#মধ্যবিত্ত
#নুসরাত_রিতু
#পর্ব_৮
ফজরে ঘুম ভাঙলো রাফির। কখন চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পরেছিলো মনে নেই তার। রাহি ও সেলিনা চৌধুরীকে সে পাশেই পেলো দুজনই ঘুমাচ্ছে বসে বসে। রাফি তাদেরকে তুলে দিয়ে নিজে মসজিদের দিকে পা বাড়ালো।
নামাজ পড়ে ফিরে এলো দুই কাপ চা আর ছোট এক প্যাকেট বিস্কুট সহ। ততক্ষণে রাহি ও সেলিনা চৌধুরী নামাজের রুম থেকে নামাজ পড়ে আগের জায়গায় বসেছে।
রাফি: আন্টি নিন চা টা খেয়ে নিন। ফ্রেশ লাগবে।
মাথাটা জ্যাম হয়ে ছিলো সেলিনা চৌধুরীর। বিনা বাক্যব্যায়ে নিয়ে নিলো সে। রাহিকে দেয়া হলে সে বললো, “আমি খাবোনা স্যার। এটা আপনি খান।”
রাফি: “আমি খেয়ে এসেছি। এটা তেমার।”
এবার রাহিও নিয়ে নিলো।
রাফি: আন্টি আত্মীয় স্বজনদের জানানো হয়েছে ঘটনাটা?
সেলিনা চৌধুরী : বাবার একমাত্র সন্তান আমি। আমার আত্মীয় বলতে শুধু রবিনের আম্মু রুমানা। বাবা ওকে মেয়ের মতোই দেখতো। ওকে বলেছি। আর রাহির বাবার নিকটাত্মীয় তেমন নেই। তাই আমাদের আর জানানোর কেউ নেই।
রাফি: ওহ আচ্ছা। এবার তো বাড়ি যাওয়া উচিৎ আন্টি। আংকেলোর কখন জ্ঞান ফিরবে তা তো জানা নেই। এক এক করে দুজনেই বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলে ভালো হতো না!
সেলিনা চৌধুরী: “আমি যাবোনা।” রাহির দিকে তাকিয়ে, “তুই এখন বাসায় যা মা। গিয়ে নিজে ফ্রেশ হয়ে ২-৪ ঘন্টা ঘুম দিয়ে আয়। আর খুশিকে বলিস দুপুরের খাবার রেডি রাখতে তুই আসার সময় নিয়ে আসিস তারপর নাহয় আমি যাবো। ”
কথাটা পছন্দ হলো রাহির। কারন তাদের মধ্যে একজনের বাসায় গিয়ে কিছু জিনিস নিয়ে আসা উচিৎ।
রাফি জানালো সে রাহিকে বাসায় দিয়ে নিজের বাসায় যাবে আবার রাহিকে নিয়েই এখানে আসবে। সেলিনা চৌধুরী বারকয়েক বারন করলেও পরে রাজি হলেন। সত্যি তার পাশে এখন কেউকে প্রয়োজন। রাহি আর রাফি সেলিনা চৌধুরীর থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আর সেলিনা চৌধুরী কেবিনের এক্সট্রা বেডে গিয়ে শুয়ে পরলো।
রাফি নিচে এসে রিকশা করে নিলো। রিকশায় উঠে রাহি বললো, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার। ঐরকম মুহূর্তে আমাদের পাশে দাড়ানোর জন্য। ”
রাফি: এটা মানুষের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পরে।
রাহি এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ জাফর সাহেবের এক্সিডেন্ট তাকে এলোমেলো করতে পারেনি তবে স্তব্ধ করে দিয়েছে। নিজের অলক্ষ্যে রাহি তার মাথাটা রাফির কাধে এলিয়ে দিলো। রিমি আর মা বাদে এটাই কোন মেয়ের এতোটা কাছাকাছি আসা রাফির। ভেতর থেকে কেমন কম্পন অনুভব করলো সে। সব ভাবনা বাদ দিয়ে শক্ত হয়ে বসে ছিলো সে। মাঝে ঠিকই ফাঁকা আছে আজও। শুধু রাহির মাথাটাই রাফির কাধে।
এদিকে রাহির কাছে রাফিকে এই মুহুর্তে সবচেয়ে বিশ্বস্ত মনে হচ্ছে। তার জীবনে সে কম ছেলেদের সাথে মেশেনি। শত শত প্রেম প্রস্তাব সে পেয়েছে। সেই কারো সাথেই রাফির মিল খুজে পাচ্ছে না সে। অনেক টিউশন টিচারও পড়াতে এসে রাহির সাথে ফ্লার্ট করেছে, প্রপোজ করেছে, রাহির কাছে তার বাবার ব্যাবসার ডিটেইলস জানতে চেয়েছে। রাহি তাদের চোখে একটা লোভ দেখতে পেত যেটা সে রাফির চোখে দেখে না। এই যে এখন সে তার মাথাটা রাফির কাঁধে দিলো রাফি এক ফোটা নড়েনি। সে স্থির হয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। অন্য কেউ হলেও কি এমনটা করতো! অন্যরা কি এখন রাহির সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতো না? এমন হাজারো ভাবনা ভাবছিলো রাহি। যার প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিলো রাফি। বাবার এক্সিডেন্টের কথা একটু সময়ের জন্য যেন ভুলেই গিয়েছিলো সে। মনে পরতেই চোখের কোন বেয়ে পানি পরলো।
________________________________
বাসার সামনে রিকশা থামলে রাফি ভাড়া মিটিয়ে তাকে বিদায় দিলো। গেটের পাশে রাহি খেয়াল করলো খুশি আর দারোয়ান বসে আছে। সামনে গিয়ে খুশিকো ডাক দিলো সে।
খুশি ধরফর করে ঘুম থেকে উঠে দেখে রাহি দাড়ানো। রাত থেকে বসে বসে এখানেই ঘুমিয়ে পরেছিলো সে আর দারোয়ান। কেঁদে দিলো খুশি। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
খুশি: “আফাআআ, আমনে আইছেন? ওরা আমারে ঘর দিয়া বাইর কইরা দিছে। কিচ্ছু নেতে দেয়নায়। দারোয়ান কাক্কুরেও বাইর কইরা দিছে। আমনেরা কাইল যাওনের পর পরই ওরা আইছে।” রাহি স্তব্ধ হয়ে ছিলো। কিছুই বুঝতে পারলো না সে।
রাহি: “কে বের করে দিছে তোদের?”
খুশি: “ন্যান্সি ম্যাডামে আর হের লগে একজন।”
রাহি যেন আকাশ থেকে পড়লো। বাবার প্রথমবারের মতো ড্রিংক করে গাড়ি চালিয়ে এক্সিডেন্ট করা আবার ন্যান্সি আন্টির খুশিকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া। এসবের কি যোগসূত্র আছে?
এদিকে রাফি কিছুই বুঝতে পারছেনা। কে ন্যান্সি কেন বের করে দিলো কিছুই না। সে শুধু এতোটুকু বুঝলো রাহিকে এখন একা ছেড়ে যাওয়া যাবে না।
রাহি দৌরে ভিতরে গেলো। সাথে রাফি, খুশি আর দারোয়ানও গেলো।
রাহি এক নাগাড়ে কলিং বেল চাপছে আর দরজা ধাক্কাচ্ছে লাস্ট দুই মিনিট ধরে৷ ভিতর থেকে কেউই দরজা খোলেনি। পুরো দোতলা জুরে রাহিদের ফ্লাট। তাই আশেপাশেও কেউ নেই। আরো মিনিটখানেক বেল বাজানোর পর দরজা খুললো ন্যান্সি। একটা সিল্কের নাইটি পরে ন্যান্সি সামনে আসার সাথে চোখ ঘুরিয়ে নিলো রাফি।
রাহি: তুমি এখানে কি করো আন্টি? আর খুশিকে বের করে দিছো কেন?
ন্যান্সি: শোন মেয়ের কান্ড। আমি এখানে থাকবো না তো কে থাকবে? কাল রাতে তোমার বাবাই তো সব লিখে দিলো আমার নামে। এখন এই বাড়ি সহ পুরো কম্পানি আমার। সো গেট আউট ফ্রম হিয়ার।
রাহি: তুমি কি বলছো তা কি জানো আন্টি? মদ গিলে গিলে মাথাটা খেয়েছো তুমি। দেখি সরো আমি বাসায় ঢুকবো। আর তুমিও এখন বাসায় যায়। সেন্সে আসলে কথা বলবো তোমার সাথে।
ন্যান্সি: “আমি সেন্সেই আছি মাই চাইল্ড। বিশ্বাস হচ্ছে না যে তোমার বাবা সব আমার নামে লিখে দিয়েছে? আচ্ছা তবে অপেক্ষা করো এখানেই আমি আসছি।”
পুনরায় দরজা আটকে ভিতরে চলে গেলো ন্যান্সি। এবার রাফি মুখ তুলে তাকালো। খুশির কাছ থেকে জেনে নিলো ন্যান্সি কে। কিন্তু তার মাথায় এটা এলো না যে সামান্য সেক্রেটারি হঠাৎ এমন ব্যাবহার করছে কেন। ন্যান্সি ফিরলো আরো দুই মিনিট পর। হাতে একটা খাম।
ন্যান্সি: এই নেও। নিজেই দেখে নেও তোমার বাবা সব কিছু আমার নামে লিখে দিয়েছে
রাহি চটপট খামটা নিলো। খুলে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো সে। তার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে রাফি দেখে ওটা একটা উইল। জাফর সাহেব তা স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি লিখে দিয়েছেন ন্যান্সির নামে। নিচে জামাল সাহেবের সিগনেচারো আছে। রাহি রাফির থেকে কাগজটা নিয়ে কয়েক টুকরো করে ফেললো।
জোরে হেসো দিলো ন্যান্সি। যেন খুব মজার কিছু দেখেছে সে।
ন্যান্সি: আমি জানতাম তুমি এমন কিছুই করবে। তাই ইচ্ছে করেই ফটোকপি দিয়েছি।।
রাহি: সড়ুন আমায় ভিতরে যেতে দিন।
ন্যান্সি: সিনক্রিয়েট করলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো মাই চাইল্ড। তারপর তোমায় পুলিশে নিয়ে গেলে তোমার বাবা মায়ের কি হবে!
রাহি: আমার বাবা মায়ের চিন্তা আপনার করতে হবে না। আপনি চলে যান এখান থেকে।।
ন্যান্সি: “আমার বাড়ি থেকে আমাকেই যেতে বলছো। বাহ বেশ ভালো তো!” কন্ঠে বিদ্রুপের হাসি।
রাফি পুরো বিষয়টা বুঝলো। আইনও যে তাদের কোন সাহায্য করতে পারবে না তা ন্যান্সির কনফিডেন্স বলে দিচ্ছে। তাই সে বললো, “উইল অনুযায়ী তো জাফর সাহেবের সকল সম্পত্তি আপনার। এই বাড়ির আসবাবপত্রও আপনার । কিন্তু তার মধ্যে থাকা জমাকাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিস তো বাড়ির লোকেরই থাকার কথা। সেগুলো তো আপনি আটকে রাখতে পারেননা।”
ন্যান্সি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো রাফির দিকে।
ন্যান্সি: কে তুমি? এই বিষয়ে কথা বলার তুমি কে?
রাফি: আমি যেই হই না কেন। বাড়ি আপনার হলেও বাড়ির টুকটাক জিনিসপত্র কিন্তু আপনার না। সুতরাং সেটা আপনি দখল করতে পারেননা।
ন্যান্সি: “ওহ তাই নাকি? এখানে সব জিনিস এই উইল অনুযায়ী আমার। তবুও যখন জামাকাপড় নিতে চাচ্ছো নেও। ২০ মিনিটের মধ্যে সব গুছিয়ে নিয়ে নেও। ” এই বলে ন্যান্সি দরজা ছেড়ে সোফায় গিয়ে বসলো।
রাহি: এটা আপনি কি করলেন স্যার? উনি মিথ্যা বলছে আপনি বুঝতে পারছেন না?
রাফি: “আমি বুঝলেও লাভ নেই রাহি। প্রমান তার পক্ষে। তার সাথে লড়তে হলে কঠিন ভাবেই লড়তে হবে। যার জন্য তোমরা প্রস্তুত না। তুমি এখনি ভিতরে গিয়ে তোমার, তোমার আম্মুর সকল গহনা, জমানো টাকা, দামি যা যা আছে জামাকাপড়ের মধ্যে করে নিয়ে এসো। খুশিকেও সাথে নিয়ে যাও। আমি ওনাকে ব্যাস্ত রাখছি। সব প্যাক করা হলে দারোয়ানকে বলে নিচে নামিও। তোমরা তিনজন এক্ষুনি যাও”
রাফির কথা বুঝতে পারলো রাহি। তাই সেও আর দেরি করলো না। খুশি আর দারোয়ানকে নিয়ে দৌরে ভিতরে গেলো সে।
ন্যান্সি দূর থেকেই তাকিয়ে আছে রাফির দিকে। রাফি হুট করেই একটা বুদ্ধি বের করলো। যদিও এটা প্রতারণা কিন্তু এই মুহুর্তে রাফির কাছে এটাই সঠিক মনে হচ্ছে।
রাফি এগিয়ে গেলো ন্যান্সির দিকে।
রাফি: “বসতে পারি ম্যাম।”
মুগ্ধতা ঠিকরে পরছে ন্যান্সির চোখ থেকে। প্রথম নজরেই রাফিকে অসাধারণ লেগেছে তার কাছে। ন্যান্সির বয়ফ্রেন্ডের নাম রকি। রকির কথা ভুলে গেলো ন্যান্সি। তার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছিলো রাফিকে তার চাই।
ন্যান্সি: সিওর।
রাফি ঠিক তার মুখোমুখি বসলো।
রাফি: “ইউ আর সো গর্জিয়াছ ম্যাম।” ন্যান্সির চোখে মুখে খুশির ঝিলিক।
ন্যান্সি: “তা তো মনে হচ্ছে না। তা যদি হতো তবে ওতো দূরে বসলে কেন? ” দম আটকে আসলো রাফির। তার সামনে বসে থাকতেই অসহ্য লাগছে রাফির। পাশে বসা সম্ভব না তার পক্ষে।
রাফি: পাশে বসলে তো স্পষ্ট করে দেখতে পেতাম না।
ন্যান্সি: “কি দেখতে চাও বলো!” চোখে মুখে কামুকতা।
রাফি: আপাতত আপনার ঐ চোখ দুটোই শুধু দেখতে চাই।
আবার মুগ্ধ হলো ন্যান্সি। রাফি খুব নরমালি পরবর্তীতে তার সাথে কথা বললো। ন্যান্সির পরিবার সম্পর্কে টুকটাক জানলো। সে আর তার বয়ফ্রেন্ড মিলেই যে এই কাজ করেছে আন্দাজ করতে পারলো সে। রাহিদের সব গোছানো হলো পঁচিশ মিনিটের মাথায়। ততক্ষণ ন্যান্সিকে ব্যাস্ত রেখেছে রাফি। রকি গেস্ট রুমে ঘুমাচ্ছে তাই কিছুই তার কানে যায়নি।
ভিতর থেকে যখন রাহি দেখলো রাফি হেসে হেসে ন্যান্সির সাথে কথা বলছে বুকটা পুড়ে উঠলো তার। কই রাহির সাথে তো কখনো এতো হেসে কথা বলেনা সে। টলমলে পা নিয়ে সামনে গিয়ে বললো, “আমার হয়েছে স্যার।”
রাফি ন্যান্সির দিকে তাকিয়ে বললো, “এবার তাহলে উঠি ম্যাম।”
ন্যান্সি: “কি বলো? ওরা যাকনা তোমার যেতে হবে না। একসাথে ব্রেকফাস্ট করবো আমরা”
রাহির চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো সাথে সাথেই। “আজ না ম্যাম অন্য কোন দিন” বলে উঠে দাড়ালো রাফি। রাহির হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বললো, “চলো” রাহিও চুপচাপ আসলো। একটা ব্যাগ খুশির হাতে আর দুইটা লাগেজ দারোয়ানের হাতে। মানে গহনা, টাকা বাদেও দামি যা যা সামনে পেয়েছে সবই নিয়ে নিয়েছে রাহি। মায়ের কোরআন শরীফও বাদ যায়নি। নিচে এসে রাহি দারোয়ান আর খুশিকে ২ হাজার করে টাকা দিয়ে তাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিলো। আর নিজে ভাবতে লাগলো সে এসব নিয়ে এখন কই যাবে।
রাফি: রিকশা ডাকি?
উত্তর দিলো না রাহি। রাফি কেন ন্যান্সির সাথে হেসে হেসে কথা বললো। কিসের এতো মজার কথা তার!
রাফি: ডাকবো?
রাহি: ……….
রাফি: তুমি কি কোন কারনে রেগে আছো রাহি?
রাহি: ……….
রাফি: আমি তোমাকে হেল্প করতে ভিতরে যাইনি কারন উনিও তাহলে আমাদের পিছু পিছু যেতেন। আর তার সামনে তুমি গহনা গুলো নিতে পারতে না। সে বাধা দিতো। তাই আমি তাকে এদিকে কথার তালে ব্যাস্ত রেখেছি।
রাহি: আপনি চলে যান স্যার। আমি একাই পারবো।
রাফি: কোথায় যাবে তুমি?আমাকে বলো আমি পৌছে দিবো তোমাকে।
রাহি: জানিনা।