রোদ্দুরের_বৃষ্টি #পর্ব_২০

0
317

#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_২০

ঘুম ভাঙবার পরই রিমি বিছানা থেকে নেমে মোবাইলটা হাতে করে বারান্দায় এলো। স্বপ্নটা দেখে তার ভালো লাগছে। অসম্ভব ভালো লাগছে। স্বপ্নটা কাকে বলা যায়? শোয়েব ভাই কি জেগে আছে না ঘুমিয়ে? আচ্ছা, ঘুমোলে কি উনি নাক ডাকে? রিমি শোয়েবের ফোন নাম্বারটা আনব্লক করলো। রাগে মানুষটা আবার না কোনো কাহিনী ঘটিয়ে ফেলে!
নাম্বারটা ওপেন করার পাঁচমিনিটও গেল না, শোয়েব কল দিয়েছে। ফোন ধরে রিমি চুপচাপই রইলো। বুক ধুকপুক করছে তার। শরীর কাঁপছে। এমন স্বপ্ন সে কেন দেখলো?
কথা বললো শোয়েব।
-এতক্ষণ অপেক্ষা করালে রিমি? বলে গেলে কি হতো? মাকেও তো বলে যেতে পারতে? আমি ডিনারে যাবো বলেছিলাম।
শোয়েবের কণ্ঠে একরাশ অভিমান।
-আপনি এতক্ষণ জেগে ছিলেন?
-জেগে ছিলাম না শুধু, কাটা মুরগির মত ছটফট করছিলাম। তোমাদের বাড়িতেই তো আসতাম। কিন্তু… আজই বিয়ে করলাম, আজই আমার বৌ না বলে চলে গেল, আমার কি দুঃখ! কে কোথায় আছো? বাঁচাও… তুমি কেন এরকম কথা শুনো না রিমি? কেন?
রিমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখতেই শোয়েবের প্রশ্ন এড়িয়ে গেল।
-আপনার ছুটি কদিন? সিলেট কবে যাচ্ছেন?
শোয়েব চুপ করেই থাকলো।
-কি হলো?
-ঠিক ছুটি না রিমি, একটা অন্য কাজে এসেছি।
রোববার চলে যাবো। কেন? বাসর রাতের জন্য? তুমি বললে আমি আরো থাকবো দুদিন। তুমি এখন বৌ হয়েছো আমার, তোমার এখন অনেক অধিকার রিমি। রাগ করার, ভুল বুঝবার! দেখেছো, রিমি বিয়ে কত চমৎকার একটা প্রটোকল মেয়েদের জন্য! বিয়ের মাধ্যমে অলিখিত অথচ কত সুস্পষ্টভাবে সব অধিকার বৌদের হাতে চলে যায়।
-ঢং একটা আপনি! কি খালি বিয়ে, বিয়ে, বিয়ে! বিয়ে একপক্ষ কবুল বললেই হয়ে যায় না…. বিয়ে এত সমান্য ব্যাপার না, জোর করে গলা চেপে ধরে নিজে কবুল বলে ফেললেই হয়না শোয়েব ভাই। সাক্ষী লাগে, নিয়ম আছে! আর তাছাড়া, এই একটা…
-কবুল তো দুইপক্ষই বলেছে রিমি। আমি তো জানি রিমি তুমি মনে মনে লক্ষবার কবুল বলো। সৃষ্টিকর্তাও জানেন সেটা। লোক দেখানো বিয়ের কোনো মানে নেই রিমি। বিয়ে সম্পূর্ণ মানসিক ব্যাপার! মানলে বিয়ে, না মানলেও বিয়ে। আর ঘটা করে যে বিয়েটা করবো, তার জন্য তো তোমার ফুরসতই নেই। গামছা বিক্রি, জামা বিক্রি, রান্না বান্না। একটা ডিসির মত ব্যস্ত তুমি…. যত্তসব।
রিমি জবাব দিলো না। চোখের কোণে আনন্দের অশ্রু চিকচিক করছে তাঁর!
-রিমি, কি হলো? রি…..
-আমার এখন একটাই লক্ষ্য শোয়েব ভাই! বিজনেস, বিজনেস, বিজনেস… বিয়ে ফিয়ে এখন সম্ভব নয়…
-বিয়ের জন্য কি তোমার বিজনেস ভেসে যাচ্ছে? তুমি কি ভেবেছো আমি কিছু বুঝিনা? তোমার ভয়টা আসলে অন্য জায়গায়… তুমি আসলে ভাবছো…
-আমার মনে হয় পৃথির সাথে আমাদের একবার কথা বলা দরকার। ও আপনাকে খুব পছন্দ করে… ও ভুল বুঝছে খুব! তাছাড়া…

শোয়েবের মন খারাপ লাগলো। রিমি কেন এত পা ফেলতে ভয় পায়? যে সম্পর্ক সে এতদিন জানেই নি, কোনো অনুভবেই ছিল না, আজ এতদিন পর সে এই সম্পর্ককে কেন গুরুত্ব দিয়ে নিজে পিছু হটতে চাচ্ছে।পৃথি বলে কেউ তো তাঁর দুঃখকষ্টের জীবনে ছিল না।
শোয়েব তো কখনোই কাউকে চায়নি। এমনকি রিমির সাথে তাঁর প্রথম দেখাটাও ঠিক করে হয়নি। অথচ রিমির জন্য তাঁর ভেতর কেমন করে জানি সবসময়! ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়। তৃষ্ণা পায়। পানি খেলেও সে তৃষ্ণা যায় না। বুক ভরে শ্বাস নিলেও যেন তৃপ্তি হয় না।অথচ রিমি গুটিয়েই রাখছে নিজেকে। রিমিকে স্বাভাবিক করতে শোয়েব প্রসঙ্গ পাল্টালো।
-এঁই, একটা কথা তো বলতে ভুলেই গেছি। আরে তোমার বিজনেস ব্যাপারে… ঢাকার কিছু ক্লায়েন্ট আমি ঠিক করে দিয়ে যাবো আপাতত। এরা বিয়ে, বার্থডে, এনগেজমেন্ট এরকম সিরিমনিতে একরকম পোশাক ডিমান্ড করে। তোমার কাজ হবে ঠিকঠাক বেস্টটাই দেওয়া। একটা বড় ক্লায়েন্ট যদি একবার স্যাটিসফাই করতে পারো, অনেকটা হয়ে যাবে! আগে ঢাকায় দেখি, পরে ঢাকার বাইরে… অর্ডার নেবে… তোমার কাজ হবে আনকমন কিছু কালেকশনস দেখানো… সামথিং ডিফারেন্ট.. সব একই শুধু কোথাও একটু বদলে দিবে…
-বড় ক্লায়েন্ট আমি কি করে পারবো শোয়েব ভাই? ডিজাইনে আমার কোনো ধারণাই নেই। তাছাড়া, পছন্দের ব্যাপারও তো আছে?
-এত কেন ভয় পাচ্ছো রিমি? ডিজাইনে যাদের ধারণা নেই, তাঁরাই সবথেকে ভালো ডিজাইন করতে পারে। আর তোমার পছন্দও তো লা-জবাব। এই যে বাংলাদেশের সবথেকে হ্যান্ডসাম ছেলেটাকে পছন্দ করলে… এক গভীর রাতে তাকে ভাত খাইয়ে গাড়িতে রেপ করলে থুক্কু চুমু খেলে… আজ এসে জোর করে কবুল বলিয়ে নিলে… হাসিল…
-চুপ… শোয়েব ভাইয়া….. কাজের কথা বলুন!
রিমি চোখ বন্ধ করলো লজ্জায়! উফ্ মানুষটার মুখে কিছুই আটকায় না।
-কাজের কথাই তো বলছি…
তারপর একটু চাপা স্বরে বিড়বিড়িয়ে শোয়েব বললে,
-কাজ না করলে তো আর বাবুরা হবে না…
রিমি সেটা শুনেও না শোনার ভান করলো।
-আচ্ছা, ডেলিভারির জন্য তো একটা গাড়ি দরকার। রেন্টে কথা বললাম, এরা অনেক চায়… আপনার পরিচিত আছে?
-রিমি, আমার গাড়িটা নিলে কি হয়? এঁই, আমি তো ঢাকায় থাকি না, গাড়ি পড়েই থাকে। নাও না রিমি।ফুয়েল তোমার। ড্রাইভার দিয়ে যাবো আমি।
-গাড়ির নাম্বারটা কিন্তু পৃথিলা জানে। আমি নিতে পারবো না। তাছাড়া সিমি আপাও জানে… কি না কি ভাবে…
-উফ্! তোমার এই বোনের দলদের না… ডট ডট ডট। দেখো, আমি ঠিক একদিন তোমার বোনগুলোকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিবো। আমার বৌটাকে এরা জ্বালিয়ে মারলো…. আমার এত সুন্দর বৌ! এদের জন্য জীবন তামা তামা…. আদা রসুন জিরা বাটিয়ে শেষ করে দিলো। আমি কিন্তু তোমাকে দিয়ে কোনোদিন আদা, রসুন, জিরা, পেঁয়াজ বাটাবো না।
রিমি হাসলো।
-এখানে আদা রসুন এলো কেন? আদা রসুনে কি ঝামেলা?
-আরে রান্না করতে গিয়ে বুঝলাম। গন্ধ যায় না ওগুলার! ওসবের গন্ধ থাকলে রোমান্টিকতা আসে না আমার! বিশেষ করে জিরা. ইয়াক্…..
রিমি খিল খিল শব্দে হেসে ফেললো….
-তাই নাকি? আচ্ছা… আমি তাহলে জিরাই সবসময়…
রিমি একাধারে হেসেই যাচ্ছে….
শোয়েব লজ্জা পেলো খুব। হুট করে এসব মশলার কথা কেন যে বলতে গেল? মশলাপাতির কথাই বা মাথায় কেন আসলো এখন? হুহ……
-রিমি শুনোতো, তোমার প্রিয় খাবার কি? আমি প্রিপারেশানটা শিখবো। সিলেটে আমাকে প্রায়ই রান্না করতে হয়…. শিখে ফেলছি টুকটাক….
-লালমরিচ দিয়ে শুটকির ভর্তা।
-তোমার পেট খারাপ করে না?
-না।
শোয়েব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। যেকোনো ঝাল ভর্তা দেখলেই তাঁর পেট জ্বলে। নিজের বৌয়ের সাথে তাঁর খাওয়ার পছন্দটাই মিললো না।
একটু মনখারাপ গলায়ই বললো,
-আমার করে। অন্য কোনো আইটেম বলো যেটায় ঝাল নেই।
-কেচকি মাছ দিয়ে টমেটোর ঝোল। চলবে?
শোয়েব দুসেকেন্ড চুপ করে থেকে বললো,
-কেচকি মাছটা কি? মানে দেখতে কিরকম? এটা কি সামুদ্রিক?
রিমি হাসলো!
-শোয়েব ভাই, আমি একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখে জাগলাম। স্বপ্নটা আমি আপনাকেই বলতে চাই। স্বপ্নটা হলো,
-রিমি স্বপ্নটা কি বেশি সুন্দর?
-হুঁ!
-তুমি কি চাও এই স্বপ্নটা সত্যি হোক?
-হুঁ….
-তাহলে এখন বলোনা। স্বপ্ন বলতে হয় দিনের বেলায় অথবা পূর্ণিমার রাতে। আর সবথেকে কাছের মানুষকে আগে বলতে হয়। তাহলেই স্বপ্ন সত্যি হয়।
রিমি ফিসফিস করে বললো, আমার যে এখন আপনাকেই সবথেকে কাছের মনে হয়…….
-স্বপ্ন বিষয়ক এই কথাটা আপনি এক্ষুণি বানালেন, তাই না শোয়েব ভাইয়া?
-আমি বানাইনি, আমার মা বানিয়েছেন। তাঁর ধারণা, চাঁদ বা সূর্য সামনে রেখে স্বপ্ন বললে, স্বপ্ন ফলে…….
রিমি বিড়বিড় করে বললো, তাহলে পূর্ণিমা আসুক।চাঁদের সামনেই বলবো।
রিমি হাই তোলার ভঙ্গি করে বললো,
-রাখি তাহলে, ঘুম এসেছে আমার আবার!
-আজ কিন্তু আমাদের ঘুমোনোর কথা না রিমি! বিয়ের হিসাবে আজ আমাদের বাসর রাত… কটা বাজে? এঁই চলে আসি আমি? বের হতে পারবে? এঁই রিমি, মনসুরের হাসপাতালে আমাদের জন্য ইমার্জেন্সি কেবিন নিয়ে নিই একটা? এঁই…..
-আপার বাবু কাঁদছে, আপা কিন্তু জাগনা। ডাকবো? আ….পা….
-তোমার আপাগুলোকে আমি…. তুমি খুব খারাপ রিমি।
-সত্যিই ঘুম এসেছে শোয়েব ভাই….. রাখছি।
-মিষ্টি করে একটা কথা বলে রাখো!
-আপনি দশটা মিষ্টি খান…..
-উঁহু, ফাজলামো না রিমি। বলো, আই লাভ ইয়ু।
-পারবো না।
-তাহলে বলো, ওগো জান আমি তোমাকে সারাক্ষণ মিস করি……
-পারবো না।
-একটা চুমু অন্ততপক্ষে দাও। আজ আমাদের বিয়ের রাত….
রিমি ফোন রেখে দিলো।
ফোন রাখতেই শোয়েবের মনে হলো, রিমিকে তো আসল কথাটা বলাই হয়নি, এ মাসেই অফিশিয়াল একটা ট্রেইনিং কোর্সে বাইরে যেতে হবে তাকে। মাস দুয়েক পরে ফিরবে!
শোয়েব মেসেজ করলো,
“কথার আগে পিছে দশবার করে ভাইয়া বলছো, আমি কি তোমার ভাইয়া?”

রিমি মেসেজ সিন করে হাসলো। ভোর হয়ে যাচ্ছে। রিমি পা তুলে বারান্দার চেয়ারেই বসলো। আজ সে ভোর হওয়া দেখবে। ভোর হওয়া এত সুন্দর কেন?
আচ্ছা, শোয়েব ভাইয়া কি তাঁর জীবনে ভোর হওয়া?

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here