#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_09+10+11+12+13
ঘোর অন্ধকারের মাঝে লোকটি রুমে প্রবেশ করে দ্রুত ফোনের টর্চ অন করেন।দরজা বন্ধ করে ক্রমশ এগিয়ে আসে সেহেরিশের বিছানার দিকে। ক্লোরোফর্ম হাতে নিয়ে রুমালে তা স্পে করে সেহেরিশের নাকে চেপে ধরে।মূহুর্তেই সেহেরিশ অচেতন হয়ে গেলে লোকটি ধপ করে সেহেরিশের পাশে বসে পরে।বালিশের পাশে থাকা সেহেরিশের ফোনটা হাতে তুলে নিতেই ঠোঁটের কোণে মিহি হাসি রেখা ফুটে উঠে।সেহেরিশের ফোনে কোন প্রকার লক নেই যার দরুনে লোকটি একে একে গ্যালারি সহ কল লিস্ট চেক করতে থাকে থাকে।কিছু কিছু তথ্য নিজের মোবাইলেও সংগ্রহ করে রাখে।কেইন এবং তুন্দ্রের সাথে সেহেরিশের বেশ কয়েকটি ঘনিষ্ট বন্ধুত্বের ছবি দেখে মূহুর্তেই রাগ মাথায় চড়ে যায়।নিজের ফোন থেকে অন্য একজনকে ফোন করে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– হোয়াটিস দিস জিউ?সেহেরিশের সাথে কেইন তুন্দ্রের কি সম্পর্ক?
-………….
– কোনটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক?তুন্দ্রের টা মেনে নিলাম বন্ধু কিন্তু কেইন?কেইন নিজের মুখে বলেছে সেহেরিশ তার ক্রাশ,হার্ট,ফেইরি।এত বছর তোমায় কেন রেখেছি আমি, সেহেরিশের কোন দিকটায় খেল রেখেছো তুমি।
-..………….
– ফ্রেন্ড!বললেই হলো আমি দেখে নেবো কেইনকে। মাইন্ড ইট।
অপর পাশের ব্যাক্তিটি কিছু বলার আগেই অজ্ঞাত ব্যাক্তিটি ফোন কেটে দেয়।গাঢ় করে শ্বাস ছেড়ে বসে যায় শেহেরিশের মাথার পাশে।তার চুলে হাত বুলিতে বুলাতে ভাবতে থাকে হাজারটা কথা।
—
সকালের আলো ফুটতেই ঘুম থেকে ওঠে পড়েন খুরশীদ।আহনাফ দেওয়ানের সাথে গ্রামের পরিবেশ দেখতে তখনি হাটতে বের হন।ফাহমিদা আফীফের মা সেঁজুতি এবং ফুফু চন্দনার সাথে রান্না ঘরে আলাপচারিতা করছেন।সামী,কেইন এবং তুন্দ্র তাদের ক্যামরা নিয়ে ফটোগ্রাফির উদ্দেশ্য বেরিয়ে গেছে সেই সাত সকালে।বাড়ির সবাই যখন নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত ঘড়ির কাটা যখন নয়টার ঘরে ছুঁই ছুঁই তখনি আফীফ ডেকে পাঠায় আমানকে।
– আমায় ডাকছিলে ভাইয়া?
– হ্যা।তোমার ভাবী কোথায়?
– রুম থেকে এখনো বের হয় নি।যত সম্ভব ঘুমেই আছে।
– এই বাড়ির নিয়ম সবার জন্য এক।সকাল আটটার পর কেউ ঘুমিয়ে থাকতে পারবে না তবে সে এখনো ঘুমিয়ে আছে তুই আমায় জানাস নি কেন?
– ভাবী আমাদের অতিথি ভাইয়া।শরীর হয়তো ক্লান্ত তাই উঠেনি।
– সকাল দশটার আগে মহারানীর ঘুম ভাঙ্গেনা আমি ভালো করেই জানি।যেহেতু আগামী দিন গুলোতে তাকে এই বাড়িতে থাকতে হবে সেহেতু এই বাড়ির নিয়মের সাথে তাকে মানিয়ে নিতে হবে।তুই বরং মৌ’কে ডাক।
– মৌ’কে দিয়ে কি হবে ভাইয়া?
– যা বলেছি তাই কর।
আমান এক ছুটে মৌ’কে ডেকে আনে।আফীফের ভক্ত মৌ।আফীফের কোন কথাই আজ পর্যন্ত অমান্য করেনি সে।বরং হেসে খেলে সবার মন মাতিয়ে রাখে,
– আমাকে ডেকেছো তুমি ভাইয়া?
– হ্যা তোমায় ডেকেছি।তোমায় আমি গতকাল কী বলছিলাম?
-উমমম কী বলেছিলে আমার তো মনেই পড়ছে না।
– তোমায় বলি নি সেহেরিশের দায়-দায়িত্ব তোমার।আমার যেমন মন জয় করেছো এবার সেহেরিশেরো মন জয় করো।
– উফফ আমি ভুলেই গেছিলাম।সামী ভাইয়ার সাথে মজা করছিলাম। এবার বলো ভাইয়া আমাকে কি করতে হবে?
– যাও সেহেরিশকে ঘুম থেকে উঠতে বলো আমরা একসাথে নাস্তা করবো।
-যথা আজ্ঞা।
মৌ মিষ্টি করে হেসে, সোজা সেহেরিশের রুমের দিকে হাটা শুরু করে।
জানলার কাঁচে শিশিরের আস্তরণ জমাট বেঁধে আছে।হালকা আলোয় আলোকিত হয়ে আছে রুমটা।ছোট্ট মৌ খুঁজে খুঁজে লাইটের সুইচ খুঁজে বের করে লাইট অন করে দেয়।বিড়ালছানার মতো কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে।
– এই যে মিষ্টিপু উঠো।আর কত ঘুমিয়ে থাকবে?উঠনা প্লিজ।তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।ওওওওও আপুনি উঠে যাও প্লিজ।
মৌয়ের এমন আবদার ভঙ্গি কথায় চমকে উঠে বসে সেহেরিশ।
– শুভ সকাল মিষ্টিপু।
– গ..গুড মর্নিং।তোমায় তো চিনলাম না।
– উফফফ আমায় ভুলে গেলে কালকেই তোমার সাথে কথা হয়েছিল।আমি মৌ।
– ওহ হ্যা,মনে পড়েছে।
– যাও দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসো।তোমার সাথে আমার আজ আলোচনা আছে।
– কিসের আলোচনা?
– তুমি তো এই বাড়ির নিয়ম রীতিনীতি কিছুই জানো না।তোমায় আজ সব শেখানো হবে।যাও বলছি দ্রুত যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় আছি এখনো নাস্তা করিনি।
– ওকে পিচ্চি বুড়ি আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি তুমি এখানেই থাকো।
কুয়াশাকে মাড়িয়ে সূর্যের তাপ অবশেষে গাছগাছালিকে গ্রাস করেছে।ভর দুপুরে সেহেরিশ এবং মৌ বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।হাতে থাকা জলপাইয়ে মরিচ মিশিয়ে কামড় বসাতেই চাপা আর্তনাদ জরে উঠে সেহেরিশ।
– আহহহ এমন টক কেউ খায়।আমার দাত শেষ আজ।
– ধীরে সুস্থে খাও দেখবে ভালো লাগবে।যানো কাল যখন তোমার গায়ে ফুল গুলো পড়ছিল তখন তোমায় একদম ফুলপরির মতো লাগছিল।
“ফুলপরী” শব্দটা শুনেই নড়ে উঠে সেহেরিশ।তড়িৎ গতিতে আবারো মনে পড়ে গেলো আফীফ দেওয়ানের কথা।আফীফ দেওয়ান তাকে ফুলপরী বলেই সম্মোধন করেছিল।ভাবনার মাঝেই সেহেরিশের চোখ চলে যায় একটি ঘরের দিকে।দেওয়ান বাড়ির বিশাল প্রাচীরের বাইরেই ঘরটি।ঘরের চারিপাশে সু-উচ্চ তালগাছ,সুপারি গাছ,নারিকেল গাছের ভরপুর।সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় পুরো দোতলার ঘরটি সম্পূর্ণ কালো রঙে আবৃত।ছাদ থেকে বাড়ির যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে বেশ ভালো করেই সেহেরিশ বুঝে নিয়েছে এই বির্লিংটার কোন জানালা নেই।
– এই বাড়িটি কার মৌ?কেমন যেন অদ্ভুদ।পরিবেশটা নিরিবিলি কেউ কি থাকে না এখানে?
– বাড়িটি নানা জানের।জানো এই বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না।সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ।
– মানে?কেউ যদি না যায় তবে এত সুন্দর ঘরটি করার মানে কী?
– তা তো আমি জানি না।তবে এই বাড়িতে নানাজান,মামা, মুনিফ ভাইয়া আর আফীফ ভাইয়া যায়।বাদ বাকি কাউকে যেতে দেখিনি আমি।
মৌ তার কথা শেষ করতেই নিচ থেকে তার মা ডেকে উঠে।যার দরুনে দ্রুত সেহেরিশকে রেখেই নিচে নেমে যায়।
ছাদের চারিদিকে বেশ কিছুক্ষণ হেটে সেহেরিশ চিলেকোঠার ঘরের সামনে দাঁড়ায়।সেদিকটায় রঙবেরঙের চন্দ্রমল্লিকা ফুল দেখে অভিপ্রায়ে তাকিয়ে থাকে।ফুলের সৌন্দর্যে সেহেরিশ এতটাই মোহিত হয়েছে লোভ সামলাতে না পেরে তুরন্তে চারটা ফুল ছিড়ে নেয়।নাকের সামনে রেখে গাঢ় করে শ্বাস টানতেই তার কানে আসে কারো পায়ের শব্দ।
সিড়ি ঘর থেকে পায়ের শব্দটা আরো নিখুঁত ভাবে এদিকেই আসছে সেই সাথে গলার স্বর শুনে সেহেরিশ চনমনিয়ে উঠে।গলার স্বরটা যে আফীফের তা বুঝতে লীন মাত্র দেরি হলো না তার।এই মূহুর্তে একা আফীফের সম্মুখে কিছুতেই যাবে না সে।তাই দ্রুত চিলেকোঠার দরজা খুলে দ্রুত রুমে প্রবেশ করে একটি ভাঙ্গা আলমারির আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।
মৌয়ের ভাষ্য মতে সেহেরিশ ছাদে একাই আছে।তাই সুযোগ বুঝে আফীফ ছাদের দিকে এগিয়ে আসলো।কানে ফোন নিয়ে মুনিফের সাথে কথা বলতে বলতে যখন ছাদে প্রবেশ করলো তখন পুরো ছাদটাই ফাঁকা।সেহেরিশের অস্তিত্ব না দেখে চুপচাপ ধীর গতিতে এগিয়ে যায়।লাহমায় তার চোখে পড়ে চিলেকোঠার দরজাটা অর্ধেক খোলা আর দরজার সামনেই একটি ফুল পড়ে আছে।আফীফ বেশ ভালো করেই বুঝে নিয়েছে সেহেরিশ তার পদ শব্দে পালিয়েছে তাই আবারো জোরে জোরে সিড়ি ঘরের দিকে হাটা শুরু করে।
আফীফের চলে যাওয়ার শব্দ বুঝতে পেরে চোখ বন্ধ করে গাঢ় করে শ্বাস নিলো সেহেরিশ।নিশ্চিন্ত মনে ধীরে সুস্থে চোখ খুলে তার সামনে আফীফকে দেখে চক্ষুচড়ক গাছ।
– এমন চোর পুলিশ খেলছেন কেন আপনি?আপনি কি চোর?আসার পর থেকেই চোরের মতো বিহেভ করছেন।
আফীফের কথায় মূহুর্তেই মাথায় রাগ চড়ে যায় সেহেরিশের
– কি?আমাকে দেখতে আপনার চোর মনে হয়?
– তা নয় তো কী?এমন চোর পুলিশ খেলছেন কেন?
– আমি চোর পুলিশ খেলবো মানে?কি বলছেন এইসব।
– সত্যি করে বলুন কি চুরি করেছেন এই বাড়ির?
– আরে আজব!
– সত্য করে বলুন, আপনি দেওয়ান বংশের আততাতী নয় তো?কে আছে আপনার আড়ালে?কে পাঠিয়েছে এই চন্দনপুরে?
– এই আপনি সকালে ড্রিংস করেছেন, কি সব যা তা বলছেন। আমি চন্দনপুরে আসিনি আমি অনন্তপুরে এসেছি আর কি সব আততায়ী বলছেন সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
– আমার কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে আপনার উপর আমার নজর থাকবে চব্বিশ ঘন্টা।
– এবার আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন।নিজেরা এই বাড়িতে আমাদের জোর করে রেখে এখন অপমান করছেন।আমি এক্ষুনি পাপাকে গিয়ে সবটা বলে দেবো।
সেহেরিশ যেতে নিলেই আফীফ তার সামনে এসে ঠেসে দাঁড়ায়।তাদের মাঝে খুব একটা দূরত্ব নেই বললেই চলে।
– এত চনমনে কেন আপনি?
– সরে যান আমার সামনে থেকে আপনাকে দেখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।প্লিজ দুরে সরুন।
– কী?আমায় দেখলে আপনার দম বন্ধ হয়ে আসে মানে কি?আপনার সাথে আমার মাত্র কাল দেখা হয়েছে আর তাতেই এমন রিয়েকশন।এখনো তো আমায় এক বিন্দুমাত্রও চিনলেন না।
– প্লিজ আপনি সরুন। আপনার সাথে আমার আর কোন কথা বলার ইচ্ছে নেই।
– আমার আছে।আপনি আমার গাছের ফুল ছিড়লেন কোন সাহসে।এই বাড়ির ফুল ছেড়া নিষেধ।
শেষ কথাটা বেশ ধমকের সুরেই বললো আফীফ।আফীফের একের পর এক তর্কে নিঃস্পৃহ অবস্থা সেহেরিশের।
– আমি জানতাম না।আর জানলে এমন কাজ কখনোই করতাম না সরি।
– ভুল যখন করেছেন তখন তার দাম দিতেই হবে।
– মানে?
আফীফ তার হাতে থাকা ফুলটি সেহেরিশের কানে গুজে দেয়।
-এবার একদম ফুলপরির মতো লাগছে।
“ফুলপরি” শব্দটা শুনেই চনমনিয়ে উঠে সেহেরিশ।তৎক্ষনাৎ আফীফ সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে দেয়ালের দিকে ইশারা করে।তার ইশারা অনুসরন করে সেহেরিশ তাকাতেই এক চিৎকারে লাফিয়ে উঠে সহসা আফীফকে জাপটে জড়িয়ে ধরে।সেহেরিশের কান্ডে আফীফ নিজেই তার সৎবিৎ হারিয়ে ফেলে।
দেয়ালের দিকে তেলাপোকা দেখলে সর্বোচ্চ সেহেরিশ হয়তো ভয়ে চিৎকার দেবে এটাই ভেবেছিল সে কিন্তু সেহেরিশ যে তাকে দশ গুন অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরবে কে জানতো?
আফীফ সেহেরিশের মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
– সেহেরিশ আপনি এতটাই ভীতু আমি তো জানতাম না।
– ত..তেলাপোকা কি চলে গেছে।
– আপনার চিৎকারে তেলাপোকা সহ আমার কানের পোকা গুলোও উড়ে গেছে।
আফীফের ঠাট্টা সুরের কথায় ছিটকে দূরে সরে যায় সে।মাথাটা নিচু করে আফসোস ভঙিতে বলে,
– সরি!
– সরি?কয়টা কারনে সরি বলবেন!আমাকে অনুমতিহীন জড়িয়ে ধরায় নাকি আপনার কর্কশ কন্ঠের চিৎকারে আমার কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায়?নাকি আমায় গায়ে
কলঙ্ক দেওয়ায়?
– কলঙ্ক?
– এই যে দেখুন আমার পাঞ্জাবিতে আপনার লিপস্টিকের দাগ।এটা যদি বাইরের কেউ দেখে ফেলে তবে সবাই ভেবে নিবে উলটা পালটা কিছু, তখন আমি মানুষের মুখ বন্ধ করবো কি করে?
সেহেরিশ ভ্রু কুচকে আফীফের বুকের দিকে তাকাতেই ভড়কে যায়।ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিটায় লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে সেদিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে সেহেরিশ।
– সরি এবারের মতো মানিয়ে নিন এই ভুল আমি আর জীবনেও করবো না।
আফীককে আর কোন কথার সুযোগ না দিয়ে সেহেরিশ দ্রুত হেটে নিচে নেমে আসে।আফীফ তার লজ্জার কারন বুঝতে পেরে বাকা হাসে।
– আমি চাই তুমি এমন ভুল বার বার করো।আমি চাই এমন লজ্জায় তুমি আবারো পড়ো।
তোমার ভুলেই একদিন আমি আমার কূলে ফিরবো।
#চলবে….
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ ❌#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১০
লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে সেহেরিশ দ্রুত মারুফার রুমের দিকে অগ্রসর হয়।দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকেই ধপাস করে বিছানায় শুয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।তার এমন অপ্রতিভ অবস্থা দেখে ভ্রু কুচকে যায় মারুফার।
– কি সমস্যা তোর কৈ মাছের মতো লাফাচ্ছিস কেন?কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
– সিংহের গুহায়।
– মানে?
সেহেরিশ খলবলিয়ে উঠে বসে। মারুফার সামনা সামনি বসে ঢোক গিলে বলে,
– আফীফ আমায় কি বলেছে যানো?আমি নাকি তার সাথে চোর পুলিশ খেলছি।তুমি বলো আমার বিহেভিয়ার কি চোরের মতো?
– হ্যা নিঃসন্দেহে আমিও বলতে পারি তোর বিহেভিয়ার চোরের মতো।
– ফুফু!
– একদম চেচামেচি করবি না।এই বাড়িতে আসার পর থেকেই তুই পালাই পালাই করছিস।তুই কি এখনো বুঝতে পারছিস না এই বাড়ির কেউ তোকে সন্দেহ করছেনা।কেউ বুঝতে পারছে না তুই সেই আট বছর আগের তাকিয়া।
– আমারো তাই মনে হচ্ছে।কিন্তু সিওর হতে পারছিনা।
– আমি সিওর তুই চিন্তা করিস না।যাই হোক তোকে বলতে ভুলেই গেছি আফীফের দাদী তোকে ডেকেছেন গিয়ে দেখা করে আয়।
– আমাকে, কিন্তু কেন?
– আহ এত সন্দেহ নিয়ে থাকিস কেন? তুই জানিস এই বাড়ির মানুষ গুলো কত ভালো খবরদার তাদের সাথে এমন উজবুক ব্যবহার করবি না এখন যা।
সেহেরিশ বিরক্ত মুখ নিয়ে রুম থেকে বেরিরে যায়। হাতে থাকা ফোনের দিকে তাকিয়ে মাথা নুইয়ে হাটছে সে।তখনি ধাক্কা লাগে কারো সাথে। চাপা আর্তনাদ করে সামনে তাকাতে মুনিফকে দেখে অপ্রস্তুত ভাবে হাসে।
– চোখ কোথায় থাকে আপনার মিস সেহেরিশ?
– আপনার রসগোল্লার মতো বড়বড় চোখ দুটি কোন হাড়িতে থাকে মি.মুনিফ।
সেহেরিশের কথার ভাবধারায় ঠোঁট কামড়ে হাসলো মুনিফ।
– আমি তো ভেবেছি আপনি কথাই বলতে যানেন না।মাই গড গতকাল কি যে ভাব ধরে ছিলেন।
– নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে উঠতে পারি নি তাই অপ্রস্তুত ছিলাম।
– তা তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছেন?
– গ্র্যান্ডমায়ের রুমে।
– খবরদার এই সম্মোধন করবেন না।নানিজান আপনায় ভীষণ বকবেন।
– কেন?নানি বকবেন কেন?
– নানির বরাবরি গ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে ভালো লাগে।কিন্তু আফীফ ভাইয়ার সামনে তিনি কিছুতেই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারেন না।আফীফ ভাইয়ার কথা হলো সবাই স্পষ্ট শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবে।এখন যদি তুমি তোমার ইংলিশ বাংলিশ কথা নানিকে বলো তবে নির্ঘাত কুরুক্ষেত্র চলবে।
– তবে আমি কি বলবো?
– দাদি বলো আর নানি বলো সম্পূর্ণ তোমার ইচ্ছা।
– ঠিক আছে তা বলা যাবে এখন বরং আমায় তার রুম টা দেখিয়ে দিন।
-ওকে চলুন।
কেইন তুন্দ্র সেহেরিশ এক সঙ্গে ছাদে দাঁড়িয়ে সেই কালো বাড়িটি সম্পর্কে আলোচনায় লেগে গেছে।
– দেখ তুন্দ্র এই ব্লাক হাউজের নিশ্চই কোন রহস্য আছে একটা জানলা নেই।অদ্ভুত সব নিরিবিলি।
সেহেরিশের কথায় তার দিকে তাকিয়ে কেইন মিহি হাসলো,
– যাই বলিস সেহেরিশ এই বাড়িটার ভাবধারাটা চমৎকার।আমার বেশ ইচ্ছে করছে এই বাড়িতে প্রবেশ করতে।
– আমারো।কিন্তু যাবো কি করে আমরা?
সুদীর্ঘ লম্বা কেইন সেহেরিশের মাথাটা তার বুকের সাথে চেপে ধরে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,
– দেখ সেহেরিশ আমার বুকের ভেতরটায় কেমন বিট হচ্ছে মানে বুঝতে পারছিস এই বাড়িটা সত্যি অদ্ভুত গা ছমে ছমে পরিবেশ।
– আহ আমার হেরার স্টাইল নষ্ট হয়ে যাবে এইভাবে কেউ ধরে।
কেইন কিছু বলার আগেই সেহেরিশের ফোনে ভিডিও কল আসে জুহির।সেহেরিশ মোবাইলটা দ্রুত রিসিভ করে তুন্দ্র কেইনের সামনে ধরে।
– হেই জুহি একা একা দিন কাটছে তো তোমার?
– নারে তোদের অনেক মিস করছি।বাবার শরীরটা এখনো ভালো হয়নি।
– আংকেলের খেয়াল রাখিস।এই দেখ আমাদের আমাদের তুন্দ্র সাহেবের অবস্থা। তিনি প্রকৃতি পেয়ে আমাদের একদম ভুলেই গেছেন।সারাদিন ফটোগ্রাফিতে ব্যস্ত।
সেহেরিশের কথা শেষ হতেই তুন্দ্র ছো মেরে মোবাইলটা তার হাতে নিয়ে নেয়।
– বিশ্বাস কর জুহি গ্রামটা এত সুন্দর!মাই গুড নেস।আর এই বাড়িটার কোনায় কোনায় যেন আভিজাত্য জড়িয়ে আছে।বাড়ির মানুষ গুলো এত সুইট অমায়িক কি বলবো তোকে।আমি এই বাড়ির প্রেমে পড়ে গেছি রে।
– আহারে বন্ধু আমার।তা কেইন সাহেবের কি অবস্থা?
– তার কথা কি আর বলবো তিনি তো এই বাড়িতে আসার পর থেকেই ভাব জমিয়ে ফেলেছে।
– একটা কাজ কর তোদের যেহেতু ওই বাড়ির প্রতি নেশা জেগে গেছে তবে ওই বাড়ির কোন ছেলেকে দেখে সেহেরিশকে বিয়ে দিয়ে দে।এট লিস্ট বন্ধুর শশুড় বাড়ির সুত্রে মাঝে মাঝেই বেড়াতে পারবি।
– এই বাড়িতে দুটি ছেলে।একটা বাঘ আরেকটা বাঘের শিষ্য।
– মানে?
– বাড়ির মালিক আহনাফ দেওয়ানের নাতি আফীফ দেওয়ান হলো বাঘ আর তার শিষ্য মুনিফ আই মিন আফীফের ফুফাতো ভাই।
তুন্দ্রের কথায় রাগ দেখিয়ে মোবাইলটা কেড়ে নিলো সেহেরিশ।দুজনের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে যায়।
ভিডিও কলে জুহিকে সম্পূর্ণ বাড়ি দেখাতে দেখাতে বাগানের মধ্যে ভাগে এসে উপস্থিত হয় সেহেরিশ।তখনি তার কানে আসে মিষ্টি সুরেলা কন্ঠের একটি পাখির ডাক।
– ফুলপরি!ফুরপরি!ফুলপরি!
সেহেরিশ সেই সুরের অনুসরণ করে চারিদিকে তাকাতে থাকে।কিছুক্ষণের মধ্যেই দোতলার একটি বারান্দা থেকে একটি কাকাতুয়া পাখির দেখা মিললো।সেই পাখিটি নেচে একমনে “ফুলপরি” “ফুলপরি করেই যাচ্ছে।সেহেরিশ ডানে বামে তাকিয়ে বিশেষ কাউকে না পেয়ে বাগানের শেষ প্রান্তে একজন মালীকে দেখে সেদিকে যায়।
– আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।আমাকে চিনতে পারছেন?
মালী সেহেরিশের কন্ঠে উঠে দাঁড়ায়।এক গাল হাসি দিয়ে আহ্লাদে সুরে বলেন,
– আরে ছুডো আফা।ভালা আছেন নি আফনি?
– আলহামদুলিল্লাহ চাচা আমি ভালো।আমার একটা প্রশ্ন ছিল।
– কইয়া ফেলেন আমি আমার সাধ্য মতো আফনারে উওর দিমু।
– এই বারান্দাটি কার চাচা?
সেহেরিশের আঙ্কুলের ইশারায় ভ্রু কুচকে তাকান মালী।
– এইডা তো ছুডো ভাইজানের।
– ছোট ভাইজান?
– আফীফ ভাইজান।
– ওহ!কিন্তু পাখিটি কাকে ফুলপরি ডাকছে?
– আমি তয় জানি না।তবে মাঝে মাঝেই পাখিডা ফুলপরি ফুলপরি কইয়া চিল্লায়।আবার কি যানি কয়!
– কি বলে?
সেহেরিশের উৎসুক কন্ঠে মালী ডানে বামে তাকায়।কেউ আছে কি না তা ভালোভাবে বোঝার জন্য কাউকে না দেখে ফিসফিস করে বলে,
– পাখিডা মাঝে মাঝে কয় “সে আসবে রাজা মন খারাপ কররো না”
– কে আসবে আর রাজা কে?
– তা তো মুই কইতাম পারতাম না।তয় রাজা হয়তো আফীফ ভাইজানরে ডাকে।এই পাখিটা কিন্তু অনেক আদর যত্নের পাখি।পাখিডা একমাত্র আফীফ ভাইজান ছাড়া কারো লগে মিশে না।সারাক্ষণ আফীফ ভাইজানের লগেই থাহে।আর আমি এর থাইকা বেশি কিছু যানি না।যা যানলাম তাই কইলাম।
– ওহ!আসি তবে।
কথা শেষ করেই সেহেরিশ সোজা হাটা শুরু করে। বাগানের চারিদিকে তাকিয়ে শত শত ফুল দেখে তার মাথায় হুট করেই দুষ্টু বুদ্ধি আসে।
– চাচা ওইগুলো কি ফুল?
– ডালিয়া।
– আর ডানের গুলো?
– জিনিয়া।
– ওকে আর এগুলো?
– চন্দ্রমল্লিকা!
– ঠিক আছে আমায় তবে সব ফুল থেকে দশটা করে ফুল ছিড়ে দাও।
– আমায় মাফ কইরেন আফীফ ভাইজানের নিষেধ আছে।
সেহেরিশ কথা বাড়ালো না বরং চাপা রাগ দেখিয়ে সোজা হাটা শুরু করলো।সে ভেবে পায় না এই আফীফকে ভয় পাওয়ার কি আছে?কিছু মূহুর্ত পর মনে পড়ে যায় আফীফের অতীতের কথা।যে ছেলের অল্প বয়সেই রক্ত গরম সে নিশ্চই এই বয়সে মোটেও শান্ত শীষ্ট নয়।
রাত প্রায় গভীর।চারিদিকে ঝি ঝি পোকার ডাক।যা সেহেরিশের কাছে চরম বিরক্তের।গতকাল তার জার্নির দরুনে ক্লান্ত শরীরে ঘুম আসলেও আজ ঘুম দুচোখে কিছুতেই ধরা দিচ্ছেনা।সেহেরিশ বারান্দার দরজা খুলে বাইরে তাকাতেই প্রবল ঠান্ডায় কেঁপে উঠলো।নিচে তাকাতেই নিয়ন বাতির আলোতে হরেক রকমের ফুল দেখে এক মূহুর্তে মাথায় শয়তানি বুদ্ধি চেপে বসলো।
গায়ে হুড়ি জড়িয়ে সাথে গায়ে চাদর জড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে নিচে নেমে আসলো।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সদর দরজাটা খোলা দেখে ভড়কে যায় সেহেরিশ।তবুও দুইচার কথা না ভেবে সোজা বাগানের দিকে হাটা শুরু করে।বাগানে প্রবেশ করেই একে একে সব কটা পছন্দের ফুল ছিড়ে হুড়ির টুপিটা সরিয়ে চুলে গুজে নেয়।বাগানে থাকা বেঞ্চিটাতে বসে ফুলের পাপড়ি ছিড়তেই তার চোখে পড়ে আফীফ বাগানের শেষ প্রান্তের গেট থেকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করছে।আর এইটুকুতে সেহেরিশ ভালো করেই বুঝে নিয়েছে বাগানের শেষ প্রান্তের গেটের মেইন রাস্তা ব্লাক হাউজের যাওয়ার রাস্তা।
আফীফকে দেখে দ্রুত দাঁড়িয়ে যায় সে।হাতে থাকা ফুল গুলো নিয়ে সুদীর্ঘ ঝাউগাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।নিরিবিলি পরিবেশটায় হঠাৎ করে ঘাসের খচখচে মিহি আওয়াজে ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে যায়।ডানে বামে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিতে বেঞ্চির দিকে নজর যেতেই ধুপ করে রাগ মাথায় চেপে বসে।গায়ের চাদরটা খানিকটা সরিয়ে ধীর পায়ে বেঞ্চের দিকে এগিয়ে আসে।সেখানে অনেকগুলো ফুল ছিড়ে পড়ে থাকতে দেখে বাকা হাসলো আফীফ।
এদিকে মুখ চেপে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা সেহেরিশের অবস্থা করুন।তীব্র শীতের মাঝে আফীফকে দেখে কান দিয়ে যেন গরম ধোয়া উড়ছে।গরমে কপাল গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমাট বেধেছে।আফীফকে ঝাউগাছের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সেহেরিশ দ্রুত সরে যেতে নেয় তৎক্ষনাৎ তার হাতটা কেউ আঁকড়ে ধরে।ভয়ের তোড়ে চিৎকার দেওয়ার আগেই আফীফ তার মুখটা চেপে ধরে।
– আগেই বলেছিলাম মেয়ে তুমি সুবিধার না। তোমার মাঝে চোর চোর ভাব।
– উম্মম্মম্মম্ম
– এক চড় দিয়ে মুখের কথা বন্ধ করে দেবো।এত রাতে এখানে কি?
– উম্মম্মম্মম্ম
– কোন উদ্দেশ্য এই বাড়িতে এসেছিস?কোন আততায়ী তুই?কার নির্দেশে এসেছিস।
আফীফের রাগান্বিত স্বরের কথায় সম্পূর্ণ ভড়কে যায় সেহেরিশ উপায় না পেয়ে আফীফের হাতের তালুতে জোরে কামড় বসায়।কিন্তু তাতেও খুব একটা সুবিধা মতো আফীফকে সরাতে পারেনি।
সেহেরিশের শ্বাস যখন বন্ধ প্রায় অবস্থা তখনি আফীফ তার হাত ছাড়ে।আফীফের দখল থেকে নিজেকে মুক্ত করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে সে।
– এত রাতে এখানে কি?
– ক..কিছু না।
– যা বলছি সোজাসাপটা উওর দাও।নাহলে উলটা পালটা কিছু হয়ে গেলে দায় ভার আমার নয়।
– ফুল নিতে এসেছিলাম।
– ফুল!তা এত রাতে ফুলের তৃষ্ণা জাগলো কেন মনে?
সেহেরিশ কোন উওর দিলো না বরং মাথাটা নিচু করে তার দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নিলো।
– আবারো ভুল করেছো।বলেছিনা এই বাড়িতে ফুল ছেড়ার অনুমতি নেই।
– সরি!
– সরি?সরিতে কি সব সমাধান?
সেহেরিশের প্রত্যুত্তর না পেয়ে আফীফ সেহেরিশের চুলের সামনে মুখ নিয়ে গাঢ় করে শ্বাস টানলো।
– আহহহ আমার বাগানের ফুলের ঘ্রাণ সুমিষ্ট।
– আপনার বাগানের ফুলের ঘ্রাণ আপনি গাছ থেকে নিন আমার মাথা থেকে নিচ্ছেন কেন?
– আবার কথা!তুমি যখন ছিড়ে তোমার চুলে গুজেছো তখন আমি চুল থেকেই নেবো।
আফীফের কথায় আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলোনা সেহেরিশ।রাগের মাথায় মিনমিনিয়ে বলে,
– অসভ্য লোক।খালি অসভ্যতা করে।
– তুমি আমায় অসভ্যতা করার সুযোগ করে দাও কেন?
আফীফের সূক্ষ্ম জবাবে চুপ হয়ে যায় সেহেরিশ।
– সোজা এখন নিজের রুমে যাবে।যদি আমি তোমায় ঘাড় ঘুরাতেও দেখি তবে আজ রণক্ষেত্র হয়ে যাবে।
আফীফের অনুমতিতে সেহেরিশ সোজা হেটে চলে যায়।কিন্তু আবারো সেই একই ভুল করে বসে। আফীফের নিষেধ থাকা স্বত্তেও সে মাঝ পথে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আর তাকে তাকাতে দেখে মেজাজটাই বিগড়ে যায় আফীফের।
– সাহস তো কম না আমার কথার অমান্য!
আফীফের ধমকে এক ছুটে পালায় সেহেরিশ।
আফীফ রাগ নিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
– মেয়ে তোর ঘাড়ের রগ সোজা করার দায়িত্ব নিলাম!
#চলবে….
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১১
গায়ের সাদা পাঞ্জাবি তার সাথে মানান সই চাদর গায়ে জড়িয়ে চুপচাপ কিছু ফাইল দেখছে আফীফ।তার পাশে বসে আছেন আহনাফ দেওয়ান।বাড়ির বাইরে মুনিফ এবং আফীফের বাবা মাসুম ট্রাকের মাল গুলো দেখভাল করছেন।শীতের মৌসুম অনুসারে আজ গরিব দুঃখিদের শীত বস্ত্র বিতরন করবেন আহনাফ দেওয়ান সাথে আফীফ।ফাইল গুলো চেক করে আহনাফ দেওয়ানকে নিয়ে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সে।
– দাদাজান আপনি গিয়ে গাড়িতে বসুন।
– তুমি আসবে কখন?
– আব্বা আর মুনিফের কাজের হিসাব নিয়ে আসছি।আপনি অপেক্ষা করুন।
– ঠিক আছে।
আহনাফ দেওয়ানকে গাড়িতে বসিয়ে আফীফ আবারো বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে।তখনি তার সাথে দেখা মিললো সেহেরিশের।গায়ে জিন্স,লং কুর্তি গলায় মাফলার,মাথায় ক্যাপ। পায়ে সু অন্যরকম সৌন্দয আজ যেন ভর করেছে তার মাঝে।আফীফ এবং সেহেরিশ দুজনেই দুজনের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে সরে গেলো।
– ওয়াও ইউ লুক লাইক সো কিউট।
কেইনের কথায় কিঞ্চিৎ হাসলো সেহেরিশ।কেইনের হাতে হাত রেখে বললো,
– থ্যাংকস।আমরা কখন যাবো?
– ওয়েট আফীফ ব্রো’কে জিজ্ঞেস করি।
আফীফ এতক্ষন সেহেরিশ এবং কেইনের কান্ড দেখছিল।কেইন কিছু বলার আগেই আফীফ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
– এমন পাব্লিক প্লেসে আমাদের বাড়ির মহিলা সদস্যদের যাওয়া নিষেধ।সে হিসেবে মিস সেহেরিশ যেতে পারবেনা।
আফীফের কথায় কেইন স্তব্ধ হয়ে যায়।মুখ ফুটিয়ে কিছু বলার আগেই সেহেরিশ শুধালো,
– আপনাদের নিয়ম বাড়ির মেয়ে কিংবা মহিলাদের জন্য।কিন্তু আমি তো আপনাদের বাড়ির জাস্ট অতিথি সেই হিসেবে আমি যেতেই পারি।
– না পারেন না।যেহেতু এই বাড়ি থেকে যাবেন সেই সুত্রে আপনার পরিচয়ে এই বাড়ির নাম আসবেই।তাই আবারো বলছি আপনি যাবেন না।
– আজব!আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি যাবো।প্রয়োজনে আপনার সঙ্গে যাবো না।এমন…
সেহেরিশের কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে তুন্দ্র এগিয়ে আসে আফীফের দিকে।
– দাদাভাই এমনিতেও আজ আমাদের গ্রামটা ঘুরে দেখার কথা ছিল কিন্তু পরে যখন যানতে পারি আপনারা আয়োজনটা করেছেন তখন ভেবে দেখলাম একসাথেই না হয় বের হবো।আমরা দুই বন্ধু যাবো সেহেরিশ যাবে না তা কি করে হয়।সেহেরিশ আমাদের সাথেই থাকবে কোন প্রবলেম হবে না।
তুন্দ্রের কথায় মাথা নাড়ালো আফীফ।হাতে থাকা কালো চশমাটা চোখে এঁটে দ্রুত গাড়িতে গিয়ে বসে আড় চোখে তাকায় সেহেরিশের দিকে।মুনিফ এবং মাসুম আসতেই তারা স্কুল মাঠের উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায়।তাদের যাওয়ার পর সেহেরিশ,তুন্দ্র,কেইন অন্য গাড়িতে যাত্রা শুরু করে।
স্কুল মাঠে আজ নানান মানুষের ঢল।চারদিকে কড়া পাহারায় আছে দৌবারিক।সেহেরিশ, তুন্দ্র কেইন মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আফীফের কার্যকলাপ দেখছে।গরীব ক্ষুদার্ত মানুষগুলোর হাতে শীতের বস্ত্র এবং খাবারের প্যাকেট তুলে দিচ্ছে আর সেই মূহুর্ত গুলো ক্যামেরায় বন্ধী করছে তুন্দ্র।
টানা চার ঘন্টা আয়োজন শেষে অবসর পেলো আফীফ।স্কুল মাঠ থেকে ভিড় কমতেই মুনিফ এগিয়ে আসলো সেহেরিশের সামনে।
– তারপর বলো কেমন দেখলে আমাদের আয়োজন?
– খুব ভালো।এলাহি কান্ড।
– হুম তা ঠিক।তোমরা কি বাড়ি যাবে নাকি গ্রাম ঘুরতে বের হবে?
– না গ্রাম দেখবো আজ।
– কিন্তু দুপুর শেষ হয়ে এসেছে কিছু খাওনি তোমরা আগে বাড়ি চলো।
– খিদে নেই আমাদের।আর টং দোকান থেকে পাউরুটি কলা নিয়ে নেবো তবুও আগে গ্রাম দেখে বাড়ি ফিরবো।
– ঠিক আছে চলো তবে আজ আমার সাথেই তোমরা ঘুরবে।
মুনিফের কথা শেষ হওয়াত আগেই বজ্রকন্ঠে ভেসে এলো আফীফের গলার আওয়াজ।
– তার দরকার নেই মুনিফ।তুই বরং আব্বা আর দাদাজানকে নিয়ে বাড়ি যা।
– কিন্তু
– কোন কথা নয় বাড়ি যেতে বলেছি বাড়ি যা।
মুনিফ আফীফের সাথে তর্ক করার সাহস আর পেলো না।সোজা মাথা নুইয়ে গাড়ির দিকে হাটা শুরু করলো।
—-
গ্রামের সরু পাকা রাস্তায় সাই সাই করে ছুটে চলছে গাড়ি।ড্রাইভিং সিটে আফীফ আর পাশেই কায়দা করে কেইনকে বসিয়ে দিয়েছে সে।পেছনে তুন্দ্র এবং সেহেরিশ।
– এই আমার খিদে পেয়েছে কেইন।কিছু একটার ব্যবস্থা কর দ্রুত।
সেহেরিশের কথায় তাল মেলালো তুন্দ্র।সবার সম্মোতিতে আফীফ সল্প পরিসরের ছোট একটি হোটেলের সামনে গাড়ি থামায়।আফীফকে দেখেই দ্রুত সেই দোকানের মালিক বেরিয়ে আসে।
– আরে ছুডো ভাইজান।এহানে কি মনে কইরা?
– আমাদের কিছু খাওয়ার লাগবে।দুপুরের আইটেম কি?
– ভাত,ডাল,মাংস,ভর্তা। চাইলে ভুনা খিচুড়ি ও আছে।
আফীফ ঘাড় ঘুরিয়ে তুন্দ্র এবং কেইনের দিকে তাকায়,
– ভুনা খিচুড়ি চলবে?
– চলবে মানে দৌড়াবে।
তুন্দ্রের সম্মোতিতে আফীফ ভুনাখিচুড়ি সাথে মাংস অর্ডার করলো।অবশেষে খাওয়ার আসায় সবাই গাড়িতে বসে গোগ্রাসে গিলতে থাকে।কিন্তু বিপত্তি ঘটলো সেহেরিশের বেলায়।
খিচুড়ি মাংসে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ স্থির নয়নে তাকিয়ে রইলো সেহেরিশ।
– এ মা এগুলো আমি খাবো কি করে?সব অয়েলি ফুড তেলে চিপচিপে করছে।
সেহেরিশের এমন নাক ছিটকানি কথায় ধমকে উঠে তুন্দ্র।
– জমিদারি পরে দেখাবি আগে পেট শান্তিকর।কি সব ডায়েট ফায়েট করিস।দুইদিন পর কঙ্কাল হিসেবে বিবেচনা করা হবে তোকে।আগামী বছর সাইন্স ল্যাবে তোকে খুজে পাবো আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর।আজ কাল সব কাউয়া গুলা ডায়েট করে খাদ্যকে কুখাদ্য বানিয়ে ছাড়ছে।
এক লোকমা খিচুড়ির সাথে কাঁচা মরিচের এক কামড় নে দেখবি অমৃত লাগবে।
– ট্রায় করবো?
– অবশ্যই।
তুন্দ্র আর সেহেরিশের কথায় চোখ ঘুরিয়ে তাকায় আফীফ।সে যানে সেহেরিশ ঝাল,অয়েলি ফুড খায় না।কিন্তু যা পারে না তা করার দুঃসাহসিকতা দেখে আফীফ কিঞ্চিৎ হাসে।
– মিস সেহেরিশ আপনার ঝাল সহ্য হয় না। তবে এখন মরিচ মুখে নেওয়া কি ঠিক হবে?
– কে বলেছে আমার ঝাল সহ্য হয় না?
– আম্মা কথার কথা বলেছেন।
– এখন সহ্য হবে এখন আমি খেতে পারবো।
সেহেরিশের দাম্ভিক কন্ঠে প্রত্যুত্তর করলো না আফীফ।বরং চুপচাপ নিজের খাওয়ার একে একে মুখে তুলে নেয়।কিছুক্ষণ পর তার কানে হাসে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কারো কান্নার আওয়াজ।কয়েক সেকেন্ডে কান্নার গতি আরো বেড়ে গেলে তড়িৎ গতিতে পেছনে ঘুরে তাকায় আফীফ।
সেহেরিশ তীব্র ঝালের চোটে মুখে হাত দিয়ে চাপা আর্তনাদ করতে থাকে।তার অবস্থা দেখে কেইন অস্থির ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে,
– হোয়াটিস ইউর প্রবলেম সেহেরিশ?
– কিরে ঝাল লাগছে এই নে পানি নে।
তুন্দ্র পানির বোতল এগিয়ে দিতে গেলেই ছো মেরে পানির বোতলটি কেড়ে নেয় আফীফ।
– খবরদার কেউ পানি দেবে না।আমি দেখতে চাই কতটা ঝাল খেতে পারে সে।এই মেয়ে বাকি মচির দুইটা শেষ করো।
ঝালের দরুনে সেহেরিশের চোখের পানি নাকের পানি প্রায় এক হয়ে গেছে।আফীফের এমন ধমকের কথায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে বেল্লিক দৃষ্টিতে।
– কি হলো তাকিয়ে আছো কেন?দ্রুত শেষ করো।
-ম..মানে?
– প্লেটের খিচুড়ি আর কাচা মরিচ সবটা শেষ করো।একবার যখন বলেছো তুমি পারবে তখন তোমার করতেই হবে।
– ম..মানে?
– আমি বাংলা বলেছি আশা করি সব বুঝতে পারছো?
– আমার পানি চাই!
– নো নেভার আগে শেষ করো।
আফীফ আর সেহেরিশের তর্কে সবাই বিমূঢ় হয়ে যায়।তারা মুখ ফুটিয়ে কিছু বালার আগেই আফীফের ইশারায় সবাই চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।
অর্ধেক খাওয়ার শেষ করতেই সেহেরিশের যখন অসাড় অবস্থা তখনি আফীফ তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দেয়।স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– সব সময় ত্যাড়ামো আমার পছন্দ নয়।যা পারো না তা করার সাহস না দেখানো ভালো।ইমম্যাচিউর বাচ্চাদের মতো আচরণ।
আফীফ তার কথা শেষ করেই বড় বড় পা ফেলে হেটে চলে যায়।এদিকে কেইন এবং তুন্দ্র দুজনেই আহাম্মক বনে সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে আছে।
ঘুরাঘুরি প্রায় শেষ পর্যায়ে সন্ধ্যার পাখিরা তাদের নীড়ে ফেরার তাড়ায় ছুটে চলছে।মাগরিবের আযান দেওয়ার সময় হয়েছে।সেহেরিশ সহ বাকিরা একটি পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে।পুকুর পাড়ের চারিদিকেই লম্বা লম্বা নারিকেল গাছের সারি তাতে যেন সৌন্দর্য দিগুন বৃদ্ধি পেয়েছে।সেহেরিশ জুহির সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে তার সাথে কেইন।এদিকে তুন্দ্র সন্ধ্যার আকাশের বহুরূপী সজ্জার ছবি তুলতে ব্যস্ত।আফীফ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কারো সাথে ফোনে আলাপচারিতা করছে।হুট করেই সে সেহেরিশের দিকে তাকালে বিরক্তে কপাল কুচকে যায়।
– মিস সেহেরিশ আপনি কি সাতার জানেন?পুকুর পাড়ের এত কিনারায় কি করছেন?সরে দাড়ান।
আফীফের কথায় পাত্তা দিলো না সেহেরিশ সে এখনো জুহির সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।তার কাছে পাত্তা না পেয়ে বিষয়টি আফীফের কাছে অপমান বোধ লাগে যার দরুনে সেখান থেকে কিছুটা দুরে সরে এসে ফোন কলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।তখনি তার কানে আসে সেহেরিশের চিৎকার।মুহূর্তে কেইন এবং তুন্দ্রের চাপা আর্তনাদে পেছনে ঘুরে তাকায় আফীফ।এতক্ষণ সে যা ভেবেছিল ঠিক তাই হয়েছে বেচারি সেহেরিশ পানিতে পড়ে ধাপাধাপি করছে।আফীফ দ্রুত এগিয়ে এসে কেইনের সামনে দাঁড়ায়।
– আমরা কেউ সাঁতার জানিনা।দ্রুত সেহেরিশকে তোলার ব্যবস্থা করো।
– একটু আগেই বারণ করেছিলাম আর এখন!
আফীফ কথা না বাড়িয়ে দ্রুত পানিতে ঝাপ দেয়।তীব্র শীতের কারনে পানি গুলো যেন বরফের মতো ঠান্ডা।কয়েক মিনিটেই সেহেরিশ এবং আফীফ দুজনের কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়।আফীফ দ্রুত সেহেরিশকে নিয়ে গাড়িতে বসে।বিড়াল ছানার মতো আফীফের কোলে কুন্ডলী পাকিয়ে নিভু নিভু চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে সেহেরিশ।
দেওয়ান বাড়িতে আজ হইচই কান্ড।রাত যত গভীর হচ্ছে সেহেরিশের জ্বর তত বাড়ছে।আফীফের জ্বরের তীব্রতা বেশি হওয়া স্বত্তেও সে চুপচাপ সবার সামনে স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করছে।কেননা একবার যদি বাড়ির সদস্যরা যানে আফীফের জ্বর হয়েছে তবে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নেবে তার দাদাজান।চুপচাপ নিজের রুমে পায়চারি করে থার্মোমিটারটা হাতে তুলে নেয়।কিছুক্ষণ মুখে রেখে জ্বর কতটা আন্দাজ করতে গেলে নিজেও মুষড়ে যায়।জ্বরের পরিমান ১০২°।
আফীফ বিরক্ত মনে গাঢ় করে শ্বাস ছাড়লো।ঔষধের বক্স থেকে দ্রুত ওষুধ নিয়ে মুখে পুরে নেয়।তখনি তার রুমে প্রবেশ করে সেঁজুতি,
– আব্বা কই তুই?
– আম্মা বলো,
– তোর তাকিয়ার জ্বর তো কমছে না আরো বাড়ছে।
– ডাক্তার আঙ্কেল কি বলেছেন যাওয়ার আগে?
– ওষুধ নিয়ম অনুযায়ী খেতে আর ঘন ঘন জল পট্টি দিতে।
– তো তাই করো।এই মূহুর্তে এত রাতে শহরের ডাক্তার আনা পসিবল না অলরেডি দশটা বেজে গেছে।তার বাড়ির সবাই কোথায়?
– তার মা,ভাই,ফুফি সবাই কাঁদছে।সবাই সেই রুমেই আছে।
– এত মানুষের ওই রুমে কী? শুধু মাত্র তিন জন থাকবে।আন্টি ফুফি আর তুমি থাকবে বাকিদের যার যার রুমে চলে যেতে বলো।
– আমি বলেছিলাম কেউ কথা শোনেনি।
– মুনিফকে বলো আমার নির্দেশ ব্যস বাকি কাজ হয়ে যাবে।এবার তুমি যাও।
– কিন্তু তোর গলা কাঁপছে কেন আব্বা?
সেঁজুতি সন্দেহ নিয়ে আফীফের হাত ধরতে এলেই কয়েক কদম পিছিয়ে যায় সে।
– কিছু হয়নি আম্মা তুমি যাও।
– আমি জানি তোর জ্বর চোখ মুখ কেমন লাল হয়ে গেছে।কথা আমার শুনবিনা তাও জানি আমি আমান কে পাঠাচ্ছি তোকে জল পট্টি দিয়ে দেবে।
– কাউকে পাঠানো দরকার নেই।আমার কথা জানলে বাড়িতে বাকি হল্লা এখনি শুরু হবে।
– চুপ কর! আমি আমান কে পাঠিয়ে দিচ্ছি কেউ জানবেনা।
রাত বারোটার পর সেহেরিশের জ্বরের তীব্রতা কমে যায়।এদিকে সবার কান্নাকাটিতে বিরক্ত হয়ে সবাইকে রুম থেকে চলে যেতে বলে।সুস্থতার অজুহাতে রাতে তার সাথে থাকতে দেয়নি কাউকে।কিন্তু কে জানতো মধ্যে রাতে জ্বরটা আবার তার তীব্রতা নিয়ে হাজির হবে।
মধ্যে রাতে ধীর পায়ে আফীফ সেহেরিশের রুমে প্রবেশ করে।দরজাটা বন্ধ করে হাটু মুড়িয়ে সেহেশের পাশে বসে কপালে হাত দিতেই নিজেও আঁতকে ওঠে।তার নিজের জ্বর নিয়ন্ত্রণে এলেও সেহেরিশের জ্বরটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।তাই দ্রুত বিছানার পাশে টেবিলে রাখা বাটি থেকে জল পট্টি নিয়ে সেহেরিশের মাথায় দিতে থাকে।
– সেহেরিশ ওও সেহেরিশ।
– হু
– শুনতে পাচ্ছো তুমি?
আফীফের কথায় সেহেরিশ পিট পিট চোখ খুলে তাকায়।আফীফকে দেখে কোন প্রতিক্রিয়া না করে বরং চুপচাপ আবার চোখ বন্ধ করে নেয়।
– কষ্ট হচ্ছে বুঝি?আগেই বলেছিলাম কিনারায় কি করছো তুমি পড়ে যাবে শুনলে না।এখন দেখো আমারো জ্বর তোমারো জ্বর।তোমার অসুস্থতা যে আমায় অসাড় করে দিচ্ছে তা কি তুমি বুঝবে?না বুঝবেনা।
সেহেরিশ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না চুপচাপ আফীফের কথা গুলো শুনতে থাকলো।আফীফ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে জ্বরের তাড়নায় সেহেরিশের সৎবিৎ নেই।
– তাকিয়া..
– হু
আফীফ সেহেরিশের প্রতিক্রিয়ায় কিঞ্চিৎ হাসে।বহু বছর পর সে তাকিয়া হিসেবে সেহেরিশের সঙ্গে কথা বলছে।
– আমার কথা মনে পড়তো তোমার।রাগী উগ্র আফীফ দেওয়ানের কথা।
– হুম অনেক বার।
– পালিয়ে গেলে কেনো?
– তুমি ধমক দাও।আদর কম করো।
– তবে কে বেশি আদর করে?
– ফুফি,পাপা,মামনি।
-আড়ালে যে ভালোবাসি যানো তুমি?
– উহু’হ
– জানি তো জানবে না।
সেহেরিশের ঠোঁটে জড়িয়ে আসা কথায় আফীফের বার বার হাসি পাচ্ছে।তবুও চুপ থেকে আলতো করে সেহেরিশের হাতের তালুতে হাত রাখে।তাকে অবাক করে দিয়ে সেহেরিশ তার হাতটা শক্ত করে আকড়ে ধরে।তাতে আফীফের ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে।
– তাকিয়া আনোয়ার সেহেরিশ ভালোবাসো কাউকে?
– না!
– কেইন কে?
– না
সেহেরিশের চোখ বার বার বুজে আসছে।তবুও আফীফের প্রতিটি কথার অস্পষ্ট ভাবে জবাব দিয়ে যাচ্ছে সে।আফীফ সেহেরিশের হাত টেনে গাঢ় করে চুমু খায়।তাতে সেহেরিশ পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়।
– আদর দেখাতে হবে না আমায় পানিতে ছুড়ে ফেলে এখন আদর দেখাচ্ছেন।
– আজব!আমি কখন তোমায় পানিতে ছুড়ে দিলাম।
সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলো না।ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে শুয়ে পড়লো তার আচরনের কারন আফীফ কিছুই বুঝলো না।তবুও অন্য পাশ ফিরে সেহেরিশের পাশে বসে পড়লো।সেহেরিশের চুলে মুখ ডুবিয়ে গাঢ় করে শ্বাস টানলো আফীফ।তার শুষ্ক ওষ্ঠে বৃদ্ধা আঙুল বুলিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,
– ছেড়ে যাবে আর আমায়?
– কদর করলে থেকে যাবো!
– সত্যি?
– হুম।
আফীফ কিঞ্চিৎ হেসে সেহেরিশের ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয়।সেহেরিশ তাতে কিঞ্চিৎ চমকালেও প্রতিক্রিয়া দেখালো না।তার সম্মোতিতে আফীফ গাঢ় করে কপালে তার অধর ছোঁয়ায়।
– ছেড়ে যাবি?
– না।
– কসম ছেড়ে যাবি না।
– কখনো না।
সেহেরিশের প্রত্যুত্তের আফীফের আট বছর আগে বুকে চাপা পড়া পাথরটা যেন সরে গেছে।আনন্দের তাড়নায় চোখের কোনে জল চিকচিক করছে।সেহেরিশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে আফীফ আবারো তার অধর ছুঁয়ে দেয়।
– তোমায় ভালোবাসলে আমি কি পাবো আফীফ দেওয়ান?
– আমার বাগানের সমস্ত ফুল তোমার করে দেবো ফুলপরি।
আফীফের উওরে সেহেরিশ শব্দ করে হেসে দেয়।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা কাটিয়ে আফীফ তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
– আট বছর আগে তোমায় এই বাড়ি থেকে বের হতে কে সাহায্য করেছিল তাকিয়া?
– পারভিন আন্টি।
– ওহ।ঘুমিয়ে যাও এবার।অনেক রাত হয়েছে।
সেহেরিশ চুপচাপ চোখ বন্ধ করে নিলো।আর তার দিকে তাকিয়ে মোহে আকৃষ্ট হয়ে তাকিয়ে আছে আফীফ দেওয়ান।চারদিক থেকে ভেসে আসছে ফজরের আযানের ধ্বনি।পাখিদের কিচিরমিচির কলরবে মুখরিত হয়ে উঠছে আরেকটি সকাল।আফীফ তার মাথাটা সেহেরিশের কানের সামনে গুজে বিড়বিড় করে বলে,
– তোমার শহরের ভোর তবে আজ আমায় নিয়ে শুরু হোক!
—-
অন্যদিকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন।হিংসাত্মক অনুভূতি নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে সে।
#চলবে…..
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১২
সকালের শিশির বিন্দু চকচক করছে প্রতিটি গাছের পাতায়।দূর প্রান্তের দৃশ্যপট ঢেকে আছে কুয়াশার চাদরে।জানলা দিয়ে নিরিবিলি চুপচাপ কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থেকে সেহেরিশ তার ঘাড়ের কিছুটা নিচের চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে বেধে নিলো।গায়ের চাদরটা ছুড়ে ফেলে সোফায় বসে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।এই মূহুর্তে জ্বর কমলেও শরীরের ক্লান্তি বেড়েছে দ্বিগুণ।তার খোঁজ নিতে তৎক্ষণাৎ রুমে প্রবেশ করে কেইন।
– সেহেরিশ!
কেইনের ডাকে চমকে তাকায় সে।মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই দ্রুত তার দুহাত জড়িয়ে ধরে কেইন তার সামনে হাট মুড়িয়ে বসে যায়।
– এখন কেমন লাগছে তোর?
– ভালো।তোর মুখ শুকনো লাগছে কেন?
– তোর চিন্তায় আমার ঘুম নরকে চলে গেছে।
– আমি ঠিক আছি।তুই নিচে যা আমি ফ্রেশ হয়ে আসবো।
– ওকে।
কেইন সেহেরিশের হাত ছেড়ে নিচে চলে গেলো।সেহেরিশ উঠে দাড়ালো জানলার বাইরে বাগানের সাইডে আফীফকে দেখে চাপা রাগটা যেন দিগুণ বেড়ে গেছে।গতকাল আফীফের উপর জেদ করেই পুকুর পাড়ের কোনায় দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু কে জানতো বিপদ তার হাতের মুঠোয়।তাই তার মনে সম্পূর্ণ দোষ আফীফ দেওয়ানের।
নিচতলায় সবার তাড়াহুড়ো হৈইচইয়ের কারন বুঝতে পারলো না সেহেরিশ।আমান এবং সামীকে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত আসে তার কাছে।
– আমান সবার এত তাড়াহুড়ো কারন কি?আজ কি কোন অনুষ্ঠান!
– কেন তুমি যানো না।তোমার দাদী,ফুফা এবং দাদাজানের মৃত্যু বার্ষিকী তাই এতিমখানার ছেলে মেয়েদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়ছে।আর আছরের সময় সবাই আনন্তপুরে যাবে কবর জিয়ারত করতে।
– এই রে জ্বরের তাড়নায় আমি ভুলেই গেছি।
সেহেরিশ বিড়বিড় করে কথাটি শেষ করে পেছনে ঘুরতেই তার সামনে এসে দাড়ায় আফীফের ফুফু চন্দনা।
– কিরে মেয়ে কি বিড়বিড় করছিস?
– না ত..তেমন কিছু না।
– কাল তো ভয় পাইয়ে দিয়ে ছিলি।তুই এত বেখেয়ালি কেন বলতো?আমার মৌ এই টুকুনি বাচ্চা কিন্তু তোর থেকেও নিজের খেয়াল ভালো রাখতে পারে।আয় তোকে কিছু খাইয়ে মেডিসিন দিতে হবে।
চন্দনা সেহেরিশের হাত টেনে তার রুমে নিয়ে যায়।চন্দনার রুমটা বেশ বড় তবে সেহেরিশের রুমের মতো আকর্ষনীয় নয়।সেহেরিশকে বিছানায় বসিয়ে মর্জিনাকে খাবার আনতে বলে চন্দনা।
– আন্টি আপনি মুনিফ আর মৌ এই বাড়িতে থাকেন তবে আঙ্কেল কোথায়?
– তিনি আছেন।ব্যবসার কাজে ঢাকায় থাকেন।মাসে দুই তিনবার আসা যাওয়া করে।
সেহেরিশ চুপচাপ বেশ কিছুক্ষণ চন্দনার দিকে তাকিয়ে রইলো তার তাকিয়ে থাকার কারন বুঝতে পেরে চন্দনা মিহি হেসে তার পাশে বসে।
– কি ভাবছো মেয়ে আমি বুঝতে পেরেছি।
– না মানে আপনি কি বুঝেছেন?
– আমি শশুড় বাড়ি ছেড়ে আব্বার বাড়িতে থাকি কেন?
– না মানে একটু জানার কৌতুহল হলো আর কি।
সেহেরিশের অপ্রতিভ মুখটা দেখে চন্দনা আবার হাসে শাড়ির আঁচলটা আঙুলে নিয়ে চিন্তিত সুরে বলে,
– আসলে আমার শশুড় ছিলেন ব্যবসায়ী।তার বড় বড় বেশ কয়েকটা আড়ত ছিল।কিন্তু তার প্রচুর পরিমানে সুদ ছিল।আমার শাশুড়ী মারা যান আমার বিয়ের সাত বছর পরে।আমার ননদেরো বিয়ে শাদী হয়ে গেছিলো।কিন্তু শশুড়ের মৃত্যুর পর এতটাই দেনা করে গেছিলেন যে আমরা আামাদের পাওনা টাও পাইনি।শেষে ভিটেমাটি বিক্রি করলে আমার আব্বা আমাদের এখানে নিয়ে আসেন।তারপর বাড়ির ব্যবসা ধরিয়ে দিয়ে আবার সাবলীল করে তুলেন।
চন্দনা এবং সেহেরিশ দুজনেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।আবার তাদের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করে।সেহেরিশের মাথায় আবারাও প্রশ্ন জাগতেই মিনমনিয়ে বলে,
– ঘটনা টা কত বছর আগের আন্টি?
– চার বছর হলো।
মনে মনে চুপচাপ অঙ্ক কষে নিলো সেহেরিশ।সে এই বাড়ি ছাড়ার চার বছর পরেই তবে চন্দনা এই বাড়িতে এসেছে।
নাস্তা শেষে কিছুক্ষণ সবার সাথে আড্ডা দিয়ে, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য নিজের রুমের সামনে যেতেই আবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আফীফের রুমের দরজার দিকে।তার রুমের পাশের রুমটাই আফীফের এছাড়া এদিকে আর কারো রুম নেই।যেহেতু এখন দোতলায় কেউ নেই সবাই ব্যস্ত সেই সুযোগে সেহেরিশ শব্দহীন পায়ে আফীফের দরজার সামনে দাড়ালো।বাইরে থেকে দরজাটা তালাবদ্ধ দেখে বেশ অবাক হলো সে।নিরস মুখটা নিয়ে পেছনে ঘুরতেই ধম করে বাড়ি লাগে কোন এক সুপুরুষের প্রশস্ত বুকের সাথে।
– চোরামির অভ্যসটা বুঝি আর যাবে না?
আফীফের গম্ভীর কন্ঠে তড়িৎ গতিতে তাকায় সেহেরিশ।দরজার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দ্রুত সরে দাঁড়ায় আফীফের সামনে থেকে।
– ভদ্র ভাবে কথা বলুন।চোর কি শব্দ?
– চোর একটি বাংলা শব্দ।যার অর্থ – যে ব্যক্তি না বলে অন্যের দ্রব্য হরণ করে।এর উচ্চারণ চোর্।বুৎপত্তি √চুর্+অ।আর উৎস সংস্কৃত।
– আরে আজব!আমি বলেছি আমায় কোন দিক থেকে আপনার চোর মনে হয়।
– আরে আসলেই তো আপনি কি চোর নাকি আপনি তো “চুন্নি”। ইয়েস চোরের ফিমেল ভার্সন “চুন্নি”।
আফীফের বাদানুবাদ কথায় বেশ রাগ লাগলো সেহেরিশের।আফীফের তর্কে সায় না দিয়ে সেহেরিশ সরে যেতে নিলেই আবারো পথ আটকায় আফীফ।
– আমার দরজার সামনে কী?
– ভুল করে এসেছিলাম এবার হয়েছে?সরুন সামনে থেকে।
– আগে দেখিতো জ্বর আছে কি না।
আফীফ অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো সেহেরিশের কপালে হাত রাখলো চোখ গুলো অন্যদিকে ঘুরিয়ে মাথা নাড়িয়ে কি যেন বিড়বিড় করলো।এদিকে আফীফের স্পর্শে সেহেরিশের আট বছর আগের স্মৃতিগুলো বার বার মাথায় ঘুরছে-ফিরছে।সেই স্মৃতি গুলো তার জীবনে আতংক হলেও কোথাও যেন সুখ অনুভব করে।অন্যরকম সুখ।এই বাড়িতে আসার পর থেকেই খারাপ লাগাগুলো তার ভালো লাগায় পরিনত হয়েছে।বাড়ির প্রতিটা মানুষের আদর, কদর তার কাছে ভালোবাসায় পরিনত হয়েছে।
– মিস সেহেরিশ কোথায় হারিয়ে গেলেন?
আফীফের প্রশ্নে সৎবিৎ বিরে আসে তার।পাশ কাটিয়ে আফীফকে সরিয়ে দিতেই কানে আসে আফীফের করা অদ্ভুত প্রশ্ন,
– কাল রাতের কথা মনে আছে?
– কাল রাত?
সেহেরিশের প্রশ্নবোধক চাহনিতে আফীফ ভালো করেই বুঝে নিয়েছে সেহেরিশের বিন্দু পরিমান ঘটানাও মনে নেই তাই কথা কাটিয়ে ভ্রু কুচকে ধমকের সুরে বলে,
– তোমায় নাকি আমি পুকুরে ফেলে দিয়েছি?বাড়ির সবাইকে এইসব কি বলে বেড়াচ্ছো তুমি?
– হ্যা মিথ্যে কি বললাম আপনি ফেলে দিয়েছেন আমায়।আপনার উপর রাগ দেখিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আর তখনি পা ফসকে পগারপার।
সেহেরিশের উওরে বেশ রাগ লাগলো আফীফের তাই ধমকের সুরে আরক্ত দৃষ্টিতে বলে,
– এই যে মেয়ে রাগটাকে ভালো কাজে লাগাও এইসব আজাইরা কাজে আজাইরা মূহুর্তে না লাগালেও চলে।যাও সামনে থেকে।
সেহেরিশের বেশ রাগ লাগলো তবুও তর্কে না জড়িয়ে নিজের রুমে চলে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর সেহেরিশ জানলার পর্দা সরাতেই মুনিফকে ব্লাক হাউজের গেট থেকে বের হতে দেখে বেশ চমকে যায়।এই বাড়ির রহস্যটা আজও তার অজানা।
এক মূহুর্ত আর দেরি না করে সেহেরিশ দ্রুত নিচে নেমে যায়।বাগানের দিকটায় দৌড়ে গিয়ে মুনিফের মুখোমুখি দাঁড়ায়।
– আরে সেহেরিশ এত দৌড় ঝাপ কেন করছেন,জ্বর কি ভালো হয়ে গেছে নাকি?
– ইয়াহ ফাইন।আমার কিছু জানার আছে।
– হ্যা বলুন।
– এই বাড়িটার রহস্য বুঝলাম না।সম্পূর্ণ কালো রঙের বির্লিং।তার উপর সবার প্রবেশ নিষেধ?
– না কিছু না।
– কিছু না বললে তো হবে না।আমার ওই বাড়িটায় যেতে মন চাইছে।আমি ছাদ থেকে ভালোভাবে ঠাহর করেছি কোন জানালা নেই সেখানে।এমন কি জানালার পরিবর্তে কোন কাঁচের ব্যবস্থা নেই।সবটাই অদ্ভুত।
সেহেরিশের প্যাচালো প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় মুনিফ।হঠাৎ করেই দুজনের কানে আসে সেই কাকাতুয়ার ডাক।
– ফুলপরি,ফুলপরি,ফুলপরি!রাজা তোমার ফুলপরি।
মুনিফ এবং সেহেরিশ উপরে তাকাতেই আফীফকে দেখতে পায়।প্রশস্ত বুকটাতে দু’হাত মুড়ি কাধে পাখিটিকে নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দুজনের দিকে একদৃষ্টিতে।তার দৃষ্টিতে নেই কোন অনুভূতি নেই কোন সচ্ছলতা।তখনি মুনিফের কাছে দৌড়ে আসে বাড়ির মালি রমিজ,
– ভাইজান আফনেরে বড় কর্তা ডাকে।
– ওকে চলো।
মুনিফ বড় বড় পা ফেলে দ্রুত চলে যায়।তার দিকে সেহেরিশ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকতেই রমিজ তার দিকে অনুনয় সুরে বলে,
– আফনারে আফনার ফুফু ডাকে।
– ঠিক আছে।
সেহেরিশ আবারো উপরের দিকে তাকাতেই আফীফকে দেখতে পেলো এখনো সে তাকিয়ে আছে তার দিকে একই অঙ্গভঙ্গিতে।
____
প্রায় সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই।অন্ততপুরে কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে কেইন,তুন্দ্র,সামী,মুরশীদ,ফাহমিদা,মারুফা এবং আহনাফ দেওয়ান,আফীফ,মুনিফ,আমান এবং চন্দনা গেলেও দেওয়ান মঞ্জিলের মহিলা সদস্য কয়েকজন বাড়িতেই থেকে যায়।
আছরের পর কবর জিয়ারতে সবার কান্নাকাটির অবস্থা দেখে সেহেরিশের অবস্থা করুন।শীতের প্রকপ বেশি থাকায় জ্বরটা যেন আবারো কেঁপে উঠেছে। সেখানে সবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকলেও হঠাৎ করেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাস্তার কিনারায় বসে যায়।তার দূর্বল শরীরের অবস্থা বুঝতে পেরে মুনিফ কাউকে কিছু না বলেই তার মা চন্দনার সাথে সেহেরিশকে চন্দনপুরে পাঠিয়ে দেয়।
চন্দনা সেহেরিশকে তার রুমে পৌছে দিয়ে বিশ্রাম নিতে বলে।প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বাজতে চললো এখনো কাউকে আসতে না দেখে সেহেরিশের মাথায় বুদ্ধি চাপলো সেই কালো বাড়িটির ভেতরে প্রবেশ করবে সে।যে ভাবা সেই কাজ সেহেরিশ দ্রুত বাগানের শেষ প্রান্তের গেটের সামনে দাড়ালো।
তখন দুপুরের পর সেহেরিশকে দেখে মুনিফ দ্রুত বেরিয়ে গেলে গেটে তালা লাগাতে ভুলে যায় যার দরুনে সেহেরিশ খুব সহজেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।
লম্বা সারি সারি তাল গাছ আর নারিকেল গাছের আকৃতি দেখে সেহেরিশের কাছে পুরো বাড়িটি ভুতুড়ে লাগেছে। ঘরের কোনায় শুধু মাত্র একটা সোডিয়াম লাইটের আলো চকচক করছে।পুরো বাড়িটি বেশ অন্ধকার।চারিদিকে ঝিঝিপোকা সহ পেঁচার ডাকে তার সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছে।জ্বরের তীব্রতা বাড়তে থাকায় বার বার চোখে যেন ঝাপসা দেখছে সে।একবার ভেবেই নিলো চলে যাবে কিন্তু আবার মনে পড়ে যায় এমন সুযোগ হাত ছাড়া করা চলবে না তাই বাড়ির চারিদিকে চক্কর দিয়ে দরজা খুঁজতে থাকে সেহেরিশ।
পাঞ্জাবির হাতাটা গুটিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে থাকলো আফীফ।কিছুক্ষণ আগেই বাড়ির কেয়ারটেকার তাকে ইনফর্ম করে ব্লাক হাউজে কোন মেয়ে প্রবেশ করেছে।তখন আফীফের বিন্দুমাত্র ভাবতে দেরি হয়নি এটা সেহেরিশ।কেননা বিকেলে মুনিফের সাথে বলা কথা গুলো আফীফ বেশ ভালো করেই বুঝেছে।
নিরিবিলি অন্ধকার মিশ্রিত বাড়িটার চারদিকে চক্কর দিতে দিতে কোন কিছুই ঠাহর করতে পারলো না সেহেরিশ কেননা চারিদিকেই অন্ধকার।ক্লান্ত হয়ে পেছনে ঘুরতে যাবে তৎক্ষনাৎ কেউ তার দু’হাত পেছন থেকে মুড়িয়ে ধরে।সেহেরিশ চিৎকার দেওয়ার আগেই লোকটি তার মুখে হাত দিয়ে আটকে দেয়।
– সাহস তো কম না সেহেরিশ আনওয়ার!বারণ করা স্বত্তেও এখানে প্রবেশ করলে কেন?
আফীফ সেহেরিশের কাধে থুতনি রাখতেই অপ্রস্তুত হয়ে যায় সেহেরিশ।নড়ে চড়ে উঠে পেছনে ঘুরতে গেলেও কোন ফন্দি আঁটতে পারলো না সে।
– এই বাড়ি নিয়ে এত কৌতুহল কিসের?শুধুমাত্র সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ বলে?আগেই বলেছি তুমি নিশ্চয়ই আততায়ী দলের কেউ।এত কৌতুহল কিসের তোমার?
আফীফের দাঁতে দাঁত চাপা প্রশ্নে সেহেরিশ কোন উত্তর দিতে পারলো না।ক্লান্ত শরীর তার উপর আফীফের কাছে বন্ধী অবস্থায় হার মেনে দুচোখ বন্ধ করে নিলো সে।কিছু মূহুর্তেই আফীফ বুঝতে পারে সেহেরিশ সেন্স লেস হয়ে গেছে।দ্রুত আফীফ তার বন্ধী থেকে সেহেরিশকে মুক্তি করে নেয়।সেহেরিশের মুখ খানা তার দুহাতে আবব্ধ করে বিড়বিড় করে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– ছোট বেলার ভুলের শাস্তি এখনো বাকি কিন্তু বড় হয়ে আবারো ত্যাড়ামি করে শাস্তির পরিমান বাড়িয়ে কি লাভ!এত শাস্তি সহ্য করার ক্ষমতা আছে তো?
#চলবে…
❌কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ ❌#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১৩
সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমের সাগরে ভাসমান চোখ দুটি নিয়ে সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে আছে আফীফ।ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁতেই ঘড়িটি ঢং ঢং করে বিকট শব্দে বেজে উঠলো।ঘরির দিকে তাকিয়ে আফীফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারো সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।সারাদিনের ব্যস্ততায় আজ এক মূহুর্তের জন্যেও বিশ্রাম নেওয়া হয় নি তার।
তখন ব্লাক হাউজে সেহেরিশের সামনে আফীফ নিজের রাগটা দমন করলেও পররর্তীতে তা যেন আরো চওড়া দিয়ে উঠছে।একে তো জ্বর তার উপর সেন্স লেস।বারন করা স্বত্তেও একই কাজ বার বার করতে কি করে সাহস পায় এই মেয়ে ভেবে পায়না সে।সেহেরিশকে তার রুমে চন্দনার কাছে রেখে গিয়ে নিজের রুমে চলে যায় আফীফ। পরবর্তীতে বাড়ির বাকি সবাই চন্দনপুর থেকে ফিরে এলে চন্দনা নিজে সেহেরিশের খেয়াল রাখবে বলে বাদবাকি সবাইকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দেয়।এদিকে বাড়ির সবাই যখন ক্লান্ত শরীরে অতি শীঘ্রই ঘুমে কাবু তখন আফীফ চন্দনাকে পাঠিয়ে দিয়ে,নিজে সেহেরিশকে জলপট্টি দিতে থাকে।আফীফের শরীর যখন ক্লান্তিতে মুষড়ে যায় তখন সোফায় হেলান দিয়ে বসে তাকিয়ে থাকে সেহেরিশের দিকে।
– আরে আপনি এখানে কি করছেন?
ভাঙ্গা গলায় সেহেরিশের ফ্যাচফ্যাচে আওয়াজে চমকে যায় আফীফ।
– দু-চোখ তবে খুলেছেন আপনি!কি অবস্থা এখন?
আফীফ দ্রুত এগিয়ে আসে তার দিকে কপালে হাত দিয়ে নিশ্চিন্ত শুরে বলে,
– যাক জ্বর তবে কমেছে।দেখতে হবে না সেবা যত্ন কে করছে!
শেষ কথাটা আফীফ ফিসফিস করে বললেও সেহেরিশের কর্ণকুহরে ঠিকি পৌছে যায়।
– কে সেবা করছে মানে কি?আর এত রাতে আপনার এই রুমে কী?রাতের বারোটা বেজে গেছে।
সেহেরিশের কথায় আফীফ প্রত্যুত্তর করলো না।বরং গলার মাফলার টা ভালোভাবে জড়িয়ে সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে,
– দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসো।আমি খাওয়ার গরম করে আনছি।
– কেন বাড়ির সবাই কোথায় আপনি যাবেন মানে কি?
– এত রাতে তোমার জন্য নিশ্চই কেউ জেগে থাকবে না।এবার আর একটা কথাও না বাড়িয়ে দ্রুত যাও।
– তো আপনি জেগে আছেন কেন?
– আমার এখনো হিসাব নেওয়া এবং দেওয়া বাকি তাই।
আফীফের কথাগুলো মাথায় ডুকলো না সেহেরিশে।আফীফ যাওয়ার পর ওয়াশরুমে ঢুকতেই মনে পড়ে যায় সে তো ব্লাক হাউজে ছিল।
খাওয়ার শেষে হাতে ওষুধ নিয়ে বিরস মুখ নিয়ে বসে আছে সেহেরিশ।তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে আছে আফীফ দেওয়ান।
– কি হলো ওষুধ মুখে দাও এত নাটক করছো কেন?
আফীফের ঝাঝালো কন্ঠে সেহেরিশ দ্রুত ওষুধ মুখে পুরে নেয়।
– কাল ব্লাক হাউজে কেন গেছিলে?
– দেখতে গেলাম কি আছে তার মাঝে যার জন্য আমাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
সেহেরিশের রুষ্টতা বুঝতে পেরে আফীফ বাঁকা হাসলো।
– জানার খুব শখ বুঝি মিস সেহেরিশ আনওয়ার?
– ইয়েস।
– তাহলে বলছি।আগে তুমি বলো, তুমি শেষ কবে গ্রামে এসেছিলে?
আফীফের এমন প্রশ্নে বিমূঢ় হয়ে যায় সেহেরিশ।তার থতমত মুখ লুকোনো অবস্থা বুঝতে পেরে কিঞ্চিৎ হাসে আফীফ।নিজেকে লুকাতে আবারো মিথ্যা কথার আশ্রয় নেয় সেহেরিশ,
– আব..আমি যখন ছোট ছিলাম দাদা-দাদী,ফুফা মারা যাওয়ার পর ইতালি চলে যাই এর পরে আমি আর বাংলাদেশে আসি নি।তবে গ্রামে আসবো কি করে।
– ওহ!যাই হোক তবে শুনো।জিনের কথা শুনেছো নিশ্চই?
– হ্যা শুনেছি বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য সঞ্চার করে এমন ক্রোমোজোম।
আফীফের সিরিয়াস মুডের কথায় সেহেরিশের এমন উত্তর কিছুতেই আশা করেনি সে।দু-হাত মুষ্টি করে কপালে ঠেকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– আমি সেই জিনের কথা বলিনি মিস। আমি আমাদের ইসলাম ধর্মের যে অদৃশ্য দেহধারী জিন আছে তার কথাই বলছি।
– হ্যা শুনেছি আমি মামনি এবং ফুফির কাছ থেকে।
– ওই ব্লাক হাউজে জিন আছে।
– কি?
– জি।
সেহেরিশ আতংক নিয়ে আফীফের দিকে তাকিয়ে আছে।বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে বসলেও হঠাৎ গা ছমছমে করায় দ্রুত এক লাফে বিছানা থেকে নেমে আফীফের পাশে সোফায় বসে পরে।
– কি হলো এখানে কি?
– আমার হঠাৎ কেমন জেন লাগছে।
– এই টুকু শুনেই কুপ কাত মিস সেহেরিশ।আর এই সাহস নিয়ে আমার ব্লাক হাউজে যাও বাহ। প্রসংশার তারিফ করতে হয় দেখছি।
– মজা করবেন না প্লিজ সত্যিটা বলুন।
– ওই বাড়িটাতে একটা জিনের সন্ধান পাওয়া গেছে।কিন্তু জিনটা বড্ড দুষ্টু।আর সেই জিনটা মেয়ে জিন আমাদের বাড়ির ছেলেদের প্রতি তার বরাবরি আকৃষ্ট তাই সেই বাড়িতে কোন মেয়ে মানুষ দেখলেই জিনটা ক্ষেপে যায়।তাই সেই বাড়িতে সব মহিলা প্রবেশ নিষিদ্ধ।কিন্তু তুমি কাল রাতে সেখানে কেন গেলে?যদি জিনটা কিছু করে ফেলতো?
আফীফের প্রশ্নে প্রত্যুত্তর করলো না সেহেরিশ।ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আফীফের পাশে আরেকটু খিচে বসে যায়।
– আপনি কি সত্যি বলছেন?
– তোমার সাথে মিথ্যা বলার সময় আমার নেই।যা হয়েছে তা শেষ। ভবিষ্যতে আর এমন দুঃসাহস ভুলেও করবেনা।আমি গেলাম দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাও।
আফীফ উঠে যেতে নিলেই সেহেরিশ তার হাত টেনে ধরে নেয়।
– প্লিজ যাবেন না আমার ভিষণ ভয় করছে আমি একা থাকতে পারবো না।যদি ওই দুষ্টু জিনটা চলে আসে তখন?
– আমি জানি না সব দোষ তোমার কে বলেছিল সেখানে যেতে?
– আর যাবো না সত্যি বলছি আমায় ছেড়ে যাবেন না প্লিজ।
– প্রমিস করো আর যাবে না?
– প্রমিস,প্রমিস,প্রমিস কোন দিন না।
সেহেরিশের ভীতু মুখখানা দেখে আফীফের বেশ মজাই লাগলো।প্রায় এক ঘন্টা ব্লাক হাউজে জিন সম্পর্কে আফীফের মুখ থেকে মিথ্যা ধারণা শুনতে শুনতে সেহেরিশ যে কখন ঘুমিয়ে গেছে তার হুশ নেই।
সেহেরিশকে রেখে আফীফ তার রুমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাত ১ টা ১২ মিনিট দেখে আফীফ দ্রুত তার রুমে যায়।সারাদিনের দখলে আজ বড্ড ক্লান্ত সে।
—-
শেষ রাতের পর একসঙ্গে পাঁচটি কুকুরের চিৎকারে কেঁপে উঠে দেওয়ান মঞ্জিল।বাড়ির ঘুমন্ত মানব গুলো আবারো জেগে যায় সচকিতে।আহনাফ দেওয়ান,আফীফ,মুনিফ,মাসুম বাড়ির পুরুষ গুলো দ্রুত সদর দরজা খুলে বাইরে আসতেই সবাই হতবিহ্বল হয়ে যায়।পুরো বাড়িটি নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে আছে।একে একে সেহেরিশ,কেইন, তুন্দ্র,খুরশীদ সবাই নিচে নেমে আসে।
আফীফ আর মুনিফ দ্রুত টর্চ নিয়ে বাড়ির চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে,
– এই বাড়িতে রাতের জন্য ছয় জন দৌবারিক সবগুলো কোথায়?
আফীফের প্রশ্নে মুনিফ সহসা জবাব দেয়,
– দুইজন ছুটিতে আছে ভাই।বাকি চারজন তো পাহারায় ছিল তারা কোথায়?
– দ্রুত বাড়ির সার্কিট চেক কর।লাইটের ব্যবস্থা কর তাড়াতাড়ি।
মুনিফ মাসুমকে নিয়ে পুরো বাড়ির লাইট গুলো আবারো মেরামত করে।আফীফ তরান্বিত তার কুকুর গুলোর বিশাল আকৃতির খাচার সামনে দাড়িয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করে। ঠিক তখনো তার সন্দেহে তেমন কিছু লাগেনি।কিন্তু বাড়ির গেইটের সামনে গেলেই সে বিমূঢ় হয়ে যায়।বাড়ির সম্পূর্ণ গেইট খোলা।এবং মাটিতে লুটিয়ে আছে নয়টি কুকুরের মৃত দেহ।
– মুনিফ!
আফীফের চিৎকারে মুনিফ সহ বাড়ির সবাই ছুটে যায়।কুকুর গুলোর মৃত অবস্থা দেখে সবার মাঝেই চাপা আতংক বিরাজ করছে।সেহেরিশ মারুফার হাতটা ধরে আছে আতংক গ্রস্ত হয়ে।
—-
ফজরের আযান শেষে আলো ফুটতে শুরু করেছে।দেওয়ান মঞ্জিলের বাইরে আজ গ্রামের মানুষের ভিড়।আফীফ দাঁড়িয়ে আছে পেছনে হাত গুটিয়ে তার সামনে ভীতগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চার দৌবারিক।
– কোথায় ছিলি তোরা?
-……..
– কি হলো কথা বলছিস না কেন?
-……..
– উওর দে।আমায় আর রাগা’স না আমি যদি একবার রেগে যাই কি হবে ভালো করেই জানিস তোরা।
– আ..আমরা নদীর পাড়ে ছিলাম ভাইজান।
– নদীর পাড়ে,কিন্তু কেন?
– আসলে…
– যা বলেছি উওর দে।যত কথা প্যাচাবি ততই বিপদে পড়বি।
দৌবারিক গুলো কিছু বলার আগেই মুনিফ আফীফের কানের সামনে বলে,
– ভাই খোঁজ নিয়ে জেনেছি এরা নদীর পাড়ে ছিল।সন্ধ্যার পর সারারাত সেখানে পিঠা উৎসব হয়।আর তারা সেখানেই ছিল।
মুনিফের কথায় অবজ্ঞার হাসি হাসলো আফীফ।
– তোদের সাহসের তারিফ করতে হয় আমার বাড়িটাকে বিপদের আশঙ্কায় রেখে তোরা নদীর পাড়ে যাস।মুনিফ এদের নিয়ে যা এদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা কর আর মৃত কুকুর গুলোকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা কর
– ঠিক আছে ভাই।
আফীফ পুরো বাড়িতে আবারো চোখ বুলিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে।প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই একটি কাগজ তার হাতের মুঠোয় চলে আসে যেটা কিছুক্ষণ আগেই আফীফ বাগানের কোনায় পেয়েছে পুটলি বাধা অবস্থায়।পুটলি থেকে কাগজটা বের করে আফীফ দ্রুত পড়া শেষ করে।লাইন গুলো আফীফের জন্য ছিল বুলেটের মতো সুচালো। কাগজে লেখা লাইন গুলো ছিল,
– শত্রু পক্ষের পতন ঘটানোর সহজ মাধ্যেম তার ভালোবাসার মানুষ অথাৎ তার দূর্বল মানুষকে আঘাত করা!
আমরা অপেক্ষায়……
আততায়ীর হামলায় আফীফ ভয় না পেলেও বর্তমানে যে তাকে সেহেরিশের উছিলায় হুমকি দেওয়া হয়েছে সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে যার দরুনে ভীত হীন আফীফ আজ ভীতিবিহ্বল।তবে সন্দেহ মাথা থেকে এখনো কাটেনি সেহেরিশের ব্যাপারটা বাড়ির সবাই যানলেও বাইরের কেউ কিছু জানে না।তবে শত্রুপক্ষ কী ঘরেই আছে?
কেইন,তুন্দ্র, সেহেরিশ একসাথে দাঁড়িয়ে আছে বসার ঘরে।তাদের মাঝে তুন্দ্র বলে উঠে,
– আজ যেহেতু ভোরে ভোরে উঠেছি তবে চলে আজ আবারো গ্রামটা ঘুরে আসি।
তুন্দ্রের কথা শেষ হতেই বজ্রকন্ঠে আফীফের গলায় উপস্থিত বাড়ির সবাই চমকে যায়।
– আমার অনুমতি বিহীন এই বাড়ির বাইরে আজ থেকে যে পা রাখবে ভবিষ্যতে হাটার জন্য তার আর পা রাখবো না আমি।মাইন্ড ইট!কথাটা সবার জন্য প্রযোজ্য।
#চলবে…..