#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
অন্তিম পর্ব (শেষাংশ )
.
তামায়া মেয়েটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুখ ভার করে তাসফির কোলে গিয়ে বসতেই সেদিকে লক্ষ্য করে তাকালো মেয়েটা। মুখে হাসি বজায় থাকলেও তাদের সাথে বসা কিয়ানার দিকে চোখ পরতেই হঠাৎ হাসিটা মিলিয়ে গেল যেন। এগিয়ে এসে দাঁড়ালো তাদের সামনে। চোখ মুখ শক্ত করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে তাসফি। মেয়েটার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। কিয়ানার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে তাসফি কে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আরে তাসফি স্যার যে, ভরা ক্যাম্পাসে এভাবে বসে বসে প্রেমের ক্লাস কবে থেকে শুরু করলেন?”
কিয়ানার দিকে একবার তাকিয়ে সামনে তাকালো তাসফি। কিছুটা ধমকের সুরেই মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“তোক… তোমাকে এখানে কে আসতে বলছে? বেয়াদব!”
তাসফির ধমকে কেঁপে উঠলো সামনের মেয়েটা। তবুও তাসফির কথার পাত্তা দিলো না। কিয়ানার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে পরখ করতে লাগলো। বোঝার চেষ্টা করলো মেয়েটা কে? আর তাসফির সাথেই বা কি করছে? কিয়ানাও একই ভাবে পরখ করে চলেছে মেয়েটাকে। পরনে হালকা ছাই রঙা লং কামিজের সাথে ম্যাচিং করে হিজাব। চোখ শুধু কাজল ছাড়া আর কোন প্রকার সাজ নেই। গভীর ভাবে দেখতেই অবাক হলো কিয়ানা, তাসফি ও তামায়ার দিকে একবার তাকিয়ে আবারও তাকালো মেয়েটার দিকে। তিন জনের চেহারা প্রায় একই রকম বলে মনে হচ্ছে। হঠাৎ কিছু একটা ভাবলো কিয়ানা। মেয়েটা তাসফির কথার তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
“আপনার ক্লাস তো আমি পরে নিবো, আগে মেয়েটাকে দেখি।”
বলেই তাসফির কোলে থাকা তামায়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। তৎক্ষনাৎ কিয়ানার মুখ ফুটে অজান্তেই অস্পষ্ট সুরে বেরিয়ে আসলো ‘রূপা’ নামটি। নামটা আস্তে বললেও তাসফির কানে ঠিকই গেলো, কিয়ানার দিকে তাকিয়ে হালকা হেঁসে মাথা নাড়ালো তাসফি। যার অর্থ সে ঠিক ধরেছে। বিস্মিত হলো কিয়ানা, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রূপার দিকে।
.
“কেউ কি তার মাম্মামের উপর রাগ করে আছে?”
নিজের মুখটা ফিরিয়ে নিলো তামায়া। তাকালো না পর্যন্ত। মেয়ের দিকে তাকিয়ে অভিমানী মুখটা দেখে হালকা হাসলো তাসফি। কিন্তু হাসিটা গোপন করে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“কোন এসেছো ভার্সিটিতে? বাসায় বলে আসার পরও তোমাকে কে আসতে দিলো? বাসায় গেলে দেখা হতো না ওর সাথে?”
“একদম কথা বলবেন না আপনি, ওকে কেন নিয়ে আসছেন আপনি? বাসায় রেখে আসলেই তো হতো, আমাকে আর কষ্ট করে এখানে আসতে হতো না। এতক্ষণে রাগটাও ভাঙাতে পারতাম।”
একটু থামলো রূপা, কিয়ানার দিকে কপাল কুঁচকে একবার তাকিয়ে তাসফির দিকে তাকালো। আবারও দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
“অবশ্য ওকে এনে ভালোই করেছেন, এখানে না আসলে তো আপনার প্রেমের ক্লাস লাইভ দেখতে পারতাম না।”
বলেই তাসফির থেকে মুখ ফিরিয়ে তামায়ার দিকে তাকালো রূপা। দু’হাতে তামায়ার গালে আলতো করে ধরে আদুরে গলায় বললো,
“মাম্মাম সরি তো, আর কখনো আমার মাম্মামকে একা রেখে কোথাও যাবো না। তোমার বাবাই তো আমাকে জোর করে পাঠিয়েছে, মাম্মাম কি তামায়াকে ছাড়া থাকতে পারে, বলো?”
একটু থামলো, জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে আবারও বললো,
“সকালে আমার মাম্মাম টাকে না দেখে কত্তো মন হয়ে গেছিলো, জানো? তাই তো চলে আসলাম আমার আম্মুটার কাছে।”
এবার তাকালো তামায়া। তাকে তাকাতে দেখে হাসলো রূপা। মেয়ের গালে বেশ কয়েটা চুমু দিয়ে বললো,
“অনেকগুলো আদর করে দিলাম। আর রাগ করে থাকে না, এবার একটু মাম্মামের সাথে কথা বলো। তা না হলে মাম্মাম আবার অসুস্থ হয়ে দূরে চলে যাবে কিন্তু।”
“না….”
চিৎকার করে বলেই গলা জড়িয়ে ধরলো রূপার। তার আধো বুলিতে বলে উঠলো
“যাবা মাম্মাম, আল লাগ কলবো না। তুমি যাবা না, বাবাই বকা দেয় তো।”
“আর কোথাও যাবো না আম্মু। ইস্, মন খারাপ করে না মাম্মাম, বাবাই বকা দিছে কেন তোমাকে?”
কথাটা বলেই তাসফির দিকে তাকালো রূপা। রাগ মিশ্রিত গলায় বলে উঠলো,
“বকেছেন কেন ওকে? আপনাকে বলেছি না, আমি না থাকলে ওকে কিছু বলবেন না। তবুও বকেছেন ওকে?”
“শেষ হয়তো তোমাদের মা মেয়ের অভিমানের নাটক? বকেছি কেন, সেটা না হয় ওকেই জিজ্ঞেস করো।”
তাসফি কিছুটা ধমকে উঠে কথাটা বলতেই তামায়া রূপাকে আবারও জড়িয়ে ধরলো। মায়ের কোলে ওঠার চেষ্টা করে নেমে আসলো তাসফির কোল থেকে। রূপা তাসফির দিকে রাগী চোখে তাকাতেই মেয়ের হাতের দিকে ইশারা করলো তাসফি। বললো,
“তার সখ জেগেছিলো ব্যাগ নিয়ে আমার সাথে ভার্সিটিতে আসবে, সাথে নাকি তার বইও লাগবে। কিন্তু অন্য কোন বই না, তার মায়ের বইটাই তার চাই।”
“তো কি হয়েছে? ডায়েরিটা নিয়ে আসছে জন্য আপনার ওকে বকতে হবে?”
“শুধু নিয়ে এসেই তো ক্ষান্ত হয় নি, হারিয়েও ফেলেছিলো। আর যাকে নিয়ে সন্দেহ করছিস, সে এটা দিতেই এসেছিলো।”
শেষ কথাটা রূপার দিকে ঝুকে এসে চাপা স্বরে বললো। তাসফির থেকে চোখ সরিয়ে কিয়ানার দিকে তাকালো রূপা। কিয়ানা এতক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। দেখছিলো তাদের ভালোবাসাময় ছোট পরিবার কে। ডায়েরির প্রতিটা পাতার লেখাগুলো যেন এবার তার চোখের সামনে পরিপূর্ণ ভাবে ভেসে উঠলো। এক নিমিষেই যেন ভুলে গেল তাসফির প্রতি তার ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় রুপ নেওয়া অনুভূতির কথা। এই ভালোবাসার কাছে তাসফির প্রতি তার অনুভূতিটা ঠুনকো বলে মনে হচ্ছে।
“সরি, আসলে আমি বুঝতে পরি নি।”
রূপার কথায় ভাবনাগুলো ছুটে গেল কিয়ানার। তার দিকে তাকিয়ে হালকা হেঁসে উঠলো। বললো,
“না.. না ঠিক আছে আপু, আসলে সরি তো আমার বলা উচিত।”
অবাক হলো রূপা, মাথা ঝাকিয়ে মানে বলতেই কিয়ানা বলে উঠলো,
“কারোর জিনিস পারমিশন ছাড়া দেখা ঠিক না, তবুও নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে আপনার ডায়েরি টা পড়ে ফেলেছি। আর শেষটা, মানে আপনার অপারেশনের ঘটনাগুলো জানার জন্য এতটাই উদগ্রীব হয়ে পড়েছিলাম যে, তাসফি স্যারকে জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলাম না।”
কিছু বললো না রূপা। তাসফির দিকে তাকাতেই হালকা হাসলো সে। বললো,
“আমাকে নিয়ে লেখা তোমার অসমাপ্ত কথাগুলো না হয় তুমিই শেষ করো। আমি বরং রাগী মেয়েটার রাগ ভাঙায়।”
বলেই রূপার গলা ছাড়িয়ে নিয়ে তামায়াকে নিতে লাগলো। বাবার কাছে না যাবার জন্য হাত-পা ছুটাছুটি করতে লাগলেও লাভ হলো না। তামায়াকে ছাড়িয়ে নিয়ে কোলে তুলে হাঁটতে লাগলো সামনে। তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বেঞ্চে উঠে বসলো রূপা। কিয়ানা বলে উঠলো,
“কিছু মনে করবেন না আপু, ডায়েরির প্রতিটা পাতার লেখাগুলো পড়ে যেন সবগুলো চোখের সামনে ভাসছিলো। আপনাদের ভালোবাসি না বলেও ভালোবাসাটা মনে সুক্ষ দাগ কেটে ছিলো। শেষটা পড়ে মনে হয়েছিলো আপনি হয়তো আর…. সরি, আপনার শেষ পরিণতিটা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে গেছিলাম।”
কিয়ানার কথাগুলো শুনে একটা হাসি দিলো রূপা। তাসফি ও তামায়ার দিকে একবার তাকিয়ে কিয়ানার দিকে তাকালো। ঠোঁটে হাসিটা বজায় রেখেই বলে উঠলো,
“এদের কে দেখছো না? এদের দুজনের জন্যই আজ আমি এখানে। এদের ভালোবাসার জোরেই আমি ফিরে এসেছি, পেয়েছি নতুন জীবন।”
কিছু বললো না কিয়ানা, শুধু তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। রূপা সেভাবেই বলতে লাগলো,
“চেন্নাই যাবার বেশ কিছু টেস্ট করায় ডক্টরা। জানতাম না রিপোর্টে ঠিক কি ছিলো, কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম আমার হাতে হয়তো আর বেশি সময় নেই। আমাকে হারানোর ভয়ে ভিতর ভিতর একদম ভেঙে গেছিলেন তাসফি, তবে কখনোই তা বুঝতে দিতে চাই নি আমাকে। কিন্তু ওই পাগলটা তো আর জানতো না, এতটুকু ওনাকে বোঝার ক্ষমতা আছে আমার। অপারেশনের আগের রাত গুলোতে একটুকুও ঘুমান নি উনি। প্রতি রাতে আমাকে জড়িয়ে চোখের পানি ফেলতেন শুধু। আমি বুঝতে পারলোও চুপ করে থাকতাম। আমাকে অটি তে নিয়ে যাবার পর শুধু একটা কথায় ভেবেছি, হয়তো আর কখনোই বেঁচে ফিরতে পারবো না, দেখতে পারবো না আমার ভালোবাসার মানুষগুলো কে। বারবার শুধু নিজের স্মৃতিতে নেবার চেষ্টা করেছিলাম তাসফি আর তামায়ার নিষ্পাপ চেহারাটা।”
জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে থামলো রূপা। সেই কথাগুলো আবারও মনে করে কষ্ট হতে লাগলো। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও বলতে লাগলো,
“নিজের জ্ঞান ফেরার পর যখন তাসফি কে দেখছিলাম, তখন ওকে চিনতেও পারছিলাম না আমি। শুধু মনে হচ্ছিলো, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে আগেও দেখেছি আমি, কিন্তু মনে করতে পারি নি। তারপর নাকি আবারও শুরু হয় আমার চিকিৎসা। দীর্ঘ সাত মাস পর সুস্থ ভাবে ফিরে আসি সবার মাঝে। আমার ভালোবাসার মানুষদের কাছে। ডক্টরা বলেছিলো এমন ক্রিটিক্যাল রোগীর বেঁচে যাওয়াটা একটা লাক। কিন্তু আমি জানি, তাসফির ভালোবাসার জোরে এবং তামায়ার মুখে মা ডাক শোনার জন্যই ফিরে এসেছি আমি।”
নিরবতায় ছেয়ে গেল দুজনের মাঝে। কেউ তৎক্ষনাৎ কিছু বললো না। বেশ কিছু সময় নিয়ে রূপা বলতে লাগলো,
“ঢাকায় আসার পর তাসফি আর তামায়ার সাথে সময় কাটাতে কাটাতে নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি। মাঝে মাঝে সমস্যা হলেও তেমন গুরুত্ব দেই নি। তাসফি আর আমাদের মেয়েকে নিয়ে চলতে থাকে আমাদের ভালোবাসাময় সংসার। মেয়েটাও বড় হতে থাকে। কিন্তু প্রায় চার-পাঁচ মাস আগে আবারও প্রচন্ড মাথা ব্যাথা শুরু হয়। জ্ঞান হারায় হঠাৎ করেই। তাসফি সময় নষ্ট না করে নিয়ে যায় ড. রিয়াদের কাছে। কয়েকটা টেস্ট করে বলেন কিছু সমস্যা হয়েছে আবারও। কিন্তু কি, সেটা পুরোপুরি ভাবে ধরতে পারেন নি। তাসফি আর কোন রিক্স নিতে চান না বলে, পাসপোর্ট ভিসা রেডি করে আবারও দু’মাস আগে চেন্নাই নিয়ে যান। ওখানে নরমাল ট্রিটমেন্ট চলতে থাকে। তাসফি আমার সাথে থাকতে চাইলেও থাকতে পারেন নি। তামায়া এবং ভার্সিটির জন্য চলে আসতে হয়েছে। বড় চাচার সাথে প্রায় দুই মাসের মতো আবারও স্বামী সন্তান ছাড়া কাটাতে হলো ওখানে। কালকে রাতের ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছেছি।”
কিছু বলতে পারলো না কিয়ানা, শুধু অনুভব করতে লাগলো তাদের ভালোবাসার মাত্রাটা। ঠিক কতটা একে অপরকে ভালোবাসলে এতটা বিশ্বাস করা যায়। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেল না কিয়ানা, তবুও অজান্তেই তার মুখ থেকে বেড়িয়ে আসলো,
“এভাবেই বেঁচে থাকুক তোমাদের ভালোবাসা আপু, অনেক ভালো কাটুক তোমাদের ভবিষ্যৎ জীবন।”
কিনায়ার কথার মাঝেই তামায়াকে নিয়ে তাসফি এসে দাঁড়ালো তাদের সামনে। বললো,
“এতদিন পর মাম্মাম কে পেয়ে তার বাবাকে ভুলে গেছে তোমার মেয়ে। নাও সামলাও ওকে।”
বলার আগেই রূপার কোলে উঠে গেল তামায়া। কিয়ানার দিকে তাকিয়ে হালকা হেঁসে বলে উঠলো,
“আজকে আসি, অন্যদিন দেখা হবে আবার।”
বলেই মেয়েকে নিয়ে তাসফির সাথে হাঁটতে লাগলো রূপা। কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে চাপা স্বরে তাসফি বলে উঠলো,
“এই অসুস্থ শরীর নিয়ে একা একা কেন আসতে গেলি ভার্সিটিতে? কালকে শেষ রাতে বাসায় এসেছিস, সেই খেয়াল আছে তোর? বেয়াদব! শরীর টাকে বিশ্রাম না দিয়ে ছুটে আসলি কেন? বাসায় গেলে পেতি না ওকে?”
“আপনিই বা ওকে আনতে গেলেন কেন? দুটো মাস আপনাদের কাছে না পেয়ে এমনিতেই কম কষ্ট পাই নি আমি। সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনাদের না দেখে আমার কতটা খারাপ লেগেছিলো জানেন? কতদিন কাছে পাই না আপনাদের।”
রূপার কথার ভঙ্গিতে এবার কিছুটা নরম হলো তাসফি। হালকা হেঁসে বললো,
“মেয়েটা তো রাগ জেদ পুরোটাই তোরটা পেয়েছে। সকালে তোকে দেখে বলে, ‘বাবাই, আমাকে নিয়ে চলো তোমার সাথে, মাম্মামের সাথে আড়ি আমার। একদম কথা বলবো না।’ আনতে না চাইলে শুরু করে দেয় তার কান্নাকাটি, বাধ্য হয়েই আনতে হলে।”
“ইস্, বললেই হলো নাকি? রাগ জেদ সবকিছুই আপনার মতো হয়েছে ওর। রাগ তো সবসময় নাকের ডগায় লেগেই থাকে আপনার।”
রূপার কথা বলার ভঙ্গিতে হেঁসে উঠলো তাসফি। তাসফি কে হাসতে দেখে তামায়াও খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। ওদের হাসিতে তাকিয়ে রূপাও হেঁসে উঠলো। মনে মনে বলে উঠলো, ‘নজর না লাগুক আমার ভালোবাসার মানুষ দু’টোকে।’
এক ধ্যানে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে কিয়ানা। আপন মনেই ভেবে চলেছে কিছু একটা। মনে মনে ভীষণ অপরাধ বোধ হতে লাগলে তার। এত সুন্দর ভালোবাসার মাঝে কিভাবে সে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে ঢুকে যাবার ইচ্ছে প্রেরণ করলো? তাসফি ও রূপার এই ভালোবাসার কাছে তো তার এই সদ্য জন্ম নেওয়া ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় নাম দেওয়া অনুভূতিটা নিছক তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছে। তাসফি ও রূপার যাবার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠলো, ‘শত শত বছর বেঁচে থাকুক এমন ভালোবাসা।’
.
তাসফি ও রূপা বাসায় আসতেই উৎসব মুখর পরিবেশে মুখরিত হলো পুরো বাসা। কাজিন দলের সবাই না থাকলেও রিফা, রিমি ও রাহাত আছে। রাহাত পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় একটা কোম্পানি তে আছে, সেই সুবাদেই রাহাতের ঢাকায় থাকা। রূপার ফেরার কথা বলে তাকে বাসায় আনা হয়েছে কয়েক দিনের জন্য। সবাই মিলে ঢাকায় আসার কারণ রূপার ফিরে আসা হলেও, আরও একটা কারণ আছে। এক মাস পর রিফার বিয়ে, তারই কেনাকাটায় আসতে হয়েছে। সবকিছু মিলে যেন আনন্দে মেতে উঠেছে পুরো পরিবার। রিমির দুই বছরের ছেলে রাজু এবং তামায়া মিলে পুরো বাসা ছুটাছুটি করে চলেছে। রিফার বিয়ের কেনাকাটা কোথায়, কিভাবে করবে সেসব নিয়েও আলোচনা করলো বড়রা। সিদ্ধান্ত হলো, তাসফি আগামীকাল সবাইকে নিয়ে যাবে শপিংয়ে, আর বড়রা তাদের সময় মতো নিজেদের কেনাকাটাগুলো করে নিবে। আলোচনার সমাপ্তি করে সবাই মিলে আড্ডা দিতে লাগলো। আড্ডা শেষে খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় বারোটা বেজে গেল। তারপর যে যার রুমে চলে গেল ঘুমানোর জন্য।
.
“এবার তো ঘুমাও মাম্মাম, অনেক রাত হয়েছে তো।”
প্রায় আধা ঘন্টা সময় ধরে মেয়েকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা চলিয়েও সফল হলো না রূপা। তামায়া হাত নাড়িয়ে বলে উঠলো,
“এভাবে এভাবে কলো বাবাই-য়ের মতো। না হলে তো ঘুম লাগবে না।”
“করছি তো আম্মু, এবার অন্তত ঘুমাও।”
“তুমি পালো না মাম্মাম, বাবাই তো এভাবে এভাবে করে।”
আবারও হাত দিয়ে ইশারা করলো তামায়া। এবার খুব বিরক্ত হলো রূপা, কিছু বলতে নিলেই তাসফি রুমে ঢুকে বলে উঠলো,
“মাম্মাম কি পারছে না আম্মু?”
তাসফির ডাকে সেদিকে তাকালো তামায়া। আবারও হাত নাড়িয়ে বলে উঠলো,
“দেখো বাবাই, মাম্মাম তো এভাবে এভাবে কলতে পালে না।”
“ওও এই ব্যাপার, আসো আমি তোমায় ঘুম পারিয়ে দিচ্ছি।”
বলেই হাতের তোয়ালেটা রেখে দিলো। বড় লাইট অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সাথে সাথে তাসফির বুকের উপর শুয়ে গলা জড়িয়ে নিলো তামায়া। আর সে আস্তে আস্তে থাপা দিতে লাগলো মেয়ের পিঠে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রূপা বলে উঠলো,
“বাহ্, খুব সুন্দর অভ্যাসে পরিণত করেছেন ওর। এখন থেকে প্রতিদিন আপনিই ওকে ঘুম পারাবেন, আমার আর কি।”
“তুমি বললে আমি সবকিছুই করতে রাজি আছি রূপুসোনা।”
হালকা হেঁসে উঠলো রূপা। বালিশে মাথা রেখে দেখতে লাগলো বাবা মেয়েকে।
.
শরীরে উষ্ণ ছোঁয়ায় ঘুমটা হালকা হয়ে গেল রূপার। একটু নড়েচড়ে উঠতেই বুঝতে পারলো কেউ একজন গভীরভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। ঘুমটা পুরোপুরি ছুটে গেল তার। সহসায় বুঝতে পারলো তাকে জড়িয়ে রাখার মানুষটা কে। মেয়েকে রেখে মানুষটা এপাশে এসে কখন ঘুমিয়েছে বুঝতেই পারে নি সে। আবারও নড়ে উঠতেই ভেসে আসলো ঘোর লাগা ঘুম ঘুম কণ্ঠ।
“নড়ে না রুপুসোনা।”
অবাক হলো রূপা, এত রাতেও জেগে আছেন উনি? আস্তে করে বলে উঠলো,
“ঘুমান নি আপনি,?”
“উহুম্….”
“কেন?”
“এতদিন পর বউকে কাছে পেলাম, ঘুমটা কি আর সহজেই ধরা দিবে?”
কিছু বললো না রূপা। তামায়া কে দেখে নিলো একবার। মেয়েটা গভীর ঘুমে। এবার পিছন ফিরে তাসফির দিকে ফিরলো। রূপাকে ঘুরতে দেখো মিটমিট করে তাকালো সে। ইশারায় বলে উঠলো ‘কি হয়েছে?’ রূপা তৎক্ষনাৎ কিছু বললো না, তাসফি কে জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ লুকালো। বললো,
“অনেক মিস করেছি তোমাকে, অনেক বেশি। আর কখনো আমাকে একা কোথাও থাকতে বলবে না, তোমাদের ছাড়া আমি কিছুতেই ভালো থাকতে পারবো না।”
“আর কখনোই আমাদের ছাড়া থাকতে হবে না তোমার, তুমি বললে এভাবেই আমাদের সাথে থাকবে।”
“তুমি না বললেও কিন্তু আমি তোমাদের সাথেই থাকবো।”
কথাটা বলেই হালকা হেঁসে উঠলো রূপা। তাসফিও হেঁসে উঠলো তার সাথে তাল মিলিয়ে। রূপাকে গভীর ভাবে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে আস্তে করে বললো,
“তুমি বললে আজ কিন্তু অনেক কিছুই হতে পারতো।”
.
.
সমাপ্ত…..
আলহামদুলিল্লাহ। প্রথম ধারাবাহিক গল্প শেষ করতে পেরেছি। সন্তুষ্ট করতে পেরেছি সবাইকে। গল্পটায় অনেক ভালোবাসা পেয়েছি আপনাদের, যা সত্যিই ভোলার মতো নয়। আশা রাখি এভাবেই সাপোর্ট করবেন আমাকে, পাশে থাকবেন সবসময়। পুরো গল্পটা পড়ে কেমন অনুভূতি জানাতে অবশ্যই ভুলবেন না। আমার ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই। শেষ পর্যন্ত পাশে থাকার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা রইল সবাইকে।🖤