যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ৪২

0
542

যাও পাখি বলো তারে

৪২.
সকালটা বৃষ্টিময়। ঘন ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে পুরো আকাশ। এক অদ্ভুদ সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু এই সৌন্দর্যের এক কোণে রয়েছে তীব্র বিষণ্ণতা। সেই বিষণ্ণতা ঘিরে ধরেছে দীঘি আর আবদ্ধকে। সল্প সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু বিভীষিকা মুহুর্ত সারাজীবনের জন্য তাদের মনে দাগ কেটে গেছে। ব্যাপারটা অদ্ভুদ হলেও সত্য। বাস্তবতা!

বিকালের মধ্যভাগ। সোফায় বসে হাত ঘড়ি পরছে আবদ্ধ। দীঘি মুমূর্ষুভাবে বিছানার এক কোণে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। দৃষ্টি তার নত। সেদিকে কিছুপলক তাকিয়ে আবদ্ধ শান্ত গলায় বলল,
— “বসে আছো কেন? উঠো! রেডি হও। দেড়ি হয়ে যাচ্ছে তো।”

দীঘি শক্ত কণ্ঠে বলল,
— “যাবো না আমি।”

আবদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “যাবে না মানে? কেন যাবে না? ডাক্তারের কাছে এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি আমি। দেড়ি হচ্ছে!”

দীঘি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো। পরপরই গম্ভীর স্বরে বলল,
— “কেন নিয়েছেন? আমার সন্তানকে খুন করতে?”

রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আবদ্ধর। সে তো তার কর্মে অনুতপ্ত তাই না? ক্ষমাও চেয়েছে দীঘির কাছে। তাহলে কেন দীঘি বারবার এসব বলে রাগিয়ে তুলছে তাকে? রাগ দমিয়ে শান্ত থাকতে চাইলো আবদ্ধ। চোখ খিঁচে ঢোক গিললো একবার। নমনীয় কণ্ঠে বলল,
— “দেখো দীঘি, আমি আমার ভুলের জন্য অনুতপ্ত। এসব বলে আমার মনটা আর বিষিয়ে দিও না। চলো, ডাক্তারের কাছে যাবে।”

দীঘির আগের মতোই দৃঢ় কণ্ঠ,
— “যাবো না বলেছি।”

এবার ধমক দিয়ে উঠল আবদ্ধ,
— “কি শুরু করেছো কি?কেন যাবে না? নিজের চিন্তা না করো, বাচ্চার কথা তো একবার ভাববে।কেন এমন জেদ করছো? আমি তো ক্ষমা চেয়েছি।”

দীঘি চোখ তুলে তাকালো আবদ্ধর দিকে। জলে ভরপুর দীঘির চোখ। আবদ্ধর বুক মোচড় দিয়ে উঠলো। দীঘির কাছে এগিয়ে যেতে চাইলে হাত উঁচিয়ে বাঁধা দিলো দীঘি। বেশ কঠিন গলায় বলল,
— “আমি জেদ করছি না আবদ্ধ। আপনাকে শাস্তি দিতে চাইছি মাত্র। যেন এরপর থেকে আমার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করতে দু’বার ভাববেন আপনি।”

আবদ্ধ গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দীঘির কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো সে। দীঘির হাত দু’টো নিজের হাতের মাঝে নিয়ে করুণ কণ্ঠে বলে,
— “আই এম রেইলি রেইলি সরি দীঘু।প্লীজ ফর্গেভ মি। আমি সত্যি অনুতপ্ত। আ-মি তোমাকে কথা দিচ্ছি আর কখনো খারাপ ব্যবহার করবো না তোমার সাথে। আমি, তুমি, আমাদের ছোট্ট অংশ মিলে সারাজীবন হাসি-খুশি থাকবো। শুধু একবার ক্ষমা করে দাও দীঘু। প্লীজ!”

দীঘি বড় একটা নিশ্বাস নিলো। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
— “আমার এসব ভালো লাগছে না আবদ্ধ। উঠে বসুন।”

আবদ্ধ উঠলো না। ঠায় বসে রইলো। দীঘি এবার জোড় গলায় বলল,
— “আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে আবদ্ধ। কথা শুনছেন না কেন?”

আবদ্ধ স্নিগ্ধ, মায়াময় এক চাহনীতে তাকালো দীঘির দিকে। আকুতি ভরা সেই মুখ দেখে আর কিছু বলতে পারলো না দীঘি। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে দৃঢ় গলায় বলল,
— “অপেক্ষা করুন। রেডি হয়ে আসছি।”

কথাটা বলার সময় একবারও আবদ্ধর দিকে তাকালো না দীঘি। অথচ আবদ্ধ তাকিয়ে ছিল পুরোটাক্ষণ। বিষণ্ণতায় ডেবে থাকা আনন্দ প্রকাশ হলো এবার। ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে উঠল আবদ্ধর।

__________________

রাত ১১টা ৩০মিনিট। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। মস্তিষ্কে কিছু একটা ভেবে চলছি লাগাতার। কিভাবে কি করবো? ফ্রিজে একটা কেক বানিয়ে রেখে ছিলাম। ওটা সাজালে কেমন হয়? উহু! মন্দ হয় না। দেয়াল ঘড়ির দিকে আবারো তাকালাম। ১১টা ৩৭বাজে। সময় নেই বেশি। তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরের দিকে ছুটলাম আমি। ফ্রিজ থেকে চকলেট কেক বের করে জেমস্ আর চকোচকো দিয়ে সাজালাম কেকটা। দেখতে সুন্দরই লাগছে। সাজানো শেষে আবারো তাকালাম ঘড়ির দিকে। ১১টা ৫৫মিনিট। সময় একদমই কম এখন। আর ৫মিনিট পর রেয়ানের জন্মদিন। কথাটা মেহেরুন আজ ডাইনিংটেবিলে রাতের খাবার খাওয়ার সময় বলেছিলো আমায়। জানতাম না আমি। এখন যেহেতু জানি, কিছু তো করতেই হয় তাই না? কেক নিয়ে দ্রুত পায়ে চলে এলাম রেয়ানের রুমের সামনে। দরজার কাছে এসেই দাঁড়িয়ে গেলাম। হালকা ধাক্কা দিতেই আধোভাবে খুলে গেলো দরজা। দ্বিধাবোধ করছি। ঢুকবো কি ভেতরে? পরক্ষণেই মনে হলো সময় বেশি নেই। সুতরাং, ভণিতা না করে ঢুকে পরলাম রুমে। রুমের আলো নেভানো হলেও ড্রিম লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ রুমটা। সঙ্গে রেয়ানের ঘুমন্ত মুখও ফুটে উঠেছে সামনে। ঠোঁট উঁচু করে আছেন উনি। হালকা মুচকি হাসলাম। তার কাছে এগিয়ে গিয়ে টেবিলে কেকটা রেখে দিলাম। খানিকটা ঝুঁকে তাকে ডাকতে লাগলাম,
— “শুনছেন? রেয়ান? উঠুন!”

উনি নড়েচড়ে উঠলেন। আধো চোখে তাকালেন আমার দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
— “এত রাতে এখানে কি? ডিড ইউ মিস মি?”

উনার কথায় জবাব দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পেলাম না আমি। চুপ রইলাম। উনি একটু সরে শুলেন। ইশারায় নিজের পাশে বসতে বললেন আমাকে। আমি দ্বিধান্বিত ভাবে বিছানার এক কোণে বসতেই আচমকা আমাকে টেনে নিজের পাশে শুইয়ে দিলেন। চমকে গিয়ে কিছু বলতে নিলে মুখ চেপে ধরলেন আমার। ঘাড়ে মুখ রেখে ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বললেন,
— “উহু! ডোন্ট সাউড। ঘুমাতে দাও। নিজেও ঘুমাও।”

বলেই মুখ থেকে হাত সরিয়ে ফেললেন। কোমড় জড়িয়ে ধরলেন আমার। কেঁপে উঠলাম। খানিকবাদে যখন বুঝতে পারলাম উনি নিজের নাক আমার ঘাড়ে ঘঁষছেন, তখন আরো জমে গেলাম যেন। কাঁপা কণ্ঠে বললাম,
— “ছাড়ুন! ক-কথা ছিল।”

উনি জবাব দিলেন না। লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে আমি বললাম,
— “হ্যা-হ্যাপি বার্থডে রেয়ান।”

উনি আরো দৃঢ় ভাবে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। বললেন,
— “৩মিনিট দেড়ি করেছো তুমি।”

হকচকিয়ে গেলাম। পরক্ষণেই রাগ হলো আমার। কাউকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালে কেউ কি এমন কথা বলে? কিন্তু উনি! কি সুন্দর বলে দিলেন, ‘৩মিনিট দেড়ি করেছো তুমি।’ তো কি হয়েছে? সবার আগে তো উইস করেছি! রেগে গিয়ে বললাম,
— “টেবিলে কেক রেখেছি, খেয়ে নিবেন। এখন ছাড়ুন আমাকে। আমার রুমে যাবো আমি।”
— “যেতে হবে না। আমার সঙ্গে ঘুমাও।”
— “যদি বলি না, তখন?”
— “থাপ্পড় খেতে না চাইলে বকবকানি বন্ধ করো।”

নাক ফুলিয়ে বললাম,
— “আপনি সব সময় এমন করেন।”
— “আমার স্বভাব।”
— “আপনি একটা পাগল।”
— “ধন্যবাদ।”

এ কথার পিঠে আর কিছু বলতে পারলাম না। পাগল বলায় যে কি-না গর্ববোধ করে। ধন্যবাদ জানায়, তার সাথে কথা বলার কোনো মানেই হয় না। চুপ রইলাম। এক মিনিট, দুই মিনিট করে অনেক্ষণ। এদিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। উনি ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছেন। হয়তো ঘুমিয়ে গেছেন। মৃদু স্বরে ডাকলাম উনাকে। উনি ঘুমের মাঝেই জবাব দিলেন,
— “হু?”

নমনীয় কণ্ঠে বললাম,
— “আপনার জন্য কেক এনেছিলাম। খাবেন না?”

এবারো ঘুমুঘুমু কণ্ঠে তার জবাব,
— “সকালে।”
— “না, আমি এত কষ্ট করে বানিয়েছি। আপনার এখনই খেতে হবে।”

এবার আর জবাব দিলেন না উনি। শত ডাকার পরও না। উল্টো আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেলেন। শান্তির ঘুম যাকে বলে! দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। তার মায়ায় আগে থেকে জড়ানো আমি। এখন সেটা আরো দৃঢ় হচ্ছে যেন। আলতো হাতে তার চুলে হাত বুলাতে লাগলাম। একসময় আমিও যে কখন ঘুমিয়ে গেলাম, টেরই পাই নি।

________________

চলবে…
– ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
(ছোট হওয়ার জন্য এত্তগুলো সরি। গ্রামে থাকায় লেখার পরিবেশ পাচ্ছি না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here