যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ৪১

0
522

#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ৪১
.
বাড়ির একটু পাশেই এক বিরাট নদীর পার আছে। সেখানেই ঘুড়তে গিয়েছি আমরা। ভেবেছিলাম জমিয়ে আড্ডা-আনন্দ করব, কিন্তু রেয়ান নামক ব্যক্তিটি আমার সব আশা মাটি করে দিলো।

গালে হাত দিয়ে গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আছি আমি। আমার সামনে কিছুদূরে রেয়ান দাঁড়িয়ে আছেন। ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত উনি। যাওয়ার আগে কড়া কণ্ঠে আদেশ দিয়ে গেছেন,
— “এক পা-ও যদি এখান থেকে নড়েছো তো পা ভেঙ্গে ফেলবো।”

বাধ্য আমি তাই বসে আছি। আমার পাশে ইয়াসিন, মেহেরুন আর সবুজ ভাইয়া। আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ইয়াসিন ভাইয়া খোঁচা মেরে বললেন,
— “আহারে মীরু! জীবন তো শেষ তোর। বরের বকা খাইতে খাইতেই জোয়ান,বুড়া সব বয়স পার করবি তুই। উফ! কি দুঃখ।”

কথাটুকু বলেই থামলেন ইয়াসিন ভাইয়া। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মাথার পেছনে এক হাত রেখে এটেটিউট নিয়ে ভাইয়া বললেন,
— “আমারে দেখ, কত্ত ভালো প্রেমিক আমি। কুহুর কাছে জিজ্ঞেস করে দেখিস, রিপোর্ট ভালো পাবি।”

সঙ্গে সঙ্গে ইয়াসিন ভাইয়ার পিঠে চড় মারলাম আমি। ভাইয়া মুখ ফুলালেন। কাঁদো কণ্ঠে বললেন,
— “তুই আমাকে মারলি?”
সবুজ ভাইয়া জবাব দিলেন,
— “না। তোমাকে আদর করেছে। ভালো লেগেছে তো?”

মুখ আরো ভুলিয়ে ফেললেন ইয়াসিন ভাইয়া। মেহেরুন হেসে উঠলো। গোমড়া মুখে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে ভাইয়া বললেন,
— “আমি এমন কি বলছি যে আমাকে এভাবে খোঁচা মারছিস তোরা? বোনগুলো তো বান্দর ছিলই এখন তুমিও যোগ দিয়েছো সবুজ ভাইয়া। এটা কিন্তু ঠিক করো নি।”

সবুজ ভাইয়া মুচকি হাসলেন। বান্দর বলায় রেগে গেল মেহেরুন। দু’হাতে ইয়াসিন ভাইয়ার চুল শক্ত করে টেনে ধরল। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
— “বেয়াদব! ছোট বোনদের বান্দর বলিস, লজ্জা করে না?”

চুল টানায় ইয়াসিন ভাইয়ার কষ্ট হচ্ছে না একটিও। বরং অতি আরামে উনি আধো চোখ বন্ধ অবস্থায় মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন,
— “আহা! কি আরাম! এভাবেই টানতে থাক মেহেরুইন্না। ভাল্লাগছে!”

মেহেরুনের হাত থেমে গেল। বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেল তার। মেহেরুন কি করতে চেয়েছে আর কি হচ্ছে! রাগের পাশাপাশি এবার বিরক্ত হলো মেহেরুন। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ইয়াসিন ভাইয়ার চুল টানার পরও ভাইয়ার একই কণ্ঠ,
— “আহা! এত আরাম কোথায় রাখি আমি? আরেকটু জোড়ে টান মেহেরুন।”

রাগে, দুঃখে এবার কেঁদে দেওয়ার উপক্রম মেহেরুনের। সবুজ ভাইয়ার হাত টেনে উঠে দাঁড়ালো সে। সামনে এগোতে এগোতে রাগী কণ্ঠে বলে উঠল,
— “চুল নাকি রড? এত জোড়ে টানার পরও বলে ব্যথা পাচ্ছে না। গন্ডার কোথাকার!”

কথাটা কানে পৌঁছালো ইয়াসিন ভাইয়ার। সে নির্লজ্জের মতো হেসেই চলছেন। যেন মেহেরুনকে শায়েস্তা করতে পেরে তিনি বড্ড আনন্দিত।

__________________

প্রায় ৫মিনিট পর রেয়ান কথা শেষ করে আসলেন আমার কাছে। চোখ তীক্ষ্ণ করে ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে কিছু একটা ইশারা করতেই ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হাসেন একবার। পরপরই ধীর পায়ে মেহেরুনদের কাছে চলে যান। সঙ্গে সঙ্গে আমার পাশে বসে পরেন রেয়ান। আমি একটু সেঁটে বসি। তা দেখে ডান ভ্রু কুঁচকে তাকান রেয়ান। আমার কাছে এসে বসেন তৎক্ষণাত। এবার সরে বসলাম না। চুপ রইলাম। উনি ফোন পকেটে রাখলেন। আড়চোখে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, উনি বিরক্তিকর চাহনী নিয়ে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। আমার নিশ্চুপ থাকাটা যে উনার বিরক্তির কারণ তাও বুঝতে পারছি। উনি কিছুক্ষণ বসে রইলেন ওভাবেই। হাল ছেড়ে খানিকটা কেশে উঠলেন। তবুও নিশ্চুপ আমি। উনার ভ্রুটা আরো কুঁচকে গেলো। আমার গা ঘেঁষে বসে ঘাড় কাত করে তাকালেন আমার দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “চড় দেবো?”

অভিমানটা আরো তীব্র হলো যেন। যেখানে উনার উচিত আমার অভিমান ভাঙ্গানোর, সেখানে উনি আমাকে চড় মারতে চাইছেন? মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। উনি আরো গম্ভীর গলায় বললেন,
— “কথা বলবে না বলে ডিসাইড করেছো? ভালো! এখন চড় টা দিয়ে দেই আমি? কোন গালে দেবো?”

এবারো যখন কিছু বললাম না আমি তখন আমার গাল টেনে ধরলেন উনি। ব্যথা পেলাম খানিকটা। উনার হাত সরাতে চাইলে আমার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলেন উনি। আমি থমকে যাই। একটু আগেও যে গম্ভীর ভাবটা ছিল সেটা একদম শান্ত হয়ে যায় উনার। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছেন উনি। অবাক হয়ে বললাম,
— “কি হয়েছে আপনার? খারাপ লাগছে? বাসায় যাবেন?”

উনি মাথা দুলিয়ে না জানালেন। মৃদু স্বরে বলেন,
— “তোমার কোলে একটু মাথা রাখি মরুভূমি?”

আকুতি ভরা তার কণ্ঠ। আমার প্রচুর মায়া হলো। অথচ প্রতিবারই উনি আমার কোলে বিনা পার্মিশনে মাথা রেখে শুয়ে পরেন। আজ কি হলো উনার? শরীর বেশি খারাপ কি? আস্তে করে বলি,
— “খারাপ লাগলে চলুন বাসায় চলে যাই। এখানে কিভাবে কি?”
উনি উত্তর দিলেন না এবার। আশেপাশের মানুষদের তোয়াক্কা না করে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েন। অদ্ভুদভাবে আমিও তার চুলে হাত বুলাতে শুরু করি। সে চুপ থাকেন অনেক্ষণ। হঠাৎ-ই শান্ত স্বরে বলে উঠেন,

— “আমার বুক ভারী হয়ে আসে মরুভূমি। আবদ্ধর জন্য চিন্তা হয়। ছেলেটা অবুঝ। যেখানে আমি সিগারেট দেখতেই পারি না সেখানে আমার নিজের ছোট ভাই সেই অখাদ্য জিনিস খেয়ে থাকে।”

অবাক হয়ে তাকালাম রেয়ানের দিকে। আবদ্ধ ধুমপান করে? কথাটা বিশ্বাস করতে পারছি না। একরাশ বিস্ময় নিয়ে রেয়ানের পরবর্তী কথা শুনতে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। কিছু সময় চুপ থেকে উনি আবারো বললেন,
— “দীঘি প্রেগন্যান্ট মরুভূমি। শুধুমাত্র নিজের ক্যারিয়ারের জন্য আবদ্ধ তাকে এবোরশণ করতে বলেছে। এ নিয়ে ওদের মাঝে ঝগড়া হয়েছিল বা এখনো হচ্ছে। ভাই হিসেবে যতটুকু আমার করার ছিল আমি করেছি। ওকে বুঝিয়েছি। আবদ্ধও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু দীঘি অভিমান করে আছে এখনো। করারই কথা। আবদ্ধ চেষ্টা করছে দীঘিকে মানাবার। এজন্যই আজকে আমাদের সাথে ঘুরতে আসেনি তারা। বাসায় থেকেই সারপ্রাইজ দেবে দীঘিকে। একটু আগে এ নিয়েই কথা হয়েছে আমার সঙ্গে আবদ্ধ। দীঘির জন্য সারপ্রাইজ তৈরি করে ফেলেছে সে। সব ঠিকঠাকই আছে। কিন্তু তবুও চিন্তা হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে আমি ভাই হয়ে কিছু করতে পারছি না ওদের জন্য।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রেয়ান। সঙ্গে আমিও। উনার চুলে আলতো হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,
— “আপনার ধারণা ভুল রেয়ান। ভাই হিসেবে যেতটুকু করার আপনি করেছেন। আবদ্ধকে সঠিক – ভুল বুঝিয়েছেন, শাসণ করেছেন! এবং আবদ্ধও সেটা গ্রহণ করেছে। ভাই হিসেবে এর চেয়ে বেশি কি-ইবা করার আছে আপনার? আপনি আপনার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করেছেন রেয়ান। তাই নিশ্চিন্তে থাকুন। ইনশাল্লাহ, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

রেয়ান কিছু বললেন না। এক হাতে আমার হাত শক্ত করে ধরে রইলেন।

__________________

দীঘি নিচে মেজো চাচীর রুমে আছে। এ সুযোগে বেলুন, মোমবাতি এবং কিছু বেবিদের ছবি দেয়ালে আটকিয়ে রুমটাকে সাজিয়ে ফেলছে আবদ্ধ। সাজানো শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ বাদে দীঘির আসার আওয়াজ পেয়ে দরজার এক কোণে লুকিয়ে যায় আবদ্ধ। ক্রমশই দীঘির পায়ের শব্দ রুমের কাছাকাছি চলে আসছে। দীঘি রুমে ঢুকতেই দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে দীঘিকে চমকে দেয় আবদ্ধ। ‘ভৌঁ’ শব্দটা অনেকটা উচ্চস্বরে বলায় ভয় পেয়ে যায় দীঘি। বুকে দু’হাত চেপে বিস্ফোরিত চোখে আবদ্ধের দিকে বড় বড় নিশ্বাস ফেলে তাকিয়ে আছে দীঘি। আবদ্ধ খানিকটা ঘাবড়ে যায়। দীঘির দিকে এক কদম এগিয়ে এসে উত্তেজিত গলায় বলে,
— “স-সরি দীঘু। আমি বুঝতে পারি নি তুমি এত ভয় পাবে।”

প্রবল ক্ষোভে দীঘি বলে উঠে,
— “আপনি তো সবকিছু না বুঝেই করেন, তাই না আবদ্ধ?”

আবদ্ধ জবাব দিতে পারে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। রুমের চারিদিকে এবার নজর যায় দীঘির। এত এত সাজসজ্জা আর বাবুদের ছবি দেখে বুকটা যেন আরো ফেটে যায় তার। কান্না আসতে চায়। কিন্তু কাঁদে না সে। গম্ভীর ভাব নিয়ে কঠিন কণ্ঠে বলে,
— “এমন বাজে অবস্থা করেছেন কেন রুমের? আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। দ্রুত এগোলো পরিষ্কার করুন। আমি বারান্দায় যাচ্ছি। এসে যেন দেখি সব পরিষ্কার করে ফেলেছেন।”

বলেই চলে যায় দীঘি। আবদ্ধ কিছু বলতে গিয়েও পারে না। নিজের প্রতি প্রবল রাগ হয় তার। অতিরিক্ত রাগে ধুপধাপ আওয়াজ করে রুম পরিষ্কার করতে থাকে সে। বারান্দা থেকে সবই শুনতে পায় দীঘি। কিছু বলে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু। একটু শাস্তি পাওয়া প্রয়োজন আবদ্ধর। একটু হলেও প্রয়োজন!

_____________

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here