রোদ্দুরের_বৃষ্টি #পর্ব_২৩_ও_২৪

0
472

#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_২৩_ও_২৪

#পর্ব_২৩

সিমিও উঠে এলো হাই তুলতে তুলতে। যেন এত রাতে বিয়ে করাটা খুব স্বাভাবিক এমনভাবে বললো,
-উফ্ রিমি! বিয়ে করবি ভালো কথা, এত চিল্লা চিৎকার না করে আস্তে করে করনা! বাবু ঘুমাচ্ছে তো।এমনিতেই সারাদিন ও’র উপর কত ধকল গেছে জানিস?
রিমি দাঁড়ানো থেকে হতাশভঙ্গিতে বিছানায় বসলো।নাসিমা মেয়ের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টি বলছে, তোকে আমি এত নরম ভাবতাম আর তুই কিনা এই পর্বতের মত উঁচু একটা ছেলেকে কাত করে ফেলেছিস? তুই এমন কেন করলি?

-আন্টি, আমি কি করবো বলুন? আমি তো, বুঝাতেই পারছিনা কিছু। বললাম একটা ওয়ার্কশপ আছে; সেড়ে আসি? রিমি মানছেই না।
সিমি চুলটা খোঁপা করে নিয়ে শোয়েবের কাছে এসে দাঁড়ালো। উৎসাহী চোখে তাকিয়ে বললো,
-বিয়ে কি এখনি করবেন?
শোয়েব হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
-সিরিয়াসলি?
-হুঁ রিমিকে বাঁচাতেই করতে হবে! ও মরে যাবে বলছে।আমি চাকরি-বাকরির ঝামেলায় থাকি, ছুটি টুটি পাইনা। কখন হুট করে কি করে ফেলে? বুঝেনই তো!
সিমি জ্ঞানীর মত মাথা নেড়ে বললো,
-হুম, বুঝতে পারছি। আমি তো বুঝেইছিলাম, রিমির কোনো কাজে মনটন নেই, ঘরে তো সে কোনো কাজই করেনা.. খাওয়া দাওয়া অনিয়ম… প্রায়ই বাবুর জিনিসপাতি আনতে ভুলে যায়…
সিমির ন্যাঁকা ন্যাকাঁ মিথ্যে রিমির অসহ্য লাগছে।
বিরক্তিতে রিমি দ্রুত অন্যঘরে চলে গেল। নাসিমা এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন, এবার রিমির পিছন পিছন গেলেন। কি ঘটছে, কিছুই তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি মনে মনে দোআ ইউনুস পড়তে শুরু করলেন… তাঁর মেয়েগুলো একটাও মানুষ হলোনা। সিমি ইন্টারমিডিয়েটে ভেগে গেল, রিমি এখন ছেলে ধরে নিয়ে এসেছে…. ইয়া আল্লাহ, রক্ষা করো!

সিমি শোয়েবের মুখোমুখি হয়ে আলোচনা করবার মত করে বসেছে।
-আচ্ছা, কাজীও তো লাগবে শোয়েব ভাই। রেজিস্ট্রির ব্যাপার আছে, সাক্ষী লাগবে।
-আমি তো বললামই আন্টিকে সব মেনেজ করতে.. আপনি তো জানেন না আপা, রিমি কত যে…..
-আমি সব মেনেজ করে ফেলি শোয়েব ভাই? রিজওয়ান সাহেবকে বলি? উনার বাবা তো বিশাল বড় এডভোকেট! বিয়ে পড়ানোর হুজুর, কাজী, পুলিশ, আমিন সব ধরনের লোক উনার পরিচিত আছেন।
শোয়েব হতভম্ব চোখে বললো,
-রিজওয়ান সাহেবকে?
-হুঁ! উনি খুব ভালো মানুষ! আমি ফোন দিলেই দুনিয়া নিয়ে এক্ষুণি হাজির হয়ে যাবেন।
-আপনি ফোন করলে?
-হুঁ
তারপর সিমি একটু লজ্জিভাবে বললো,
-যখনি উনি আসেন, বাবুকে কোলে নিয়ে আব্বু, আব্বু ডাকেন। এই যে বাবুর “শুভ” নামটা উনিই তো দিলেন। বললেন, ও আমার জীবনে সবথেকে শুভ জিনিসগুলো বয়ে আনবে।
-রিজওয়ান সাহেব এরকম বলেছেন?
বিস্ময়ে শোয়েবের মুখ এতবড় হা হয়ে গেল।
-উনি প্রথমে যেদিন বাড়িতে এলেন, এসেই আমায় দেখে বললেন, আমি নাকি রিমির থেকেও মিষ্টি দেখতে। বাবুর মা নাকি বুঝাই যায়না। চোখের নিচে কালি দেখে বললেন, আপনি রাতে কম ঘুমোন নাকি?
-উনি আপনার সাথে এরকম কথা বলেন?
সিমি শোয়েবের কথার জবাব না দিয়ে ব্যস্তভাবে ফোন করলে রিজওয়ান সাহেবকে…….

রাত দুটা নাগাদ হুজুর আর কাজির উপস্থিতিতে বিয়ে হয়ে গেল রিমি আর শোয়েবের! সাক্ষী হলো, রিজওয়ান আর রিজওয়ানের এক বন্ধু। তবে বিয়ে একটা হলো না, হলো দুটো। অন্য পাত্র-পাত্রী রিজওয়ান আর সিমি। শোয়েবের বিয়ের মাঝখানে রিজওয়ান হঠাৎ ফট করে বলে বসলো,
-শোয়েব ভাই আপনি যদি একটা সাক্ষী হন, আমিও এখন বিয়েটা করে ফেলতাম?
-আপনিও এখন বিয়ে করবেন?
-হুঁ!
-পাত্রী?
-পাত্রী এখানেই আছে!
শোয়েব স্তব্ধ হয়ে চারিদিক দেখলো।
-কে?
-সিমি! উনার বাবু আমাকে দেখলেই বাব-বাব-বাব বলে। ফেরেশতা শিশু, কি ভেবে বলে কে জানে? হয়তো আল্লাহর ইশারা এটা, আমিই বোধহয়…… জানেন, যতবার কোলে উঠে মুতো করে দেয়। যাওয়ার সময় আঙুল ধরে বলে, বাববাববাব…….
-এতটুকু বাবু কথা বলে নাকি?
-স্পষ্ট কেউ বুঝে না, কিন্তু আমি বুঝি। হয়তো বাবার ফিলটা পায় আমার মধ্যে। আপনি যদি সাহায্য করতেন…..
রিজওয়ান আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো।
সীমাহীন বিস্ময়ে শোয়েব রিজওয়ানের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে মনে মনে বললো, গাঁধা!
বিয়ের পুরোটা সময় নাসিমা কেঁদে গেলেন। এটা কি আনন্দের নাকি দুঃখের ঘটনা তিনি বুঝতে পারছেন না। রিমি একবারও আর শোয়েবের সামনে যায়নি আর। কবুল বললো, কাঁথার ভেতর শুয়ে।
সিমি মহানন্দে বাবুকে জাগিয়ে তুলেছে, ওকে কোলে করেই রিজওয়ানের আশেপাশে ঘুড়ছে। একটু পরপর
রিজওয়ানের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে বলছে,
-শুভ দেখো, এই যে আজ তোমার নতুন খালু হলো, বাবা হলো।
রিজওয়ান তাতেই লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে!
অথচ শোয়েব? তৃষ্ণায় কখন থেকে তাঁর গলা শুকনো। রিমিকে কি ডেকে বলবে, এক গ্লাস পানি দিতে?
রিমির ফোন অনবরত বেজে চলছে, রেহেনা ম্যাডাম ফোন করছেন! তাঁর মানে শোয়েব জানিয়েই এসেছে বাড়িতে। রিমি ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখলো। ফোন ধরবে না এখন সে, লজ্জা করছে তাঁর! আচ্ছা, শোয়েব ভাই এঘরে চলে আসবে না তো? জোর করে যদি টেনে নিয়ে যায়? রিমি আর ভাবতে পারলো না।

শোয়েব অনেকক্ষণ ওয়েট করে থেকে এঘরে বসেই রিমির ফোনে টেক্সট পাঠালো।
“একবার কি আসবে? আমি কি করবো? চলে যাবো?”
টেক্সটের আনসার দিতে রিমি সামনেই এলো, এর মাঝে শাড়ি বদলে নিয়েছে রিমি। গোলাপি একটা কুর্তি পরেছে। মাথার চুলের বিণুনি খুলে নিয়েছে।রিমির চুল এত লম্বা? ওড়না চাদরের মত জড়িয়ে নিয়ে হাত তার ভেতরে ভাঁজ করে রেখেছে। শোয়েবের ইচ্ছে করলো… এক্ষুণি….
রিমি শোয়েবের দিকে না তাকিয়েই বললো,
-আপনার মা আমার ফোনে অনবরত কল দিয়ে যাচ্ছেন। উনি টেনশানে আছেন। আপনি প্লিজ বাসায় যান।
-তুমিও চলোনা সাথে! রিমি… সকালেই চলে আসবে…. রিমি ইয়ে মানে, আসলে…..
শোয়েব ঠিক বলতেও পারছেনা, আবার রিমিকে টেনে নিয়ে যেতেও পারছে না… উফ্ সিমি আপা এ ঘর থেকে যাচ্ছেনা কেন? রিজওয়ানকে একটা চড় মারলে কেমন হয়? যা নারে গাঁধা তোর বাববাববাকে নিয়ে গিয়ে ঘুমানা….
রিজওয়ান রিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
-শোয়েব ভাই চলে যাবে, তাহলে আমি কি করবো?
-আমাকে কেনো জিজ্ঞেস করছেন? আপাকে বলুন।
হাত কচলে রিজওয়ান বললো,
-আমার তো মনে হয় বাবা বাসায় ঢুকতে দিবেনা। কয়েকদিন গেলে বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে না হয় একটা ব্যবস্থা হবে। মামলাও করতে পারে… রিমি ম্যাম, শোয়েব ভাই বাবাকে একটু জানিয়ে রাখবেন আমাদের ব্যাপারটা…….
রিমি রাগান্বিত গলায় বললো,
-আপনি একটা মাথামোটা! আপনি একটা ন্যাড়া!
খবরদার, আমাকে আপনাদের ব্যাপারে একদম জড়াবেন না। মামলা করলে একা জেলে যাবেন।
-তুই কি অভদ্ররে রিমি, একটু ঠিক করে কথা বলনা।
-পারবো না ঠিক করে কথা বলতে… যত্তসব…
সিমির চোখের পানির প্যানপ্যানানি শুরু হলো,
-আজই মানুষটা তোর দুলাভাই হলো, আজই বকছিস এমন করে? সারাজীবন তো আর পড়ে থাকবে না। তোর বোনের এত বড় উপকার করলো, আর তুই? ছিঃ রিমি। রিজওয়ান কিন্তু শোয়েবের থেকে কম কিছু নয়… কই একটু যত্ন-আত্তি করবি।
আচ্ছা শোয়েব ভাই আপনিই বলুন, বেচারা বিপদে পড়ায় একটু…..
সিমির কথার ফাঁকে রিমি শোয়েবের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো।
শোয়েব উঠে বেড়িয়ে গেল।
গাড়িতে এসে বসে টেক্সট করলো,
“একটু আসো না রিমি প্লিজ! সুন্দর করে একটা বাই বলে যাও অন্তত”
রিমি মেসেজের জবাব দিলোনা। শোয়েব দশমিনিট ওয়েট করে গাড়ি স্টার্ট করে টার্ন নিতে নিয়ে দেখে রিজওয়ান বেড়িয়েছে। শোয়েব দেখেই, মনে মনে বলল ছাগলা!
রিজওয়ান হাত ইশারায় শোয়েবকে উইনডো গ্লাসটা নামাতে বললো,
-কি ব্যাপার? আপনিও চলে যাচ্ছেন নাকি? বৌ তাড়িয়ে দিলো, না শালী?
-না না তাড়িয়ে নয়, আম্মাকে সালাম করতে গেলাম বললেন থেকে যাও বাবা!
-আম্মাটা কে?
প্রশ্নটা করেই শোয়েব ইতস্ততায় জিভ কাটলো।
-ইয়ে মানে, শোয়েব ভাই জুয়েলার্স খোলা পাওয়া যাবে? আসলে বিয়ের দিনে কিছু তো দিতে হয়? যতই হোক, আমার তো প্রথম বিয়ে।
শোয়েব রূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো। যার অর্থ আর একটা কথা বললে তোর পিঠের ছাল তুলে ফেলবোরে হাঁদা। রিজওয়ান সেই দৃষ্টির অর্থ বুঝলোনা। মহাখুশিতে বললো,
-আপনিও চলুন না সাথে, রিমি ম্যামের জন্য কিছু কিনে ফেলবেন। আপনিও তো কিছু দেননি!!
-কে বললো দিইনি? আমি দিয়েই এসেছি…
-তাই নাকি? তা কখন দিলেন? কি দিলেন?
শোয়েব হাত নেড়ে বাই বলার ভঙ্গিতে বললো,
-ওটা টপ সিক্রেট। বৌকে দেওয়া উপহারের কথা অন্যকে বলতে নেই। খোদা হাফেজ…..
শোয়েবের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রিজওয়ান মাথা চুলকাতে লাগলো, সিমিকে কি দেওয়া যায়?
আচ্ছা শুধু কি সিমিকে দিলে চলবে নাকি বাবুকেও দিতে হবে?

বাসায় নামবার আগে শোয়েব টেক্সট করলো রিমিকে,
“তোমাকে হারানোর খুব ভয় আমার; আমায় অযোগ্য ভেবে যদি কখনো ফেলে দাও, তাই কব্জা করলাম।আমায় রাখবে তো সাথে সারাজীবন? বলো প্রমিস!”
রিমি টেক্সট রিপ্লাই করলো,
“আপনি বলেছেন, আমার প্রমিস হয়ে গেছে”
শোয়েব আবার মেসেজ করলো,
“” একটা কল দিই? স্বপ্নটা বলবে, আজ পূর্ণিমা। চাঁদ আছে”
রিমির রিপ্লাই এলো,
“প্লিজ না, সামনে থেকে বলবো”।
শোয়েব গাড়ির ডোরটাতে হেলান দিয়ে রাতের আকাশে ঝকঝকে চাঁদটার দিকে তাকালো। ফিসফিস করে বললো,
“আমার জীবনের সব পূর্ণিমা এখন থেকে তুমি রিমি; তোমার মিষ্টি আলোয় আমি আলোকিত হয়ে বাঁচতে চাই”

#পর্ব_২৪

শোয়েবের বাবুর জন্য রেখে যাওয়া গিফট প্যাকটা খুললো রিজওয়ান। বাবুর জন্য সুন্দর একটা মিনি খেলনা প্লেন। তবে ভেতরে আরেকটা ছোট প্যাকেট, তাতে লিখা,
“তোমার জন্য রিমি”
প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে রিজওয়ান বিড়বিড় করে বলল, শোয়েব ভাই এত চালাক!
সিমি মুখ কুঁচকে বললো,
-ঘোড়ার ডিমের চালাক। এইযে এত পাগল হয়ে বিয়েটা করলো, রিমির মধ্য আছেটা কি? না বুদ্ধি, না রসকষ! আচ্ছা,প্যাকেটে কি? আমরা খুলে দেখি?
সিমির কথা অগ্রাহ্য করে রিজওয়ান ডাকলো,
-রিমি ম্যাডাম, রিমি ম্যাডাম…..
পাশের ঘর থেকে রিমি জবাব দিলো না। নাসিমা এলেন।
-এটা রিমি ম্যামের, শোয়েব ভাই রেখে গেছেন। শুভর গিফটের সাথে দিয়েছেন।
সিমি রিজওয়ানের দিকে তাকিয়ে রেগে অপর দিকে মুখ ঘুড়িয়ে শুলো।
-অন্যের গিফট খোলা কি ঠিক? ইশ্! আমার বৌটা কি সুন্দর করে রাগ করেরে বাবা। দেখি দেখি, রাগলে লাল হয় নাকি নীল হয়?
সিমি আহলাদে গদগদ হয়ে বললো,
-যাও, কথা নেই তোমার সাথে।

রিমি প্যাকেট খুলে হতভম্ব! মানুষটা এত কেন করে? এত বেশি করাটা কি ঠিক?
নাসিমা কৌতুহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেললেন,
-তুই কাঁদছিস যে? কি দিলোরে রিমি?
-হেরফের ঘুচিয়ে দিলো মা। এই মানুষটা আমার হেরফের ঘুচিয়ে দিতে দিতেই ক্লান্ত মা। আমি এত অযোগ্য কেন মা? এত কেন সামর্থ্য কম আমার?
রিমি কান্নার সুর থামাতেই যেন মুখ চেঁপে ধরলো মায়ের বুকে। নাসিমা মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন।
-বিজনেসের জন্য গাড়ি দিলো মা। শিউলিকে পৌঁছে দিয়েছে বিকেলেই। এখানে গাড়ির পেপারসগুলো।দূরের অর্ডারগুলোর ডেলিভারি এখন স্বাচ্ছন্দ্যে দিতে পারবো।
রিমি চোখ মুছে নিয়ে বসলো। কাগজগুলো গুছিয়ে,
ল্যাপটপটা খুলে নিয়ে বললো,
-মা শুয়ে পড়ো তুমি। আমার অনেক হিসেব নিকেশ আছে। আমি কাজ করবো এখন।
নাসিমা অবাক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। কে বলবে, একটু আগেই বিয়ে হয়েছে। কোনো অনুভূতিই কি নেই? মেয়েটার যেন মানুষের মন রাখতেই রাখতেই সর্বস্ব শেষ। মন, শরীর সবই বিধ্বস্ত!
-দু-ঘন্টা ঘুমিয়ে নিলে পারতি তো রিমি! কত ধকল গেল।
চুলটা খোঁপা করতে করতে রিমি মায়ের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে হাসলো। বড় বেদনার, বড় অনিচ্ছার হাসি। নাসিমা কাছে গিয়ে মেয়ের কপালে চুমু খেলেন।
-তুই চলে যা রিমি শোয়েবের সাথে। সুখে শান্তিতে ঘরকন্না কর। আর কত টানবি আমাদের?
-সব অত সহজ নয় মা। শোয়েবের জন্য অনেক জটিল! আমি মানুষটাকে সব সহজ করে দিতে চাই।জানো মা, মানুষটা একদম পাগল। এই যে আমায় পছন্দ করলো, শুধু রাগ আর রাগ… কখনো ঠিক করে বলবেওনা কিছু। কিন্তু মেজাজ! যেন আমারই সব বুঝে নেওয়ার কথা। যেন উনার ভেতরের সব আমার কাছে? একটাই খালি বলবে, আমি কেন সব জানিনা?
কথাগুলো বলতে বলতে রিমির মুখটা অন্যরকম ভালোলাগা আর আনন্দে চকচক করে উঠলো।
নাসিমা ফিসফিস করে বললেন, শোয়েব যেন তোর সব শক্তি হয়!! ভালোবাসা যেন তোর কোনো দুর্বলতার কারণ না হয়!
রিমি গভীর মনোযোগে ডিজাইন চুজ করতে লাগলো… মিক্সড একটা ডিজাইন করবে সে।এরপরেই অর্ডার…

শোয়েবের যাবার ডেট ফাইনাল হয়ে গেছে। সাত তারিখেই যাবে। পৃথিলাও যাচ্ছে সাথে। সিমির পৃথিলার সাথে ভাব বিয়ে করেই ক্যানসেল। শুধু তাই নয়, রিজওয়ান এখন রিমিদের বাড়িতেই থাকছে।রিজওয়ান অবশ্য বিয়ের পরদিন তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলো একবার। রিজওয়ান সাহেবের বাবা নাপিত ডাকিয়ে উনার মাথা ন্যাঁড়া করে দিয়েছেন।সাথে কঠোর করে স্ট্রেইট বলে দিয়েছেন, দ্বিতীয়বার যদি তিনি ছেলেকে সামনে দেখেন গলা কেটে ফেলবেন। মাথা কামানো এটা তো জাস্ট হালকা শাস্তি। মাথা ন্যাঁড়া করবার পর রিজওয়ান সাহেবকে তাঁর দরকারি জিনিসপাতি গুছিয়ে নিতে এক ঘন্টা সময় দিয়েছিলেন। রিজওয়ান এর মধ্যে মহানন্দে ব্যাগ গুছিয়ে চলে এসেছে।সব্যাগ দেখে রিমি চোখমুখ কুঁচকে বলেছিল,
-আপনার সামর্থ্য আছে, বৌ নিয়ে বিদেয় হোন প্লিজ।যেখানে খুশি সেখানে যান। ভাড়া বাসায় থাকুন।
রিজওয়ান মাথা চুলকে জবাবে বলেছিলো,
-যাবো তো। মিসি বলছে এখন যাবেনা। আব্বু বড় হোক। হাঁটাহাঁটি শিখুক। একা বাসায় কে দেখবে? মিসি তো সামলাতে পারবেনা। এখানে আম্মা আছেন।
রিমি আশ্চর্যভাবে জিজ্ঞেস করলো,
-মিসিটা কে?
রিজওয়ান রাজ্যের লজ্জা নিয়ে জবাব দিলো, আমি ওকে মিসি ডাকি! সিমিকে উল্টো করে দিয়েছি। ও’ই বললো, আমি মিসি ডাকলে ওর ভেতরটা কেমন খাবুত খাবুত করে জানি!
-তার মানে আপনি যদি আমায় বিয়ে করতেন, আমায় মিরি ডাকতেন। ছিঃ…
তারপর থেকে রিমি আর কিছু বলেনি রিজওয়ানকে।
সুযোগ বুঝে এই আহলাদির কঠিন শিক্ষা একদিন সে হাবলাটাকে ঠিক দিবে।

বিয়ের পর এই এক সপ্তাহে শোয়েবের সাথে রিমির দেখা হয়নি। ফোনে কথাও হয়নি। যেটা হয়েছে সেটা হলো মেসেজ বিনিময়। ফোনে কথা বলতে গেলেই সেটা কি করে জানি, ঝগরার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে!
খুবই তুচ্ছ কারণে ঝগরা। যেমন, সেদিন সকালে শোয়েব অফিস বেরোবার আগে ফোন করলো, রিমি ততক্ষণে বুটিকে চলে এসেছে।
শোয়েব বললো,
-গুড মর্ণিং রিমি।
-হুঁ।
-হুঁ বলছো কেন? গুডমর্নিং বলো, ইটস কমন কার্টেসি। কার্টেসিও শেখাতে হবে?
-সরি গুডমর্নিং! কেমন আছেন? নাশতা করেছেন?
-নাশতা করেছি মানে। ক’টা বাজে? গোসল টোসল করে অলরেডি অফিসে বেরোচ্ছি। তুমি?
-আমি তো দোকানেই! আমি অবশ্য শর্টকাটে চলে এসেছি, ঘুম থেকে উঠে ভাত খেয়ে চলে এসেছি।
-গোসল করোনি?
-না, শীত শীত অলসতা লাগলো। বিকেলে ফিরে গিয়ে করবো!
-শীত শীত অলসতা মানে? মেয়ে মানুষকে হাঁসের মত হতে হয়, সকালে উঠেই সোজা পানিতে… নাহলে হাঁসের মত গন্ধ লাগে। আর তুমি বছরে একবার। হাঁস তো অনেক দূরে…
-আমি হাঁস?লহাঁসের মত গন্ধ বেরোয়?
-গোসল না করলে অমনি তো। কই; আমি তো রোজ সকালেই করছি, তোমার শীত শীত! এত অকর্মা হলে হয়? আমার এক বান্ধবী ছিলো, শান্তি। হিন্দু! ও তো বারোমাস ভোর ছ’টার আগে গোসল সেড়ে পুজো দিতো। ওকে জিজ্ঞেস করলে বলতো, মেয়েদের নাকি শীত লাগেনা। আর তুমি?
-আপনার বান্ধবী রোজ গোসল করে কিনা সেটাও আপনি জিজ্ঞেস করতেন?
-হুঁ … আচ্ছা তুমি, গতকাল গোসল করেছো তো?
রাগে রিমি বললো,
-না।
-তাইতো বলি, ভালো করে শুকলে তো ফোনেই। আচ্ছা, জিরা, মাছ মেখেছো তো গায়ে?
রিমি চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে ফোন রেখে দিলো। এত কেন ঝগরাটে মানুষটা?
ঝগরা এড়াতে টেক্সটই ভালো। একরমক টেক্সট, জবাব অন্যরকম।
তবে এই সপ্তাহের মাঝে রিমি বিরাট দুটা ওয়েডিং সিরিমনিতে কস্টিউম সাপ্লাই করেছে। লাভের অঙ্ক বিশাল। একটু শ্রম দিতে পারলে বিজনেস যে এত প্রফিট দেয় রিমি আগে জানলে এটাই করতো। এই যেমন আজও সে একটা অর্ডার পেলো, ১০০ পিস বৌভাতের একই ডিজাইনের শাড়ি। রিমি সে ব্যাপারেই এখন কাজ করছে, আজ দুপুরে সে খেতেও যায়নি বাড়িতে। কর্মচারী মেয়েটি প্যাকিং করছে একটার পর একটা।
এর মধ্যেই শোয়েব এসে হাজির! আজ কেন, সকালেই তো মেসেজে বললো, যাবার আগে আর দেখা হবেনা তাহলে? উফ্…… রিমিতো আজ সকালেও গোসল করে আসেনি। এর মধ্যে….
রিমি দেখেও না দেখার ভান করলো। শোয়েব আজ জিন্সের সাথে ব্লাক শার্ট পরে এসেছে। কালো শার্ট যে কেন পরে? চুল আজ একদম ফুরফুরে। মানুষটা বিয়ের পর আরও লম্বা হয়ে গেল নাকি?
শোয়েব ফোনসেটটা পকেটে ঢুকিয়ে বেশ আয়েশ করে একটা টুল টেনে বসলো। রিমি একটু জড়সড় হয়ে গেল। শোয়েব শার্টের কলারে হাত বুলিয়ে ঠিক করতে করতে বললো,
-ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগানো দরকার। এই যে লাঞ্চে তোমরা যে যার মত বাইরে যাচ্ছো, তখন যে থাকছে সে কি করছে? তাছাড়া… এই যে আমি এলাম তুমি লজ্জায় তাকাতেও পারছোনা, অন্তত তখন মনিটরিং স্ক্রিনে আমায় দেখে নিতে.. বিয়ের পর কত সুন্দর হয়েছি আমি জানো?
-ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার কথা আলাপ করা হয়ে গেছে, নেক্সট উইকেই হয়ে যাবে। আসুক, তখন দেখে নেবো…
রিমি মাথা আরও নিঁচু করে ফেললো।
-বাসায় গিয়েছিলাম। রিজওয়ান লাঞ্চে এসেছে দেখলাম। মাথা বেল করা মনে হলো, নাকি একেবারে ট্রিম করেছে?
-বাবু চুল ধরে নাকি টানাটানি করে তাই ফেলে দিয়েছে।
-তিনি এখানেই থাকছেন?
-হুঁ….
-বাড়িতে মিস্ত্রি কাজ করছে দেখলাম!
-হুঁ।
-পৃথি বাড়িতে যায় এখনো?
-হুঁ
রিমি আরো মনোযোগ দিলো নোটপ্যাডে…
-আমার দিকে তাকাবেও না?
-হুঁ….
শোয়েব এবার উঠে গিয়ে রিমির থুতনি উপরের দিকে তুলে ধরলো।
-কি হুঁ হুঁ করছো? তাকানো যায় না একবার? বানের জলে ভেসে এসেছি আমি? ফোন ধরোনা কেন? পাশের কর্মচারী মেয়েটি অদ্ভূতভাবে তাকাচ্ছে। রিমি আস্তে স্বরে বললো,
-ছাড়ুন শোয়েব ভাই, দেখছে….
-আমি তোমার ভাই? ভাই বলো কেন পাঁচবেলা করে? মজা না?
শোয়েবের দৃষ্টি রিমির চোখে। এভাবে কতক্ষণ তাকিয়ে
রিমি ঝটকা মেরে শোয়েবের হাতটা সরিয়ে দিলো।
-শিউলি আসুক, আমি যাবো আপনার সাথে…..
-আমি ওয়েট করতে পারবো না, একটুও না।
তারপর কর্মচারী মেয়েটির দিকে ইশারা করে দেখিয়ে বললো,
-ও’কে বুঝিয়ে দিয়ে আসো। আমি বাইরে ওয়েট করছি।
শোয়েব বেড়িয়ে গেল। এবং সাথে সাথেই ফিরে এলো,
-আবার দেরি করবে তুমি। তোমার বিশ্বাস নেই একদম…
তারপর রিমিকে কোলে করে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
-এই যে মিস, আপনার ম্যামকে আমি কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি কিছুক্ষণ ব্যাবসা সামলান।
-আরে আমার ব্যাগ, ব্যাগ…. শোয়েব ভাই, মোবাইল তো রয়ে গেল…..
শোয়েব রিমিকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নাকটা টিপে ধরে বললো,
-থাকুক মোবাইল। ফ্রম নাউ ইউ আর ডিসকানেক্টেড উইথ আদারস….. তোমাকে আমি অনলি মি করে ফেললাম।
(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here