#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে-স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব-৬
শিখা বেগম গিয়ে দরজা খুলে দিলো।রায়ানরা চলে এসেছে।রনিত চৌধুরী এবং রেখা চৌধুরীকে ছাড়া আর কাউকেই উনি চিনতে পারে নি।শিখা বেগম সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে সবাইকে ভিতরে আসতে বলে জাকিয়া বেগমকে ডেকে বলেন,
– বড়বু দেখো কারা এসেছে!
আহান আর দীপ্ত অনেকটা পথ ড্রাইভ করে এসেছে তাই জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হতে আহানের রুমে চলে গেলো।লাজুক মেহমানদের দেখতে পেয়ে মেহমানরা ওকে দেখার আগেই আদিবার ঘরে চলে যায়।জাকিয়া বেগম উপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন,
– কে এসেছে?
রনিত সাহেবকে দেখতে পেয়ে জাকিয়া বেগম তাড়াতাড়ি করে নিচে নেমে আসেন।উনাদের কাছে এসে বললেন,
– কেমন আছেন ভাইজান?ভাবী আপনি কেমন আছেন?আপনাদের আসতে কোনো অসুবিধা হয় নি তো?
পরমুহূর্তেই আবার গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– এই লতিকা মেহমানদের জন্য ঠান্ডা পানি আর শরবত নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।
রনিত চৌধুরী জাকিয়া বেগমকে ব্যস্ত হতে দেখে বললেন,
– আলহামদুলিল্লাহ আমরা ভালো আছি ভাবী।ভাবী আপনি এত ব্যস্ত হবেন না।
– আসুন ভাইজান, বাকি কথা পড়ে শুনা যাবেক্ষণ।এই ছোট কোথায় গেলি?দেখ কারা এসেছে।
জাকিয়া বেগমের গলা শুনে জ্যোতি বেগম (সাজির ছোট চাচি) রান্নাঘর থেকে ঠান্ডা পানি আর শরবত নিয়ে এসে সবাইকে ভালোমন্দ জিজ্ঞাস করে চলে যান।জাকিয়া বেগম রায়ানকে চিনতে পারছেন না।ওখানে চারজন ছেলে মেয়ে রয়েছে।তাঁদের মধ্যে কে রায়ান চিনতে না পেরে রেখা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– তা ভাবী ওদেরকে তো চিনতে পারছি না।রায়ান….
জাকিয়া বেগম উনার কথা শেষ করার আগেই রেখা বেগম মুচকি হেসে রায়ান আর রাহাকে দেখিয়ে বললো,
– এই যে আমার ছেলে রায়ান আর মেয়ে রাহা।
রায়ান আর রাহা উঠে এসে জাকিয়া বেগমকে সালাম করে।
– আর ওরা হচ্ছে বনি আর বহ্নি।ওরা দুইজন রায়ান এর বন্ধু।
বনি আর বহ্নিও জাকিয়া বেগমকে সালাম দেয়।জাকিয়া বেগমও সালাম এর জবাব দেন।
রেখা বেগম ফের বললো,
– বনি আর বহ্নি এই দেশের বংশধর হয়েও নিজের পৈতৃক জন্মভূমি কখনো দেখার সু্যোগ হয় নি।তাই রায়ান এর বিয়ের উছিলায় রায়ান ওদের নিয়ে এসেছে।
– খুব ভালো হয়েছে।
জাকিয়া বেগম বললেন।
রনিত সাহেব কখন থেকে এদিক সেদিক চোখ বুলাচ্ছেন।কেমন যেনো ছটফট করছেন।দেখে মনে হচ্ছে কাউকে খুজছেন।জাকিয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে উৎকন্ঠিত স্বরে বললেন,
– ভাবী,আসলাম তো অনেকক্ষণ হলো।তা আমার বন্ধুটি কোথায়?তাকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।
– এই তো বন্ধু,আমি এখানে!
আহসান সাহেব বললেন।রনিত সাহেব উৎফুল্লতার সাথে এগিয়ে গিয়ে আহসান সাহেবকে জড়িয়ে ধরতেই আহসান সাহেবও প্রানপ্রিয় বন্ধুকে জড়িয়ে ধরেন।দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে লাফাচ্ছে রীতিমতো। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে কেউ কেউকে ছাড়তেই না।তাদের এই কান্ড দেখে সবাই হেসে উঠলো।রেখা বেগমকে চোখ মুছতে দেখে জাকিয়া বেগম একটু না অনেকটা বেশিই অবাক হলেন।উৎকন্ঠিত স্বরে বললেন,
– কি হলো ভাবী আপনি কাঁদছেন কেন?
রেখা বেগম স্মিত হেসে ধীর কন্ঠে বললো,
– এটা খুশির কান্না ভাবী!আনন্দের অশ্রু!জানেন ভাবী,এই মানুষটাকে কতগুলো বছর পর এইভাবে হাসতে দেখছি।বিদেশে কাটানো গত কয়েকটি বছর যেন বিষাদে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছিল উনার জন্য। আমাকে উনি বলতেন, বিদেশের মাটিতে একেকটা দিন উনার কাছে একেকটা যুগ মনে হতো। নিজের আপন মানুষগুলোকে ছাড়া নিজের জন্মভূমিকে ছাড়া আর থাকতে পারছেন না।আমি উনাকে বলতাম দেশে এসে ঘুরে যেতে।কিন্তু উনি রাজি হতেন না।বলতেন, দেশে গেলে বরাবরের জন্যই যাবোই।কিছুদিনের জন্য গিয়ে মায়া বাড়ানোর দরকার নেই।
কথাগুলো শেষ করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন রেখা বেগম।জাকিয়া বেগমও শীতল কণ্ঠে বললেন,
– আগে যখন আদিবার আব্বু বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত থাকতো তখন তো নিজেকে নিয়ে ভাবার জন্যও সময় ছিল না।কিন্তু ইদানীং আদিবার আব্বুকেও দেখি রোজ বিকালে আমাদের পুরান বাড়িতে যায়।যেখানে গেলেই নাকি তাদের শৈশবে কাটানো দিনগুলো চোখে ভেসে উঠে।গত মাসে আমাকেও নিয়ে গিয়েছিল।দুই বন্ধুর কাটানোর বিভিন্ন জায়গাগুলো আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে।
এতটুকু বলেই থেমে গেলেন জাকিয়া বেগম।সামনের দিকে তাকিয়ে রনিত সাহেব আর আহসান সাহেবকে উদ্দেশ্য করে গলার স্বর উঁচু করে বললেন,
– এমন বুড়ো বয়সে কাউকে এইভাবে লাফালাফি করতে দেখেছেন কখনো?অনেক হয়েছে এবার থামুন!নয়তো এই বয়সে হাড়গোড় ভেঙ্গে দুই বন্ধুকে বাকিজীবনটা হাসপাতালে কাটাতে হবে!
জাকিয়া বেগমের কথাটা শুনে সবাই হেসে দেয়।আহসান সাহেব আর রনিত সাহেব তাদের বাচ্চাসুলভ আচরণে ক্ষানিকটা লজ্জায় পড়ে গেছেন।আহসান সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে জোর গলায় বলে উঠলেন,
– তাও ভালো!অন্তত বাকি জীবনটা তো দুই বন্ধু একসাথে কাটাতে পারবো!
– কে রে?রনি এসেছিস নাকি?এই বুড়ো মায়ের কথা তো ভুলেই গেছিস দেখছি।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রাবিয়া বেগম(গোধূলির দাদু) বললেন।রনিত সাহেব এগিয়ে গিয়ে রাবিয়া বেগমকে সালাম করে জড়িয়ে ধরলো।বললেন,
– কেমন আছো মা?
– যেমন রেখে গিয়েছিলি!
– হুম আমার মা তো এখনো অনেক ইয়াং এই আছে দেখছি!
রনিত সাহেব রাবিয়া বেগমের হাত ধরে নিয়ে সোফায় বসালো। রেখা বেগম এসে রাবিয়া বেগমকে সালাম করে বললেন,
– কেমন আছেন মা?
– এইতো আছি কোনোরকম!তুমি কেমন আছো বউমা?
– জ্বি মা ভালো।
– আমার দাদুভাইরা কোথায়?
– এই যে দাদু আমরা!
চোখের চশমাটা ঠিক করে সামনের দিকে তাকান রাবিয়া বেগম।রাহা আর রায়ান এসে উনাকে সালাম করলো।দীপ্তি বেগম, সাজ্জাদ সাহেব,ইমরুল সাহেব একে একে সবাই এসে বসেছে। আলিফ আলবী ঘুমিয়ে পরেছিল। ওরাও মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে।আর বাকি রইলো ইহান!ওকে সাজি কি কাজে একটু বাইরে পাঠিয়েছিল।একটু আগে ইহানও চলে এদেছে।বাড়ির সবাই বসে সবাই নিজের মাঝে আলাপ আলোচনা করে অনেকক্ষণ।হালকা-পাতলা খাওয়া দাওয়াও করে সবাই।খাওয়া শেষ করে আবার আলাপচারিতা শুরু করে রনিত সাহেব।বিয়ের প্রসঙ্গ আসতেই রনিত সাহেব বললেন,
– ভাবী যাকে দেখার জন্য এসেছিল,আমার ঘরের লক্ষী,সে কোথায়?
– আদিবা ওর ঘরেই আছে।
জাকিয়া বেগম আলিফকে আদিবার ঘরে পাঠালো লাজুককে বলার জন্য যাতে আদিবাকে নিয়ে আসে।
____________
– ওই তো চলে এসেছে!
ইহানের কথায় সবাই সিঁড়ির দিকে তাকায়।দীপ্তও একপলক তাকালো সিঁড়ির দিকে।কিন্তু শুধু লাজুক আর আদিবা আসছে।গোধূলিকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না।এখন দীপ্ত ভাবছে অন্যকথা!অনেকক্ষণ হয়েছে মেহমানরা এসেছে। একবারও গোধূলিকে দেখলো না!এমনিতে তো সারা বাড়ি মাথায় করে রাখে।আজ হঠাৎ এতো ভদ্র হয়ে গেল কিভাবে?আছে হয়তো কোথাও।দীপ্ত বেশি মাথা না হাতে থাকা ফোনের দিকে মনোনিবেশ করে।লাজুক এসে সবাইকে সালাম দেয়।তারপর আদিবাকে রাবিয়া বেগমের পাশে বসিয়ে দেয়।রেখা বেগমের তো ছেলের বউকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।মিষ্টি হেসে বললেন,
– ঘোমটাটা তুলো তো মা।আজ কালের মেয়েরা এত লজ্জা পায় নাকি?তার থেকেও বড় কথা আমরা কি তোমার অপরিচিত কেউ যে এতো লজ্জা পেতে হবে?
রেখা বেগম ফের বললো,
– মা তুমিই না হয় ঘোমটা টা সড়িয়ে দাও একটু।বেচারি খুব লজ্জা পাচ্ছে।
কথাটা লাজুককে উদ্দেশ্য করে বললেন রেখা বেগম।সবাই আদিবার দিকে তাকিয়ে আছে।রেখা বেগমের কথা মতো লাজুক আস্তে করে আদিবার মাথার ঘোমটাটা সড়িতে দেয়।ঘোমটা সড়াতেই চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় দীপ্ত।
– ঘোমটার আড়ালে এটা কে?
চলবে…..