যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ৪৩

0
797

যাও পাখি বলো তারে

৪৩.
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেখলাম আমি আমার নিজ রুমে শুয়ে। কিন্তু আমি তো রেয়ানের রুমে ছিলাম। এখানে কিভাবে এলাম? পরপরই ভাবলাম, হয়তো রেয়ান দিয়ে গেছেন আমাকে। বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই রেয়ানকে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন চাপতে দেখে অবাক হলাম। উনি আবার কখন এলেন? আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলেন উনি,
— “ওয়! এক কাপ কফি আনো তো।”

আহা! কি সুন্দর আদেশ! মোটেও ভালো লাগলো না আমার। তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললাম,
— “আপনি এখানে কেন? কেউ দেখলে কি ভাববে বলুন তো।”
উনি ভাবলেশহীন ভাবে বললেন,
— “কি ভাববে?”

চোখ দু’টো বড় করে বললাম,
— “কি ভাববে মানে? জানেন না আপনি? বের হয়ে নিচে যান এক্ষুণি! আমি আসছি কফি বানাতে।”

আমার কথা যেন শুনলেনই না উনি। ফোনে মনোযোগ রেখে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন,
— “যেতে ইচ্ছে করছে না।”
— “মানে? আপনি কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছেন?”

চোখ তুলে তাকালেন রেয়ান। ফোন পকেটে রেখে বলতে লাগলেন,
— “তুমি রেগে গেলে তোমাকে কেমন লাগে জানো?”

বিরক্ত হলাম। ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই উনি উঠে দাঁড়ালেন। আমার দিকে সামান্য ঝুঁকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “বিড়ালের মতো লাগে। মনে হয়, কোনো বাচ্চা বিড়াল মিউ-মিউ করছে।”

রাগ হলো আমার। তবুও চুপ রইলাম। উনি বাঁকা হাসলেন। চলে যেতে নিলে বলে উঠলাম আমি,
— “আমাকে রুমে আপনি নিয়ে এসেছিলেন তাই না?”
ভ্রু উঁচিয়ে তার প্রশ্ন,
— “তো কে আনবে? অন্য কেউ তো তোমার ভাড় বহন করবে না নিশ্চয়ই?”

উনার দিকে রাগী চোখে তাকাতেই উনি বাঁকা হেসে চলে গেলেন নিচে। তার কিছুক্ষণ পরই নিচে নেমে এলাম আমি। ইতোমধ্যে অনেক আত্মীয় চলে এসেছেন বাসায়। এদের মধ্যে কেউ আমার পরিচিত আবার কেউ অপরিচিত। সবাই একত্রিত হয়ে বসে আছেন ড্রইংরুমে। আমি সবাইকে সালাম দিয়ে চলে এলাম কফি বানাতে।

কয়েক মিনিট পর কফি বানানো শেষে ড্রইংরুমে পা বাড়ালাম আমি। কফির মগ হাতে রেয়ানের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম চাচ্চুরা আর ফুফিরা মুখ শক্ত করে বসে আছেন। বুঝলাম না কিছু। একটু আগেও তো হাসি-খুশি ছিল সবাই। এখন কি হলো আবার? ভাবনার মাঝেই একজন বয়স্ক মহিলা রসিকতা করে বলে উঠলেন,
— “তা মাইয়্যা? বিয়া হইবার আগেই এক লগে রুমে থাহো, এগুলান কি ভালা মাইয়্যার কাম?”

হতভম্ব হয়ে গেলাম। এগুলো কি ধরণের কথা? ভ্রু কুঁচকে বললাম,
— “ঠিক বুঝলাম না আন্টি।”

বিশ্রীভাবে হেসে মহিলাটি আবার বলল,
— “মিসা(মিথ্যা) কতা কইবা না। আমি তোমারে আর রেয়ানরে দেখছি একি রুম থেইকা বাইর হইতে। শোনো মাইয়্যা, বিয়ার আগে এগুলান ভালো না। শুধরাইয়া যাও।”

রাগে, লজ্জায়, অপমানে মুখটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো আমার। চোখ জলে ভরে এলো। আড়চোখে তাকালাম রেয়ানের দিকে। উনি চোয়াল শক্ত করে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন। মহিলাটি আরো কিছু বলতে নিলেই রক্তিম চোখে তাকালেন মহিলাটির দিকে। হাঁটুতে দু’হাতের কুনুই ভর করে ঝুঁকে বসে শান্ত অথচ কঠিন কণ্ঠে বললেন,
— “তো কি বলছিলেন আন্টি?”

মহিলা সামান্য ঘাবড়ালো। পরপরই নিজের মতো বলে উঠল,
— “তোমারে আর কি কমু? তোমরা কি আমার কতা শুনবা? তোমরা…”

মহিলাটি নিজের কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই রেয়ান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “তাহলে বলছেন কেন?”

মহিলাটি যেন বুঝতে পারলো না রেয়ানের কথা। ‘হা’ করে তাকিয়ে রইলো রেয়ানের দিকে। রেয়ান কথা বলায় এবার সাহস পেলেন ইয়াসিন ভাইয়া। বয়স্ক মহিলাটিকে মুচকি হেসে বললেন,
— “আপনি একটু বেশি বেশি বলেন আন্টি। আব্রাহাম ভাই আর মীরুর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল।”

মহিলাটি কিছু বলতে চাইলো। সুযোগ দিলেন না রেয়ান। উঠে দাঁড়ালেন। মেজো চাচ্চুকে শক্ত গলায় বললেন,
— “সব ব্যবস্থা করো আব্বু। কালকেই যেভাবে হোক মীরাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘরে তুলবো আমি।”

কথা শেষ হতেই দ্রুত পায়ে ছাদের দিকে চলে গেলেন রেয়ান। সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে আমিও কফি হাতে রেয়ানের পিছু পিছু গেলাম।

দক্ষিণা বাতাস বইছে। হাত দু’টো মুঠো করে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন রেয়ান। তার পাশে দাঁড়িয়ে আমি। প্রায় অনেক্ষণ শুধু দাঁড়িয়েই আছি আমরা। এদিকে কফি প্রায় ঠান্ডা হয়ে এসেছে। আমতা আমতা করে বললাম,
— “শু-শুনছেন?”

সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে ছাদ থেকে ছুঁড়ে মারলেন রেয়ান। বাগান গলিয়ে পুকুরে গিয়ে পরলো মগটা। আচমকা এমন হওয়ায় বিস্মিত হলাম আমি। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। দু’হাতে চুল আকঁড়ে ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন রেয়ান। নিঃশব্দে উনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। উনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। হঠাৎ শক্ত করে আমার হাত ধরলেন। চমকে উঠলাম। রেয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলাম, উনি সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। হাতা গোটানো বাম হাতটা প্যান্টের পকেটে গুঁজে রেখেছেন। মুখে তীব্র রাগ ফুটে উঠেছে উনার। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হাতে হাত রেখে প্রায় অনেক্ষণ ওভাবেই মুহুর্তটা অনুভব করলাম আমরা।

_______________

দুপুর হয়ে গেছে। আমরা তখনো দাঁড়িয়ে আছি পাশাপাশি। ছাদের রেলিং-এ পিঠ ঠেকিয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রেয়ান। প্রচুর লজ্জা লাগছে আমার। মাথা নিচু করে আছি। হঠাৎ মনে হলো রেয়ান হাসছেন। সন্দেহ কাটাতে চোখ তুলে তাকালাম। ভাবনা ঠিক! রেয়ান নিঃশব্দে হাসছেন। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মুচকি হেসে বললেন,
— “লাল টমেটো দেখতে বেশ লাগছে।”

লজ্জা তীব্র হলো যেন। আবারো মাথা নিচু করে ফেললাম। আমার দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালেন রেয়ান। কপালে নিজের অধরজোড়া ছোঁয়াতে নিবেন, তার আগেই কোনো মেয়েলী কণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠল,
— “সরি! সরি! সরি! রং টাইমে এসে গেছি না? ডিস্টার্ব করার জন্য সরি। আমরা বরং চলে যাই এখন, ঠিকাছে?”

তৎক্ষণাৎ সামনে তাকালাম আমরা। মেহেরুন হাতে কেক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে আবদ্ধ, দীঘি, সবুজ আর ইয়াসিন ভাইয়া আছেন। মেহেরুনের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ইয়াসিন ভাইয়া বলেন,
— “আরে কিসের সরি? ডিস্টার্ব তো করেই ফেলেছিস। এখন আবার চলে যাওয়ার কি দরকার? যেহেতু ডিস্টার্ব করেই ফেলেছি, সেহেতু যেটা করতে এসেছি সেটা একেবারে করেই যাবো। ঠিক বলেছি না আবদ্ধ?”

আবদ্ধ সায় দিলো। সঙ্গে সঙ্গে সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল,

— “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ
হ্যাপি বার্থডে, হ্যাপি বার্থডে
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ আব্রাহাম ভাই।”

সবার এত সুন্দর চেঁচানোতেও অভিব্যক্তি পাল্টালো না রেয়ানের। উনি আগের ন্যায় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “ফাঁটা বাঁশের মতো চিলাচ্ছিস কেন?”

সবাই ‘এ্যাঁ!’ বলে আওয়াজ করে উঠল। ইয়াসিন ভাইয়া মুখ তেঁতো করে বললেন,
— “আমরা তোমাকে এত সন্দর করে উইস করলাম, কই তুমি আমাদের ধন্যবাদ জানাবে। টাকা-পয়সা কিছু দেবে। তা-না! উল্টো এভাবে বলছো! এটা তুমি ঠিক করলে?”

ইয়াসিন ভাইয়ার কথায় সায় দিয়ে সবুজ ভাইয়া বললেন,
— “ইয়াসিন ঠিক বলছে। আমাদের এত কষ্টের উইস-কে তুই এভাবে অপমান করতে পারলি?”

রেয়ান ডান ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
— “কি কষ্ট করেছিস তোরা? পাঁচ’শত টাকা দিয়ে একটা কেক এনেছিস আর এমন ফাঁটা গলায় চিলাচ্ছিস। এটা তোদের কষ্ট?”

মেহেরুনের প্রতিবাদি কণ্ঠ,

— “যেটাই হোক ভাইয়া। তোমাকে আমাদের টাকা দিতেই হবে।”
— “কিসের টাকা?”

আবদ্ধ মুচকি হেসে বলল,
— “তোমার জন্মদিনের গিফট হিসেবে দিবে টাকা।”

রেয়ান প্রশ্নাতীত কণ্ঠে বললেন,
— “গিফট তো তোদের দেওয়ার কথা তাই না?”

আবদ্ধ দাঁত বের করে হাসলো এবার। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
— “হ্যাঁ, কিন্তু তোমার বেলায় আলাদা হবে। কেননা তুমি আমাদের বড় ভাই।”

ইয়াসিন ভাইয়া বললেন,
— “ঠিক! বড় ভাইয়াদের গিফট দিতে নেই। তাছাড়া তুমিই একবার ভাবো, আজকে তোমার বার্থডে। কালকে আবার তোমার বিয়ে! হাও রোমান্টিক! তো সে হিসেবে আমাদের ট্রিট দিবে না তুমি? মানে টাকা আরকি!”

কিছুপলক ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন রেয়ান। পরপরই কপালে আঙ্গুল ঘঁষলেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন,
— “ঠিকাছে। দিবো। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”

প্রথমের কথাগুলো শুনে খুশিতে লাফিয়ে উঠেছিল সবাই। কিন্তু শেষের দিকে শর্তের কথা শুনে সবার মুখের হাসি মিইয়ে গেলো। সবাই একসাথে তোতলিয়ে বলল,
— “ক-কি শর্ত?”

উনার শান্ত কণ্ঠে আবারো জবাব,
— “ছাদ থেকে লাফ দেয়। যার হাত-পা ভাঙ্গবে না, তাকে ১হাজার টাকা দেবো আমি।”

সবাই কিছুক্ষণ ‘হা’ হয়ে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই কেক কাটতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। টাকার কথা উচ্চারণ করলো না আর একবারো। কেননা, তারা জানে লাভ নেই। শুধু শুধু সিংহের মুখে হাত দেওয়ার দরকার কি? তাদের এসব কান্ড দেখে হেসে উঠলাম আমি আর দীঘি। আমার দু’জন বরাবরই নিরব দর্শক। হঠাৎ কোত্থেকে কেক এনে আমার মুখে পুড়ে দিলেন রেয়ান। খানিকটা কেক নাকে আর গালে লাগিয়ে দিলেন। কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,
— “হ্যাপি বার্থডে টু মি, মাই মিসেস।”

সাথে সাথে চারদিকে হৈ-হুল্লোড় আরো বেড়ে গেলো। আমার মনে হলো, মাটি যেন ফাঁক হয়ে যাক আর আমি মিশে যাই। অথচ আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রেয়ান দিব্যি নির্লজ্জের মতো ঠোঁট কামড়ে হাসছেন।

________________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here