#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_২৬_ও_২৭
#পর্ব_২৬
-হ্যালো মা
-হ্যালো লীনা.. তোমরা ফিরছো কখন?
-আজ হবে না মা। মা আমি আসলে শোয়েবের জন্য ফোন করছিলাম। ও’ আমাদের জয়েন করবে বলেছিলো। এখন তো ফোনটাই তুলছে না।
-ও রুমে বৌমা। ঘুমুচ্ছে।
-ঘুমুচ্ছে মানে?
-হুঁ, আমাকে তো বললো কেউ যাতে নক না করে.. ফোন সাইলেন্ট বোধহয়! বৌমা, তোমার শ্বশুরও কি রাতে থেকে যাবে?
-মা, বাবা তো পাপার সাথে দাবা খেলতে বসে গেছে।
দরজা বন্ধ করে। সো চান্স নেই। আচ্ছা, মা শোয়েব যখনি জাগবে, আমাকে একটা ফোন করতে বলবেন। জরুরি কথা আছে।
-আচ্ছা, রিংকু ঝিংকু কি করছে?
-আছে, ওদের তো বুঝেনই। অনেক ফ্রেন্ডস পেয়ে গেছে। মা, আমি ড্রাইভারকে দিয়ে খাবার পাঠিয়েছি, আপনি খেয়ে নিয়েন।
-ওসব আবার কেন যে করতে গেলে… রাতে ফিরলে বলো, আমি ডিনার বানিয়ে নিবো…
-আজ থেকেই যাচ্ছি মা! বাই…
লীনা বিরস মুখে ফোন রাখলো।
পৃথিলা এদিকেই আসছে।
লীনা হেসে বললো,
-ওহ পৃথি, শোয়েব তোমার ফোন ধরবে কি ওতো বাসায়ই নেই! কি একটা কাজে নাকি বাইরে গেছে। মায়ের ফোনই ধরছেনা।
পৃথিলা হাসলো।
-ঢাকায় আর কাজ কি? রিমির বিজনেস দেখতে গেছে হয়তো..
-ওহ.. তুমি এত নেগেটিভ কেন? শোয়েব ইজ এ সফট হার্টেড ম্যান। এটা কেন পজিটিভলি দেখছোনা পৃথি। দরিদ্র একটা মানুষকে সাহায্য করছে এটা কেন ভাবছোনা?
পৃথিলা কফিতে চুমুক দিলো।
-আপা, আমি কিন্তু তোমার কথায় খুব ভরসা করে আছি। তোমার দেওর, তুমিই জানো।
-সত্যিই ও” বাইরে সোনা। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর তোমার শোয়েব, তোমার সময়!
লীনা পৃথির থুতুনিটা টিপে দিলো।
-তবে খুব সাবধানে সোনা, শোয়েবকে প্রেসারে ফেলে কিছুই করানো যায় না। এটা সবসময় বুঝাতে হবে, শোয়েব যা চায় তুমিও তা চাও।
-এত আর ভালো লাগছে না। আপা, আর কত?
-একটু ধৈর্য্য তো ধরতে হবে। শোয়েব ভীষণ ভালো ছেলে কিন্তু।
-ওই একটা কারণেই তো… নাহলে এর থেকে সুপার ক্যারিয়ারের ছেলেরা তো…..
লীনা একটা চোখ টিপে দিলো পৃথিকে। পৃথি মিষ্টি করে হাসলো।
-লেটস ইনজয় বেবী।
লীনা যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক বাবা রাগ কমেছে তাহলে।
রিমি বাড়ি ফিরলো পরদিন রাত ন’টায়!
নাসিমা মেয়েকে দেখেই বললেন।
-সকালে খেলি কোথায়? দুপুরে? নিজের প্রতি এত অবহেলা… বর পেয়ে নিজেকে ভুলে গেলি রিমি?
রিমি ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিছানায় সটান শুয়ে পড়লো। জুতোটা পায়েই বিছানায় পা তুলে দিলো।আজ সারাদিন সে অনেক খেটেছে, ফুরফুরে মনে খেটেছে…. বিজনেসে তার শুভদিন আসিতেছে… আসিতেছে….
-কিরে শোয়েবদের ওখান থেকে ফিরলি কখন? শাড়ি পেলি কোথায়?
-সকালের নাশতা শোয়েব ভাইদের ওখান থেকে করে বেড়িয়েছিলাম মা। দুপুরে খাইনি মা। এত কাজ ছিল যে…
-মুরগী করেছি। পোলাও করলাম।
-খাবো না মা। ইচ্ছে করছে না। ঘুম আসছে।
রিমি শুয়েই আড়মোড়ার মত করলো শরীরটা।
নাসিমা ইতস্তত করতে লাগলেন সামনে দাঁড়িয়ে। রিমি মায়ের দিকে আড়চোখে দেখলো।
-কিছু বলবে মা?
-পৃথি এসেছে। তোর সাথে দেখা করতে বসে আছে আমার ঘরে। বিদেশ চলে যাবে বলছিলো।
রিমি শোয়া থেকে সাথে সাথেই উঠলো। পৃথি গাড়ি আনেনি কেন আজকে? তার মানে বাবা ওকে নামিয়ে দিয়ে গেছে? তার মানে…. রিমি আর ভাবতে পারলোনা। একসেট কাপড় নিয়ে কলতলার দিকে রওনা দিলো সে।
-আগে কথা বলে নে না রিমি! পরে নাহয়….
রিমি আবার পেছন ঘুড়ে দাঁড়ালো। ব্যাগটা খুলে দুটো ছোট্ট জুয়েলারি বক্স বের করে বললো,
-মা একটা মজার জিনিস দেখবে? এই দেখো, এই যে দুটো চেইন। একটা স্বর্ণের, একটা ইমিটেশনের… বলোতো কোনটা ইমিটেশনের?
রেহানা মুখ কুঁচকালেন।
-দুটো তো একই রকম!
-ভালো করে দেখো। দেখে বলো…
-এটা ইমিটেশন!
-ওকে। নাউ রেডি টু সি দ্য ম্যাজিক। এই চেইন দুটো নিয়ে আমি ছোট্ট একটা খেলা খেলবো চলো।
নাসিমা মেয়ের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছেন না।স্থিরদৃষ্টিতে রিমির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
-আহ্ চলো না মা।
রিমি মাকে টেনে নিয়ে সিমির ঘরে এলো।
-এখানে দাঁড়িয়ে যাস্ট দেখো মা।
সিমি বাবুকে খাওয়াচ্ছে। রিমিকে দেখেই বললো,
-পৃথি তোর জন্য সেই কখন থেকে বসে আছে, আর তুই মাত্র ফিরলি! হ্যাঁরে কাল রাতে ছিলি কোথায়?রিজু তো তোর চিন্তায় অস্থির… আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলো।
রিমি সিমির কথার জবাব দিলোনা। হেসে বললো,
-আপা তোর আর অামার জন্য দুটো ঘরে পরার বারোমাসি হার নিলাম। দেখতো, তোর কোনটা পছন্দ!
সিমি মহানন্দে চেইনদুটো হাতে নিলো।
রিমি ইমিটেশনের চেইনটা নিয়ে গলায় পরে বললো,
-আমার এটা। আপা, তুই এটা নে!
সিমি স্বর্ণের চেইনটা হাতে নিয়ে এদিকওদিক করে দেখে বললো,
-তোর গলারটা দেখি? তুই বরং এটা নে রিমি। তোর গলারটা আমায় দিয়ে দে। ওটা পাতলা মনে হচ্ছে…
-দুটো তো একই আপা। একই দামের…
-দাম নাতো, তোর গলারটা বেশি পাতলা মনে হচ্ছে।দে না…
রিমি মহানন্দে নিজের গলার চেইনটা খুলে নিয়ে সিমিকে দিলো। সিমি ইমিটেশনের চেইনটা সানন্দে গলায় পরলো। আনন্দে তার চোখ চকচক করছে।
#পর্ব_২৭
নাসিমা বিরক্ত ও রাগান্বিত। সিমি এত বোকা! রিমি সাথে সাথেই সিমির গলার চেইনটা খুলে নিলো।
-এত পাতলা চেইন তোর গলায় মানাচ্ছে না আপা। আরেকটু বড় লকেটসহ হলে ভালো হবে! কাল চেইঞ্জ করে নিয়ে আসবো!
-আমার লকেটটা এস লিখা নিস!
রিমি মাথা নাড়লো।
নাসিমা মেয়ের কান্ডে হতভম্ব।
সিমির ঘর থেকে বক্স দুটো হাতে বেরিয়ে, মায়ের কানে কানে রিমি বললো,
-পৃথি আপার কাছে চলো।
পৃথিলা শুয়েছিলো। রিমিকে দেখেই উঠে বসলো।
-আপনি ওয়েট করছিলেন আমার জন্য?
-কালই চলে যাচ্ছিতো… তোর সাথে দেখা করে যাবো বলে।
-আপনার জন্য একটা গিফট ছিল। এই যে…
রিমি চেইন দুটো বাড়িয়ে ধরলো।
-আমার খুব ভালো লাগবে, যদি নেন! একটা আমার জন্য অন্যটি আপনার। সেইম…
-উপহার কিন্তু পছন্দ করে দিতে হয়।
-তাহলে এটা নিন। ওটা আমার!
রিমি স্বর্ণের চেইনটা পৃথির দিকে বাড়িয়ে ধরলো। পৃথি হাতে নিয়ে বিছানার পাশেই রাখলো। ইমিটেশনেরটা রিমি পৃথিলার সামনে টেবিলেই রাখলো।
-আমি ফ্রেশ হবো। আপনি খেয়েছেন?
পৃথিলা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
রিমি বেরিয়ে দরজার কাছে যেতেই পৃথিলা বললো,
-তুই এত কেন ইনসিকিউরড রিমি?
রিমি তাকালো শুধু।
-নিজের সিকিউরিটি তো তুই অন্যভাবেও তৈরি করতে পারিস, তাই না? দারিদ্রতা, অসহায়ত্ব, স্ট্রাগল কখনোই একটা মানুষের গুণ নয়, দুর্বলতা। সেটা তো জানিস, তাই না? একটা মানুষ তাঁর দক্ষতা দিয়ে যেটা অর্জন করে সেটা গুণ।
রিমি মিষ্টি করে হাসার চেষ্টা করলো।
-তুই কেন স্থায়ীভাবে নিজের সিকিউরিটি তৈরি করছিস না। সাময়িক কিছু কি কখনোই শুভ? যা পাচ্ছিস তাই আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছিস যে… এমনও তো হতে পারে ওটা সলিড নয়। জীবন অনেক দীর্ঘ সময়ের রিমি। আমরা ভেবে নিই জীবন ছোট.. বাট ইট’স এ লং জার্নি…..
-আপা, অনুভূতি আর সম্পর্কে আমরা সবাই একইসাথে ইনসিকিউরড এবং এই দুই বিষয়ই সাময়িক। দীর্ঘ জীবনে আমরা শুধু টেনে নিয়ে যাই মাত্র। পয়েন্টটা হলো, কে কোন প্রসেসে শেষ করবে? কেউ হেরে, কেউ জিতে শেষ করে। তবুও তো করে…
করতে হয়! সুখ বা দুঃখ কোনো অনুভূতিই একটার উপস্থিতিতে আরেকটা মিথ্যে হয়ে যায় না। এই যেমন, আমার এখনের আর্থিক স্বচ্ছলতা কিন্তু আগের অর্থনৈতিক কষ্টের দিনগুলোকে মিথ্যে করতে পারেনি। শুধু বদল এসেছে…
-তার মানে তুই বলতে চাইছিস, যেটা সাময়িক অথচ সুখের তুই সেটা নিবি।
-অবশ্যই নিবো। ধরেন, আমার ভীষণ পেট ব্যাথা। ডাক্তার বলে দিলো এই পেট ব্যাথা আমার আজীবনের। এরমধ্যে কেউ একজন আমাকে একটা ঔষধ দিয়ে যদি বলে এটা খেলে এক ঘন্টার জন্য আপনি এই ব্যাথা থেকে মুক্তি পাবেন, তাহলে কেন খাবোনা? এক ঘন্টাও জীবনে কম কি?
পৃথিলা এবার রিমির দেওয়া চেইনের বক্সটা খুললো!
-গোল্ড। বাপরে, বিজনেস তো ভালোই এগিয়েছে দেখছি। সাথে বুদ্ধিও…..
-আমার এখন সত্যিই ফ্রেশ হতে হবে আপা। ক্লান্ত লাগছে।
রিমি বেরিয়ে গেল!
নাসিমা দরজার আড়ালে দাড়িয়ে ঠিক দেখলেন, রিমি চলে যেতেই পৃথিলা নিজের চেইনটা বদলে রিমির টেবিলে রাখা ইমিটেশনের চেইনটা নিলো…
পৃথি বেড়িয়ে যাবার সময় নাসিমা পিছু ডাকলেন।
-থেকে যা, কতদিন আর আসবিনা…
পৃথিলা ছলছল চোখে বেড়িয়ে গেল। রাগ হচ্ছে তার, কষ্ট হচ্ছে তার। যে শোয়েবকে সে অনায়াসেই পেত, রক্তের সম্পর্কের জন্য লড়াই করে পেতে হচ্ছে।
বারান্দা পেড়িয়ে পৃথিলা ওড়নায় চোখ মুছলো। মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারলে….
পৃথিলা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না।
রাতে রিমি শুতে গিয়েই বললো,
-মা, তুমি অন্য ঘরে শোও। পার্টিশানের দরজা আটকে দিও। আমি একা শুবো।
নাসিমা চট করে বিছানায় উঠে গেলেন।
-আমি তোর সাথেই শুবো রিমি.. একা একা আমার ভয় লাগে খুব…..
স্বর্ণের হারটা নাসিমা মেয়ের গলায় পরিয়ে দিলেন।রিমি প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো।
-দুজনকেই তুই বেছে নেবার সুযোগ দিলি, দুজনেই কিনা ইমিটেশন নিলো? তোর জিনিসে মেয়েদুটোর কি যে লোভ! কিন্তু তোর চেষ্টা, তোর ভাগ্য, তোর সফলতা চাইলেও তোকে ছেড়ে যাবেনা।
-লোভ করে তো জেতা যায়না মা। সততা নিয়ে চেষ্টা করলে অনেক ছোট জিনিস বড় হয়ে যায়, আবার শুধু লোভের কারণে অনেক বড় জিনিস ছোট হয়ে যায়… হুহ..
-কত জ্ঞানী হয়ে গেছিসরে তুই! এঁই শোয়েবের মা তোকে কিছু দিলো? প্রথমবার ছেলের বৌয়ের মুখ দেখলো… কি দিলোরে?
রিমি জবাবে মুখ ভেংচালো শুধু।
হেডফোনটা কানে লাগিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলো। আজকাল তার গান শুনতে বেশ মজা লাগে, বিশেষ করে রোমান্টিক গান।
এই যেমন,
“তোমায় দেখতে দেখতে আমি, যেন অন্ধ হয়ে যাই…”
আচ্ছা, দেখতে দেখতে অন্ধ হবার কি আছে?
অবশ্য শোয়েব ভাইকে দেখে দেখে অন্ধ হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই…
(চলবে)