#গোধূলি_লগ্ন
#Writer_Tabassum_Tajnim
#Part_14
অনন্যা মন খারাপ করে কিছুক্ষণ পুলকের চলে যাওয়া দেখলো। দরজায় কেউ নক করছে, অনন্যা এসে দরজা খুলে দিলো।পূন্য দাড়িয়ে আছে, পূন্যর দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিলো।
পূন্য রুমের ভিতরে এসে চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে অনন্যাকে বললো,,
–ম্যাডামের কি আজকে খাওয়া দাওয়া লাগবে না!!! আমি যে আর খিদের জ্বালা সহ্য করতে পারছি না,
অনন্যা এগিয়ে এসে পূন্য কাঁধে দু হাত রেখে থুতনি টা কাঁধে রেখে বললো
— ম্যাডাম, বুঝি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন!!! সরি,, ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হয়ে গেছে, তুমি একটু বসো আমি চটপট ফ্রেশ হয়ে আসি।
পূন্য অনন্যার বিছানায় বসে পড়লো,, চোখটা আটকে গেলো কালো মলাটের ডায়েরি টার উপর,, এই ডায়েরিটার উপর চোখ পড়লেই এক শীতল একটা অনুভূতি হয়, ইচ্ছে করে ডায়েরি টা কে পড়তে, ডায়েরি টা কে ছুঁতে। অনন্যার ডাকে পূন্যর ঘোর কাটলো।
অনন্যা টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে পূন্যকে বললো,,
— ভাবি, চলো চলো,, আমার পেটের ভিতর একটু ইঁদুর দৌড়াচ্ছে,
পূন্য উঠে পা বাড়ালো, পিছন পিছন অনন্যা। ওরা একসাথে বসে খেলো। এই বাড়িতে অনন্যার একমাত্র কথা বলার সঙ্গী পূন্য। বছর দুয়েকের বড় ছোট হলেও এখন বান্ধবীই বলা চলে দুজনকে। একসাথে হাসা হাসি,,এ ওর মাথার চুল বেধে দেওয়া দুজনে একসাথে ঘুরতে যাওয়া, এগুলো অনন্যা আর পূন্যকে আরো কাছে নিয়ে এসে।
দুপুরের দিকে অনন্যা আবার বেলকুনিতে গেলো,, কিন্তু পুলক কে দেখতে পেলো না। অনন্যার মন খারাপ। আবার পূন্য ভাবিও কালকে বাড়িতে চলে যাবে, সে তো পুরো একা হয়ে যাবে। অনন্যার পূন্যর রুমে ঢুকে দেখে পূন্য কাপড় গোছানো শুরু করে দিচ্ছে। অনন্যা বললো,
— ২ দিন পর তো গিয়ে নিয় আসবো। এতো কাপড় নেওয়ার দরকার টা কি!!
— ইসস,, আমি দুই পর আসলে তো। কমপক্ষে ১ সপ্তাহ পর আসবো।
— না,, একসপ্তাহ না,,, চার দিন পর।প্লিজ, প্লিজ,, তুমি ছাড়া তো একা হয়ে যাবো আমি,, বুঝছো না কেনো??
— আচ্ছা, ঠিক আছে
মোর্শেদা বেগম আস্তে আস্তে হেটে পূন্যর রুমে ঢুকলো। মোর্শেদা বেগমের একদম ইচ্ছে নেই পূন্যকে বাড়ি পাঠানোর। কারন পূন্য চলে এই বাড়ি একদম ফাকা হয়ে পড়ে থাকে। মেয়েটার পায়ের নুপূরের শব্দে পুরো বাড়ি জেগে থাকে। এই কয়েকদিনে মোর্শেদা বেগমের মন যে পূন্য জিতে নিয়েছে। কতো সুন্দর করে কথা বলে মেয়েটা, কতো সুন্দর করে হাসে, চারদিক সামলে নেয় বুদ্ধি করে,, আর তার কতো খেয়াল করে। কিন্তু বেয়ান এমন করে বললো যে না করতে পারলো না। আর ওদের কাছেও তো মেয়েটা কতোদিন ধরে যায় না,, ওদের ও তো মন খারাপ করে। আচ্ছা যাক,, কয়েকদিন গিয়ে থেকে আসুক।
মোর্শেদা বেগম বললেন,,
— বৌমা,, বলছি বেশিদিন কিন্তু থাকবে না। আমাদের বাড়ি কিন্তু খালি হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি চলে আসবে কেমন।
পূন্য ব্যাগের চেইনটা লাগিয়ে মোর্শেদা বেগমের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললো,,
— ঠিক আছে মা।
মোর্শেদা বেগম জ্বিভে কামড় দিলেন,, ছিঃ ছিঃ,, মেয়েটাকে এখনো ঐ বাড়িতে গেলোই না তার আগেই সে তাড়াতাড়ি আসার কথা বলে দিলো। আসলে মেয়েটা তাকে একটা মায়ায় বেধে ফেলেছে।
গাড়ি থেকে নামতেই তৃপ্তি এসে জড়িয়ে ধরলো পূন্যকে। জড়িয়ে ধরেই পূন্যকে জিজ্ঞেস করলো,,
— কেমন আছিস আপু??
— ভালো না থাকলে কি এখন এখানে থাকতাম!!
তৃপ্তি পূন্যকে ছেড়ে দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর গাড়িতে উঁকি মেরে দেখলো, তিয়ান এসেছে কিনা।
পূন্য তৃপ্তির সামনে হাত নাড়লো,, তারপর বললো,,
— যাকে খুজছেন,, সে তো আসে নি।
–কেনোওওও
— অফিসে অনেক কাজ,, তাই আসতে পারে নি। এখন কি আমি এখানে দাড়িয়ে থাকবো!! ভিতরে যাবো না!
তৃপ্তি হেসে বাসায় আসলো।
শিউলি বেগম কিছুক্ষণ থ মেরে দাড়িয়ে মেয়েকে দেখলেন। তারপর জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। একটু পর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
— কি রে খাওয়া দাওয়া করিস না! একদম শুকিয়ে গেছিস তো। আর এমন কালো হয়ে গেছিস কেনো?? দুধে আলতা গায়ের রং ছিলো,, আর এখন কেমন হয়ে গেছে।
তৃপ্তি পানির গ্লাস টা হাতে নিয়ে বললো,
— কই আম্মু, আমি তো দেখছি আপু মোটু হয়ছে, আর সুন্দর ও হয়ছে।
পূন্যকে ছেড়ে দিয়ে শিউলি বেগম তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে বললেন,
— তুই চুপ থাকবি একটু। যা বুবুনের রুম টা একটু গুছিয়ে দে। পূন্য, তুই ও যা। জামাই কেনো আসে নি???
— অফিসে দরকারি কাজ ছিলো। তাই আসতে পারে নি।
তৃপ্তি এসে পূন্যর হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে যেতে লাগলো। শিউলি বেগম হাসলেন,, এই দুই বোন একসাথে থাকলেই ঝগড়া, আর দূরে গেলেই মিল। একজন আরেকজনের জন্য কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিবে।
আজ পূন্যর পছন্দের বড়া করতে হবে। পূন্য বড়া খুব পছন্দ করে,, শিউলি বেগম দৌড়ে রান্নাঘরে গেলেন। আজকে পূন্যর বাবাকে ফোন দিয়ে বলতে হবে বাসায় আসতে,, মেয়েটা এসেছে।
পূন্য এসেই শুয়ে পড়লো। তৃপ্তি ও ওর পাশে শুয়ে পড়লো। তারপর জিজ্ঞেস পূন্যকে জিজ্ঞেস করলো,,
— বুবুন তুই সুখে আছিস তো???
পূন্য চোখ বন্ধ করে বললো,
— হুম।
পূন্য চোখ খুললো,, দৃষ্টিটা সোজা মাথার উপরে ঘুরতে থাকা পাখাটার দিকে চলে গেলো। আজ এতো তাড়াতাড়ি এই প্রশ্নটার উত্তর দিয়ে দিলো, শুধু তাড়াতাড়ি না খুব সহজেই উত্তর দিয়েছে।
তৃপ্তি উঠে বসলো,, পূন্যকে একদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ দেখলো,,সত্যিই পূন্যর চেহারায় একটা সুখী সুখী ভাব এসেছে। কয়েকদিন আগেও যে মেয়েটার মুখে হাসি ছিলো না, আজ তার মুখে হাসি লেগে আছে, এখানে আসার পর থেকেই হাসছে। তাহলে কি বুবুন নিবিড় কে ভূলে গেছে। আবার নতুন করে জীবন শুরু করছে!! হুম, এটাই তো তৃপ্তি চায়, তার বুবুন সুখে থাকুক।
তৃপ্তি মৃদু হেসে বললো,
— বুবুন,, তিয়ান ভাইয়া কি জানে নিবিড় ভাইয়ার কথাটা??
–হুম।
–কিছু বলে নি???
— নাহ্,,
–তাহলে তো বলতে হয় তিয়ান ভাইয়া অনেক ভালো। আচ্ছা একটা কথা বলবো??
— হুম,,,
— তুই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলি তিয়ান ভাইয়া নিবিড় ভাইয়ার থেকে হ্যান্ডসাম কিনা?? আমি সেদিন উত্তর না দিলেও আজ বলছি,, তিয়ান ভাইয়া কিন্তু অনেক হ্যান্ডসাম। নিবিড় ভাইয়াও হ্যান্ডসাম, কিন্তু তিয়ান ভাইয়াকে আমার একটু বেশিই ভালো লাগে।
পূন্য শুয়ে থেকে তৃপ্তিকে একবার দেখলো। তার কাছে কিন্তু নিবিড়কেই ভালো লাগতো,, এখন তার পছন্দ পাল্টে যাচ্ছে, সে নিজেও জানে না এখন কাকে ভালো লাগে,, কি ভালো লাগে!
নিবিড় আজকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এলো। অফিসে থাকতে ভালো লাগে না। সারাদিন এক জায়গায় থাকতে ভালো লাগে নাকি! ভাবছে কিছু দিনের জন্য কোথাও ঘুরতে যাবে। কিন্তু এখন যদি কোথাও ঘুরতে যায় তবে সাথে মিতুকে নিতে হবে। যেটাতে নিবিড়ের একদম ইচ্ছে নেই। রুমে ঢুকার আগে চা দিয়ে যেতে বলেছিলো,, এখনো নিয়ে আসে নি।
আয়েশা আক্তার মিতুকে দিয়ে চা পাঠালেন। তিনি একটা জিনিস ভালো করে লক্ষ করলেন, মিতুর মধ্যে আজ পাগলাটে ভাব টা নেই। কেমন যেনো নিরব হয়ে আছে,, তিনি একটু খুশিই হলেন।
নিবিড় রুমে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে,, কেনো জানি ভালো লাগছে না। বাড়িতেও ভালো লাগছে না।
— আপনার চা,,
কথাটা শুনে নিবিড় চোখ খুললো,, মিতু দাড়িয়ে আছে,,চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। নিবিড় উঠে বসলো,, মিতুর হাত থেকে চায়ের কাপ টা নিলো।
ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মিতুর দিকে লক্ষ করলো। মিতুর মুখটা কেমন জানি হয়ে আছে, ফ্যাকাশে,, প্রতিদিন যেমন চঞ্চলতার ছাপ থাকে চেহারায়, আজ তার বিন্দু মাত্র ও নেই। কেমন যেন নিষ্প্রান। কিন্তু কেনো??
চায়ের কাপে একের পর এক চুমুক দিচ্ছে। হঠাৎ তার মনে পড়লো, কাল রাতের ঘটনা,, মিতু কে তো সরি বলা হয় নি।
মিতু চলে যাচ্ছিলো,,তাই নিবিড় তাড়াতাড়ি ডাকলো,,
— মিতু,,, একটু দাড়াও,, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
মিতু দাড়িয়ে গেলো। নিবিড় উঠে মিতুর কাছে এলো,, কিছুক্ষণ দাড়িয়ে শক্তি সঞ্চয় করলো, সরি বলার জন্য, তারপর বললো,
— কাল রাতে তোমাকে আঘাত করা আমার ঠিক হয় নি। I’m sorry,,
মিতু চোখ বড় বড় করে নিবিড়ের দিকে তাকালো। অনেকক্ষণ এভাবে থাকার পর বাম গালে হাত রাখলো,, তারপর বললো,,
— এতো জোরে মেরেছিলেন,, আমি ভাবলাম দুয়েকটা দাত পড়ে গেছে, কিন্তু ভাগ্য ভালো পড়ে নি, নাহলে সারাজীবন একটা দাঁত পড়া মেয়েকে নিয়ে থাকতে হতো। আর এতো শক্তি পান কোত্থেকে???
নিবিড় মিতুর কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, কাউকে সরি বললে প্রতিউত্তরে ইট’স ওকে বলে বলেই জানতো নিবিড়। ওর মুখ বন্ধ ছিলো সেটাই ভালো ছিলো। এখন সরি বলাতে ওর মুখ আবার খুলে গেছে। নিবিড় কিছু না বলে চা টা শেষ করে মিতুর হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিলো। তারপর শার্টটা চেঞ্জ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এখানে থাকা মানে মিতুর কথা আর অত্যাচারে পাগল হয়ে যাওয়া।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে,, তিয়ান এখনো অফিসেই বসে আছে। চোখটা বন্ধ করে চেয়ারটা তে হেলান দিয়ে হাতে সিগারেট নিয়ে বসে আছে। মাথাটা ব্যাথা করছে,, আজকে একটার পর একটা মিটিং করে টায়ার্ড হয়ে গেছে। এখন ফাইলগুলো দেখে তারপর বাসায় যাবে। পূন্য হয়তো চলে গেছে,,একটা কলও দেয় নি,, অবশ্য সে পূন্যর কাছ থেকে এটা আশাও করছে না। তাকেই কল দিতে হবে।
ভাবতে ভাবতেই তিয়ানের মোবাইল টা বেজে উঠলো,, চোখ বন্ধ রেখেই মোবাইলটা হাতড়ে হাতড়ে টেবিলের উপর থেকে নিলো,,
ওপাশ থেকে বললো,,
–হ্যালো,,,
— কে বলছেন??
— নাম্বার টা সেইভ করো নি নাকি??
তিয়ান চোখ খুললো,, সীমা!! বিস্ময় নিয়ে নাম্বার টা দেখলো,, নাহ্ সীমার নাম্বার কোনো কালেও তিয়ান সেইভ করে নি। কারন মেয়েটাকে তার একদম ভালো লাগতো না, সহ্যই হতো না। সব সময় একটা গায়ে পড়া ভাব ছিলো ওর মধ্যে। আর তাছাড়াও তার ড্রেস গুলো একদম ভালো লাগতো না।
তিয়ান বললো,,
— কেনো কল দিয়েছো??
— এমনিতেই,,, তোমার গলার স্বর শুনতে ইচ্ছা করছিলো। তাই কল দিয়েছিলাম।
— সীমা তুমি কি বুঝতে পারো না, যে আমি তোমাকে সহ্য করতে পারি না।
— পারি,, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আমি তো তোমাকে সহ্য করতে পারি। আচ্ছা যায় হোক বিয়ে করেছো,, তোমার বউকে তো একবার দেখালে না। আসতেও বলো না একদিন। দেখি তোমার প্রান প্রিয়াকে। কি হলো আাসতে বলবে না??
— হুম,, এসো।
— ওকে কাল আসি তাহলে।
— না,, পূন্য বাড়িতে নেই। ওর বাবার বাড়ি গেছে। ছয় সাত দিন পরে আসবে তখন এসো। এখন রাখছি।
তিয়ান ফোনটা কেটে দিলো। ওর সাথে কথা বলতে একদম ভালো লাগে নি।
চলবে,,,,,,