প্রেমমানিশা – পর্ব ১৩

0
347

#প্রেমমানিশা(১৩)

সানার লেখা চিঠি পড়ে ফারহানের দৃষ্টি চিঠির উপরেই স্থির হয়ে গেছে। চিঠির লেখাগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। জানান দিচ্ছে চোখের কোণে জমে থাকা নোনাজলের অস্তিত্ব। চিঠির প্রত্যেকটা শব্দ তার হৃদয়ে ঝড় তুলছে। চিঠি পড়ে সানাহ্কে হারানোর ভয় যেন আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ফারহান তো চায়নি সানাহ্কে তার প্রাক্তন প্রেমিকা করতে। চেয়েছিল চিরদিনের জন্য প্রেমিকা করতে……

এতদিন তো রাজি ছিল না কিন্তু এখন তো রাজি । তাহলে বাঁধা কোথায় ? সানার পিতৃ পরিচয় আর তার অসুস্থতাই কি তার সবচেয়ে বড় বাঁধা ? তাহলে উচ্ছন্নে যাক এই বাঁধা। এসব বিধি নিষেধের ধার ধারে না ফারহান। সে চলে আপন মর্জিতে। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে তার এই আধ পাগল প্রেমিকাকে সে খুঁজে বের করবেই এট এনি কস্ট। হারাতে দিবে না সে সানাহ্কে।
কিন্তু কোথায় খুঁজবে ? সানাহ্ কি চিঠিতে কোনো হদিস দিয়েছে সে কোথায় ? প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য ফারহান চিঠির লেখায় আরেকবার চোখ বুলালো কিন্তু হতাশ হলো। নাহ সানাহ্ কিছুই উল্লেখ করেনি।

ফারহানের মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরছে কোথায় সানাহ্।
হঠাৎ কি মনে পড়তে ফারহান চিঠিটা আরেক নজর দেখল। চিঠিটা দেখেই ‘ ওহ শিট ‘ বলে লাফিয়ে উঠলো। সকলে ফারহানকে এভাবে রিয়েক্ট করতে দেখে চমকে ওর দিকে ফিরল। ফারহান কিছুক্ষণ কপালে হাত রেখে কিছু একটা ভেবে তারপর মিসেস কায়নাতের উদ্দেশ্যে বললো ‘ আন্টি আপনার ভাইদের বাড়ি কোন বিভাগে যেন ? ‘

‘ বরিশাল ‘ কথাটা বলে যেন কায়নাতও চমকে উঠলো। অবাক দৃষ্টিতে ফারহানের দিকে তাকালো। ফারহান এবার সবার উদ্দেশ্যে বললো ‘ সবাই রেডি হয়ে নিন…… আমরা আজ রাতেই বরিশাল যাচ্ছি। সানাহ্ ইজ এট হার আঙ্কেলস হাউজ। কারোর সানার মামাদের ফোন করে বলার দরকার নেই যে আমরা বরিশাল যাচ্ছি। সানাহ্ সন্দেহ করলে আবার পালাবে…. ‘

—-

‘ মামা আসবো ? ‘ বলেই সানাহ্ দুবার নক করলো শায়খের দরজার গায়ে।

তবে নক করার পরও যখন কোনো সাড়া শব্দ পেলনা তখন এক প্রকার বাধ্য হয়েই দরজা খুলে ভিতরে উকি দিল। দেখল শায়খ তার চিরাচরিত রুপেই কানে ইয়ারফোন দিয়ে ল্যাপটপে কারোর সঙ্গে কথা বলছে। সানাহ্ গুটি গুটি পায়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে শায়খের পিছনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে বোঝার চেষ্টা করলো শায়খ কার সঙ্গে কথা বলছে। শায়খ তার কোনো দূর সম্পর্কের আত্মীয় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছে বুঝতে পেরে বিরক্তিতে সানার কপালে ভাঁজ পড়ল। সে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো।

ল্যাপটপে ইহসানের সঙ্গে কথা বললেও ঘরে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে পিছনে ফিরল শায়খ। ভাগ্নিকে দেখে ইহসানকে বললো ‘ ব্রো আই উইল টক উইথ ইউ লেটার ‘ । কথাটা বলেই কল কেটে দিয়ে ঘুরে বসে বললো ‘ কথা বলতে এসেও কথা না বলে ফিরে যাচ্ছিস কেন ? ‘

শায়খ তাকে লক্ষ্য করেছে বুঝতে পেরে নিজের বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে শায়খের মুখোমুখি সানাহ্ তার বিছানায় পা উঠিয়ে বসে বললো ‘ তো কি করবো ? তোমার ঐ দূর সম্পর্কের ভাইয়ের সঙ্গে মেকি হাসি হেসে মধুর আলাপ করবো ? ‘

‘ আহা মধুর আলাপ করতে কখন বললাম ? তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন ? আত্মীয় স্বজনদের দুই চোখের বিষ ভাবা স্বভাব তোর বদলায়নি না ? ‘ শায়খ বললো।

‘ স্বভাব তো আর টিসু পেপার নয় যে ইউজ করে ফেলে দিবো। ওটা আমার স্বভাব, অভ্যাস নয় যে বদলে ফেলবো। ‘ নিরস মুখে একগুঁয়ে ভাবে উত্তর দিল সানাহ্।

‘ ভ্রূ সোজা কর তোর আর তোর চেহারার ভঙ্গি ঠিক কর। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আমার সামনে থাকবি না। আমার গা জ্বলে….আমি বুঝি না আমাদের আত্মীয় স্বজনের উপর তোর কিসের রাগ ? ‘ শায়খ রাগী গলায় বললো।

‘ তাদের উপর আমার মোটেই রাগ নেই। ফ্যাক্ট হলো এরকম গা জ্বালানো আলগা ভাব দেখানো লোক আমার পছন্দ না। এরা শুধু উপর দিয়েই ফিটফাট,ভিতর দিয়ে সদরঘাট। তোমার সঙ্গে আজ খাতির করছে। কাল তুমি বিপদে পড়লে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও একবার ভাববে না। এরা নামকা ওয়াস্তে আত্মীয়। আসল কথা তাদের সঙ্গে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্কই নেই। এই লোকটা তোমার বড় মামার ছোটো ছেলে ইহসান না ? এই খবিস ব্যাটা না তোমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেনি ? তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলো কেন ? ‘

‘ মাম্মি মারা যাওয়ার আগে বলেছিল তার ভাই বোনদের সঙ্গে আর তাদের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে যেন অন্তত সংযোগ রাখি,তাদের ভুলে যেন না যাই। সেই জন্যই…তাছাড়া সম্পর্ক থাকলে এমন হবেই। ‘ শায়খ বললো।

‘ আমার মনে হচ্ছে লোকটার কোনো ধান্ধা আছে। তুমি ওর থেকে দূরে থাকো। বলা যায়না এত মধুর আলাপের পিছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। ‘

‘ আচ্ছা বাবা আমি ওদের থেকে দূরেই থাকবো। এখন তুই এত রাতে আমার ঘরে কেন এসেছিস সেটা বল ? তুই তো সহজে আসার মেয়ে নস। অনেক দিন পর আমার ঘরে তোর পায়ের ধুলো পড়লো। ‘ শায়খ হাসিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে বললো।

‘ ঘরে শুয়েছিলাম কিন্তু ঘুম আসছিলো না তাই ভাবলাম তোমার ঘরে এসে তোমাকে বলে দুজনে মিলে ড্রয়িং রুমে একটা জোস মুভি দেখি। এই জন্যই এসেছিলাম.…কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি তোমার সো কল্ড ভাইয়ের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। ‘ সানাহ্ একগুঁয়ে ভাবে উত্তর দিলো।

‘ আরে না এখন আর কি কথা বলবো। এমনিতেও তুই না আসলেও আমি দশ মিনিটের মধ্যে ল্যাপটপ রেখে দিতাম। এখন যখন এসেই পড়েছিস চল একটা মুভি দেখি। বলা যায়না তুই আবার কখন হুট করে বেরিয়ে যাস….সুযোগের সৎ ব্যবহার করা ভালো। কী মুভি দেখবি ? Bhool bhulaiya চলবে না ? রাতের বেলা দেখতে ভালো লাগবে..… ‘ শায়খ বলতে বলতে উঠে দাড়ালো।

‘ হুম..… ‘ কথাটা বলেই অন্যমনস্ক হয়ে গেলো সানাহ্। মনে মনে কিছু একটা ভেবে বললো ‘ তুমি তাহলে bhool bhulaiya ছাড়ো……আমি আসছি ‘ ।

শায়খ সানার কথায় কোনো উচ্চবাচ্য না করেই সরাসরি নিচে চলে গেলো। এইদিকে শায়খ ঘর ছেড়ে বের হতেই সানাহ্ ওর ট্রাউজারের পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা খাম বের করে সেটা শায়খের ল্যাপটপের নিচে রেখে দিল। তারপর ঘরের দরজা চাপিয়ে সেও নিচের দিকে হাঁটা দিলো।

—-

পূর্বে সূর্য উঠেছে কিছুক্ষণ আগেই। ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ইদানিং মিস্টার আশরাফের বাড়ির বাগানে নতুন এক পাখির উদ্ভব হয়েছে। পাখির গায়ের রঙ উড়তে সময় নীল দেখালেও কোথাও বসলে সেটা বাদামি রঙ হয়ে যায়। মিস্টার আশরাফ এই ধরনের পাখি আগে দেখেননি।

প্রথম দিন যেদিন এই পাখির আনাগোনা দেখেছিলেন তখন অজান্তেই অবাক হয়েছিলেন। উনার যাবতজীবনে এরকম পাখি আগে দেখেননি কিংবা দেখলেও খেয়াল নেই। পরে নেটে সার্চ দিয়ে জানলেন ওটা বাজরিগার পাখিরই একটা জাত,শুধু গায়ের রংটাই ভিন্ন এই যা। তবে অন্য বাজরিগার পাখির থেকে উনার কাছে এই নীল বাদামি রঙা বাজরিগার পাখিই বেশি ভালো লেগেছে।

একবার মনে হয়েছিল দু তিনটে পাখি ধরে নিয়ে সুন্দর গোল্ডেন কেজে রেখে ভাগ্নি অতসীকে দিবেন, তার পাখি অনেক পছন্দ। পরে কি মনে হতেই সেই চিন্তা বাদ দিলেন। শুধু শুধু ওই বাড়িতে পাখি দিয়ে নিজের বিপদ বাড়িয়ে কি লাভ ? সানাহ্ যদি জানতে পারে যে এই পাখি উনি দিয়েছেন তাহলে উনাকে উদ্ধার করে ফেলবেন। অজানা এক কারণে মেয়েটার কোনো প্রাণীর সঙ্গেই সখ্যতা নেই। এমনকি নিজের কাছের মানুষদের সঙ্গেও না। এত বছরের জীবনে এখনও একটা ফ্রেন্ড জুটেনি।

তাছাড়া বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। তাই উনি চাইলেই পাখিকে তার মুক্তি দশা থেকে বন্দী জীবনে আবদ্ধ করতে পারেন না। সেটা হবে পাখি জাতির প্রতি অন্যায়। উনার ছোট ভাগ্নি অতসী হলো একদমই তার মত, পশু-পাখি প্রেমিক। পক্ষান্তরে সানাহ্ প্রকৃতি প্রেমিক, যে শুধু জানে নীরবে নিভৃতে প্রকৃতি উপভোগ করতে। সানাহ্ একদমই তার মায়ের মত। আমরিনেরও প্রকৃতি পছন্দ ছিলো। মা মেয়ে দুটোই প্রকৃতি বিলাসিনী।

নীল বাদামি রঙ্গা বাজরিগার পাখি দেখতে রোজ বাগানে আসাটাই মিস্টার আশরাফের এখন নিত্য দিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাখিগুলোও অদ্ভুত ভাবে এখন আর ওনাকে দেখে দৌড়ে গাছের আড়ালে গিয়ে লুকোয় না। স্বানন্দে গুটুর গুটুর করে একে অপরের মাঝে প্রেম নিবেদন করে, একে অপরকে খাইয়ে দেয়। এদের দেখে মিস্টার আশরাফের মাঝে মাঝে আফসোস হয় কেন এত জীবন একটা মেয়ের জন্য আবেগ পুষে রেখে বিয়ে করলেন না। বিয়ে করলে হয়তো আজ তার পাশেও তার প্রিয়তমা থাকতো, যে রোজ সকালে তার সঙ্গে দাড়িয়ে এমন বাজরিগার পাখি দেখতো।

মিস্টার আশরাফ পাখিই দেখছিলেন পরে কি মনে হতে উপরের দিকে তাকালেন। উপরে এক নজর তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন। ছাদে উনার মেঝ ভাই আর তার স্ত্রী দাড়িয়ে আছে যে এক সময় তার অঘোষিত প্রেমিকা ছিল। মিস্টার আশরাফ কখনও ভাবেননি এভাবে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের ভাইয়ের সঙ্গে দিনের পর দিন দেখতে হবে। তবে সেসব এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। এখন আর কষ্ট লাগে না। আর কতই বা কষ্ট সহ্য করবে এই মন ? পঁচিশটা বছর তো হলো….

—-

এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো শায়খের। ঘুমঘুম চোখে একবার এলার্মের দিকে তাকালো। ঘড়িতে এখন ছয়টা বেজে পঁয়তাল্লিশ। তার অফিস সাড়ে আটটায়, এখনই উঠে ফ্রেশ হতে হবে। শায়খ আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। কাল রাতে মুভি দেখে এসে শুতে শুতে রাত তিনটে বেজে ছিলো। মুভি দেখার পরেও দুই মামা ভাগ্নিতে মিলে গল্প করেছিল বলেই এত দেরি। সানাহ্কে এতদিন পর দেখে শায়খ সামলাতে পারেনি। এতদিন ধরে জমানো সব গল্প উগড়ে দিয়েছে । কথার শোনার ক্ষেত্রে সানাহ্ মনযোগী শ্রোতা, কথার মাঝে কথা বলে বক্তাকে বিরক্ত করে না।

শায়খ বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরদোর যথা সম্ভব গুছিয়ে বাথরুমে ছুটলো গোসলের জন্য। গোসল সেরে রেডি হয়ে অফিসের ব্যাগ গুছানোর পাঁয়তারা করলো। ফাইলগুলো ব্যাগে নিয়ে ল্যাপটপটা যখন ঢোকাতে যাবে তখনই চোখে পড়লো ল্যাপটপের নিচের সাদা খামটা। ল্যাপটপ ব্যাগে রেখে অবাক হয়ে সাদা খামটা হাতে নিল। খাম হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে আলতো হাতে খাম খুলে সাদা কাগজ বের করলো। সাদা কাগজ খুলতেই তাতে ফুটে উঠলো আনাড়ি হাতে লেখা বাংলা চিঠি।

চিঠির লেখা দেখে শায়খের বুঝতে কষ্ট হলো না ওটা সানার লেখা। এমন বাজে আর বিচ্ছিরি বাংলা লেখা একমাত্র সানার পক্ষেই লেখা সম্ভব। কিন্তু সানাহ্ চিঠি লিখেছে ? কী এমন দরকার পড়লো যে মুখে না বলে চিঠি লিখলো ? কৌতূহল দমাতে চিঠি পড়তে শুরু করলো….

প্রিয় মামা,

আমার মামণির জীবনে সব থেকে বড় পাওয়া যে তুমি সেটা কি তোমার জানা আছে ? জানা থাকার কথা কারণ মামনি সবকিছুতে সবসময় তোমার নাম আগে নিত। ঈদের জামা কেনা থেকে শুরু করে উইন্টার কালেকশন, সামার কালেকশনে জামা থেকে শুরু করে বুরুশ অব্দি সবকিছুই তুমিময় ছিল। তারপর আমার নাম আসতো। এই নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার কত বাকবিতণ্ডা চলতো তাইনা ?

তোমাকে আমি কোনদিনও সহ্য করতে পারতাম না কারণ আমার সবকিছুতে তুমি অজান্তেই ভাগ বসাতে। আমার পছন্দের খাবার পর্যন্ত মামনি তোমাকে আগে দিত তারপর আমাকে। এ নিয়ে মামণির সঙ্গেও কম ঝগড়া হয়নি আমার। তবে এতকিছুর পরও তুমি আমায় খুব ভালোবাসতে। আমায় আগলে রাখতে। কেন তোমার পিঠাপিঠি বলে ? নাহ প্রথম ভাগ্নি বলে….মানুষের প্রথম সবকিছুর প্রতি একটা আলাদা ধরনের মায়া থাকে।

আমার মামণির কাছে তার প্রথম সন্তান তুমি আর দ্বিতীয় সন্তান আমি। আচ্ছা ভাই বোনদের মধ্যে এজ ডিফারেন্ট যত বেশি থাকে ভালোবাসাও কি ততই বেশি থাকে ? আমার জানা নেই কারণ অতসী আমার থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট। আমাদের মধ্যে ভালোবাসার প্রকাশটা বরাবরই কম কারণ না সে আমাকে কখনও মন খুলে কিছু বলেছে আর না আমি কখনও তার সঙ্গে কিছু শেয়ার করেছি। কারণটা হয়তো আমিই ইনিশিয়েটিভ নেইনি বলেই।

মামণির পর আমার সব থেকে কাছের মানুষ বলতে তুমিই আছো। নাহ মাও আমার খুব কাছের কিন্তু সে মা হিসেবে আমার বন্ধু কম গার্ডিয়ান বেশি। তুমি আমার কাছের মানুষ বলেই বলছি। কথাটা তেতো হলেও আমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছি সবসময়ের জন্য, আর কখনও ফিরবো না সেখানে। কারণ কি ভাবছো ?

কারণ কিছুই না তবে অনেক কিছু। তুমি কি জানো এত বছরে মা বাবা অজান্তেই বারবার আমাকে বুঝিয়েছে এই স্বার্থপর পৃথিবীতে আমার কেউ নেই ? ওদের এক্সট্রা কেয়ার আমায় বিরক্ত করে। কথায় কথায় মায়ের প্রশ্নভাব আমাকে ফুঁসে তুলে। বাবার আমাকে নিয়ে সারাদিন ভয়ে থাকাটা আমায় বিষণ্ণ করে তুলে। আর…. এখন ফারহানের রিজেকশনও আমায় ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। তার এক্সেপশনও আমায় নিজেকে নিজের কাছে দয়ার পাত্রী করে তুলে। তুমি জানো আমি ভীষন রকমের ইমোশনাল ইন্ট্রোভার্ট জেদী… যেই জেদ প্রকাশ পায়না কিন্তু সহজে নেমেও যায়না।

আমার জেদ, আমার ইগো আমায় বলে দিয়েছে এই চেনা পৃথিবীতে আমার জায়গা নেই। আমার জায়গা অচেনা পৃথিবীতে যেখানে থাকবে না পরিচিত কেউ। সেই পৃথিবীতে আমার দুনিয়ার রানী আমি। আমার মর্জির মালিক আমি। সেখানে আমার কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না, কাউকে আমাকে নিয়ে ভয়ে থাকতে হবে না। কারোর রিজেকশন আমায় গুড়িয়ে দেবে না।

তাছাড়া আমার অতীত আর অসুস্থতার কথা জেনে কেউই আমাকে বিয়ে করবে না তাই সারাজীবন মা বাবার উপর বোঝা হয়ে থাকতে হবে। কারোর উপর বোঝা হয়ে থাকতে চাইনা আমি। অনার্স অব্দি আমি এই বাংলাদেশেই আছি তবে অনার্সের পর কোথায় যাবো সেটা আমার জানা নেই… ইচ্ছা আছে ক্যালিফোর্নিয়া যাবো। IELTS করেছিলাম, সেখানে ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার মত স্কোর পয়েন্ট ছিল। তাছাড়া ভিসার জন্য এপ্লাই করেছি। অনার্স শেষ হতে তো আর কিছু দিন বাকি। শেষ করে খানিকটা রেস্ট নিয়েই রেজাল্ট নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার মাটিতে পা রাখার ইচ্ছা আমার আছে।

আমার প্রিয় মামা হিসেবে তোমার কাছে আমার শেষ অনুরোধ। আমি চাই অন্তত আর কেউ নাহোক তুমি যেন আমার অবস্থান জেনে শান্তি পাও। আমি সিলেট উঠবো… জাপান ভাইয়ের হেল্প নিয়ে ওখানে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছি। জাপান ভাই বলেছে আমার যা কোয়ালিফিকেশন তাতে একটা ভালো নাচের স্কুলে চাকরিও হয়ে যেতে পারে। তুমি তো জানো আমি ছোটো থেকেই নাচে তালিম নিয়েছি তাই ওটাই আমার জন্য আপাতত সহজ হবে। আমি চাই তুমি আমার অবস্থান জানো। এসবের মাঝে তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনা কারণ তুমি আমার মামণির প্রথম সন্তান…

দয়া করে এই কথাগুলো যে আমি তোমাকে বলেছি সেটা কাউকে বলো না। এই চিঠিও কারোর হাতে পড়তে দিও না… পড়া হলেই পুড়িয়ে দাও। চিন্তা করোনা আমি যেখানেই থাকি না কেন সুখে থাকবো। অন্তত এত মানসিক অশান্তি থেকে দূরে থাকবো। মামা তুমি আমার বাল্য সখা… আমার মামণির ছোট্ট আদুরে ভাই তুমি। আমাকে তোমার বন্ধু মনে করে আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখো।

ইতি,
সানাহ্

চিঠি পড়ে স্তম্ভিত শায়খ। সে ভাবতে পারেনি তার ভাগ্নিটা এভাবে তাদের অজান্তে এত বছর ধরে ভিতর ভিতর জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছে। এভাবে তরপেছে জানলে কখনোই এসব হওয়ার অবকাশ রাখতো না। সানার চিঠি পড়ে শায়খ অন্তত এটা শিওর যে সানাহ্কে ফারহানের রিজেকশন বড়ই কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু ফারহানকে কি সানাহ্ ভালোবাসতো ? ভালো না বাসলে সানাহ্ যেমন শক্ত মেয়ে তাতে এমন তুচ্ছ কারণে এত বছরের ধৈর্য্য ভেঙে বেরিয়ে পড়ত না।

ফারহানকে শায়খ এত বছরে যা চিনেছে তাতে ফারহান চমৎকার একটা ছেলে। বিহেভিয়ার খুবই ভালো আর মিশুকেও… শুধু সানার কথা শুনলেই পালাই পালাই করে। তাহলে ফারহান কি করে রিজেক্ট করলো সানাহ্কে ? সে কি সানাহ্কে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ?

নাহ্ শায়খ কিছু ভাবতে পারছে না। মন চাইছে ছুটে গিয়ে আদরের ভাগ্নির কান ধরে নিয়ে আসতে ? কিন্তু সেটা পারছে না। ভাগ্নি যে তাকে বড়ই বিশ্বাস করে সবটা বলেছে। সানাহ্কে ফিরিয়ে আনলে কি তার বিশ্বাস ভাঙ্গা হবে ? তাকে কি কষ্ট দেওয়া হবে ? অনেক বড় দ্বিধা দ্বন্ধে ভুগছে শায়খ।

অফিসে যেতেও মন চাইছে না। আবার না গেলে বসকে ইমেইল করে, ভার্চুয়ালি ফোন করে, হেড ডিপার্টমেন্টেও ম্যাসেজ করতে হবে। ধুর এত ঝামেলা ভালো লাগছে না। পারবে না সে এতকিছু করতে… চাকরি গেলে যাবে। বয়স তো আছে চাকরি করার। চাকরি গেলে আসবে কিন্তু ভাগ্নি গেলে আসবে না। নিজের ভাগ্নি আগে….

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here