#শুভ্রতায়_নবনীতা
#নবনীতা_নীরু
পর্ব ঃ ৫
— দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন না!
— থ্যাংক ইউ স্যার।
নিহান স্যার কি বলবে বুঝতে পারছে না।আমার মনে হচ্ছে নিতান্তই উনি খুব ভাল একটা মানুষ। বয়স হয়তো আটাশ কি উনত্রিশ হবে, লম্বায় হয়তো প্রায় ৬ ফুট ই হয়ে যাবে,গালে খোচা খোচা দাড়ি,দেহের তুলনার চোখগুলো একটু ছোট ছোট (একদম হাতির বাচ্চার মত হিহি)
— কিছু ভাবছেন?(নিহান স্যার)
— না স্যার কিছু না।স্যার একটা পারসোনাল কথা জিজ্ঞেস করব?
— যদিও কাউকে এই সুযোগটা দেওয়া হয় না,আপনার আজকে প্রথমদিন তাই আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন।
— স্যার,ম্যাম মানে আপনার এক্স ওয়াইফ রনিতা কিভাবে মারা গিয়েছিল?
— আমাদের ভালোবাসার বিয়ে ছিল।আমি যখন অনার্স চতুর্থ বর্ষে মানে অনার্স তখন ও শেষ হয়নি।রনিতা আমার চেয়ে অনেকটাই ছোট প্রায় পাঁচ/ছয় বছরের।তবুও ওর বাড়ি থেকে বিয়ের কথা চলে আর রনিতা আমার কথা বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছিল।তারপর ওদের বাড়ি থেকে তেমন অসুবিধা করে নি,আমার বাবার সাথে কথাবার্তা বলে বিয়েটা ঠিক করে ফেলে।
সবার মতামতেই আমাদের দুজনের মিলন হয়,আমরা বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হই।
খুব ভালো কাটছিল আমাদের সময়।কয়েকমাস পরই রনিতা কন্সিভ করে।আমি ওকে বলেছিলাম বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলতে।মানে অন্তত দুই বছর পর যেন বাচ্চা নেওয়ার কথা ভাবে।কিন্তু রনিতা জেদ করে বাচ্চা রেখে দেয় কারণ সে বাচ্চা অনেক বেশি ভালোবাসে।
অতঃপর আমাদের ঘর আলো করে এলো নীরু।
সবাই তো বলে প্রেমের বিয়ে টিকে না বা ঝামেলা বেশি হয়,আপনি কি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না আমাদের মাঝে হালকা মান অভিমান শুধু হতো,কখনো ঝগড়া হয় নি তেমন।নীরুকে নিয়ে ভালোই দিন চলছিল আমাদের।
বিপত্তিটা ঘটে গতবছর শুধুমাত্র ওর জেদের কারণে।নীরুর যখন সাড়ে তিন রনিতা তখন আবার কন্সিভ করে।এবার আমি অনেক প্রেশার দেই বাচ্চা নষ্ট করে দিতে,কারণ গতবার নীরুর বেলায় সে অনেক অসুস্থ ছিল।আমার কথা একটুও শোনে নি রনিতা।ডেলিভারির সময় ডাক্তার জানালো যে কোন একজনকে বাঁচানো যাবে।
আমি বলে দিলাম রনিতাকে বাঁচাতে।কত খারাপ সময় যে গেছে তখন আমার!আফটার ডেলিভারি,ডাক্তার জানালো মা আর বেবি কাউকে বাঁচানো যায় নি।
বিশ্বাস করুন তখন একদম আমার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেছিলো।রনিতা এমন না করলেও তো পারতো,কেন শুধু শুধু আমার মেয়েটাকে মা হারা করলো?আমাকেই কেন বা একা করে চলে গেল!
নিহান স্যার নিজেকে সামলে নিতে বাহিরের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করছিলেন। হয়তো চোখে পানি চলে এসেছে তাই ওমন করছে।যখন কোন পুরুষ কোন নারীর জন্য চোখের পানি ফেলে তখন সে নারী স্বার্থক।
— স্যার..
— হ্যাঁ বলুন।
— আমাকে এখন কি করতে হবে?
— আপাতত এই কাগজটায় সাইন করে দিন,এক বছরের আগে আপনি জব ছেড়ে চলে যেতে পারবেন না।।
আমি সাইনটা করে দিলাম কারণ এত টাকা বেতনের জব কে ছেড়ে দিতে চাইবে!স্যার কাগজটা নিয়ে উনার ড্রয়ারে রাখলেন।
— আপনার অফিস টাইম কয়টা থেকে কয়টা জানেন তো?
— স্যার একটু বলে দিলে ভাল হয়।
— আপনার কাজের সময় নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত, কোন কোনদিন একটু বেশি থাকতে পারে।আপনি কি আপনার এই আট ঘন্টা অফিসেই দিবেন নাকি এক ঘন্টা আমার মেয়েকে দিতে পারবেন?তাহলে খুব ভাল হয়।
— আমি এমনি বাসায় ফেরার সময় ওর সাথে দেখা করে যাব।অফিসের সময় থেকে সময় ম্যানেজ করতে হবে না স্যার।
— আচ্ছা ঠিক আছে।আপনি আপনার কেবিনে গিয়ে বসুন, লিয়া আপনাকে সব কাজ বুঝিয়ে দিবে।সামনে সপ্তাহ থেকে যে কোন মিটিং বা অফিসের বিষয়ে যে কোন কিছুতে আপনার থাকতে হবে।এই এক সপ্তাহ শুধু আপনার ট্রেনিং।
— ঠিক আছে স্যার,ধন্যবাদ। আমি তাহলে আসছি স্যার।
— জ্বী আসতে পারেন।
আমিও স্যারের কেবিন থেকে চলে এসে নিজের ডেস্কে বসলাম।লিয়া আপু আমাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছে।পিএ এর পরেই নাকি উনি আর অনেক পুরাতন কর্মী। অফিসের সাথে আছেন অনেকদিন ধরে।
যাই হোক ট্রেনিং যেহেতু এক সপ্তাহ, তাই এই এক সপ্তাহ আমাকে সব শিখে নিতে খুব পরিশ্রম করতে হবে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল,এই নীরু মেয়েটা আমাকে বাসায় আসতে দিতেই চায় না।আর তাছাড়া এখন অফিসে একটু বেশি সময় দিতে হবে।সবকিছু শিখে নিতে হবে আবার এখানে সেখানে গিয়ে কথা বলার জড়তা কাটিয়ে উঠতে হবে।
বাড়িতে ঢুকেই দেখি মা বাহিরে বসে আছে।আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন
— তোর প্রতিদিন আসতে কয়টা বাজবে?
— কেন মা কি হয়েছে?
— উল্টো প্রশ্ন করিস কেন তুই?
— দশ, বারো দিন সন্ধ্যা হয়ে যাবে কারণ এখন আমার সব বিষয় বুঝে নিতে হচ্ছে,পরে পাঁচটা পর্যন্ত অফিস।
— কালকে থেকে বের হবার সময় বোতলে মরিচ গুরো নিয়ে বের হবি রাস্তায় বিপদ আপদের কথা বলা যায় না।।
— আচ্ছা মা,আমি ফ্রেশ হই।বলেই চলে এলাম কারণ মার কথায় না বলে বিরোধিতা করলে আরও কিছুক্ষণ বকুনি খেতে হতো।
ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে পড়তে বসলাম।এর মাঝে তুশিও এসে অফিসে কি কি হলো,কেমন লাগলো ইত্যাদি বিষয় জানতে চাইলো।
— বল না আপা কেমন কাটলো তোর প্রথমদিন?
— ভালোই,বই নিয়ে আয় পড়তে বস।
পাশের ঘর থেকে মায়ের গলা এলো তুশি একদম মেয়েটাকে জ্বালাবি না,পড়তে দে,নিজে তো পড়বেই না আবার আরেকজন যে সারাদিন অফিস করে এসে ও পড়তে বসেছে আর উনি গিয়ে গল্প জুড়ে দিচ্ছেন।
তুশিও গিয়ে বই নিয়ে এসে পড়তে বসলো।আমরা দুইবোন পড়ছিলাম।এমন সময় বাবা ঘরে ঢুকলেন।
— বাবা আপনি?কোন দরকার?
— তোরা দুই বোন তো মাংসের সিঙারা খেতে পছন্দ করিস,তাই তোদের জন্য নিয়ে এলাম।
— বাবা আমাকে দাও আগে কতদিন মাংসের সিঙারা খাওয়া হয় না।(তুশি)
— বাবা বসেন আপনি।
— তোর মাকেও ডাক,একসাথে খা সবাই।
— বাবা আমি আজকে অফিসে গিয়েছিলাম,চাকরিটা খুব ভাল বেতন ও আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভাল।
— ভাল হলেই ভাল রে মা,আমি তো এখন আর কিছু করতে পারি না।
— বাবা চিন্তা করিয়েন না, আল্লাহ আছেন,কোন না কোনভাবে সংসার ঠিক চালিয়ে নেবেন।
— তোকে একটা কথা বলার ছিল রে মা।
— হ্যাঁ বাবা বলেন।
— আমি জানি আমি ভুল করে ফেলেছি কিন্তু এখন আর কিছু করার নাই।
— কি হয়েছে বাবা?
— তোর মা গতবছর পনেরো দিনের জন্য তার বোনের বাড়ি বেড়াতে গেছিলো মনে পড়ে?
— হ্যাঁ মনে আছে তো।
— তোর মা আসলে সেদিন…
— মা এসো বসো সিঙারা খাও(আমি)
— হ্যা বাবা আপনি বলেন।
— সেদিন তোর মা কোন বোনের বাড়ি গিয়েছিল না।
— তাহলে?
— খেয়ে নে, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো, আমি তো বলছিই।আমার নিজেকে এখন খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।(বাবা)
— আমি জানি না মা তোর কাছে আমি কোন মুখে ক্ষমা চাইবো!সেদিন মা/রা গেলেই বেঁচে যেতাম।।
— আমি তোমাদের কথা কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।
— কোন মুখে তোকে জানাবো সেটা আমিও বুঝতে পারছি না।(বাবা)
— তাড়াতাড়ি বলো তো বাবা।
— তোর মায়ের হার্টের সমস্যা হয়েছিল,ডাক্তার বলেছিল ঠিক করতে দুই লাখ টাকা লাগবে।কোথাও টাকা পাচ্ছিলাম না,গরিব মানুষ এতগুলো টাকা কোথায়ই বা পাবো,কেউ ধার ও দিচ্ছিলো না।গ্রামের মাতব্বারকে বলতে তিনি দিতে রাজি হলেন।শর্ত দিলেন তার বড় ছেলের সাথে তোকে বিয়ে দিতে হবে।টাকা পরিশোধ করতে হবে না,আমার খুব টাকার দরকার ছিল,ছেলেটাও খুব ভাল তাই আমি আর না করি নি।টাকা নিয়ে তোর মায়ের চিকিৎসা করাই।
— আমাকে আগে কেন বলেন নি বাবা,তবে সমস্যা নেই আপনারা আমার জন্য যা ভেবে রেখেছেন তার জন্য আমার কোন না নেই।
তবে ওরা তাড়াতাড়ি বিয়ের চাপ দিবে না তো?
— বলেছে ছেলে বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এলেই বিয়ের ব্যবস্থা করবে।
— সেটা যেন একবছর পর হয় বাবা,কারণ আমার চাকরির এগ্রিমেন্টে সাইন করা হয়ে গেছে এক বছরের আগে আমি চাকরি ছাড়তে পারব না।
চলবে…
সামনে আসতে চলেছে গল্পের নতুন মোর…