ভুল -পর্ব ১৪

0
259

#ভুল ১৪তম পর্ব
#jannat_Nur

অবন্তী আর সিরাত এসেছে আমতলী গ্রামে! আমতলী গ্রামের বসবাস করে তার মামা মিরাজ মিয়া।
এই গ্রামে তার মামা ঘর জামাই হিসেবে চলে এসে তার মামির বাবার বাবার জমিতে বাড়ি করে আছে। এলাকার কিছু মানুষের কাছ থেকে তার মামা মিরাজ মিয়ার বাড়ির সন্ধান করছিল, একজন বৃদ্ধ লোক সিরাত আর অবন্তীকে মিরাজ মিয়ার বাড়িতে নিয়ে গেল।

মিরাজের বউ এদিকে আসো দেখো দুইটা ছেলে মেয়ে তোমার স্বামীকে খুঁজতেছে! তোমাদের বাড়ি চিনেনা আমি নিয়ে আসলাম।
লোকটার কথা শুনে মধ্য বয়স্ক মহিলা বের হয়ে আসলেন।

সিরাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমরা? তোমাদের চিনতে পারলাম না, শাকিলের বাবাকে কিভাবে চেনো।

সিরাত বুঝতে পারলো শাকিল হয়তো তার মামাতো ভাইয়ের নাম।

মিরাজ মামা আমার মামা হয়, তার বোন ছিল সুফিয়া বেগম আমি তার ছেলে।

সিরাতের কথা শুনে মিরাজের বউ অবাক হয়ে যায়! তার ছেলে এতদিন পরে কিসের জন্য এখানে এসেছে। সিরাত বলে এত অবাক হচ্ছেন কেন আমি আপনাদের এখানে কোনকিছুর জন্য আসিনি! আমি শুধু এসেছি আমার মায়ের খোঁজে, মামাকে ডাকুন তার সাথে কথা বলি।

তোমার মামা ঘরের ভিতরে আছে, তোমরা ঘরের ভিতর আসো! সে অসুস্থ কয়েকদিন ধরে জ্বর বিছানা থেকে উঠতে পারে না। তোমার মায়ের খোঁজ খবর নিতে আসছো, তার কোন খোঁজ খবর তো আমরা জানি না। তোমাকে রেখে দিয়ে যখন তাড়িয়ে দিয়েছিল তোমার মাকে, আমাদের বাসায় এনে রাখছিলাম। কিন্তু সে খুব পাগলামি করছিল অন্যের বাচ্চাদের নিয়ে কাড়াকাড়ি করতো, বলতো আমার ছেলে এইটা। তাই এলাকার মানুষ আমাদের বাড়িতে এসে বিচার দিত, সুফিয়া যখন শুনতে পারে তোমাকে নিয়ে তোমার বাবা আমেরিকা চলে গেছে! তোমার মা আমাদের বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, তারপর কখনো আর আমাদের এখানে আসেনি।

মামির কথা শুনতে শুনতে মামার কাছে জিজ্ঞেস করলেন সিরাত, মামি যা বলল তা সত্যি নাকি মামা? আপনি কেমন ভাই এত বছরের মধ্যে বোনের কোন খোঁজ খবর নেননি! আমার বাবা আমাকে আমেরিকা নিয়ে গিয়েছে, আমাকে মিথ্যা বলেছিল আম্মু অন্য কারো সাথে পালিয়ে গিয়েছে আমাকে রেখে। কিন্তু আপনারা তো সত্যিটা জানেন আমার মায়ের কোনো অপরাধ ছিল না। আমার মায়ের হয়তো মাথায় সমস্যা হয়েছিল আপনারা কি পারতেন না তাকে ডাক্তার দেখাতে, সেবা যত্ন করে সুস্থ করতে। আম্মু কোথায় গিয়েছে সেটা কি আপনি জানেন?

মিরাজের মুখে কোন কথা নেই সে জানে নিজের বোনকে সে দেখে রাখতে পারেননি! বোনের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে জেনেও তাকে বাড়ি থেকে যেতে দিয়েছে, এটার জন্য সবসময় তার মনে অপরাধবোধ হয়।

কি হলো মামা আপনি চুপ করে আছেন কেন, কিছু জানলে বলেন! আমি আমার মাকে খুঁজে বের করব।

বাবা রে তোর মায়ের উপর অন্যায় করেছিলাম তোর মামির কথা শুনে! তোর মামি বলেছিল এলাকার মানুষ এসে তোর মায়ের নামে বিচার দিয়ে যায় তাই তোর মাকে বলেছিলাম যদি এরকম করিস আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবি না। তারপর যখন জানতে পারলো আমিরুল তোকে নিয়ে আমেরিকা চলে গিয়েছে, আমাকে বলেছিল তোর মা, কিছু টাকা দাও আমি আমার ছেলেকে আনতে আমেরিকা যাবো। তাকে বলেছিলাম আমেরিকা যেতে হলে বিমান দিয়ে যেতে হয় পাসপোর্ট ভিসা করতে হয়, এত টাকা তুই কোথায় পাবি। তখন আমাকে বলেছিল আমি ঢাকা যাব এয়ারপোর্টের কাছাকাছি থাকবো, মানুষকে বলব আমাকে আমেরিকা নিয়ে যেতে। আমি তখন তাকে বাধা দিতে পারিনি, আমার সেই সামর্থ্য ছিল না।

সিরাত আর কিছু না বলে অবন্তীকে বলল আসো চলে যাই, এখানে তো আর কিছু জানা গেল না। আমি ঢাকা যাব এয়ারপোর্টের আশেপাশে খোঁজ করব।
ঘর থেকে বের হয়ে সিরাত আবার ফিরে আসলো তার মামার কাছে।

মায়ের একটু বর্ণনা দেন তাকে দেখে যেন আমি চিনতে পারি, তার শরীরে কোথাও কোন দাগ ছিল, বা তিল চিহ্ন? যা দেখে তাকে শনাক্ত করা যায়।

তোর মা দেখতে প্রায় তোর মত ছিল, আর গালে একটা তিল ছিল, বাম সাইডের গালে। হাতে একটা কাটা দাগ আছে কব্জির উপরে, অনেক ফর্সা ছিল সুফিয়া। এখন যদি বেঁচে থাকে হয়তো আর ফর্সা থাকবে না রাস্তাঘাটে ঘুরে ফিরে বোনটা আমার হয়তো শেষ হয়ে গেছে। বলতে বলতে মিরাজ মিয়া কান্না করে দিলেন।

এখন আর আফসোস করে কি হবে বলেন, যদি তখন একটু সাহায্য করতেন আমার মা সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে জীবন যাপন করতে পারতো। এখন বেঁচে আছে কিনা জানিনা, তবে আল্লাহর কাছে চাইবো তাকে যেন আমি খুঁজে পাই! সে যেন আমার জন্য বেঁচে থাকে, জীবনে সুখ পেলো না কিছু মানুষনামী অমানুষের কারণে। আপনারা সবাই দোষী সবার কারণে আমার মায়ের জীবনটা তন্নচ্ছন হয়ে গিয়েছে! কেউ আমার মাকে সাহায্য করেনি আশ্রয় দেয়নি, মানুষ এত নির্দয় হয় কিভাবে।

মিরাজ মিয়া এবং তার স্ত্রী দুজনের অনুতপ্ত, সিরাতের কথার উত্তরে কি কথা বলবে, সত্যিই তারা অপরাধী! তাই তাদের কিছু বলার মুখ নেই।

সিরাত কিছু বুঝতে পারছে না কিভাবে তার মাকে খুঁজে পাবে। ভাবছিল তার মামার এখানে আসলে মায়ের সন্ধান পাওয়া যাবে, হয়তো কোন সূত্র পাওয়া যাবে মাকে খুঁজে পাওয়ার। কোন সন্ধান না পেয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে, ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কান্না করতে! কেন এমন হলো তার জীবন, মায়ের আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলো কেন। তার মায়ের জীবনটা এত কষ্টের লাঞ্ছনায় কেন কাটলো।
সিরাতের দিকে তাকিয়ে অবন্তী বুঝতে পারছে সিরাত প্রায় কান্না করে দিবে, চোখের পানি টলমল করছে। এমন পরিস্থিতিতে যেন কোন সন্তান কখনো না পড়ে আল্লাহর কাছে এমনটাই আরাধনা করছে অবন্তী। তার নিজের বাবার প্রতি এত রাগ হচ্ছে বলে বুঝাতে পারবে না, ইচ্ছা করছে মানুষটাকে খুন করে ফেলতে। সাথে তার মায়ের প্রতিও রাগ হচ্ছে কেন সে তার স্বামীর কথা বিশ্বাস করলো, নিজের স্বামীর চরিত্র সম্পর্কে তার কি ন্যূনতম ধারণা নেই। তাদের ভুল সিদ্ধান্তের জন্যই সুখী একটা পরিবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সবগুলো অমানুষ যেমন তার পরিবার তেমন সিরাতের মামা-মামি, সবাই নিজ স্বার্থের জন্য সিরাতের মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে, অন্যায় আচরণ করেছে।

অবন্তী বাসায় এসে চুপচাপ শুয়ে আছে দরজা জানালা বন্ধ করে। রাতে খাবার জন্য তার মা কয়েকবার ডেকে যাচ্ছে কিন্তু সে দরজা খুলছে না। রফিক মিয়া এসে দরজার কাছে ডাকলেন,

অবন্তী, মা তোর কি হয়েছে, তুই নাকি বিকাল থেকে বাসায় এসে মন খারাপ করে আছিস? শুনলাম সিরাতের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলি, সিরাত কি তোর সাথে খারাপ আচরণ করেছে! যদি করে থাকে বল আমাকে আমি তার বাবার সাথে কথা বলবো। সিরাত যদি তোর সাথে অন্যায় কিছু করে তাহলে বল তাকে ছেড়ে কথা বলবো না, ভয় পাস না দরজা খুলে দে।

অবন্তীর এত পরিমাণে রাগ হচ্ছে তার বাবার কথা শুনে, নিজে মানুষের সাথে অন্যায় করে আবার অন্য জনকে বলে সে অন্যায় করেছে কিনা, বিবেকহীন মানুষ একটা। দরজা খুলে দিয়ে বাবার সামনাসামনি হয়ে অবন্তি বলে উঠলো,

তোমাদের মনমানসিকতা এত নিচু কেন, সিরাতের সাথে আমি ঘুরে এসে আমার মন খারাপ এটা দেখেই ভেবে নিয়েছে সে আমার সাথে কিছু করেছে। সবার চরিত্র খারাপ ভাবার কোনো কারণ নেই, যে যেমন তাকে সে তেমনি ভাবে। সিরাত যথেষ্ট পরিমাণ ভদ্র এবং ভালো ছেলে, সে চাইলে অনেক মেয়ের সাথেই অবৈধ সম্পর্ক করতে পারতো এবং এখনো পারবে। তার সাথে আমি দুইদিন ঘুরতে বের হয়েছি আমার শরীরের সাথে তার শরীরে একটু স্পর্শ করতে চেষ্টা করেনি সে। এমন কোন কথা বলেনি যাতে করে আমার অসম্মান হয়। আর তুমি তাকে নিয়ে কিনা কি সন্দেহ করে বসে আছো, সেটা তো থাকবেই মানুষ বলে না, যে যেমন তার ধারণা তেমন।

রফিক মিয়া বুঝতে পারছে না তার মেয়ে তার সাথে এরকম ব্যবহার করছে কেন, আকার ইঙ্গিতে বুঝালো তার চরিত্র ভালো নয়! কেন এমনটা বলল অবন্তী। তাই সে কিছু না বলে রুমা আক্তারকে গিয়ে বলল তোমার মেয়ের কি হয়েছে সে আমার সাথে এই প্রথমবার বাজে আচরণ করল। তাকে জিজ্ঞেস করো সে কি চায়।

রুমা আক্তার অবন্তীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল তোর কি হয়েছে! বাবার সাথে কেন বাজে আচরণ করছিস? দেখলাম বিকালে ফেরার পর থেকে তোর মন খারাপ। সিরাতের সাথে কিছু হয়েছে,
সে তোকে কিছু বলেছে? বললে বল ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

আম্মু তোমরা নিজেকে কি ভাবো, ধোয়া তুলসী পাতা? আর সবাই খারাপ! সিরাতের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম বলে সে আমাকে কিনা কি করে ফেলছে, তাই মন খারাপ এটাই ভেবে নিয়েছো। কেন তোমরা কি কোন অন্যায় অপরাধ করতে পারো না।

অবন্তীর কথা শুনে রুমা আক্তার কিছুই বুঝতে পারছে না, কখন থেকে অবন্তী আবোল তাবোল বলে যাচ্ছে।

তোর কি হয়েছে বল, কেন আমাদের সাথে এরকম করছিস।

আমার কিছু হয়নি, তোমাদের সাথে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না! আমার চোখের সামনে তোমরা আসবে না, আমার যখন ইচ্ছা হবে আমি খেয়ে নেব, এখন যাও তুমি আমার রুম থেকে।

রুমা আক্তার অবন্তীর রুম থেকে বের হয়ে রফিক মিয়াকে গিয়ে বললেন, তোমার সাথে যে ব্যবহার করেছে আমার সাথে তেমনি করল! এরকম কেন করছে। আমি সিরাতকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে অবন্তীর, কেন আমাদের সাথে এরকম বাজে বিহেভ করছে।

সিরাত ছাদে দাঁড়িয়ে আছে, ভাবছে এয়ারপোর্টে গেলে কি তার মাকে খুঁজে পাবে, আল্লাহ যেন তার মাকে পাইয়ে দেয়। রুমা আক্তার রুমে সিরাতকে না পেয়ে ছাদে আসলেন, সিরাতকে ডাক দিয়ে বললেন, বাবা সিরাত তোমরা আজ কোথায় ঘুরতে গিয়েছিলে?

ফুপির প্রশ্ন শুনে সিরাত কিছুটা থমকে গেল, ফুফি এমন প্রশ্ন করছে কেন, অবন্তী কি তার মাকে বলে দিয়েছে।

কেন ফুপি কি হয়েছে, আমরা তো এই আশেপাশে ঘুরাঘুরি করলাম পার্কে গেলাম।

ও আচ্ছা কিন্তু ফেরার পর থেকে অবন্তী দরজা বন্ধ করে শুয়েছিল, আমি কয়েকবার ডেকেছি খাবার খেতে সে দরজা খুলে না! এখন রাত হয়ে গিয়েছে তবুও দরজা খুলে না। তার বাবা তাকে ডাকতে গিয়েছিল বাবার সাথে কি খারাপ ব্যবহার কখনো সে। আজকের আগে তার বাবার সাথে বা আমার সাথে খারাপ আচরণ করেনি কখনো। তোমার আংকেল খুব কষ্ট পেয়েছে, আমাকে এসে বলল অবন্তী কেন এমন করছে তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। আমি জিজ্ঞেস করায় আমার সাথেও খুব বাজে ব্যবহার, এতটুকু বড় হয়েছে কখনো আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি! মুখে মুখে তর্ক করেনি, আজকে এই মেয়ে দুজনের সাথেই কি রকম ব্যবহার করলো। তোমার সাথে কি তার কোন কিছু, মানে রাগারাগি হয়েছে বা কথা কাটাকাটি।

সিরাত বুঝতে পারল অবন্তী কেন তার বাবা-মার সাথে এরকম করছে। সিরাত বলল না তো আমার সাথে ভালোই ছিল বাসায় ফিরে এমন করছে কেন সেটা আমি জানি না।

সত্যি কি তুমি কিছু জানো না, জানলে বলো আমার মেয়ে তো এরকম করার মানুষ না।

আমি মিথ্যা বলব কেন, চলেন অবন্তীর সামনাসামনি কথা বলি, তার সাথে আমার কোনো রাগারাগি হয়নি।

ঠিক আছে তোমার আর এখন যেতে হবে না, রুমে খাবার দিয়েছি খেয়ে নাও। রুমা আক্তার চলে যেতে সিরাত ফোন বের করে কল দিলো অবন্তীকে,

তুমি নাকি ফুপি আঙ্কেলের সাথে খারাপ ব্যবহার করতেছ, এখনই তা করা ঠিক না নিজেকে সামলাও আমি যেন না শুনি আর এমন করছো।

কি করবো বল আমার তো এদের দেখতে ইচ্ছা করছে না।

আপাতত দেখে যাও কিছু করার নেই, না দেখে কোথায় যাবে তুমি।

দুচোখ যেখানে চায় সেখানে চলে যাব, এদেরকে আমার মা-বাবা বলতেও বিবেকে বাধে।

নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করো অবন্তী, আগে আমার মাকে খুঁজে পাই, আমার বাবাও কিন্তু অপরাধী কম নয়! তারও শাস্তি পেতে হবে।

বাংলাদেশে আসার পর থেকে আমিরুল ইসলাম ছোট ভাই সাব্বিরকে নিয়ে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করেছে। সিরাতকে বলেছিল তার সাথে ব্যবসায় যোগ দিতে! সিরাত বলেছে কিছুদিন পর থেকে ব্যবসায় মন দিবে আগে সে বাংলাদেশটা ঘুরে দেখবে।
আসলে তার মাকে খুঁজবে এটাই হলো আসল কথা। সিরাত কিন্তু এখন তার বাবার সাথে তেমন কথা বলে না আমিরুল ইসলাম এটা বুঝতে পারে। বাংলাদেশে আসার পর থেকে ছেলেটা তাকে এড়িয়ে চলছে কেন এমন করছে তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here