#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১৬
৩০।
অনেকদিন ধরেই মহুয়া বাতিঘরে যায় নি। যেহেতু বাসায় বিয়ের তোড়জোড় চলছে, এর মধ্যে বই পড়ার মতো সময় তার একদমই নেই। কিন্তু প্রহর প্রতিদিনই মহুয়ার অপেক্ষায় থাকে। আর দিনশেষে মহুয়াকে না দেখে এক রাশ আক্ষেপ নিয়ে ঘরে ফিরে। মহুয়া সপ্তাহে একদিনই বাতিঘরে যায়। আর আজ সে না গেলে তিন সপ্তাহ হয়ে যাবে। কিন্তু আজ মহুয়ার পক্ষে বাতিঘরে যাওয়া একদমই অসম্ভব। কারণ আজ মাফিন ও স্বস্তিকার এনগেজমেন্ট।
এদিকে প্রহর আজ অফিসে না গিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্তই বাতিঘরে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রহর এতোদিন সেখানে বিকেলেই গিয়েছিল। আর মহুয়া তো সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে বসেই বই পড়তো। তাই এতোদিন প্রহর অফিস থেকে ফেরার পর বাতিঘরে গেলেও মহুয়াকে দেখতে পেতো। আর এখন যেহেতু মহুয়ার সাথে তার দেখা হচ্ছে না। তাই সে ভাবছে, হয়তো তার মায়াবিনী সকালে এসে বই পড়েই চলে যায়। আগের মতো সন্ধ্যা পর্যন্ত আর বসে থাকে না। আবার এমনও তো হতে পারে সে এখন সপ্তাহের অন্য কোনো দিন এসে বই পড়ছে।
আজ প্রহর অনেক আশা নিয়েই তার মায়াবিনীর জন্য অপেক্ষা করছে। আর তাকে সঙ্গ দিচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের “নবনী” উপন্যাসটি।
এদিকে স্বস্তিকা সকাল থেকেই আয়নার সামনে বসে রূপচর্চা করছে আর কিছুক্ষণ পর পর তার নতুন শাড়ির দিকে তাকাচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে এখনই শাড়িটা পরে ফেলতে। কিন্তু তাকে তো একটু ধৈর্য ধরতে হবে। কারণ অনুষ্ঠান শুরু হতে আরো কিছু সময় বাকী আছে।
স্বস্তিকা শাড়ির সাথে মিলিয়ে পরার জন্য গহনা বের করছে ও এরপর মেকাপ টিউটোরিয়াল দেখে কিভাবে সাজবে তা নিয়েই চিন্তা করছে। হঠাৎ ফাতেমা জান্নাত এসে স্বস্তিকার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“কথা বলো। তোমার সাথে কথা বলবে।”
স্বস্তিকা ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, “কে?”
ফাতেমা জান্নাত কোনো উত্তর না দিয়েই চলে গেলেন। স্বস্তিকা কানের কাছে ফোন নিয়ে মিনমিন করে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম।”
ওপাশ থেকে মাফিন বলে উঠলো,
“এতো আস্তে সালাম দিচ্ছো? পেট কামড়াচ্ছে নাকি?”
পুরুষের কন্ঠের স্বর শুনে স্বস্তিকা নড়েচড়ে বসলো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো নম্বরটি সেইভ করা নেই। সে আবার কানের কাছে ফোন নিয়ে বলল, “কে বলছেন?”
মাফিন হেসে বলল,
“আন্টি যেহেতু তোমাকে ফোন ধরিয়ে দিয়েছে, তাহলে তো বোঝা উচিত, আমি কে হতে পারি!”
স্বস্তিকা আমতা আমতা করে বললো,
“আপনি কি সেই উনি?”
মাফিন মুখ চেপে হেসে বললো,
“হুম, আমি সেই উনি।”
“ওহ আচ্ছা।”
স্বস্তিকা মনে মনে হাসলো। তারপর আয়নায় নিজেকে দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করলো।
মাফিন বলল,
“কার্টুনের মতো বসে আছো, তাই না?”
স্বস্তিকা চোখ বড় বড় করে মাথা তুলে নিজেকে একবার দেখে বলল,
“কার্টুনের মতো বসে আছি মানে?”
“তুমি কি কার্টুন দেখো না?”
“না, আমি কি বাচ্চা? আপনি কি আমাকে বাচ্চা ভাবছেন?”
“তুমি তো বাচ্চাই।”
স্বস্তিকা কথাটি শুনেই মুখ ভার করে রইল। মাফিন আবার বলল,
“আচ্ছা তোমার তো একটা নাম আছে, তাই না?”
“তো? আমার কি নাম থাকবে না?”
“হ্যাঁ, সেই নামটাই বলো। কি নাম তোমার?”
“আপনি কি নাম জিজ্ঞেস করার জন্য আমাকে ফোন দিয়েছেন?”
“হুম।”
“নামটা তো আপনি আম্মিজান থেকেও জিজ্ঞেস করতে পারতেন।”
“যার নাম সে নিজে বললেই অনেক সুন্দর দেখায়।”
স্বস্তিকা গাল ফুলিয়ে বলল,
“আজ আমাদের এনগেজমেন্ট আর আপনি এখনো আমার নাম জানেন না?”
“কিভাবে জানবো? তুমিই তো বলো নি। আর তোমার নাম মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করার সাহস ছিল না। আর বোনরাও হয়তো জানে। কিন্তু ওদের কাছে জিজ্ঞেস করলে ওরা হাসাহাসি করবে। বলবে, আমি এখনো নাম জানতে পারি নি। তাই তোমার কাছেই জিজ্ঞেস করছি।”
“আচ্ছা, বুঝলাম। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”
“কি প্রশ্ন?”
“আম্মিজানকে ফোন দিয়ে এমন কি বলেছেন যে আমাকে ফোন ধরিয়ে দিয়েই চলে গেল!”
“এটা আবার কেমন প্রশ্ন?”
“আম্মিজান তো আমাকে কখনো কোনো ছেলের সাথেই কথা বলতে দেয় নি। তাই আমার জানার ইচ্ছে জাগছে আপনি কি এমন বলেছেন?”
মাফিন শব্দ করে হাসলো। স্বস্তিকা নিচু স্বরে বললো,
“হাসার মতো কি কিছু বলেছি?”
“তুমি আসলেই একটা কার্টুন। আমি কি যেমন-তেমন ছেলে নাকি? আমার সাথেই তো আজ তোমার এনগেজমেন্ট। একটুখানি কথা বলার অনুমতি তো দেবেই।”
স্বস্তিকা রাগী কন্ঠে বলল,
“আপনি আমাকে বার বার কার্টুন বলছেন কেন?”
“কারণ তুমি দেখতে কার্টুনের মতো। একদম ডোরেমন।”
“আর আপনি দেখতে জিরাফের মতো।”
“তোমার তো সবাইকে জিরাফই মনে হবে কারণ তুমি ছোটবেলায় হরলিক্স খাও নি।”
স্বস্তিকা গম্ভীরমুখে বলল,
“আর কিছু বলবেন?”
“নামটা কিন্তু এখনো জানালে না।”
“আমার নাম স্বস্তিকা তালুকদার।”
“আর আমার নাম মাফিন ইবনে উম্মী।”
স্বস্তিকা অবাক কন্ঠে বলল,
“এ আবার কেমন নাম!”
“কেন তোমার পছন্দ হয় নি?”
“না, তা না। আচ্ছা, মাফিন ইবনে উম্মী অর্থ কি?”
“মাফিন অর্থ কোমল পিঠা। আচ্ছা, তুমি মাফিন কেকটা কখনো খেয়েছো?”
“হুম, খেয়েছি।”
“মা বলেছে, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন অনেক ভীতু ও গোলগাল চেহারার ছিলাম। মা তাই আদর করে আমাকে মাফিন নাম দিয়েছিল।”
“আর উম্মী অর্থ?”
“একচুয়েলি বাংলা উচ্চারণে উম্মী মনে হলেও, নামটা আসলে উম্মে। ইউ এম এম ই, উম্মে। কিন্তু কিভাবে যেন উম্মী হয়ে গেল। আর উম্মে অর্থ মা। যদিও আমার নাম শুনলে হঠাৎ মনে হতে পারে, এটা হয়তো কোনো মেয়ের নাম। কিন্তু আমার নামের সম্পূর্ণ অর্থ মাফিন মায়ের ছেলে।”
“অনেক সুন্দর অর্থ। আচ্ছা, আমি আপনাকে কি বলে ডাকবো?”
“মাফিন বলেই ডাকবে।”
“না, আমি এভাবে আপনাকে নাম ধরে ডাকতে পারবো না।”
মাফিন স্বস্তিকার কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল,
“হায় আল্লাহ। তুমি তো আগাগোড়াই একটা কমেডি সিরিজ। দেখো স্বস্তিকা, আমাকে মাফিন বলেই ডাকবে। এই যে শুনছো, ওগো, হ্যাঁ গো এসব বললে কিন্তু ঝামেলা হবে।”
“কি ঝামেলা হবে?”
“আমার এসব পছন্দ না।”
“ওহ আচ্ছা।”
মাফিন কিছু না বলে কল কেটে দিল। স্বস্তিকার সাথে শুরুতে কথা বলে তার ভালোই লেগেছিল। কিন্তু হঠাৎ কেন যেন তার বিরক্ত লাগা শুরু হয়ে যায়। মাফিন মনে মনে ভাবল,
“শেষমেশ একটা টিউবলাইট আমার কপালে এসে জুটলো।”
বিকেলে স্বস্তিকা ও মাফিনের এনগেজমেন্টের পর মাফিন স্বস্তিকার সাথে কোনো কথা না বলেই চলে গেল। স্বস্তিকার বিষয়টা ভালো লাগলো না। হঠাৎ কি এমন হলো যে মাফিন তার সাথে কোনো কথায় বললো না।
এদিকে মহুয়ার অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে রাত হয়ে গেল। তাই প্রহর মন খারাপ করে বাতিঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটতে লাগলো। তার এই মুহূর্তে মায়াবিনীর জন্য চিন্তা হচ্ছে। প্রহর ভাবছে,
“মেয়েটা এতোদিন কেন আসছে না? ওর কোনো সমস্যা হয় নি তো? মেয়েটা কি অসুস্থ?”
প্রহর এসব ভাবতে ভাবতে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে সোজা বারান্দায় গিয়ে বসে পড়লো। তারপর টুস-টুসির দিকে তাকিয়ে বলল,
“টুসটুস, আমি কি মায়াবিনীকে একটা মেসেজ পাঠাবো? জিজ্ঞেস করবো তার কি হয়েছে?”
অনেক ভাবাভাবির পর প্রহর মারিয়ার আইডিতে একটা মেসেজ পাঠিয়ে লিখলো,
“কেমন আছো?”
কিন্তু কোনো উত্তর এলো না। প্রহর অনেক রাত পর্যন্ত এই আশায় বসে ছিল যে তার মায়াবিনী তার মেসেজের উত্তর দেবে। কিন্তু দেয় নি। শেষমেশ নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে প্রহর সকালে উঠেই তার মাকে তার মনের কথা জানিয়ে দিল। সব শুনে মাসুমা আকতার বললেন,
“আমার ছেলেটা একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে, আর তার সাথে কি আমার ছেলের বিয়ে দেবো না? তুই একদম চিন্তা করিস না। আমি মেয়েটার খোঁজ নিয়ে দেখবো।”
মায়ের কথায় প্রহর এবার চিন্তামুক্ত হলো। আর মনে মনে ভাবলো,
“মায়াবিনী, তুমি এবার কিন্তু আমারই হবে।”
চলবে-