#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ১৮
০৩.
বড়্গাঙ থেকে কয়েক গজ দক্ষিণে রয়েছে ‘বেড়ান্নে লেক শো ক্যাফে।’ কাপ্তাই হৃদের তীরে বেড়ান্নে ক্যাফে তৈরি করা হয়েছে। কাপ্তাই হৃদের পানির কাছাকাছি করে বানানো হয়েছে একাধিক ছাউনি। সেখানে থাকার ব্যবস্থা না থাকলেও খাবারের ব্যবস্থা আছে। অধিবাসীর বিভিন্ন খাবারো পাওয়া যায় এখানে। রিসোর্ট থেকে নাস্তা করেই আমরা এই বেড়ান্নে ক্যাফেতে এসেছি। বিকাল পর্যন্ত এখানেই থাকবো আমরা।
সেখানে যেতেই প্রথমে একটা ব্রিজ রয়েছে। যা থেকে কাপ্তাই লেকের আংশিক হৃদ দেখা যায়। বেড়ান্নে ক্যাফেতে ঢোকার জন্য রয়েছে একটি বাঁশ ও কাঠের তৈরি দরজা। ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে অনেকগুলো আম গাছ দেখতে পাই আমরা। চারপাশটা অনেকটা আম বাগানের মতো। সবাই এখন লম্বা একটি সরু রাস্তায় হাঁটছি। কয়েক মিনিটের সরু রাস্তাটা অতিক্রম করার পর দু’তালার একটি রেস্টুরেন্ট দেখতে পাই আমরা। এর সামনে রয়েছে ছোট-খাটো একটা মাঠ। গাছগাছালিতে ভরপুর এটি! বসার জায়গা থেকে শুরু করে হৃদের কাছাকাছি একটি গাছের সাথে ঝুলানো হয়েছে গাড়ির টায়ার দিয়ে তৈরি দোলনা। সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে শোয়ার জন্য দড়ি দিয়ে বানানো লম্বা দোলনাও আছে মাঠে। আর তার ঠিক সামনেই রয়েছে হৃদ। এছাড়া বোর্টিং করার ব্যবস্থাও করা হয়েছে এখানে। হৃদের একপাশে কয়েকটি বোর্ট রাখা আছে। ইতোমধ্যে অনেকেই বোর্টিং করছে সেখানে। বোর্টিং কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলেই তারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যবহার করতে দেন সবাইকে। এবং এতে কত খরচ হবে তাও উল্লেখ করা হয়েছে একটি কাগজে।
ছোট মাঠটায় দাঁড়িয়ে আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করছি আমরা। চাচ্চুরা সবাই রেস্টুরেন্টে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। আর আমরা নিজেদের মতো আনন্দ করছি। আমি, দীঘি, মেহেরুন, শ্রেয়া আর হীমানি একপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। শ্রেয়া আর হীমানিকে যতটা খারাপ ভাবতাম ততটা খারাপ নয় তারা। ভালোই! বিনয়ের সাথে কথা বলছে আমার সাথে। আমার একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন রেয়ান, আবদ্ধ এবং সবুজ ভাইয়া। তারা কোনো একটা বিষয়ে ম্যানলি টাইপ হাসছেন। সবার হাতেই একটা করে কোকাকোলার ছোট কাচের বোতল। তবে তাদের সাথে ইয়াসিন ভাইয়াকে দেখছি না আমি। কোথায় সে? একটু আশেপাশে তাকাতেই দেখলাম মহাশয় দড়ি দিয়ে বানানো লম্বা দোলনাটায় সটান হয়ে শুয়ে আছেন। চোখে সানগ্লাস আর হাতে জ্যুসের গ্লাস। তার ভাবখানা এমন, যেন সে কোনো রাজ্যের রাজা। তবে তাকে দেখতে মোটেও রাজাদের মতো লাগছে না। উল্টো হাসি পাচ্ছে।
আমি এগিয়ে গেলাম ইয়াসিন ভাইয়ার কাছে। সঙ্গে দীঘি, মেহেরুন আর শ্রেয়ারাও আসলো। আমাদের নিজের দিকে আসতে দেখে ইয়াসিন ভাইয়া তুমুল এটেটিউট নিয়ে সানগ্লাসটা বাম হাত দিয়ে কপালের উপরে উঠিয়ে এক চুমুক জ্যুস খেয়ে বললেন,
— “গরিপস! দেখো আমাকে, জায়গাটার সাথে কি সুন্দর সুট করছে আমায়। উফফ! গায়ে শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে আমার।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
— “শীতল হাওয়া তো বইবেই। এখানে গ্রীষ্মকালেও প্রচুর বাতাস আর ঠান্ডা থাকে। এখন তো শীতকাল! আর তোর না ঠান্ডা লেগেছে? গায়ে সোয়েটার নেই কেন ভাইয়া?”
বলতে না বলতেই ইয়াসিন ভাইয়া হাচি দেওয়া শুরু করলেন। মেহেরুন খোঁচা দিয়ে বলে উঠল,
— “আমাদেরকে গরিপস্ বলা পাবলিক দেখি নিজেই রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিচ্ছে। ছিঃ ইয়াসিন? দূরে যা। তোর থেকে রোগ-জীবাণু ছড়াচ্ছে।”
ইয়াসিন ভাইয়া প্যান্টের পকেট থেকে টিস্যু বের করে নাক মুছতে মুছতে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
— “বেয়াদ্দপ মেয়ে! তোরা এসেছিলি আমার কাছে। তাই চুপ একদম! তাছাড়া আমি কি ইচ্ছে করে হাচি দিচ্ছি? তোদের বদ দোয়ায় বারবার হাচি আসছে আমার।”
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
— “তার মানে তুই আমাকে বলছিস আমি তোকে বদ দোয়া দিয়েছি? স্বার্থপর! কারো ভালো চাইতে নেই আসলে। বিশেষ করে তোর।”
ইয়াসিন ভাইয়া মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
— “চাইতে হবে না তোমার। যার ভালো করা দরকার তার কাছে যাও।”
কথা বলার ফাঁকে আড়চোখে বারবার রেয়ানকে ইশারা করছেন ইয়াসিন ভাইয়া। যা প্রথমে বুঝতে না পারলেও এখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে। যেন চোখের ইশারায় ইয়াসিন ভাইয়াকে বলছি- “আর একটা বাজে ইঙ্গিত করলে তোর বিয়ে জীবনেও হবে না।”
আমাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে ইয়াসিন ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হাসলেন। মেহেরুন আর দীঘিও মিটিমিটি হাসছে। একমাত্র শ্রেয়া আর হিমানী ছাড়া। তারা বোকা বোকা চেহারায় তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। হয়তো কিছু বুঝতে পারছে না তারা। এরমধ্যে ইয়াসিন ভাইয়া এবার মেহেরুনকে বলে উঠলেন,
— “ওই মেহেরুইন্না, শোন তোকে একটা এডভাইস দেই। আমি তোর বড় ভাই লাগি বুঝছিস। তাই কোনো আজেবাজে কিছু বলা বা করার আগে বড় ভাইয়া কথাটা মনে রাখবি। সবসময় সম্মানের চোখে দেখবি, ভাইয়া ডাকবি। নাহলে মামীকে বলতে দেড়ি করবো না আমি। বুঝছিস?”
মেহেরুন রাগে কিরমির করে উঠল। ইয়াসিন ভাইয়ার হাত থেকে গ্লাস এক টানে নিয়ে গ্লাসে থাকা জ্যুস ইয়াসিন ভাইয়ার মাথায় ঢেলে দিলো। পরপরই দীঘিকে নিয়ে চলে গেলো। ঘটনা আকস্মিক দীঘিসহ আমরা পুরো স্তব্ধ। দীঘি মেহেরুনের দিকে তাকিয়ে হা করে আছে। দীঘিকে এমন করে তাকাতে দেখে মেহেরুন হেসে বলল,
— “আরে এমনভাবে তাকানোর কিছু নেই। ইয়াসিন ভাইয়াকে এখনো চিনোনি? বেহায়া ও! দেখবে প্রথমে একটু রাগারাগি করলেও পরে দাঁত কেলিয়ে হাসবে। নিজে থেকেই কথা বলবে আমার সাথে।”
দীঘি কিছু বলল না। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। এদিকে ইয়াসিন ভাইয়া কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকলেও পরে জোড়ে চেঁচিয়ে উঠেন। ফলসরুপ সবার নজর এখন তার দিকে। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ইয়াসিন ভাইয়া বিড়বিড় করে বলে উঠেন,
— “বেয়াদ্দপ! ফাজিল মেয়ে! একবার হাতের কাছে পাই ওরে। জ্যুসের সমুদ্রে জুবাবো ওরে। ফাজিল মেয়ে! বড় ভাইকে একটুও সম্মান করে না। যত্তসব ডাইনী ছোট বোন।”
বলতেই এবার সবার দিকে নজর পড়ল ইয়াসিন ভাইয়ার। সবার ড্যাবড্যাব তাকানোতে লজ্জা পেলো সে। শ্রেয়া আর হিমানীকেও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্বাভাবিক ফরমে ফিরে এলেন ইয়াসিন ভাইয়া। দাঁত কেলিয়ে বললেন,
— “এসবে কিছু মনে করো না। ছোট বোন দুষ্টুমি করলে তো একটু বকতেই হয় তাই না? আর তোমাদের নাম শ্রেয়া আর হীমানি না? তোমাদের কিন্তু আজকে অনেক সুন্দর লাগছে। আচ্ছা, তোমাদের কি কোনো সুন্দরী মুসলিম ফ্রেন্ড আছে? চাকমাদের মতো দেখতে হলেও চলবে। আছে?”
তার কথার ধরণ দেখে হেসে কুটিকুটি আমি। মাথা দিয়ে জ্যুস টুপটুপ করে পড়ছে, সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার। সে আছে তার ফ্লাটিং নিয়ে। অদ্ভুদ! হীমানি আর শ্রেয়াও হা করে তাকিয়ে আছে। সব যেন তাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। একটু আগেও না এ লোক রাগে চেঁচাচ্ছিল? হঠাৎ আবার কি হলো? প্রশ্নটা যেন তুমুল আকারের জটিল তাদের জন্য।
০৪.
মাঠের একপাশে রাখা চেয়ারে বসে আছি আমি। দূরে থাকা ইয়াসিন ভাইয়ার দুষ্টুমি দেখছি। সে নিজে থেকে মেহেরুনের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে কিন্তু মেহেরুন তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। উল্টো ঝগড়া চলছে দু’জনের মাঝে। যা দেখে উপস্থিত সবাই মিটিমিটি হাসছে। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ ভারী কণ্ঠে বলে উঠল,
— “এখানে একা একা কি করছো?”
পাশে ফিরে তাকাতেই দেখলাম রেয়ান আমার পাশে বসে। হাতের ফোনটা টেবিলে রাখতে রাখতে আবারো বললেন,
— “ঠান্ডা লাগছে? এক্ট্রা চাদর আনা উচিত ছিল তোমার। শীতে কাঁপছো তুমি!”
সামনে তাকিয়ে বললাম,
— “কোথায়? শীতকাল যেহেতু একটু আকটু তো শীত লাগবেই। এতে ঠান্ডা লাগবে না আমার। বরং ভালো লাগছে।”
বলেই মুচকি হেসে উনার দিকে তাকালাম। উনি শান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। পরক্ষণেই আমার বাম গালটা টেনে ধরলেন। মুচকি হেসে বললেন,
— “কিউট!”
— “হাহ্?”
কথাটা শুনে বিস্ময়ে উনার দিকে তাকালাম। উনি আবারো মুচকি হেসে টেবিলে থাকা মিষ্টি নিয়ে আমার বিস্ময়ে হা করা মুখে ভরে দিলেন। বললেন,
— “তাড়াতাড়ি খেয়ে শেষ করো। আমি আসছি।”
আমি যেন ঘোরের ভেতর চলে গেছি। ঘোরের মাঝেই মাথা উপর-নিচ নাড়ালাম। উনিও চলে গেলেন সবুজ ভাইয়ার কাছে। হাত দিয়ে মিষ্টি কাঁমড়ে নিয়ে সেটা চিবুতে চিবুতে টেবিলের দিকে নজর পরতেই ভ্রু কুঁচকে এলো আমার। রেয়ান তার ফোন রেখে গেছেন এখানে। হয়তো নিতে ভুলে গেছেন। আমিও সেদিকে এত পাত্তা দিলাম না। কিন্তু কি মনে করে আবারো ফোনের দিকে তাকাতেই এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলাম। এয়ারটেল অফিস থেকে মেসেজ আসায় ফোন চালু হয়ে গেছে। এবং ফোন চালু হতেই লক স্ক্রিনে একটা ছবি ভেসে ওঠে। যা দেখেই স্তব্ধ আমি। শুভলং ঝর্ণায় আমার আর উনার একসাথে ঝর্ণার পানি স্পর্শ করার দৃশ্য ফুটে উঠেছে ফোনের লক স্ক্রিনে। এটা কে তুলেছে? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই একরাশ লজ্জা হামলে পড়ল আমার ওপর। আড়চোখে একবার তাকালাম উনার দিকে। উনি মুখে হাসি ফুটিয়ে কথা বলছেন সবুজ ভাইয়ার সাথে। উনি যখন হাসেন তখন উনার চোখগুলো ছোট ছোট হয়ে যায়। ফর্সা মুখটার গাল আর নাক লাল হয়ে যায়। অদ্ভুত সুন্দর লাগে উনাকে। আচ্ছা, এত সুন্দর কেন উনি? একেবারে হ্যান্ডসাম ম্যান!
__________________
চলবে…