দিন_বদলের_হাওয়ায়
পর্বঃ০৩
তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
বিছানাসহ পায়ের দিকের অংশটা পানিতে ভিজে যাচ্ছে। শোয়া থেকে উঠে রেদোয়ানকে ডাক দিলাম। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। দুই তিন বার ডাকার পড়ে সে উঠলো। কি আশ্চর্য নিজের লুঙ্গি সহ পায়ের অংশটা সবটুকু ভিজে যাচ্ছে আর সে টেরও পাচ্ছে না। রেদোয়ান উঠে বসে রইলো কিছুক্ষণ। চোখের ঘুম কাটে নি বোধহয়। আমি বিছানা গুটানোর চেষ্টা করছি। রেদোয়ান চোখ মুছে বললো, আমার লুঙ্গি ভেজা কেনো? আমি কি বিছানায়..?
তার এমন কথায় প্রচুর রা”গ হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চে,পে বললাম, উপরে দেখো।
রেদোয়ান উপরের দিকে তাকালো। চালের ফুঁটো দিয়ে পানি পড়ছে। সেও উঠে আমার সাথে বিছানা সরানোর চেষ্টা করছে। চাদরটা উঠিয়ে তোশকটা মুড়িয়ে একপাশে রাখলাম। চালের কোন অংশ দিয়ে পানি পড়ছে তা দেখার চেষ্টা করছে রেদোয়ান। এরপর আমাকে বললো, আয়ু বড় সাইজের কোন পলিথিন হবে? নিয়ে এসো যাও। নাহলে পানি আটকানো যাবে না। আর যেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে মনে হয় না তাড়াতাড়ি থামবে।
পলিথিন তো এখানে নেই। তাহলে তো মায়ের কাছে যেতে হবে।
তবে যাও না! দাঁড়িয়ে আছো কেন? সব ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে দেখছো?
আমি কিছু না বলে মায়ের ঘরের দিকে গেলাম। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। মায়ের ঘরের সামনে যেতেই মা বাবাকে বারান্দায় দেখলাম। তারাও কাঁথা বালিশ সরাচ্ছে। কি আশ্চর্য! মা বাবা বারান্দায় ঘুমিয়েছে? তাহলে কি মামা মামি যায় নি? আমি মায়ের কাছে যেতেই মা বললো, কি হইছে আয়রা? তোগো ঘরে কি পানি পড়তাছে? খাড়া আমি পলি আইনা দেই।
মা বিছানা সরাতে সরাতে বাবাকে বললেন, আপনে বিছানা সরান আমি ওরে পলিথিন দেই।
এরপর মা ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলেন। দুই তিন বার ধাক্কাধাক্কির পর মামি দরজা খুললেন। ঘুম জড়ানো চোখে বললেন, এতো রাইতে দরজা টাক্কাটাক্কি করতাছেন কেন? ঘুমাইতে দিতেন না?
পলি নিমু সুরমা। আয়রার ঘরে পানি যাইতাছে।
মামি বিরক্ত হলেন প্রচুর। মা ঘর থেকে পলিথিন নিয়ে আমায় দিলেন। আমি সেটা নিয়ে দ্রুত ঘরে গেলাম। রেদোয়ানকে দিলাম। সে কিভাবে যেন সেটাকে চালের সাথে এক করে দিলো। এরপর খাটে বসতে বসতে বললো, লুঙ্গি দাও তো আয়ু। এটা তো পুরোটাই ভিজে গেছে।
ওকে অন্য একটা লুঙ্গি দিয়ে ভাবলাম মা বাবার কাছে যাবো। তারা ওই বারান্দায় থাকলে তো পুরো ভিজে যাবে। রেদোয়ানকে কিছু না বলে আবার মা বাবার কাছে গেলাম। বিছানা গুটিয়ে একপাশে দুজনে বসে আছে। বাড়ির অন্য কারো কোন শব্দ পাচ্ছি না। সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে বোধ হয়। অনেকটাই ভিজে গেছে তারা। আমার নিজের অবস্থাও ভিজে চুপচুপে। মা বাবার কাছে গিয়ে বললাম, বাবা ঘরে চলো এখানে থাকলে ভিজে অসুখ করবে।
মা বাবা একে অপরের দিকে তাকালেন। দুজনকেই ইতস্তত বোধ করতে দেখলাম। বাবা তো ভাবনার সাগরে ঢুবে গেছেন। আমি আবার বললাম, কি ভাবছো? জলদি চলো। ভিজে কি হয়েছে অবস্থা দেখেছো?
বলেই বাবা মাকে টেনে ঘরে নিয়ে আসলাম। রেদোয়ানকে সব বলে আবার মামির কাছে গেলাম। ওই ঘর থেকে বাবা মায়ের জন্য শুকনো কাপড় আনতে হবে। কয়েকবার দরজা ধাক্কা দিয়েও মামির সারা পেলাম না। এরপর জোরে ধাক্কা দিয়ে মামিকে ডাকলাম। মামি বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতে খুলতে বললো, বার বার এভাবে দরজা ধক্কাছ কেন? মাইনষেরে ঘুমাইতে দিবি না? তোগো জ্বা_লা_য় কি এই বাড়িতে কেউ টি_ক_তা_র_বো না? তুই তো মস্ত বড় একটা আ_প_দ!
ভীষণ অবাক হলাম। মামির এ ব্যবহার প্রত্যাশা করি নি। তার চেয়ে বড় কথা আমার বাবার বাড়িতে সে আমার সাথে এভাবে কথা বলছে? রা,গ হলো প্রচুর। বললাম, ‘বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে তা দেখতে পাচ্ছো মামি? এই বৃষ্টিতে মা বাবা বারান্দায় বসে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। আর তুমি ঘুমানোর চিন্তা কর? কেমন মানুষ তুমি? যাদের কাছে থাকছো তাদের প্রতি এই সহমর্মিতা তোমার?
বলেই দ্রুত ঘরে ঢুকে গেলাম ড্রয়ার থেকে মায়ের শাড়ি আর বাবার জন্য লুঙ্গি, গেঞ্জি নিবো। মামি আমার পিছন পিছন আসতে আসতে বললো, কি! আমাকে এতো বড় কথা শুনালি তুই? এ বাড়িতে দুদিনের জন্য বেড়াতে আসছি আর তুই!
মামি রা,গে কথা বলতে পারছেন না। তবুও রা,গ সংযত করে বললেন, তুই আমাকে সহমর্মিতা শিখাতে এসেছিস? আগে নিজে এটা শিখ। তোর জামাইয়ের চাকরি আছে? খাছ তো মা বাপের ঘাড়ে বসে। খাছ আবার প্যাকেটে প্যাকেটে কি কি জানি নেছ দেখলাম বিকালে। আমি তো চলেই যাবো। নিজে আগে শিখ।
মামির কথায় চোখ ভরে গেলো। এভাবে কথা বলবে আশা করি নি। কাঁপা কণ্ঠে বললাম, আমি কি এখানে থাকতে এসেছি? আমিও তো বেড়াতে এসেছি। বাবা মায়ের ঘাড়ে কোথায় খেতে আসলাম?
মামি দ্বিগুণ উ”ত্তে”জ”না নিয়ে বললেন, হ শ্বশুর বাইত্তেও তো মাইনষের ঘা,ড়ে বইসা খাছ। ছোট ছোট দেবর গুলারে ভা”ই”ঙা খাছ। সবাইরে তো ভালোই না”জে”হা*ল করা শিখছোছ। আবার বড় গলায় কথা কছ। স”র”ম করে না তোর?
মামির কথায় লজ্জায় অ,প,মা,নে মিশে গেলাম। কিছু না বলে সেখান থেকে চলে আসলাম। মামি বিড়বিড় করে আরো কি যেন বলছেন। চোখের পানি আটকে ঘরে এসে মাকে শাড়ি আর বাবাকে লুঙ্গি দিলাম। এরপর নিজের জামাকাপড়ও বদলে নিলাম। মামির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা কাউকে কিছুই বললাম না। খাটে কাঁথা বিছিয়ে উপরে বিছানা চাদরটা দিয়ে মা বাবাকে খাটে বসতে বললাম। বাকি রাতটা হয়তো নির্ঘুম কাটাতে হবে।
ভোরের দিকে বৃষ্টিটা কমে গেলো। ফজরের আযান দিতেই বাবা আর রেদোয়ান মসজিদে চলে গেলো। আমি আর মা নামাযটা পড়ে কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লাম। রাতে ঘুম হয় নি। এক ঘুমেই আটটা বেজে গেলো। উঠে দেখলাম পাশে মা নেই। রেদোয়ানও এখনো আসে নি। আড়মোড়া ভে”ঙে চুলে খোপা করে ঘর থেকে বের হলাম। বাড়িতে এখনো কেউ উঠে নি। কারো সারা শব্দ পাচ্ছি না।
পুরো উঠান কাদামাটি আর গাছের পাতায় ভরে আছে। ঝাড়ুটা হাতে নিয়ে উঠানটা ঝাড়ু দিলাম কোনমতে। কাদার কারণে ঝাড়ু দেওয়াও যাচ্ছে না। এরপর রান্নাঘরে গিয়ে মাকে দেখলাম আলু কাটছে আর কান্না করছে। কিছু বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, মা কাঁদছো কেন?
মা আমাকে দেখে দ্রুত চোখের পানি মুছে ফেললেন। এরপর বললেন, না কাঁদতাছি না।
মিথ্যা বলো না। কাঁদছো কেন?
এমনিতেই।
আমায় বলবে না? কেউ তোমায় কিছু বলেছে?
মা চুপ করে বসে রইলেন। হঠাৎই বললেন, কাইল রাইতে তোর মামির লগে তোর কথা কা_টা_কা_টি হইছে তাই না?
বুঝতে পারলাম মামি হয়তো মাকে কিছু বলেছে। নিশ্চয়ই মাকে খুব ব_কা_ব_কি করেছে। ভীষণ ক_ষ্ট হলো। আমার জন্য আমার মাকে কেউ কিছু বলুক এটা আমি চাই না। আমি অস্থির হয়ে বললাম, এইজন্য মামি তোমাকে ব_কে_ছে মা? আমায় মাফ করো মা। আমার জন্য তোমায় কত কথা শুনতে হলো। আমি এক্ষুনি মামির কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি।
মা আমার দিকে কেমন করে জেনো তাকিয়ে রইলেন। আমি উঠে মামির কাছে যেতে নিলেই মা আমার হাত ধরে থামিয়ে দিলেন। মায়ের পাশে আমাকে বসিয়ে দিলেন। এরপর বললেন, তোর মামি গেছে গা। আমিই যাইতে কইছি। তোরে অনেক কথা শুনাইছে হে তাই না রে মা? যে আমার বাড়িতে থাইকা আমার মাইয়ারে কথা শুনাইবো তার জায়গা এই বাইত্তে নাই তাই যাইতে কইছি। তোর লেইগ্গা আমার পরান পু_ড়ে রে মা। আল্লাহ্ একদিন তোরে সুখ দিবো।
মা কাঁদছে। আমি কিছু বললাম না। নিশ্চুপ ভাবে মায়ের পাশে রইলাম।
সকালে আমি আর মা মিলে নাস্তা তৈরি করে নিলাম। সাড়ে নয়টা নাগাদ সায়রা উঠলো। সায়রা রান্না ঘরে এসেই আমাকে বললো, আপা শাহেদের জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে দে না রে।
আমি বললাম, কফি তো নাই রে। চা করে দেই?
কফি নেই মানে? সবসময়ই তো এলে কফি পাই। এবার নেই কেন? মা বাবাকে বলো নি কফি আনতে?
মা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বললেন, তোর বাপে এইসব কফিটফি চিনে নাকি? গেরামের এই বাজারে ওডি পাইবো কনে? আয়রাই তো প্রত্যেকবার আসার সময় নিয়া আসে। ওগুলিই তো থাকতো ঘরে। শেষ হইয়া গেছে।
সায়রা কিছু বললো না। বিরক্তি নিয়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর পায়রা ঘুম থেকে উঠলো। সবাইকে নাস্তা বেড়ে দিলাম। সবাই যে যার মতো খেয়ে নিলো। আমি আর মাও খেয়ে নিলাম।
সকাল এগারোটা নাগাদ রেদোয়ান বাড়ি আসলো। সে নাকি তার সার্টিফিকেটের কপি আনতে বাড়ি গিয়েছিলো। বাড়িতে এসে একটু জিরিয়ে গোসল সেরে কাগজপত্র আবার নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আমিও মায়ের সাথে কাজে নেমে পড়লাম।
আবার ফিরলো দুপুর তিনটার দিকে। কাগজপত্র জমা দিয়ে এসেছে। ওনাদের নাকি ওকে পছন্দ হয়েছে। বাকিটা কাল জানাবে বলেছে। শুনে খুশি হলাম। রেদোয়ানকে খাবার বেড়ে দিলাম। সে খেয়ে নিলো। এরপর কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লো সে। রাতে ঘুমাতে পারে নি। এখন একটু ঘুমাক।
বিকেলে বাবা আমায় তার কাছে ডাকলেন। সায়রা আর পায়রাকেও ডাকলেন। কেন তা জানি না। বাবার কাছে গেলে বাবা বললেন, তোরা সব তৈরি হইয়া ল। তোর ফুফুর বাড়ি যামু। তোগো ফুফু একটু অসুস্থ।
শুনে খুশি হলাম। অনেক দিন ফুফুকে দেখি না। এরপর বাবা আরো বললেন, আর শোন তোগো তিন জনরে যেই শাড়ি দিছি তোরা এগুলা পড়িছ। আর জামাই গোরে যেই পাঞ্জাবি দিছি তাগোরে পড়তে কইছ। আমি একটু দেখমু। আমার ভাল্লাগবো।
বাবার কথায় ভাবনায় পড়ে গেলাম। পায়রা, সায়রা দুজনেই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে বাবা সবাইকেই কাপড়চোপড় দিয়েছে। তবে পায়রার ননদ গতকাল আমাকে দেখে ওমন কথাটা কেন বললো…?
চলবে…..
গল্পের পরবর্তী সকল পর্ব শুধুমাত্র এই আইডিতেই পোস্ট করা হবে।পেজ থেকে লিংকে ক্লিক করে যারা পর্বটা পড়ছেন তারা পুরো গল্পটা পড়তে চাইলে আমার এই পারসোনাল আইডিতে এড হয়ে নিন।শুধুমাত্র এই আইডিতেই গল্পের পরবর্তী পর্ব পোস্ট করা হবে।সকলে এড হোন।কথা দিলাম আইডির গল্পগুলা আপনাদের মন ছুয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ
আইডির লিংকঃ
https://www.facebook.com/raj22680