#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৯
রাত সাড়ে তিনটার দিকে আদিরা ওর মা-বাবার সাথে বড়ো রাস্তার পাশে একটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে আছে। দেলোয়ারের কাঠের ব্যাবসার ট্রাক ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করেছে। কিছু চোরাই কারবার আছে যা এখন ঠিকঠাকের কাজ চলছে। রাস্তায় মানুষজন নেই। দুই একজন তাও দেলোয়ারের লোক। ওদের ট্রাক চলে যাবার পর ওরাও এখন নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে। রাস্তায় একটাও গাড়ি নেই। আদিরার বাবা বলেন,
–শোন মা, তুই কোনো চিন্তা করবি না। কাইল যদি দেলোয়ার আমারে জিগাইবো তহন আমি কমু যে তুই ওগো কোনো এক ট্রাকের ভিতর লুকায়ে ঢাকা গেছোছ। তারপর আমরা আর জানি না তোর ব্যাপারে।
আদিরা অবাক হয়ে বলে,
–আব্বা তুমি মিথ্যা বলবা?
আদিরার বাবা গামছা দিয়ে চোখ মুছে আদিরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
–আর কোনো উপায় নাইরে মা। একটা মিথ্যা যদি তোরে বাঁচাতে পারে তাহলে আমি মিথ্যাই কমু। গুনাহ্ হইবো জানি কিন্তু আমার মাইয়া তো ভালা থাকবো। আর এই মিথ্যা না কইলে চেয়ারম্যান আমাগোরেও গ্রামে টিকতে দিবো না। তুই ঢাকা গিয়া খুব ভালা কইরা পড়ালেখা করবি। এই গ্রামে তুই মাথা উুঁচু করে ফিরবি। কোনো দেলোয়ার তহন তোর চুলও বাঁকা করতে পারবো না।
আদিরা কাঁদতে কাঁদতে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে। সে তার বাবা-মা, ভাইকে অনেকগুলো বছর দেখতে পারবে না ভেবেই তার বুক কস্টে ফেঁটে যাচ্ছে। আদিরার মা আদিরার কপালে স্নেহের স্পর্শ এঁকে বলেন,
–গাড়ি কখন আসবো? একটু খবর নিয়া দেখ। তোর ভাইটা বাড়িতে একা তো।
আদিরা মারসাদের নাম্বারে ফোন করে। মারসাদ ফোন ধরে না। আদিরার তখন ভয় হতে থাকে যে মারসাদ কী সত্যি সত্যি আসবে? সে তার বাবা-মাকে আশ্বাস দিয়েছে যে। তার বাবা যে কীনা তাকে ইন্টারের পর পড়াতে চায় নি সেও এখন চায় আদিরা পড়ুক। ভোর চারটা বাজতে চলল এমন সময় কিছুটা দূরত্বে একটা গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা গেলো। আদিরারা আড়ালে লুকিয়ে গেলো। লুকিয়ে নজর রাখতে লাগলো কে এসেছে।
মারসাদরা গাড়ি এক জায়গায় থামায়। আহনাফ ড্রাইভারকে বলেছে হেডলাইট যেনো বন্ধ রাখে। মারসাদ তখন আদিরার কল কে*টে দিয়েছিল। এখন সে আদিরার নাম্বারে কল করে। আদিরা তার হাতের ফোনটার সশব্দে চিৎকারে হকচকিয়ে উঠে তারপর স্ক্রিনে মারসাদের নাম্বার দেখে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। ফোন রিসিভ করে সালাম দিলে মারসাদ গম্ভীর স্বরে বলে,
–কই তুমি? আমরা চলে এসেছি।
আদিরা মারসাদের গম্ভীর কন্ঠস্বরে সামান্য চকিত হলেও এবার বুঝতে পারে ওই গাড়িটাতে মারসাদরা আছে। আদিরা মারসাদকে বলে,
–কাছেই আছি। একটু অপেক্ষা করুন আসছি।
আদিরা ওর বাবা-মাকে নিয়ে আস্তে আস্তে সতর্কতার সাথে গাড়ির কাছে যায়। মারসাদ আদিরার বাবা-মায়ের সাথে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করার পর আদিরার বাবা বলেন,
–তুমি কে বাবা? আদিরার বন্ধু?
মারসাদ আদিরার বাবার প্রশ্নের ধরণ বুঝে বিনম্র স্বরে জবাব দেয়,
–না আঙ্কেল। আদিরার বান্ধুবী মাহির বড়ো ভাই আমি। আদিরা যে ভার্সিটিতে পড়ে আমিও সেখানে পড়ি। আমার বোন আমাকে জানানোর পর আমি আদিরাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনি চাইলে আমার বোনের সাথেও কথা বলতে পারেন।
আদিরার বাবা লজ্জিত হলেন মারসাদ তার কথার ধরণ বুঝে ফেলাতে। তিনি ইতস্তত কন্ঠে বলেন,
–তুমি আমারে ভুল বুইঝো না বাবা। মাইয়া আমার ঢাকা যাইবো তোমাগো লগে আর আমি তো তোমাগো চিনি না তাই আরকি!
আহনাফ মারসাদের পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলে,
–সমস্যা নেই আঙ্কেল। আদিরা আমার ছোটোবোনের মতো। ওর কোনো ক্ষতি হতে দিবো না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।
আদিরার বাবা-মা দুজনেই ভরসা পেলেন। আহনাফ আদিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–আদিরা তুমি সিমকার্ডটা এখানে রেখে যাও। ঢাকা গিয়ে নতুন সিমকার্ড কিনে নিও। দেলোয়ার লোক লাগিয়ে তোমার খোঁজ পেলেও পেতে পারে। আঙ্কেল-আন্টিকে জিজ্ঞাসা করলে বা ফোন সার্চ করে যেনো বিশেষ লাভ না হয়।
আদিরা তাই করে। সময় স্বল্পতার কারণে আদিরা অতিদ্রুত তার বাবা-মায়ের কাছে থেকে অশ্রুসিক্ত বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। মারসাদ আদিরার বাবার কাছে এসে দাঁড়ায় তারপর পকেট থেকে দুই লাখ টাকার চারটা বান্ডেল বের করে আদিরার বাবার হাত ধরে বলে,
–কিছু মনে করবেন না আঙ্কেল। এই টাকাগুলো দিয়ে নিজেকে ঋণ মুক্ত করবেন। আদিরাকে জানাবেন না এর ব্যাপারে।
আদিরার বাবা মারসাদের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুই পা পিছিয়ে যান। সে নিতে অস্বিকৃতি জানিয়ে বলেন,
–না বাবা। মাফ করো আমারে। আমি এই টাকা নিতে পারমু না। এক ঋণ মিটাইতে গিয়ে আরেক ঋণ হইবো। তাছাড়া তুমি আমার মাইয়ারে উদ্ধার কইরা এমনেও আমারে ঋণি করছো।
মারসাদ মুচকি হেসে বলে,
–আমি এক বাবাকে দিচ্ছি। যিনি তার মেয়েকে বাঁচাতে অসহায় ছিল। তার মেয়েকেও বাঁচিয়ে নিয়েছি। আপনি এটাকে ধার হিসেবে নেন তাহলে। কোনোদিন যদি এর থেকেও বহু মূল্যবান কিছু চেয়ে বসি তাহলে সেটা আমাকে দিয়েন। আর টাকাটা আমার মৃত মায়ের ও আপিলির। আমার নিজের না। আমার মায়ের এক সন্তান ন*রপ*শুদের হাত থেকে টাকা থাকা স্বত্বেও বাঁচতে পারে নি। দয়া করে রাখবেন এটা।
আদিরার বাবা ইতস্তত করছেন। মারসাদ তা দেখে বলে,
–বেশি ভাববেন না। আমি আপনার মেয়ের দেনমোহর দিলাম।
আদিরার বাবা-মা চমকে তাকালেন। দেনমোহর তো বিয়ের সময় দেয়। তারা তো তার মেয়ের বিয়ে দেয় নি। মারসাদ হেয়ালি করে বলে,
–বিশ্বাস রাখতে পারেন। আমি আপনার বিশ্বাস ভাঙবো না। সামনে যদি কোনো খারাপ পরিস্থিতি আসে তাহলে আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করে নিবো। আপনাদের অনুমতি চাই। মেয়ের দেনমোহর হিসেবে রাখুন। এরপর আপনার মেয়েরটা আপনার মেয়ের সাথে বুঝে নিবেন। এখন আমার সময় কম। ফজরের আজান হবে কিছুক্ষণের মধ্যে। তার আগেই চলে যেতে হবে।
মারসাদ টাকা গুলো জোর করে আদিরার বাবার হাতে দিয়ে চলে যায়। আদিরার বাবা অবাক হয়ে মারসাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।
……………
আঁধার কেটে নতুন প্ররাম্ভ। আসরের পর প্রকৃতিতে এক পশলা ভারী বর্ষণ হলো। কৃষ্ণ মেঘের ঘনঘটা বিশাল অন্তরিক্ষে। কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়ার ডাল ভেঙে পরে আছে রাস্তাঘাটে। কেউ হয়তো কৃষ্ণচূড়া তার প্রেয়সীর হাতে মুঠোভরতি করতে চেয়েছিল। আদিরারা এখন ঢাকা এসে পৌঁছালো। আসার পথে যাত্রা বিরতির জন্য দেরি হলো। পুরো পথে মারসাদ আদিরার সাথে একটা শব্দ বিনিময়ও করে নি। আদিরা মারসাদকে কিছু বলতে উসখুস করছিল কিন্তু গম্ভীর্যতাপূর্ণ মুখাবয়ব দেখে সাহস হয় নি। আদিরার হোস্টেলের সামনে আদিরাকে নামিয়ে দিয়ে একটুও অপেক্ষা না করে চলে গেল মারসাদরা। আদিরা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে নির্নিমিখ পথের দিকে চেয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেসে গিয়ে সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া সব ভাবতে লাগলো। এতো কিছু হয়ে গেলো চারটা মাসে যে চোখের পলকেই সব হয়ে গেলো। আদিরা স্বগোতক্তি করে,
“আমার সকল বিপদে না চাইতেও আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত হয়। কিন্তু কেনো? এজন্যই কী বলেছিলেন? আপনার মন চুরি করেছি? আমার তো মনে হয় আপনি স্বেচ্ছায় মন হারিয়েছেন! তবে আপনি আমার প্রয়োজনের বাহিরে প্রিয়জন হয়ে উঠুন! আজ কিয়ৎ অনুমতি দিলাম মনকে!”
……..
হোস্টেলের ছাদের চাবি নিয়ে মারসাদ ছাদে উঠলো। আরক্তিম আভা ছড়িয়ে ভানু পশ্চিম আকাশে হেলে পরেছে। আকাশে এখনও কিয়ৎপরিমাণ মেঘের উপস্থিতি রয়েছে। হয়তো রাতের আঁধার বিশালাকায় অম্বরে ছেয়ে গেলে আবারও নিজেদের ঝমঝম ছন্দে আবির্ভাব ঘটবে বৃষ্টিকন্যাদের। মারসাদের মন হুট করে খুব ভালো হয়ে আছে। সন্ধ্যায় পাখিদের ঘরে ফেরার কিচিরমিচির গানে মারসাদ ছন্দ কাটে,
“রাঙুক এই আরক্তিম অম্বর,
তোমার আমার প্রণয়ের রঙে।
কৃষ্ণচূড়ার চাদরে আচ্ছাদিত বর্ষণমুখর শহরে,
প্রেম আসুক নিজের সকল রঙ নিয়ে।
আমৃত্যু আমি বারবারে তোমার প্রেমে পরতে চাই,
মায়াবিনী মনোহারিণী!”
_______তিথী
________
মারসাদের ভাবনাশক্তিকে সত্য করে সন্ধ্যায় প্রকৃতি বর্ষণে সিক্ত হলো। আদিরার রুমমেট একজন আছে শুধু। সে আগে আগে বাড়িতে গিয়ে ফিরেও এসেছে। আদিরা জানালার ধারে অলস বসে বৃষ্টি উপভোগ করছে। আজ গ্রামে থাকলে এবং কোনো পারিপার্শ্বিক বাধা-বিপত্তি না থাকলে আদিরা উঠোনজুড়ে বৃষ্টিতে ভিজতো। বৃষ্টির শিতল ছাঁটে মুগ্ধ হতো। আদিরার রুমমেটও আদিরার সাথে এসে বসেছে। দুজনে একসাথে বৃষ্টি দেখছে। আদিরার রুমমেট তার মোবাইলে রবীন্দ্রসংগীত “মন মোর মেঘের সঙ্গী” ছেড়ে দিলো। আদিরার রুমমেট রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত। দুজনে মিলে বৃষ্টিতে হাত ভিজিয়ে উপভোগ করছে।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,
দেরি হওয়ার জন্য দুঃখীত। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।