#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৮_ও_১৯
#পর্ব_১৮
রিমি লুকিয়ে প্রায় বেরিয়েই যাচ্ছিলো, ম্যানেজার সাহেব পথ আটকালেন।
-ম্যাম, শোয়েব স্যার বলেছেন দেখা করে যেতে। আমাকে এখানে বসিয়ে রেখেছেন, আপনি যাবার সময় যাতে…..
রিমি জোর করে ভদ্রতার হাসি হাসলো! আজ তার রক্ষা নেই আর….
রিমি ঘরে এসে দেখে শোয়েব ঘরে নেই। বাথরুমে, পানির শব্দ আসছে…
রিমি যেই না বিছানার একপাশে বসতে গেল শোয়েব ডাকলো।
-এই যে ম্যাডাম, আমি এদিকে। বাথরুমের দরজা খোলাই, আপনি এখানে এসে কথা বলতে পারেন।নাহলে ২মিনিট বসুন আমি গা মুছেই আসছি!
রিমি জবাব দিলো না। ১মিনিটও গেল না, শোয়েব বেরিয়ে এসেছে। গা ভর্তি সাবান, তোয়ালে পরনে।
রিমি তাকাতে গিয়েও তাকালো না। মানুষটা যে কি! এই অসময়ে গোসল করছে। অন্তত গায়ে পানি ঢেলে সাবান ধুয়ে তো আসবে? রিমি তো বসেছেই।
মাথার সাবানের ফেনা শোয়েব হাত দিয়ে আরও জেদ করে যেন মাখাচ্ছে। রিমির যে কি আনইজি লাগছে, উফ্!
শোয়েব প্রায় চিৎকার করেই বললো,
-আমাকে পৃথিলাকে বিয়ে করতে হবে? আমার বিয়ে নিয়ে ভাবার মহান দায়িত্ব নিয়েছো? ফাজিল বেয়াদব মেয়ে! তাছাড়া আমি তোমার কথা শুনবো কেন?
আমার ফোন নাম্বার ব্লকড! আমি কি এত জ্বালাই তোমাকে?
রিমি জবাব দিলো না।
-পৃথি কার বোন, কার কি এসব দেখার কোনো দরকার আমার আছে কি? আমাকে এভয়েড করা! ইতরামি আমি বের করবো তোমার!
মাথা নিচু করে আছে রিমি। ইশ্ মানুষটা যে এত ঝারি ঝুরি দিয়ে কথা বলছে, যদি পরনের তোয়ালেটা হঠাৎ খুলে পরে যায়…… উফ্ তখন কি হবে?
-কি হলো? আমি কি এতই ডিস্টার্বের কারণ? অন্য নাম্বার থেকে ফোন করলে রিসিভ করেই কেটে দেওয়া, এসব কি?
এইবার রিমি কথা বললো,
-খুব অল্প ফোন করেন। আবার যখনি করেন, পৃথি সামনে থাকে নয় আমি ব্যস্ত! তাই…..
-নিজে থেকেও তো একটা ফোন করা যায়? আমি কি খাই না খাই, কিভাবে থাকছি মেসেজ লিখলে উল্টাপাল্টা উত্তর এসব কি?
শোয়েবের রাগঝরা কণ্ঠ! রাগ আরও বেশি লাগছে কারণ রিমি তাঁর দিকে তাকাচ্ছে পর্যন্ত না। এই যে শোয়েবের ফর্সা বুকটা। এর আগে তো শোয়েব কাউকে ইচ্ছে করে দেখায়নি! এই যে শোয়েব এখন জিম করছে, তাকালে কি হয়? পিঠের দিকে অনেকগুলো তিল আছে শোয়েবের, একটু ছুঁয়ে দিলে কি হয়? হুহ…
এই মেয়েটা যে কি? ইচ্ছে হলে চুমু খেয়ে মাখামাখি নাহলে তাকাবেও না। শোয়েব কি একটা চড় দিবে আস্তে করে?
-গতকাল রাতে এসেই তোমাদের বাড়ি গেলাম, পৃথিলার গাড়ি দেখলাম… ফেরত এলাম। পৃথি কি রোজই যায়?
রিমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
-ওহ বোনের সাথে ঐক্যজোট বাঁধা হয়েছে। মা কি আদর করে ওকে?
রিমি আবার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। শোয়েব সাবান মাখা গা নিয়েই রিমির গা ঘেঁষে বিছানায় বসলো। রিমি নড়াচড়াও করলো না।
চাপা আওয়াজে বললো,
-বিছানায় সাবান লাগছে, সারা ঘর মাখামাখি। আপনি গোসল সেড়ে আসুন। আমি বসছি।
-আমার ঘর, আমার বিছানা, আমার ইচ্ছা, সব আমার, তোমার কিছু? তোমার কি?
রিমি কান চেপে ধরলো। এত কেন চেঁচাচ্ছে মানুষটা।সবাইকে শুনিয়েই ছাড়বে।
-রিজওয়ান গাধাটা কি ফোন করা বন্ধ করেছে?
রিমি তৃতীয়বারের মত হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো।
-এখন বোনের জন্য আমি ক্যানসেল। ভালোই তো?
মরে যাই আমি তাহলেই সবার শান্তি…. তাহলেই সবাই শান্তিতে বিজনেস করবে।
রিমি এবারও যথারীতি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো! এবং তারপরই জিভ কাটলো। ইশ ভুল হয়ে গেছে….
-আসলে না মানে…
শোয়েব রাগে কিরকির করতে করতে গিয়ে দরজা আটকালো। রিমি ঘামছে।
-আমি আসলে, কথার মারপ্যাঁচে…
রিমির কথা শেষও হলো না, শোয়েব এসে প্রায় ঝাপিয়েই পড়লো, একহাতে রিমির গলা চেপে ধরে বিছানায় শুইয়ে ধরে মুখটা খুব কাছে নিয়ে বললো,
-মরে গেলেই খুশি। সত্যিটা বেরিয়ে এলোতো। আমি মরে গেলে তোমাকে রেখে যাবো ভেবেছো? এখন বোনের জন্য আমাকে বিদেয় করে দেয়া হচ্ছে?
রিমি চোখ বন্ধ করে আছে। লজ্জায় তার অস্তিত্ব মিশে যাচ্ছে। মানুষটা এত কাছে, তার নিঃশ্বাস পড়ছে রিমির মুখে। মানুষটা যে রেগে ছিল রিমি জানতোই, কিন্তু এরকম পাগলামি করবে ধারণাও করেনি।শোয়েব গলা ছেড়ে এবার রিমির চুলের বিণুণি টেনে ধরলো।
-লাগছে আমার। বেণী টান পড়ছে। সব চুল ছিড়ে গেল…. মাগো…
-ছিড়ুক। তুমি দুনিয়ায় জীবিত থেকে বল খেলবে, আর আমি মরে গিয়ে তারা হয়ে তা দেখবো, তাতো হয় না। সেদিন ওভাবে চুমু খেয়ে আমার মাথা নষ্ট করে দেবার কি দরকার ছিল? স্বার্থপর মেয়ে, বোনের জন্য এখন… এই দুটো মাসে মিস করতে করতে জীবন শেষ আমার! এমনিতেও বাঁচবো না মনে হচ্ছে।
রিমি চোখ বন্ধ করেই হেসে ফেললো।
-সাবান লাগছে গায়ে…. ইশ্। ছাড়ুন।
শোয়েবকে ধাক্কা দিয়ে রিমি উঠে দাঁড়ালো। শোয়েব দাঁড়িয়ে থেকেই রিমিকে আবার টেনে জড়িয়ে ধরলো। বাঁ হাতে কোমরের পেছনটায় ধরে রিমির নাকটা ধরে সোজা করলো।
-বিয়ে করবো, আজকেই, আজকেই, আজকেই…
-আমি করবো না।
-কেন?
-আমি তো আপনাকে পছন্দ করি না! তাছাড়া কোনো সম্পর্কও নেই আমাদের।
শোয়েব গালের থেকে সাবান নিয়ে রিমির চোখের পাতায় মাখিয়ে দিলো,
-উফ্ চোখ জ্বলছে আমার! আহ্…
-এবার সম্পর্কের কিছু মনে পড়ছে?
রিমি না তাকিয়েই স্পষ্ট স্বরে বললো,
-কিচ্ছু মনে নেই আমার!
রিমি সেদিন যে কাজটা করেছিলো, শোয়েব সেই কাজটাই করলো।
-এবার মনে পড়েছে রিমি আপু? নাকি মাথায় কঠিন আঘাত করতে হবে?
-আমি এমন কিছুই করিনি যে মনে থাকবে।ছাড়ুন।
-তাহলে আমি করে দিই?
রিমির জামার পেছনের চেইনটা খুলতে খুলতে শোয়েব আবার বললো,
-আমি খুবই খারাপ মানুষ রিমি। তুমি হয়তো ভেবেছো, কিছুই বুঝিনা আমি। কষ্ট কতভাবে দেয়া যায় সব আমি জানি। আমাকে নিয়ে খেলা?
শোয়েব আরও শক্ত করে রিমির কোমরটা টেনে নিলো। কাঁধের কাছের হাতের দিকে রিমির জামাটা টেনে নিচে নামিয়ে বললো,
-বিয়ে করতে কি বলতে হয়? তুমি আমার বৌ; কবুল, কবুল, কবুল! আর কি মোহরানা? এই যে এটা…
রিমির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে! ঠোট কাঁপছে; কপালে ঘাম, বেঁহুশ হয়ে গেল নাকি?
শোয়েব চিন্তিত ভাবে বললো,
-কি হয়েছে রিমি? রিমি? রি..মি.. এতটুকুতেই গলা শুকিয়ে গেল? আমাকে তো অনেক কিছু করা হলো, আমি কি ভয় পেয়েছি?
রিমি অস্পষ্ট আর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
-আপনার তোয়ালে খুলে পড়ে গেছে। ছাড়ুন আমাকে, চোখে পানি দিবো।
শোয়েব রিমিকে ছেড়ে দিয়ে কয়েকসেকেন্ডের জন্য চুপ। রিমি দু-হাতে মুখ ঢেকে থরথর করে কাঁপছে তখনো।
শোয়েব শুকনো একটা ঢোক গিলে নিয়ে তোয়ালেটা উঠিয়ে নিয়ে পরতে পরতে বললো,
-খুললে খুলেছে। আই ডোন্ট কেয়ার! আমি কি মেয়ে নাকি যে লজ্জা পাবো?
রিমির সারা শরীর সাবানে মাখামাখি। রিমি ওড়নায় মুখ মুছতে মুছতে বললো,
-পাগল হয়ে গেছেন আপনি! দাঁড়ানোর কোনো খেয়াল নেই। হুঁশজ্ঞান নেই। আমার ডান পায়ের পাতা ভর্তা করে ফেলেছেন।
রিমি বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানিরছিটা দিলো। শোয়েব দরজায় দাঁড়িয়ে বললো,
-তোমার গায়ে জ্বর নাকি রিমি? গা গরম লাগলো…
রিমি জবাব দিলো না।
রেহেনা দরজায় নক করলেন।
-শোয়েব, শোয়েব… দরজাটা খোল তো….
বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে শোয়েব খুব স্বাভাবিক ভাবেই দরজা খুললো।
-নিচে আয়। পৃথিলা এসেছে, ও’র রেজাল্ট বেড়িয়েছে। খুব ভালো করেছে নাকি। কিরে তুই এমন সাবান গায়ে? ঠান্ডা বসে যাবে তো বুকে… গোসল সাড়….
-যাও তো মা….
শোয়েব দরজা বন্ধ করে আবার রিমির কাছে এসে দাঁড়ালো।
রিমি ততক্ষণে মুখ মুছে নিয়ে জামার বিভিন্ন জায়গার সাবান মুছছে। শোয়েব আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললো,
-তুমি ঠিক যেভাবে বাঁচতে চাও সেভাবেই বাঁচবে। আমি কখনোই কিছু আলাদা করে চাইনা তোমার কাছে। কেন বুঝোনা কত কষ্ট হয় আমার? কত রাগ!এসব ভাল্লাগেনা আমার। তুমি কেন এত শক্তের মত হয়ে আছো?
রিমি এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।
কাঁদতে থাকলো অনবরত!
ব্যাকুল কণ্ঠে বললো,
-আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা। ব্যাংকের টাকা নিয়ে বিজনেস শুরু করলাম। মাসখানেক পরে শুনলাম, টাকাটা নাকি কেউ একজন দিয়েছে। নাম বলছে না কিছু। শুধু বলছে, কিস্তি লাগবে না। দু-বছর পর এককালীন শোধ দিতে হবে। ব্যাপারটা শুনেই মন দুর্বল হয়ে আছে। যদি পৃথিলা বা বাবা দিয়ে থাকে? টাকা-পয়সা সব খরচ! আমি কোথা থেকে ফেরত দিই এখন? দিনরাত এক করে কাজ করতে হচ্ছে! টাকার ব্যাপারে সরাসরি কথা বলতেও সাহস পাচ্ছি না। যদি বলে, পৃথি দিয়েছে? আচ্ছা, পৃথিকে টাকা ফেরত দিতে গেলে যদি বলে,
তুই তো আমার এর থেকেও দামী জিনিসগুলো নিয়েছিস, ফেরত দিতে হলে সব ফেরত দে।
শোয়েব এগিয়ে গিয়ে রিমিকে জড়িয়ে ধরলো।
রিমির কান্না দ্বিগুণ হয়ে গেল।ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো,
-আপাও চলে যাবে বলছে ও’র সাথে। আমি কি করবো? কিছুই মাথায় আসছে না।
-তুমি ওকে বাড়ি আসতে দিচ্ছো কেন? না বলছো না কেন? এই সংসার এতদিন ধরে তুমি টানছো…..
-আমি তা করতে পারবো না! আপনি বরং পৃথিলাকে বিয়ে করে ফেলুন। তাহলেই সব মিটে যায়। সবাই আমায় খারাপ ভাবছে….
শোয়েব আবারও রেগে গেল।
-তোমার সমস্যা মিটাবার জন্য আমাকে কয়টা বিয়ে করতে হবে শুনি?
-মানে?
-মানে হলো, একটু আগে তোমায় বিয়ে করলাম। এখন পৃথিকে বলছো! দুদিন পর বলবে, সিমি আপাকে করুন। ও’র বাচ্চার তো বাবা নেই, আপনি বাবা হোন….
রিমি চমকে তাকিয়ে চোখ মুছলো। শোয়েবের থেকে দূরে দাড়িয়ে বললো,
-আমায় কখন বিয়ে করলেন?
-কেন, একটু আগেই তো। আবার মিথ্যে?
রিমি হতাশ চোখে তাকিয়ে বললো,
-সব কি অত সহজ? আমার জন্য কখনোই কোনো কিছু সহজপথে নেই…. জীবনের পুরো পথটাই জটিল!
শোয়েব রিমির হাত দুটো ধরে নিয়ে বিছানার পাশে ডিভানে বসিয়ে দিলো। নিজের দু-হাত দিয়ে রিমির দু-হাত শক্ত করে ধরে বললো,
-জীবনেরপথে নামলে পথই পথ দেখায়। সেই পথে তোমার যাস্ট শুরু রিমি। তুমি একবার মন দিয়ে শক্ত হয়ে দেখো; সব অনেক সহজ হয়ে গেছে। তোমার যা সত্যিকারের প্রাপ্য তা তুমি পাবেই। আমি আছি তো, থাকতে চাই পথের সাথী হয়ে।
-যদি না পাই সেই প্রাপ্যটা?
-হতেই পারেনা। তবে এমন হলে আমি ভাববো, এর থেকে ভালো কিছু তুমি হয়তো পেয়ে গেছ…
রেহেনা আবার দরজায় ডাকছেন। শোয়েব অপলক রিমির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ডানচোখের উপর এক গাছি এলোমেলো চুল এসে পড়েছে…. অশ্রুভেজা, ক্লান্ত দুটি কৌতূহলী চোখ। ও চোখে কি আছে? এত কেন টানে শোয়েবকে? ও চোখের দিকে তাকালে কেন শোয়েবের ছোটবেলার গল্প বলতে ইচ্ছে করে? কেন ইচ্ছে করে, শোয়েবের সব ব্যর্থতার গল্পগুলো ইনিয়ে বিনিয়ে শুনিয়ে দিতে?
রিমি মৃদু হাসলো।
-কাউকে তার ভালো সময়ে অভিনন্দন না জানালে সেটা দৃষ্টিকটু। আপনি যান।
শোয়েব উঠে দাঁড়ালো।
-আমি এখন গোসল করবো। কোথাও যেতে পারবো না।
বাথরুমে যেয়ে শোয়েব আবার মুখ বাড়ালো।
-টাকাটা তোমাকে পৃথি দেয়নি, সো এত অনকম্ফর্টেবল হতে হবে না। যে দিয়েছে, তার তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। অন্ততপক্ষে তার স্বপ্নটা ভেস্তে দিও না।
-তার মানে যে দিয়েছে সে আপনাকে আগেই বলেছে?
-পরে বলেছে। তুমি কিন্তু এখন কোথাও যাবেনা, ফ্রেশ হয়ে আমরা ডিনারে যাবো।
রিমি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এত কেন ঋণ তার? এত টাকা শোধ করতে করতেই তো সে বুড়ি হয়ে যাবে?
রিমি বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে বললো,
-আপার বাবু হবার সময় যে টাকাটা দিয়েছিলেন, তা কি ফেরত দিতে হবে?
শোয়েব চেঁচিয়ে জবাব দিলো,
-তোমার যদি এটা ধার মনে হয়, অবশ্যই ফেরত দিতে হবে…..
রেহেনা আবার এসে দরজায় দাঁড়ালেন!
-শোয়েব কোথায় রিমি? পৃথি ঘরে আসতে চাইছে…
রিমি জবাব দিলো না। রেহেনার সাথে তার একটা নীরব দৃষ্টি বিনিময় হলো শুধু……
রিমি তারপরই বেরিয়ে গেল।
#পর্ব_১৯
বাড়িতে এসেই রিমি দেখলো নাসিমা বারান্দায় বসে আছেন।
-বারান্দায় কেন মা? তাও আলো নিভিয়ে?
-তোর জন্যই বসে ছিলাম। রান্না করতে গিয়ে দেখি, শরীর খারাপ লাগছে। এসে বসলাম এখানে।
রিমি কাছে এসে মায়ের গায়ে গলায় হাত বুলালো।
-কই, জ্বর টর তো নেই? প্রেশার নয়তো? ডাক্তার দেখিয়ে আসি, চলো।
নাসিমা না সূচক মাথা নাড়লেন।
-ডাক্তার লাগবে না। আরেকটু দেখি। তুই বরং রান্নাটা শেষ কর। অর্ধেক রেখে চলে এসেছি।
জুতোটা খুলে রিমি আপার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো, সিমি ঘুমিয়ে আছে। রিমি ব্যাগ রেখে কলতলায় চলে গেল। শরীরটা এখন আরো খারাপ লাগছে তার। ঘাড়ে ব্যাথাও করছে। হাতমুখ ধুয়ে এসে রিমি মাকে ডাকলো।
-রান্নাঘরে এসে বসো তো মা। বারান্দায় দুমিনিট পরপর গিয়ে তোমার খোঁজ নিতে পারবো না।
নাসিমা রান্নাঘরে এসে বসলেন। রিমি চা বানাচ্ছে….
তার জামার পেছনের চেইনটা খোলা কেন? সাদা সেমিজ দেখা যাচ্ছে। ইশ্ মেয়েটার কিছুই খেয়াল থাকেনা।
-তোর জামার চেইনটা খোলা যে রিমি….
রিমি বিস্মিতভাবে পিঠে হাত দিলো। হ্যাঁ তাইতো…. এভাবেই তো সে রিক্সা করে বাড়ি এলো…. রিমি টেনে চেইন বন্ধ করলো।
-বুড়ো হয়ে গেছি, বুঝলে মা! কিচ্ছু মনে থাকে না ।
রিমি চায়ের কাপটা মায়ের হাতে দিতে দিতে বললো,
-মা রান্নার একটা লোক রেখে দিই? আমাকে দোকানে সময় দিতে হয় অনেক। প্যাকিং, ডেলিভারি, অনেক ঝামেলা।
নাসিমা জবাব দিলেন না। তাঁর এই এত বেখেয়ালি মেয়েটার সব জিনিসেই সজাগ দৃষ্টি, শুধু নিজের প্রতিই মনোযোগ দিলো না কোনোদিন। হুহ……
নাসিমা চায়ে চুমুক দিলেন। রিমি চুলো জ্বালালো।
-মা চুপচাপ কেন? বেশি শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তার বাড়িতে বলি?
-তোকে আজ খুব সুন্দর লাগছে রিমি। চেহারা খুলে গেছে।
রিমি জবাবে কিছুই বললো না।
নাসিমা আয়েশ করে বসলেন। চোখ বন্ধ করে কথার সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
-তোর রান্নার ফাঁকে একটা গল্প শোনাই। শুনবি?
রিমি মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। ব্যাথাতুর অনিচ্ছার হাসি।
নাসিমার বুকের ভেতরটা যেন দুমরে মুচরে গেল।মেয়েটাকে তাঁর অনেক কথা বলার আছে। সিমি চলে গেলেও যাতে মেয়েটা শক্ত থাকতে পারে! সাহস দরকার খুব।
চায়ের কাপটা রেখে নাসিমা রিমির আরেকটু কাছে এসে বসলেন।
-সিমিরা হবার পর থেকেই তো আমার প্রস্রাবের সমস্যা হলো বুঝলি? সারাক্ষণ পাতলা সুতি কাপড় ভাঁজ করে পরে থাকতে হয়, বদল করে ধুয়ে দিই।তখন প্যাড কেনার সামর্থ্য কই? সবসময় পরিস্কার থাকার চেষ্টা করি। তাও তো বুঝিস, প্রস্রাবের একটা বিকট গন্ধ যেন গায়ে গায়ে থাকেই। তোর বাবা আলাদা বিছানায় ঘুমানো শুরু করলেন। আমায় খুব দরকার নাহলে কাছে ডাকতেন না। কালে ভদ্রে স্বামী সম্পর্ক হতো আমার।
রিমির গল্প শুনতে বিরক্ত লাগছে। পাবলিক ডিল করে করে কারো কথা শুনতে তার আর ভালো লাগেনা। এত নোংরা কষ্ট কেন তার জীবনে? যত্তসব!
-তোমার গল্প শুনবো না মা, তুমি বারান্দায় বসো গিয়ে। যাও… শরীর খারাপটা আরো বাড়বে বরং…
রিমিকে অগ্রাহ্য করে নাসিমা বিলাপের সুরে তাও বলতে থাকলেন।
-কিন্তু আমার তো কাতর মন বুঝলি। বয়সও কম….
আমি করলাম কি রাতে মাঝে মাঝে সেঁধে যেতাম তোর বাবার বিছানায়; জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করতো।পাশে ঘুমোতে মন চাইতো। দুটো বাচ্চা নিয়ে রাতে একা শোয়া যে কি কষ্টের! কিন্তু আমি শুতে চাইলেই, তোর বাবা চেঁচামেচি করতেন। মাঝে মাঝে তো এমন চেঁচাতেন, প্রতিবেশীরা শুনতো। আশেপাশের ভাবীরা প্রায়ই নাক সিটকিয়ে আমাকে বলতো, মেয়ে মানুষ, জামাই যেন জীবনে দেখেনি… শোওয়ার জন্য কত পাগল! সে যখন চায় না সেঁধে যাওয়া কেন? আমাদের স্বামীরা তো আমাদের পায়ে ধরে নিয়ে বিছানায় শোয়। এই এত সুন্দর দেখতে আমি! এই একটা অসুখে সব সুখ চলে গেল জীবন থেকে। তুই যখন হলি, আমি তোকে ভালো করে শুকতাম মাঝে মাঝে। আমার জরায়ুতে হয়েছিস… বাজে গন্ধ নেই তো আবার? কিন্তু না, তোর গায়ে কি সুন্দর মিষ্টি গন্ধ! আমি নিশ্চিন্ত হলাম।
নাসিমা জোরে জোরে শ্বাস ফেলে কাঁদছেন। ঘামে আর চোখের পানিতে বুকের আঁচল ভিজে গেছে তাঁর।
রিমি তরকারিতে ধনেপাতা ছড়িয়ে দিলো। কি সুন্দর ঘ্রাণ!
রিমি এগিয়ে এসে নাসিমাকে জড়িয়ে ধরলো।
-মা তোমার শরীরে অনেক মিষ্টি গন্ধ জানো? ধনে পাতার মত, তোমায় খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে মা।
নাসিমা মেয়ের চুলে হাত বুলালেন।
-মানুষ বলে না, শারীরিক সম্পর্ক কিছু না, মনের সম্পর্কই আসল! ভুল বলে জানিস? বড় ভুল বলে। শরীর অনেক সময় পুড়িয়ে তোকে শেষ করে দিবে। আর শরীরই যদি না থাকে মন তো নেই-ই। তোর বাবা বাড়ি থেকে যাবার পর, আমার শরীর মন দুই-ই আরাম পেলো। রাতে তোরা দুজনে ঘুমিয়ে পড়লে, আমি রান্নাঘরে এসে পা ছড়িয়ে বসে পড়তাম। এই আঁচল ফেলে দিয়ে বুকে ধুপধাপ কিলিয়ে চিৎকার করে কাঁদতাম। কি যে শান্তি পেতাম জানিস? কি যে প্রসন্নতা… আহা কান্নায় এত সুখ! মাঝে মাঝে তো ফ্লোর গড়িয়ে কাঁদতাম।
-এরকম তো আমার মাঝে মাঝেই হয় মা। কিছুই ভালো লাগেনা। হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে, কাঁদতে ইচ্ছে করে।
রিমির কণ্ঠে রাজ্যের অসহায়ত্ব!
-জানিস রিমি, তখন খালি মনে হতো যখন সুস্থ ছিলাম, তখন কেন তোর বাবাকে বেশি করে জড়িয়ে ধরে শুলামনা। কেন বেশি করে আদর করে নিলাম না? কেন?তোর বাবা তখন তো আমার আঁচল ধরে ঘুড়ে বেড়াতো। আমিই বিরক্ত হতাম…..
রিমির চোখের জল বাঁধ মানছেই না।
-তোমার কি বুদ্ধি মা! এত গুছিয়ে কথা বলো! আমায় কেন এসব বলো? নিতে পারিনা… মা অপারেশন করাবে? একটা চেষ্টা করে দেখি? সুস্থ তো হতেও পারো।
-এই অসুখটাকে এখন আমি ভালোবেসে ফেলেছিরে রিমি। থাক না…
-আমার যেদিন অনেক টাকা হবে আমি সেদিন বাংলাদেশের সবথেকে বড় সার্জনকে ডাকবো। নিয়ে যাবো তোমাকে…
-তখন কি আর লাভ হবে রিমি? সময়েরটা সময়ে না পেলে পরে দরকারই হয় না। এই যেমন তুই, ঠিকঠাক কিছুই পাস না। এখন দেখ, নতুন কেউ এসে জুড়ছে সব… এই জন্যই তোকে বলছি, যে প্রাপ্য সুখটা তুই সামনে পাবি, প্রাণখুলে দু-হাতভরে নিবি। এমন তো পরে নাও পেতে পারিস। সময় কাউকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় নারে রিমি। যখন যেটা তোর কাজের সম্মানী, তোর যোগ্যতার অর্জন হাত পেতে নিবি। কোনো ছাড় নেই…
রিমি মায়ের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-তোমার সব রূপ নিয়ে জন্মালাম আমি। সব আমায় দিয়ে দিলে। এই রূপ তো আমি চাই না। কষ্টটা দিতে, ওটা নিয়ে জন্মালে শেয়ার হতো কিছুটা…
নাসিমা নিঃশব্দে রিমির দিকে বোবা দৃষ্টি মেলে চেয়েই রইলেন। মনে মনে বললেন, তুই হচ্ছিস এই পৃথিবীতে আমার পাওয়া শুদ্ধতম উপহার! এই উপহারটা দেবেন বলেই হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমায় কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা নিয়েছেন। তোর জন্য আমার সব পূণ্য কাজের বিনিময় আমি বিধাতার কাছে চেয়ে রেখেছি। সাত পৃথিবীর শান্তি যেন তোর জীবনে আসে…
রান্না শেষের দিকে। রিমি সব গুছিয়ে নিতে থাকলো। সিমির বাবুর কান্না শোনা যাচ্ছে, উঠেছে বোধহয়! নাসিমা আড়মোড়া ভাংতে ভাংতে বললেন,
-কথা বলে বলে ক্ষিধে লেগে গেছে। ভাত বাড় রিমি….
রিমি সিমিকে ডাকলো।
-আপা, তুই মায়ের সাথে খেয়ে নে। আমি বাবুর কাছে বসছি।
-আমি ওঘরে যেতে পারবোনা এখন। একটু কষ্ট করে এখানে দিয়ে যা না…. রিমি।
রিমি মহাবিরক্তি নিয়ে সিমিকে ভাত দিয়ে গেল।
-বাবুর আকীকাটা কবে করবি? তুই তো দেখি কিছুই বলিস না ইদানিং। আস-যাস, চুপচাপ। এত ব্যস্ত? কিরে?
রিমি জবাব দিলোনা। মুখ ভেংচালো শুধু!
সিমি হাত ধুয়ে ভাত খেতে বসলো। রিমি বাবুকে কোলে করে রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগলো,
-ওকে রান্নাঘরে নিস না রিমি। কত জীবাণু, মসলার ঝাঁঝ… তুই তো হাতটাও ধুয়ে নিস নি ঠিকঠাক। উফ্…
রিমি মুখ বেঁকিয়ে বললো,
-লাগুক ঝাঁঝ। তোর ছেলে তো আর এদেশের রাজা না যে সারাক্ষণ সুখে সুখে থাকবে। একটু জীবাণু টীবাণু খাক না…..
সিমি রাগে গজগজ করতে থাকলো।
রিমি বাবুর নাক টিপে টিপে বলতে থাকলো,
-তোর পঁচা মা। আমি ভালো খালা বুঝলি? তোর যে খালু হবে…
রাতে রিমি মায়ের সাথেই শুলো। বিছানায় শুয়েই
বললো,
-চুলে বিলি কাটবে না মা খবরদার। প্যাঁচ লেগে যায়। আর নো কথা…. ঘুম এসেছে আমার!
এবং আশ্চর্যরকম ভাবে সেইরাতে ঘুমিয়ে সে চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখলো… ঘুম ভাংলো রাত সাড়ে তিনটেয়….
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা