#মধ্যবিত্ত
#পর্ব_২৭
#নুসরাত_রিতু
ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো উচ্ছসিত রিমির কন্ঠ।
রিমি: আসসালামুআলাইকুম, কেমন আছো ভাবি? [গলায় দুষ্টু ভাব]
রাহি: ওয়াআলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু। আলহামদুলিল্লাহ তুমি কেমন আছো নতুন বউ?
রিমি: আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ঘুম কেমন হলো তোমার?
রাহি: আলহামদুলিল্লাহ। রাতে মাথা ব্যাথা করছিলো ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছি। ঘুম ভেঙেছে ফজরের আজানের শব্দে।
রিমি: সেকি রাতে তোমার আর ভাইয়ার মধ্যে কোন কথা বার্তা হয়নি?
রাহি: নাহ্। কখন রুমে এসেছে আমি তাই টের পাইনি।
রিমি: তোমাদের বিয়ে আর বাসর দুটোই কেমন যে হলো কিছুই বুঝলাম না।
রাহি: তুমি বলো তোমার বাসর কেমন হলো?
রিমি লাজুক কন্ঠে বললো, ” নামাজ পড়েছি, পরিচিত হয়েছি তারপর ঘুমিয়ে গিয়েছি।”
রাহি: ইশ আমাদের নামাজটাও পড়া হলো না।
রিমি: ওহ তিনি আমাকে দেনমোহরের টাকাটা দিয়ে দিয়েছে। সেটা দিয়ে কি করবো আমি?
রাহি: কোথাও ইনভেস্ট করে রাখতে পারো। পরে হজ্জে যাওয়ার সময় কাজে লাগবে।
রিমি: ভালো বুদ্ধি। কিন্তু কোথায় ইনভেস্ট করবো?
রাহি: ছোটখাটো জমি বা গহনা কিনে রাখতে পারো।
রিমি: আচ্ছা আজ তো আসছিই তখন বাকি কথা হবে। তোমরা তাড়াতাড়ি চলে এসো কিন্তু।
রাহি: আমিও যাবো?
রিমি: তা নয়তো কি? অবশ্যই আসবে অপেক্ষা করবো আমি। এখন রাখি কেমন! উনি হয়তো নামাজ থেকে চলে এসেছে।
রাহি: আল্লাহ হাফেজ।
রিমি : আল্লাহ হাফেজ।
ফোন রাখর কিছুক্ষণ এর মধ্যেই রুমে প্রবেশ করলো রাফি। রাফি নিজেই সালাম দিলো। রাহি জবাব নিয়ে বললো, “আপনি কি এখন ফ্রী আছেন স্যার?”
রাফি: হ্যা, কিছু বলবে?
রাহি: হ্যা কিছু কথা ছিলো।
রাফি: আমারও তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।
রাহি: আপনিই আগে বলুন।
রাফি: তুমি বলো কি বলবে তারপর আমি বলছি।
রাহি: না আপনিই আগে বলুন।
রাফি: সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি তাই এমন ভাবে জিজ্ঞেস করছি। কিছু মনে করো না।
রিমির সাথে গতোকাল কথা হয়েছিলো আমার। কিন্তু আমি গিয়ে দেখি তুমি কবুল বলে ফেলেছো। আমার হাতে কিছুই ছিলো না। তোমার কি এই বিষয়ে কিছু বলার আছে?
রাহি: আমারও রিমির সাথে কথা হয়েছে। কিন্তু তখন কি থেকে কি হয়ে গেলো আমি কিচ্ছু বুঝতে পারিনি। আমি জানতাম আপনি অন্য কেউকে পছন্দ করেন তবুও আমি কেনো বিয়েতে রাজি হলাম জানা নেই আমার।
রাফি অবাক হয়ে বললো, “আমি অন্য কেউকে পছন্দ করি মানে? রিমি তো বললো তুমি অন্য কেউকে পছন্দ করো।”
রাহি: কি বলেন? রিমি যে বললো ও আপনার রুমে চুড়ি দেখেছিলো। হয়তো আপনি সেটা স্পেশাল কারো জন্য এনেছিলেন তাই লুকিয়ে রেখেছেন।
রাফি চট করে উঠে ড্রয়ার খুলে চুড়ি দুই মুঠ বের করে দেখিয়ে বললো, “এই চুড়ি?”
রাহি: আমিতো জানি না।
রাফি: রিমি ঐদিন এই চুড়িই দোখেছিলো। ওর জন্য চুড়ি কেনার সময় এই চুড়িগুলো কিনেছিলাম একজনকে দেবো বলে। পরে আর দেয়া হয়নি তাই থেকে গেছে।
কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাফি। যার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে রাহি। সেই পুরোনো রাহি ফিরে এলো নতুন রাহির মধ্যে। কান্নারা সব দলা পাকিয়ে গলা চেপে ধরেছে তার। এই দীর্ঘশ্বাস কেনো?
সরাসরি রাফির চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, “কার জন্য কিনেছিলেন চুড়িগুলো?”
রাফি: বলবো কোন একদিন।
রাহি: কোন একদিন কেনো আজ বলতে সমস্যা কই?
গলার আওয়াজ চড়ে আসলো রাহির। রাফিও কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেছে। দ্রুত হাতে দরজা আটকে দিলো যেনো রাহির আওয়াজ বাইরে না যায়।
রাফি: আস্তে কথা বলো রাহি। বাসায় অনেক মেহমান।
রাহির ক্রোধ বাড়লো বই কমলো না। এতোদিন ভেবেছিলো হয়তো কোথাও একটা কিন্তু আছে। রাফি হয়তো সত্যি সত্যি কেউকে ভালোবাসে না। কিন্তু আজকে রাফির বলা কথা আর দীর্ঘশ্বাস রাহিকে বুঝিয়ে দিলো রাফি সত্যি কেউকে ভালোবাসে।
দ্বিগুণ ক্রোধ নিয়ে রাহি বললো, “আপনি আগে আমাকে বলবেন চুড়িগুলো কার জন্য কিনেছেন? তাকে বিয়ে না করে আমাকে বিয়ে কেনো করলেন আপনি?”
রাফির শান্ত চোখেও তখন রাগ আর অসহায়ত্ব দুটোই দেখা গেলো।
রাফির মনে হচ্ছে এখন উপযুক্ত সময় না নিজের অনুভুতির কথা বলার। একটা জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে বললো, “যাও ওজু করে আসো।”
রাহি: আমি কি বলছি আর আপনি কি বলছেন?
রাফি: ওজু করে আসতে বলেছি।
রাহি অনিচ্ছা সত্বেও ওজু করে আসলো। ততক্ষণে মাথা ঠান্ডা করে নিয়েছে রাফি। রাহি আসার পর বললো, “করেছি ওজু এবার বলুন চুড়ি করা জন্য কিনেছেন?”
রাফি কোন উত্তর না দিয়ে দুটো জায়গামাজ বিছিয়ে দিচ্ছিলো। রাহি রাফির সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বললো, “আপনি স্বামী আমার আর চুড়ি কিনবেন অন্য কারো জন্য, প্রশ্ন করলেও কিছু বলবেন না পেয়েছেন টা কি আপনি?”
এই কথায় রাফির একটু হাসি আসলো। মুচকি হেসে বললো, “আমি তো তোমার স্বামী হয়েছি কাল চুড়ি কিনেছি অনেক আগে।”
রাহি: আমি কি আপনার সাথে মজা করছি? হাসছেন কেনো আপনি? আপনি কি সত্যি অন্য কেউকে ভালোবাসেন?
চোখে পানি ছলছল করছে রাহির। রাফি সামনের জায়নামাজটায় দাড়িয়ে রাহিকে বললো পিছনের টায় দাড়াতে। রাফির মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে রাহি যদি সত্যি অন্যকেউকে ভালোবাসতো তাহলে এই চুড়ি নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি সে করতো না। এই প্রথম নিজের কোন ভুল ধরতে পেরে সে হয়তো এতোটা খুশি হচ্ছে।
রাহি জায়নামাজে দাড়িয়ে বললো, “এখন কোন ওয়াক্তের নামাজ পড়বো? হারাম সময়ই তো শেষ হয়নি।”
রাফি : হারাম সময় শেষ হয়েছে। আগে দু রাকাত নফল নামাজ পড়বো তারপর ইশরাক পড়ে উঠবো।
সাধারণত সবাই রাতের বেলা এই নফল নামাজ পরে তারপর তাহাজ্জুদ পড়ে। কিন্তু আমার বেলায় তো সবই উল্টো। বোনের বিয়ের দিন নিজের বিয়ে হয়ে যায় বাসরে এসে দেখি বউ ঘুমায়।
রাফি ইচ্ছে করেই রাহিকে খোচা মেরে কথাটা বললো। কেনো যেনো রাহিকে ক্ষেপাতে আজ খুব ভালো লাগছে তার। চাইলেই সে বলে দিতে পারে সত্যিটা কিন্তু রাহির লাল হওয়া নাক ফোলা ফোলা চোখ দেখে তার এখন সত্যি টা বলতে ইচ্ছে করছে না।
কিন্তু রাফিকে নিরাশ করে রাহি আর কোন উত্তর দিলো না। চুপচাপ নামাজের জন্য দাড়ালো। রাফিও বাক্যব্যায় না করে নিজে ইমামতি করে নামাজ শেষ করলো। তারপর আলমারি খুলে একটা খাম বের করে রাহির দিকে বাড়িয়ে বললো, “এখানে পচাত্তর হাজার টাকা আছে। তোমার দেনমোহর। আমার সামর্থ্যে এতোটাই সম্ভব ছিলো আশা করি তুমি বুঝবে।”
রাহি ছো মেরে টাকাটা নিয়ে বললো, “না আমি বুঝবো কেনো আমিতো টাকার লোভেই বিয়ে করেছি তাইনা।” কথাটা বলে খামটা নিজের হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।
রাফি মুচকি হেসে বললো, “তাই তো দেখছি। কোথায় লাজুক লাজুক মুখ করে খামটা নিবে তা না রীতিমতো কেড়ে নিলে।”
রাহি: আমার টাকা আমি লাজুক মুখ করে নেই আর কেড়ে নেই তাতে আপনার কি?
রাহি: নাহ, আমার কিছুই না।
কথাটা বলেই বিছানায় শুয়ে পরলো রাফি।
রাহি: আপনি আবার শুয়ে পরলেন কেনো? বলুননা কার জন্য কিনেছেন চুড়িগুলো?
রাফি চোখ বন্ধ অবস্থায়ই বললো, “না থাক, বললে তুমি কষ্ট পাবে।”
রাহি চোখ দিয়ে তখন গঙ্গা যমুনা বইছে। নাক টেনে টেনে বললো, “পাবোনা আমি কষ্ট আপনি বলুন কার জন্য কিনেছেন।”
রাফি: যাও তোমার জন্য কিনেছি খুশি এবার?
কথাটা শেষ করেই পাশ ফিরে শুয়ে পরলো সে।
রাহি: মিথ্যে বলে সান্ত্বনা দিতে হবে না। আপনি সত্যি সত্যি বলুননা কার জন্য কিনেছেন। সত্যি বলছি আমি তাকে কিছুই বলবো না।
রাফি নিশ্চুপ ভাবটা এমন যেনো রাহিকে সে পাত্তাই দিচ্ছে না। কিন্তু মনে মনে রাফি যে কতোটা খুশি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এরমধ্যে রেনু বেগমের ডাকে বাইরে যেতে হয়েছে রাহিকে। ও বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসেছে খুশি।
সেলিনা চৌধুরী আজ আসেননি। খুশিকে জিজ্ঞেস করায় খুশি জানালো ময়েের শশুর বাড়ি আসা নাকি ভালো দেখায় না তাই তিনি আসেননি। এদিকে রাফির কর্মকাণ্ডে রাহির মাথা এমনিই গরম ছিলো এখন আবার মা বাবা কেউ না আসায় সবার সামনেই কেঁদে দিলো। যদিও খুব বেশি মানুষ ছিলো না। দু একজন মহিলা আর রেনু বেগম। সবাই ভাবলো বাবা মায়ের কথা মনে পরায় রাহি কাঁদছে।
রেনু বেগম রাহিকে না পাঠিয়ে নিজেই গিয়ে রাফিকে ডেকে আনলো। ছেলেদের খাবার বসার ঘরে দেয়া হয়েছে আর মেয়েরা খাবে পর্দা দিয়ে আড়াল করা খাবার জায়গায়। সকালটা কাটলো এমন ভাবেই।
চলবে….