারি?
শিউলি আড়চোখে রিমিকে না বোধক ইশারা করলো। রিমি শিউলির ইশারা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললো,
-জি অবশ্যই। আজ বিকেলেই…. আপনার পছন্দমত।
-ওকে… আমি তাহলে লেইজারের পর টেক্সট করে সব জানিয়ে দিবো……
শিউলি হেসে বললো,
-আমরা উঠছি এখন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।দোয়া করবেন। আমরা কিস্তিটা যাতে ঠিকঠাক… মানে ব্যবসাটা যাতে দাঁড়িয়ে যায়….
-ওহ শিওর অফকোর্স.. অফকোর্স….
ব্যাংক থেকে বেড়িয়ে রিমিই প্রশ্নটা করলো।
-রিজওয়ান সাহেবকে কফি খাওয়ালে সমস্যা কি?
-কোনো সমস্যা নেই। আমি আসবো না, তুই যা….
রিমি একটু মুখ ভেংচালো।
-কোনো কৃতজ্ঞতা নেই। কাজ শেষ, খোদা হাফেজ… ছিঃ…
-মালামালের লিস্টি করেছিস!
রিমি ব্যাগ থেকে কাগজটা বের করে দিলো।
-মেমো নেবার সময় কিন্তু প্রতিটা পিসের আলাদা রেটটা টোটালের পাশে কোণায় লিখিস। সহজ হবে তাতে।
-বাব্বা তুইতো দেখি পাক্কা ব্যবসায়ী হয়ে গেছিস রিমি।
রিমি বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে; কাজ আছে তার অনেক কাজ….
ফলের দোকানের সামনে গিয়ে রিমি প্রতিটা ফলের দামই জিজ্ঞেস করলো। আপাটা যে কি? সবথেকে দামের ফলগুলাই তাঁর চাই! এতোদিন ছিল নিজের দোহাই, এখন বাবুর!

রিমি বাড়িতে এসেই ছোটখাটো একটা শক্ খেলো। গাড়ি করে কে এসেছে? শোয়েব ভাই? রিমি দরজার কাছে গিয়েও ঘরে ঢুকলো না, পৃথিলা এসেছে……
হুঁহ। রিমির ভেতর থেকে একটা হাহাকার করা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। সোজা পেছন রাস্তায় গিয়ে রিমি কলতলায় বসলো। গোসল করবে নাকি শুধু হাতমুখ ধুয়ে নিবে?
নাসিমা প্রায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন।
-পৃথিলা এসেছে, সিমির বাবুর জন্য এই এত্তকিছু নিয়ে।
রিমি যেন শুনলোই না।
-সাবানটা নিয়ে আসো মা। এই যে ধরো, ব্যাগটা নাও!
নাসিমা ব্যাগ হাতেও দাঁড়িয়েই রইলেন। কাঁদছেন অনবরত….
-আমার সামনে থেকে যাও মা।
সারাদিন খেটে এসে এসব কান্নাকাটি একদম তাঁর পছন্দ না!
রিমি ধমকের স্বরে বললো,
-মা প্লিজ। কান্না বন্ধ করো…. অসহ্য লাগছে….
রিমি আসন পেতে বসে গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে বললো,
-আপার ছেলেটা মা অনেক ভাগ্যবান। এই দেখোনা, ও হবার পর আমার লোন হলো, তোমার মেয়ে ফিরে এলো, আপা খুশি, আমি খু্জে পেলাম…..
এটুকু বলে রিমি একটু থামলো। তারপর আবার বলতে লাগলো,
-বাবুটার নাম কিন্তু আমি রাখবো মা। ও’র নাম রাখবো সৌভাগ্য…. মা দুলাভাই থাকলে কি এই নামটা পছন্দ করতেন? আচ্ছা মা পৃথিলাকে আমি এখন কি ডাকবো? মেজো আপা? নাকি বড় আপা টু?
নাসিমা কোনো জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।
সাবান হাতে কলতলায় এলো পৃথিলা।
রিমি নিঃশব্দে সাবান হাতে নিলো। কত স্বাভাবিক, কত পুরোনো সম্পর্ক যেন!
পৃথিলা এগিয়ে এসে বসলো সামনের বেদিতে….
রিমি তাকালো না একবারও। মাথায় অনবরত পানি ঢালছে সে। চোখের পানি কি পৃথিলা বুঝে ফেলবে?
পৃথিলা একদৃষ্টিতে রিমির দিকে তাকিয়ে আছে। আহারে কি মিষ্টি চেহারা! গালের কোমলতা যেন ফুলের পাপড়িকেও হার মানায়… কিন্তু চোখদুটো এত ক্লান্ত কেন? এতদিনের দায়িত্ব সামলে নিশ্চয় বড় বিরক্ত সে? একা একা এই এতকিছু বইছে। পৃথিলাকে যদি বলে, এতোদিন তো তুমি ভালো থেকেছো, আমরা তো ভালো থাকিনি। তাহলে এর কি জবাব দিবে পৃথিলা?
গোসল সেড়ে রিমি সোজা বসলো তার ব্যবসার হিসেব নিয়ে। সবকিছুর একটা প্রাইমারী ছক করে নিতে হবে।
সন্ধ্যায় রিমি বের হবার সময় পৃথিলা বললো,
-আমার সাথে চলনা রিমি। কোথায় যাবি আমি নামিয়ে দিই?
রিমি জবাব দিলো না। চুল বাঁধছে একমনে সে….
পৃথিলা কয়েক সেকেন্ড রিমির জবাবের অপেক্ষায় থাকলো, তারপর সিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপা যাই, তুই কিন্তু বাবুকে হাতের উপর নিয়ে ঘুমাবি না! খবরদার!
রিমি মৃদুস্বরে পিছন ডাকলো,
-পৃথিলা ম্যাম, আপনার খুব বেশি সমস্যা না হলে থেকে যান না রাতে। আজ বাবুর নাম রাখা হবে।
পৃথিলা অবাক দৃষ্টিতে রিমির দিকে তাকালো। রিমির চোখ ছলছল করছে কিন্তু ভাবভঙ্গি বড় নির্লিপ্ত! তার ইচ্ছে করছে, সে এক্ষুণি রিমিকে জড়িয়ে ধরে বুক ভাসিয়ে কাঁদবে।
রিমি চোখের কোণার জলটা সাবধানে ওড়নায় মুছতে মুছতে বললো,
-এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? হুট করে তো… আপা বলতে লজ্জা করছে আমার!
পৃথিলা আর একমুহূর্তও দাড়ালো না সেখানে।
রিমি রেস্টুরেন্টে এসে দেখে রিজওয়ান বসে আছে।
-আমি কি দেরি করে আসলাম?
-না না, ইউ আর অন টাইম ম্যাডাম। আমি আগে চলে এসেছি বরং!
রিমি ব্যাগটা সাইড করে রেখে একটু আরাম করে বসলো। রিজওয়ান নিজেকে স্বাভাবিক করছে। এখনো তাঁর দৃষ্টি ফোন স্ক্রিনে।
রিমি ওড়নার কোণটা আঙ্গুলে গোছাচ্ছে, কিভাবে শুরু করবে সে?
(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here