#প্রেমে_পড়া_বারণ পর্ব ১১
লেখা: জেসিয়া জান্নাত রিম
বিয়ের সমস্ত শপিং শেষ করে তিন্নিরা গ্রামে এসেছে আজ পাঁচ দিন। আপাতত কাছের মেহমানরা আসতে শুরু করেছে। বিয়ে বাড়িতে হাজারটা কাজ। সবকিছুর তদারকি করছে তিন্নি। তিন্নি দের সাথে গ্রামে এসেছে ওর বড় ফুফুরা। ওদের কাজিনরাও সব চলে এসেছে,তবে রওনক এখনো আসেনি। তার আসতে একটু দেরি হবে। তিন্নির ছোট ফুফুরা ওরা আসার দুইদিন পর এসেছে। ইফতেখারের পরিবারের কেউই আসেনি শুধু ইমতিয়াজ কে তিন্নি সাথে করে নিয়ে এসেছে। ও এখন তিন্নির সাথে সমস্ত কাজে হেল্প করছে। কাজের মাঝে থাকলে কিছুক্ষণের জন্য হলেও কষ্ট ভুলে থাকা যায়। আজ আফিফদের আসার কথা। তিন্নি বাসট্যান্ডে যাচ্ছে ওদের আনতে। যদিও ওরা গাড়ি নিয়ে আসছে। কিন্তু বাসট্যান্ডের পরের রাস্তাটা মুখে বলে দিলে ওরা চিনবে না আর ফর্মালিটিজ ও আছে তাই তিন্নি নিজে যাচ্ছে ওদের আনতে।রেডি হয়ে বেরোনোর সময় শায়লা তিন্নি কে এক কোণায় ডেকে নিয়ে বললেন,
— ওদিকে ওদের থাকার ব্যবস্থা ঠিক মতো হয়েছে?
— চিন্তা করো না। কাল আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি। সব ঠিকঠাক।
— আমাদের আত্মীয় স্বজন ও তো আসতে শুরু করেছে ওদের থাকার কি ব্যবস্থা করলি।
— নিচে আপার রুম বাদে বাকি গুলো মুরব্বিদের জন্য। আপার রুমে রুনা আর সোহেলি আপার সাথে থাকবে শুধু। আর ওপরে আমার ঘরে সমস্ত মেয়েরা থাকবে। আর মাঝের জায়গাটাতে ছেলেদের জন্য ঢালা বিছানা করা হবে। উত্তর ঘর আর কাচারি ঘরটাও পরিস্কার করা হয়েছে জায়গার অভাব হবে না।
— আরেকটা কথা তোকে জিজ্ঞেস করবো ভাবছিলাম….
— জলদি বলো আম্মা দেরি হয়ে যাচ্ছে।
— না মানে বিয়ের সমস্ত কিছু তো তুই করছিস। বেশ জমকালো ভাবেই করছিস। তিথির পড়ার পেছনে তো তিথির ডিপিএস এর পুরো টাকাই খরচ হয়েছে। সানভির ডিপিএসে ও অত টাকা নেই। তোরটা তো ফ্লাট কেনার সময়ই ভাঙ্গা হলো। এখন এত টাকা পাচ্ছিস কোথায়?
— তোমার মনে নেই আমাদের দুইবোনের বিয়ের জন্য ও আব্বা একটা ডিপিএস খুলেছিল আর প্রতিবছর জমি থেকে যে টাকাগুলো আসে ওগুলো ও ব্যাংকে জমা হয় সবমিলিয়ে আপার বিয়ের খরচের পুরোটাই উঠে গেছে। অত চিন্তা করো না।
— ফ্লাট কেনার পর ঐ ডিপিএস টা তোর আব্বা তোর জন্য রেখেছিল। তুই ওটাও ভেঙে ফেললি?
— আমি অত টাকা দিয়ে কি করবো আম্মা। আমার পড়ার তো তেমন খরচ নেই আর না করবো বিয়ে। এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না তুমি আপার বিয়ে নিয়ে ভাবো। আর ভালো কথা আপার বিয়ের সমস্ত শাড়ি গহনা আপার ঘরে রাখা হয়েছে। ওগুলো ঠিক ঠাক করে গুছিয়ে রাখো। সময় মতো হাতের কাছে কিছু পাওয়া যায় না। আর আপার সাথে যে ডালা গুলো যাবে সেগুলো সাজানো শুরু করো। কিছু কম হলো কিনা খেয়াল রেখো সময় থাকতে থাকতে কিনে আনা যাবে। আর আপাকে টাকার ব্যাপারে কিছু বলো না। আমি বের হলাম।
কথাটা শেষ করেই বেরিয়ে এলো তিন্নি। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানে আরো কথা বাড়ানো। এই মুহূর্তে তা একদম উচিত হবে না।
বাস স্ট্যান্ডে মোট সাতটা বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম গাড়িটা থেকে আবিদ নেমে দাঁড়িয়ে আছে যাতে তিন্নি এলে ও সবার আগে দেখতে পারে। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক পায়চারী করে আফিফ কে এসে বলল,
— তোমার শালিকাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করো তো কতক্ষন লাগবে আসতে?
— একটু আগেই তোর সামনে ফোন দিলাম তো। বললোই তো রাস্তায় আছে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।
— আবিদ ভাইয়ার আর তর সইছে না। ভাইয়া পায়চারী বন্ধ করে ঐ দোকান থেকে আমাকে কিছু চিপস কিনে এনে দাও তো।
কথাটা বলল আবিদের ফুফাতো বোন মৌমি। আবিদ ওকে এক ধমক দিয়ে বলল,
— গাড়িতে তো সবসময় খাওয়ার ওপরই থাকলি। এখন আবার চিপস কেন? চুপচাপ বসে থাক।
আফিফ বলল,
— আরে যা তো কিনে আন। আমরা সবাই খাবো। সময় কেটে যাবে। আর চিপস কিনতে কিনতে দেখবি তিন্নিও চলে এসেছে।
আফিফের কথা শেষ হতেই মৌমি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। তারপর আবিদের হাত টানতে টানতে দোকানে নিয়ে গেল। অতঃপর আবিদ কে চিপস কিনতেই হলো। কেনা শেষ করে আবারো ফিরে এলো ওরা। ততক্ষণে তিন্নিকে দেখা গেল ভ্যান থেকে নামছে। ভাড়া মিটিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এলো তিন্নি। বলল,
— সরি একটু দেরি হয়ে গেল। আসলে সব কাজ আমাকে দেখতে হচ্ছে তো।
আফিফ বলল,
— আরে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিনি তো সমস্যা নেই।
— ভাইয়া এটাই ছোট ভাবী?
মৌমি প্রশ্ন করতেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো তিন্নি। আফিফ বলল,
— ও মৌমি আমার ফুফাতো বোন।
তিন্নি মৌমিকে বলল,
— আমি তোমার ছোট ভাবী হই এটা তোমাকে কে বলল?
— আরে কারো বলতে হবে নাকি আমি জানি তো। দেখো ভাইয়ার ভাই যেমন ভাইয়া হয়। তেমনি ভাবীর বোন তো ভাবীই হবে তাইনা।
তিন্নি আবিদের দিকে তাকাতেই দেখলো ও মিটি মিটি হাসছে। তিন্নি বুঝতে পারলো বুদ্ধিটা আবিদের। ও মৌমিকে বলল,
— তুমি আমার অনেক বড় একটা সমস্যার সমাধান করে দিলে বুঝেছ।
— কি সমাধান?
— আমি ভাবছিলাম তোমার আবিদ ভাইকে কি বলে ডাকি। এখন তোমার লজিক মতো আফিফ ভাই আমার দুলাভাই হয় আর দুলাভাইয়ের ভাইও তাহলে দুলাভাই। তারমানে আবিদ কে আমি ছোট দুলাভাই ডাকবো।
কথাটা শুনে আবিদ বিষম খেলো। তারপর মৌমির মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
— গাড়িতে উঠে বোস খালি বকবক।
আর তিন্নির দিকে তাকিয়ে বলল,
— আমি তোমার কোন দুলাভাই টুলাভাই না। তোমাকে ও ভাবী বলেছে কারণ তুমি আমার বউ।
— আপনার আমার বিয়ে হলো কবে?
— এক্ষুনি।
— কিহ?
— তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমি তোমাকে প্রতিটি মূহুর্তে বিয়ে করেই চলেছি।
— এগুলো বলে আপনি কি প্রমাণ করতে চাইছেন?
— প্রমাণ করার কিছু নেই সবাই অলরেডি জানে তুমি আমার বউ। আর যারা জানে না তাদের আমি নিজ দায়িত্বে জানিয়ে দিবো। রইলো কথা তোমার তুমিও শিঘ্রই সবকিছু মেনে নেবে।
— সেটা কোনোদিনই হবে না। আপনি এধরনের কথা আমাকে আর বলবেন না।
— কেন? এ ধরনের কথা বললে তুমি নিজেকে সামলাতে পারোনা, আমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছা করে?
— মোটেও না। এসব বলে কোনো লাভ নেই। বৃথা চেষ্টা।
— আচ্ছা আমাকে আমার বৃথা চেষ্টা করতে দাও। তোমার বোনের বিয়ে শেষ হতে হতেই তুমি আমার প্রেমে হাবুডুবু খাবে।
— কনফিডেন্স থাকা ভালো। কিন্তু ওভার কনফিডেন্স জিনিসটা ভালো না।
— চ্যালেন্জ?
— কিসের চ্যালেন্জ?
— বিয়ে শেষ হওয়া পর্যন্ত যদি তোমাকে আমার প্রেমে না ফেলতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে আর কোনো দিন তোমাকে আমি বিরক্ত করবো না।
— সত্যি?
— এরা সবাই সাক্ষী থাকলো। সবার সামনে কথা দিচ্ছি।
— ওকে। এখন চলুন যাওয়া যাক।
তিন্নি গাড়িতে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসল। আবিদ ড্রাইভারকে পিছনের গাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। আফিফ গাড়িতে থাকা সবার সাথে তিন্নির পরিচয় করিয়ে দিলো। যেতে যেতে তিন্নি বলল,
— বিয়ের ডেকোরেশন অথবা অনুষ্ঠান নিয়ে আপনাদের কোনো ফরমায়েশ আছে? থাকলে আমাকে আগে থেকে জানিয়ে দিন। আমি মোটামুটি একটা প্লানিং করে ফেলেছি।
আফিফের এক কাজিন রাফি বলল,
— সমস্ত কিছু তুমি করছ প্রফেশনাল কাউকে নিয়ে ভালো হতো না। তুমি কি পারবে?
আফিফ হেসে বলল,
— তুই বোধহয় জানিস না তিন্নি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করছে। ওর প্লানিং কোনো প্রফেশনাল থেকে কম হবে না।
তিন্নি বলল,
— আসলে বিষয়টা সেরকম না। প্রফেশনাল কাউকে নিলে ভালো হতো কিন্তু নিজের মনে করে তারা কাজটা করতো না। আর গ্রামের অনেকেই এই বিয়েতে কাজ করছে। তাদের কাউকে কাজ দেওয়াও যেত না। তাই আমিই সবকিছু দেখছি। আশা করি আপনাদের নিরাশ করবো না।
— তুমি কি ভাবলে সেটা বলো?
— আসলে কি বলেন তো গ্রামের বিয়েতে কিন্তু অনেক মজা হয়। শুধু এরেজমেন্টে একটু সমস্যা থাকে। আর আজকাল শহরের বিয়ে গুলো সব কেমন যেন নাটকীয় নাটকীয় তবে তাদের এরেজমেন্টটা ভালো থাকে। আমি দুটোর পজেটিভ জিনিস গুলো মিলিয়ে কিছু ভাবছি।
— ভালো তোমার মতো এগোয় তবে তুমি একা সবকিছু করবে এটা কেমন দেখাবে আফটার অল বিয়েটা আমার আর তিথির দুজনের। তোমার একটা এসিস্ট্যান্ট প্রয়োজন। আবিদ কে নিয়ে নাও। আজ থেকে বিয়ে পর্যন্ত ও তোমার এসিস্ট্যান্ট।
— আরে না তার কোন প্রয়োজন নেই। আপনাদের যেখানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেটা আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। বিয়ের কাজ করতে করতে রাত অনেক হয়ে যাবে আবার ভোরে ভোরে শুরু ও করতে হবে। বারবার আসা যাওয়া কষ্টকর।
— এ সমস্যার ও সমাধান আছে। ও তোমাদের ওখানে থাকলো।
— ওখানে তো সবাই নিচে বিছানা করে একসাথে ঘুমাবে। এক্সট্রা রুমের ব্যবস্থা নেই।
— সমস্যা নেই। আবিদ ও ওদের সাথে ঘুমাবে। কিরে আবিদ পারবি না?
আবিদ মাথা নাড়ল। তিন্নি তাও আপত্তি করলো। আফিফ বলল,
— ওর সমস্যা না থাকলে তোমার অসুবিধা কোথায়?
আবিদ বলল,
— বুঝলি না ভাইয়া আমাকে সবসময় সামনে দেখলে ও আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে না।
কথায় কাজ হলো তিন্নি আর আপত্তি করলো না।
আফিফদের সবাই কে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আবিদ কে নিয়ে বাড়িতে এলো তিন্নি। বাড়ি ফিরে সবার আগে আফিফদের খাবার ব্যবস্থা করে সেখানে পাঠিয়ে দিলো ও। তারপর শায়লা কে ডেকে আবিদের খাবার দিতে বলে বিয়ের কাজে বেরিয়ে এলো ও। তিথি আবিদ কে দেখে নিজের রুম থেকে বের হলো। আবিদ বলল,
— কি খবর ভাবী?
— খবর ভালো। খালি একটু বোরিং লাগে।
— সেকি তোমার বিয়ে আর তোমারই বোরিং লাগে?
— শোনো অন্যের বিয়েতে মজা করা সহজ। কিন্তু নিজের বিয়েতে পুতুল হয়ে বসে থাকো। কেউ কিছু করতে দিচ্ছে না। আর তিন্নি দুইটা বডিগার্ড সবসময় সেট করে রেখেছে।
— বডিগার্ড?
— আমার দুই কাজিন। তাদের কথা মতো উঠতে বসতে হচ্ছে। এটা খাও, ওটা করো, হ্যান প্যাক লাগাও, ত্যান প্যাক লাগাও দুটিতে মিলে পাগল করে রেখেছে। রাত জেগে তোমার ভাইয়ের সাথে কথা বলবো সেটাও হচ্ছে না। বলে কিনা ডার্ক সার্কেল পরবে। ঘুমের নাম দিয়েছে বিউটি স্লিপ। আর কি বলবো বিয়ে আনন্দ থেকে বিরক্তি বেশি দিচ্ছে।
তিথির কথায় হাসলো আবিদ। আসলেই বিয়েতে সবাই মজা করে। শুধু বেচারা বর বউ নিজের বিয়েতে কোন মজাই করতে পারে না। সেজে গুজে বসে থাকো। মাঝে মাঝে ছবি তোলো। বর যাও একটু এদিক সেদিক ঘুরতে পারে কিন্তু বউ বেচারি ভারি মেকআপ,গহনা আর পোশাক পরে এক জায়গায় চুপচাপ বসে থাকে। ব্যাপারটি সত্যিই বোরিং।
চলবে…………