#গোধূলি_লগ্ন
#Writer_Tabassum_Tajnim
#Part_19
মিতুর বুঝতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেলো,,কিছুক্ষণ ঠোঁট শক্ত করে রাখলো, তারপর নিবিড়ের কাছে ধরা দিলো,, নিজের শরীরের সমস্ত ভার নিবিড়ের উপর ছেড়ে দিলো,
মিতু ঘুমিয়ে আছে,, নিবিড় একদৃষ্টিতে মিতুর দিকে তাকিয়ে আছে,চোখের উপর সে হালকা করে চুমু খেলো। এই প্রথম মিতুর চোখে লজ্জা ভয় আনন্দ এক সাথে ছিলো, তিন জিনিসের সংমিশ্রণে সে কি এক চাহনি ছিলো!! নাকি কাছে আসার আহব্বান। সে জীবনে সবচেয়ে বড় একটা ভূল করে ফেললো,, কি করে করলো সে এটা, তখন একবার ও পূন্যর কথা মনে হয় নি। নাহ্,, নিজের উপর লজ্জা হচ্ছে, পরক্ষনেই আবার ভাবলো পূন্য যদি তিয়ানের কাছে যেতে পারে, তাহলে সে কেনো পারবে না। কীসের লজ্জা! মিতু তো তার স্ত্রী। সব গুলিয়ে যাচ্ছে নিবিড়ের, বুঝতে পারছে কি করবে? ঘোরের মাথায় কি করেছে এখন সে বুঝতে পারছে।
সমুদ্রের বালিতে খালি পায়ে হাটার মজাই আলাদা,, আজ পর্যন্ত এমন কেউ নেই যে সমুদ্রের বালিতে খালি পায়ে হাটে নি, কেউ যদি এমন থাকে তাহলে তার জীবনটাই বৃথা।
পূন্যও খালি পায়ে হাঁটছে,, ছোট ছোট ঢেউ এসে পা ছুয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ হাঁটার পরও ক্লান্ত লাগছে না। কিন্তু তারপর ও একটা পাথরের উপর এসে বসলো,, সমুদ্রের দিকে তাকালো,,আজ সমুদ্রটা কেমন যেনো উত্তাল,, কিন্তু আজকে এতো সুন্দর লাগছে,, সমুদ্রটাকে,
“আমাকে তোমার মধ্যে ঠাঁই দাও, আমি তোমাতে বিলিন হতে চাই, এই জগতের গোলকধাঁধায় আমি বেঁচে মরতে চাই না, আমি তোমার মধ্যে মরে বাঁচতে চাই।”
অস্পষ্ট ভাবে ঠোঁট হালকা নাড়িয়ে কথাটা বললো পূন্য, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো,, বারবার কেনো তার অতীত এসে তার সামনে দাড়ায়! আচ্ছা সমুদ্রেরও কি অতীত আছে! তাকেও কি অতীত আর বর্তমানের সামনে দাড়াতে হয়! তখন হয়তো সে কান্না করে,, সমুদ্র কি কান্না করে!!
একটু জোরেই স্পষ্ট করে বললো,,
” আমাকে মুক্তির পথ দেখিয়ে দাও,, আমি আর অতীত বর্তমানের মুখোমুখি হতে পারছি না, ক্লান্ত হয়ে গেছি আমি। অতীতের সাথে যুদ্ধ করতে করতে, তারপরও কেনো অতীতে ফিরে যেতে মন চায়!! মুক্তি দাও,, তোমার বিশালতা দিয়ে আমাকে মুক্ত করো।”
দু ফোটা জল আবার গাল বেয়ে পড়তে লাগলো, একটা বিশাল ঢেউ পাথরে আঘাত করে ছিটকে পড়লো পূন্যর গায়ে। চোখের জলটাও ধুয়ে মুছে নিয়ে নিলো। পূন্য তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললো,,
–” তোমার পানিতে কি লবনের কম পড়েছে? যে আমার চোখের নোনা জল ধুয়ে মুছে নিয়ে গেলে! কেনো গো?? তোমরা সবাই এমন কেনো? শুধু সবার থেকে নিতে চাও, কিছু দিতে চাও না।আমার কাছ থেকে নিতে নিতে তো সবই নিয়ে নিলে আর কি নেওয়ার বাকি আছে!!!”
আরও একটা বড় ঢেউ পাথরে আঘাত করে ছিটকে পড়লো পূন্যর শরীরে,, এবার মোটামুটি অনেকটাই ভিজে গেছে। সূর্যটার দিকে তাকালো,, কমলা রংয়ের সূর্যটা আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রে।
“বড্ড লোভী,, তুমি বড্ড লোভী,, আমার চোখে নোনা জল তো নিলেই,, এখন এতো সুন্দর সূর্যটাকেও নিজের মধ্যে নিয়ে নিচ্ছো! আলোও শুষে নিচ্ছো। ”
মনে মনে বললো পূন্য।
রূপন্ত অনেকক্ষণ ধরে দূরে দাড়িয়ে থেকে লক্ষ করলো, পূন্য ঐ পাথরটার উপর সেই কখন থেকে বসে আসে। রূপন্ত কখনোই চায় নি যে পূন্য কষ্ট হোক,, কিন্তু কি আর করা? রূপন্ত পূন্যর পাশে গিয় বসলো, পূন্য রূপন্তকে দেখে হাসলো,,
রূপন্ত বললো,,
— তিয়ান ভাইয়া হয়তো খুজছে তোমাকে!! যাও।
পূন্য উঠে দাড়ালো, জুতো গুলো পায়ে দিয়ে পাথরের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে হেটে হোটেলের দিকে যেতে লাগলো।
রূপন্ত চোখের চমশাটা একটু নাড়িয়ে চোখের দিলো। উঠে দাড়ালো,, প্যান্ট টা ফোল্ড করে সমুদ্রের বালিতে হাঁটতে লাগলো। মনের সুখে হাসতে লাগলো,, পিছন থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে থমকে গেলো, হুম তাকেই ডাকছে,,,
পূন্য হোটেলে ঢুকে তাড়াতাড়ি হাটতে লাগলো, হয়তো তিয়ান উঠে গেছে।
নিবিড় রূপন্ত রুমের দরজাটা হালকা সরিয়ে বাইরে আসছিলো, কিন্তু পূন্যকে দেখে থমকে গেলো,, ভিজে গায়ে পাতলা শাড়ির আঁচল টা দিয়ে বারবার শরীর ঢাকার এক বৃথা চেষ্টা করেই চলছে পূন্য।
নিবিড়কে দেখে পূন্য পা কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলেও আবার চলতে শুরু করলো,, রুমে এসে দরজাটা লক করে দিলো। কি ব্যাপার নিবিড় আমার চোখের দিকে তাকালো না,, চোখে চোখ পড়তেই কেমন করে সরিয়ে নিলো। তিয়ান কে রুমে দেখতে না পেয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো,,, কার সাথে যেনো কথা বলছে,,
— দেখো,সীমা Don’t disturb me,,,
তিয়ান কথাটা শেষ করতেই পিছন থেকে পূন্যর গলার আওয়াজ পেলো,, লাইনটা কেটে পিছনে ঘুরে দেখলো,, পূন্য দাড়িয়ে আছে।
— সীমা কে??
পূন্যর প্রশ্নে তিয়ান হাসলো,, পূন্যকে টেনে কাছে আনলো,, কথা ঘুরিয়ে বললো,,
— ভিজে গেছো তো দেখছি,,সমুদ্রে নেমেছিলে নাকি!!
— না,,
— ঠিক আছে যাও,এখন চেঞ্জ করে নাও।
পূন্য চলে গেলো,,তিয়ান কিছুক্ষণ বারান্দায় দাড়িয়ে রইলো,, পূন্যকে না বলাটা ভূলেই হয়েছে।
ঘুম থেকে উঠে মিতু রুমে নিবিড় কে দেখলো না। বিছানার এক পাশে পড়ে আছে শাড়িটা, মিতু শাড়িটা নিয়ে পড়লো,, নিবিড়ের স্পর্শ সারা শরীরে লেগে আছে,, ভাবতেই শিহরিত হলো মিতু। মনে হচ্ছে আজই সবচেয়ে খুশির দিন মিতুর জীবনের।
রূপন্তর পাশে একজন হাঁটছে,কিন্তু এখনো মেয়েটাকে ভালো করে দেখেনি রূপন্ত,এমনিতেও মেয়েদের থেকে সে একটু বেশি দূরত্বেই থাকে। ভয় করে,, সবাই যদি তৃপ্তির মতো হয়। এবার রূপন্ত তাকালো, চোখের চশমাটা চোখে রেখেই হালকা উপর নিচ করলো,মেয়েটা দেখলো,মেয়েটা রূপন্তর দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পরে গেলো, মেয়েটা হাসলো, ভারী অদ্ভুত হাসলে মেয়েটার গালে টোল পড়ে! চোখ গুলো কেমন ড্যাব ড্যাবে,, মাথার চুলগুলো উড়ছে,, বারবার মুখে এসে পড়ছে,, কারো চুল এতো সুন্দর হয়! এতো সিল্কি,স্ট্রেইট হয় নাকি! এই মেয়েটাকে না দেখলে বুঝতেই পারতো না।
রূপন্ত আবার সামনের দিকে তাকালো,,কি ভাবছে,,পূন্য আপুর মাথার চুল ও অনেক সুন্দর। পূন্য আপুর সৌন্দর্যের তুলনায় এই মেয়ের সৌন্দর্য্য কিছুই না। তারপরেও কেনো এতো ভালো লাগছে!!
অনেকটা পথ এসে পরেছে। এবার রূপন্ত বললো,,
— চলুন এবার যাওয়া যাক। অনেকটা দূর চলে এলাম তো।
মেয়েটা মাথা হ্যাসূচক মাথা নাড়লো। হোটেলের কাছে এসে মেয়েটা বললো,,
— আসি তাহলে,, আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো,,
কিছুদূর গিয়ে মেয়েটা আবার ঘুরে দাড়ালো। রূপন্তর কাছে এসে বললো,,
— আপনার নামটাই তো জানা হলো না,,
— রূপন্ত। আপনার নাম কি??
মেয়েটা হেসে বললো,,
— আমার নাম না হয় নাই বা বললাম। নাম চেনার দরকার কি? মুখ চেনা থাকলেই হলো। কি বলেন??
— হুম,, তবে মুখের সাথে সাথে নাম চেনাটাও জরুরী।
— আপাতত অপরিচিতা বলেই ডাকেন। আস্তে আস্তে পরিচিত হবো। সাথে নামটাও জেনে নিবেন।
মেয়েটা চলে গেলো,, মিস অপরিচিতা!!! রূপন্ত ভ্রু নাচিয়ে হাসলো। কিছুদূর হেটে যেতেই রূপন্ত কে কেউ আবার পিছন থেকে ডাকলো,,
–মি. কানা এইদিকে আসেন।
নিবিড় ভাইয়ার গলা,, রূপন্ত ঘুরে দাড়ালো। তারপর হেসে মোবাইলটা বের করে নিবিড়ের একটা ছবি তুললো। নিবিড়ের হাতে সিগারেট থাকার কারনেই ছবি টা তুলেছে রূপন্ত। নিবিড় সাথে গিয়ে বসতে বসতে বললো,,
— আজকে কয়টা সিগারেট??
— একটা। আচ্ছা রূপন্ত তুই সবাইকে এখানে নিয়ে এলি কেনো?
–বেড়াতে এসেছি, তাই সবাইকে নিয়ে এলাম,, একা বেড়াতে আসলে ভালো লাগে নাকি!!
— অন্য কোনো কারণে,,, নিয়ে এসেছিস। আমার কাছে লুকাতে পারবি না। বল কি সেই কারণ??
— সত্যিই বলবো??
–হুম।
— যদি বলি তোর সাথে মিতুর সম্পর্ক টা আর পাঁচ টা স্বাভাবিক সম্পর্কের মতো করতে।
— বৃথা চেষ্টা,, কোনো দিন ও স্বাভাবিক হবে না।
— কেনো?? পূন্য আপু যদি সুখী হতে পারে,, তাহলে তুই কেনো পারবি না??
— পূন্য সুখী!! কে বলেছে?? তুই পূন্যর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিস কখনো??
রূপন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো,,তারপর বললো,,
— হুম হয়তো বা সুখী নয়,, কিন্তু হওয়ার চেষ্টা করছে বাঁচতে চেষ্টা করছে অন্যকারো সাথে,, তাহলে তুই কেনো সুখী হওয়ার চেষ্টা করতে পারবি না??কেনো তুই অন্যকারো সাথে বাঁচতে পারবি না??
নিবিড় হাসলো,, সিগারেট টা দুই ঠোঁটের মাঝে নিলো,ধোঁয়া টা আকাশের দিকে ছাড়লো,, তারপর হাসি তে ফেটে পরলো, হাসি থামিয়ে বললো,,
— তুই এখনো ভালোবাসার মানে বুঝতে পারিস নি। অন্য কারো সাথে বাঁচা তো দূরের কথা অন্য কারো সাথে বাঁচার কথা আমি ভাবতেও পারবো না।
–কেনো পারবি না?
নিবিড় উঠে দাড়ালো,, হাতের সিগারেট টা পাথরের উপর ফেলে হাটতে লাগলো,, আকাশে চাঁদ উঠেছে,, সমুদ্রের বালিগুলো অনেক সুন্দর লাগছে,, রুপালি রং ধারন করেছে। ছোট ছোট ঢেউ এসে নিবিড়ের পা স্পর্শ করলে একটু পর পর। অন্যকারো সাথে বাঁচা সেতো অসম্ভব,, কারন আমি যে পূন্য নামক নেশায় আসক্ত হয়ে আছি। সে নেশা থেকে একটা রোগ ও হয়ে গেছে,, রোগের নাম প্রেমাসক্তি। এতো সহজে যে এ রোগ থেকে আমি মুক্তি পাবো না, তাহলে অন্য কারো সাথে বাঁচবো কি করে?? কিন্তু আমি যে একটা বড় ভূল করে ফেলেছি,, সেই ভূলের মাশুল দিবো কিভাবে??? হোটেলে ফিরতে একদম ইচ্ছা করছে না নিবিড়ের। তারপরেও ফিরতে হলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিবিড় রুমে ঢুকতেই পিছন থেকে মিতু বললো,,
— আপনি কোথায় গিয়েছিলেন??
নিবিড় ঘুরে মিতুকে দেখলো, হাত থেকে ঘড়িটা খুলে আয়নার সামনে রাখলো,, তারপর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো,,
মিতু আবার বললো,,
— সমুদ্রে গিয়েছিলেন!! আমাকে নিয়ে যান নি কেনো??কাল কিন্তু সকালে সূর্য উঠা দেখবো? কি নিয়ে যাবেন তো??
মিতু নিবিড়কে ধাক্কাতে লাগলো,, নিবিড় উঠে বসলো,, ইচ্ছা করছে মিতুকে চড় মারতে,,চোখ লাল করে মিতুর দিকে তাকালো,, মিতুর সাহস হয় কি করে?? পরক্ষনেই আবার মনে পড়লো,, কয়েক ঘন্টা আগে নিবিড়েই সেই সাহস আর অধিকার দিয়েছিলো। ঠান্ডা গলায় বললো,,
–হুম,, নিয়ে যাবো।
তারপর শুয়ে পড়লো। সম্পর্কটা দিন দিন জটিল হয়ে যাচ্ছে, এখন না মিতু কে ছাড়তে পারবে, আর না কোনোদিন পূন্যকে ভূলতে পারবে। মিতুর দ্বায়িত্ব টা এখন তো তার উপরে। দ্বায়িত্ব এড়াতে পারবে না। একটা ভুল,এই ভূলটা কি করে করলো?
মিতু তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলো নিবিড় যেভাবে তাকিয়েছিলো, কিন্তু রাজি হয়ে গেলো, তাহলে এভাবে তাকানোর কি দরকার ছিলো?
মিতু শুয়ে পড়লো,, একটু পর নিবিড় কে জড়িয়ে ধরলো। নিবিড় মিতুর হাতটা সরিয়ে দিতে গিয়েও পারলো না
–পূন্য
আয়নার সামনে দাড়িয়ে থাকা পূন্যর হাত থেকে চিরুনী টা নিয়ে পূন্যর চুলগুলো চিরুনী করতে লাগলো তিয়ান। পূন্য তিয়ানের দিকে ঘুরলো,তিয়ানের চোখ পূন্যর মধ্যে অন্যকিছু খুজছে।
তিয়ান হাত পূন্যর কপাল স্পর্শ করে আস্তে আস্তে গাল বেয়ে ঠোঁট স্পর্শ করে গলা তে নামতেই পূন্য তিয়ানের হাত ধরে ফেললো। নরম গলায় বললো,
— ঘুমিয়ে পড়ো।
তিয়ান হাতটা ছাড়িয়ে পূন্যর হাত ধরে হেঁচকা টানে নিজের বাহু বন্দী করে নিলো। বিছানায় পড়ে গেলো,, তিয়ান বললো,,
— আমার একটা ইচ্ছা পূরণ করবে??
গালে কয়েকটা চুমু,, পূন্য হাত দিয়ে তিয়ানের মুখ চেপে বললো,,
— কি ইচ্ছে??
— লাল পেড়ে শাড়ি পেঁচিয়ে পড়বে, খোলা চুল দুটো গোলাপ ফুল চুলে আটকানো, কপালে ছোট একটা টিপ, বড় বড় চোখগুলোতে মোটা করে কাজল, পায়ে আলতা, হাত ভর্তি লাল কাঁচের চুড়িতে আমি তোমাকে দেখতে চাই। বলো দেখা দিবে??
চলবে,,